উশুলডুংরির রাজা

লেখক: তরুণকুমার সরখেল

এক

অখিল সিং সর্দার পাহাড়ি অঞ্চলের একটি পরিচিত মুখ। তিনি একদিকে যেমন এখানের একটি টোলার বাসিন্দা ঠিক তেমনিভাবেই একজন পরিবেশ-বান্ধবও।

পাকদণ্ডী পথ সোজা চলে গেছে পাহাড়ের উপরে। সেই পথের পাশে বহু লতা-গুল্ম জাতীয় গাছ শিকড় বিস্তার করে মাটি ধরে রেখেছে। ফলে বর্ষার তীব্র জলধারাতেও পাকদণ্ডী রাস্তার কোনও ক্ষতি হয় না। চৈত্রের শেষদিকে সেইসব লতা-গুল্মগুলোর পাতা ও শুকনো ডাল রৌদ্রে শুকিয়ে একেবারে বারুদ হয়ে আছে। পুরো অঞ্চলজুড়ে এরকম শুকনো পাতার পাহাড় জমে গেছে। এখানে ওখানে যেসব টোলা ও বস্তি রয়েছে রাতের বেলা তারা শুকনো পাতার খড়খড়ানি শুনতে পায়। মনে হয় বন্য শ্বাপদ হেঁটে বেড়াচ্ছে পাতা মাড়িয়ে।

সরকারি বেশ কিছু প্রজেক্টের কারণে এই অঞ্চলে একসময় প্রচুর শালগাছ নিধন যজ্ঞ চলে। ছোটো বড়ো মিলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়। অবলা গাছেদের হয়ে বলার কেউই ছিল না। শেষে বাধ্য হয়ে অখিলেশকে মাঠে নেমে পড়তে হয়। তাঁর চেষ্টার ফলে অনেকটা সাপও মরবে অথচ লাঠিও ভাঙবে না এই চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ে আবার নতুন করে সবুজায়ন শুরু হয়েছে। গাছগাছালির ফাঁকে যেসব সাঁওতাল বস্তি রয়েছে সেখানে বসেছে সৌর-আলো। উদ্যম আর চেষ্টা থাকলে পরিবেশকে যে বাঁচানো যায় তা অখিলেশ হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েছেন।

রাত তখন এগারোটা। হঠাৎ লোকজন দেখতে পেল শিলংদার ওদিকটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের শুকনো পাতায়। গরম বাতাস সেই জ্বলন্ত শুকনো পাতা ছড়িয়ে দিচ্ছে চতুর্দিকে। ফলে যেখানেই একটুকরো আগুনের ফুলকি পড়ছে সেখানেই আগুন তীব্র মাত্রা নিচ্ছে। আগুনের ভয়াবহতা দেখে শিউরে উঠছে টোলার লোকজন। এ আগুন আয়ত্তে আনা তাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

মাত্র একঘন্টার মধ্যে গরম হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে আগুন ছড়িয় পড়ল বানঘুটু, লা-ডুংরি, বান্দু প্রভৃতি গ্রামসংলগ্ন স্থানেও। আগুন মানেই জঙ্গলের প্রভূত ক্ষতি। খড়ে ছাওয়া ঘরবাড়ির উপর সেই আগুন এসে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। ঘরবাড়ি তো পুড়বেই, জীবনহানিও হতে পারে।

ছুটে এলেন অখিলেশ। লোকজনকে জুটিয়ে এনে প্রথমেই ফোন করলেন বনদপ্তরে। দপ্তরের কর্মীরা জানালেন এ আগুন পাহাড়ে এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে তাদের পক্ষে এখন আর কিছুই করা সম্ভব নয়। শুকনো গাছে সারারাত ধরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলবে। এমনকি সকাল পর্যন্ত সেই আগুনের রেশ থাকবে।

দুই

‘উশুলডুংরির রাজা’ ছবিতে দেখানো হবে একটি পাহাড়ি গ্রাম। সাঁওতালি শব্দে উশুল মানে হল উঁচু। আর ডুংরি শব্দের অর্থ ছোটো পাহাড়। সেই পাহাড়ের মাথার উপর একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম।

পরিচালক অনিমেষ বসাকের এই জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছে। উশুলডুংরির উত্তর দিকে শিলিংদা, দক্ষিণে কালিঝরনা। পূর্বে রয়েছে গড়ুরঝরনা। মোট কথা এই অঞ্চলের মধ্যে‍ অবস্থিত পাঁচ-ছ’টি টোলা ও টোলাকে বেষ্টন করে যে জঙ্গল রয়েছে সেখানেই আউটডোর শুটিং হবে।

ছবির মূল বক্তব্য – এই জঙ্গল ও ঝরনাকে ঘিরে প্রকৃতির মধ্যে যে আদিমতা লুকিয়ে রয়েছে তাকে রক্ষা করা। উশুলডুংরির এক নব্য যুবক কীভাবে সেই লড়াই একা লড়ে যাচ্ছে সেটাই ছবিতে দেখানো হবে।

ছবির পরিচালক অনিমেশ বসাকের দলবল কালীপাহাড়ের সরকারি বিশ্রামাগারে অবস্থান করছিল। প্রায় তিরিশ-বত্রিশজনের একটি পুরো দল দেখল, পর্বত বহ্নিমান। পুরো পাহাড়জুড়ে আগুন লেগে গেছে। এই কয়েক সপ্তাহ আগেই একবার পাহাড়জুড়ে আগুন-আগুন পলাশ তার খেলা দেখিয়ে বিদায় নিয়েছে। এবার হাজির হয়েছে সত্যিকারের আগুন। নিশ্চয়ই দাবানল থেকেই ঘটেছে এই বিপত্তি। অবশ্য অনেক সময় মানুষের অসতর্কতার ফলেও ঘটে যায় এরকম দুর্ঘটনা।

জয় বলে ছেলেটি, যে এই উশুলডুংরির রাজা সিনেমায় নব্য যুবকের ভূমিকায় অভিনয় করবে সে বলল, “না, আর বসে থাকা যাবে না। আগুন যেভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে টোলার ঘরবাড়ি সব ভস্মীভূত হয়ে না যায়। তাছাড়া অনেক পশুপাখিও মারা পড়বে।”

আরেক অভিনেতা ফয়েজ খান বলল, “কিন্তু কীভাবে? দেখছিস না এখানের একটা পুকুরেও জল নেই। জল ছাড়া আগুন নেভানো যায় নাকি?”

জয় তবুও ছটফট করতে লাগল দেখে ফয়েজ বলল, “চল, একটু এগিয়ে দেখি যদি গ্রামবাসীদের কিছুটা সহায়তা করা যায়।”

তিন

জয় আগুনের কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল একদল লোক প্রাণপণে গাছের কাঁচা শাল আর পলাশপাতা সংগ্রহ করে আগুনের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। জলের বিকল্প হিসাবে এভাবেই আগুন ছড়িয়ে যাওয়া আটকাচ্ছে এরা।

একজন বলল, “অখিলদা, উত্তরদিকে আগুন বস্তির কাছাকাছি এসে পড়েছে। ওদিকটা আগে যাওয়া দরকার।”

অখিলেশদা বললেন, “প্রচুর কাঁচা ডালপালা চাই, সবাই হাত লাগাও।” এই বলে ছুটলেন উত্তরদিকে।

পেছনে পেছনে জয় ও ফয়েজও ছুটল।

টোলার কাছাকাছি যেতেই ওরা শুনতে পেল এখানের দরিদ্র অধিবাসীরা প্রচুর পরিমাণে কেন্দুপাতা সংগ্রহ করে রেখেছে। কেন্দুপাতাকে কাজে লাগিয়ে এদের রুজিরোজগার হয়। চালাঘরের বাইরে দড়িতে ঝোলানো সেইসব শুকনো পাতায় আগুন ধরল বলে।

জয় ও ফয়েজ ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানে। কাঁচা পলাশের ডাল দিয়ে আগুনের উপর আঘাত হানতে লাগল। আগুনের প্রবলতা কমতে লাগল অনেকটাই। পায়ের জুতো দিয়েও আগুন দলতে হচ্ছে অনেক সময়। ফলে গায়ে মাথায় ছাই মেখে ওরাও গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে গেল।

তারপর সারারাত ধরে চলল অখিলেশদার নেতৃত্বে আগুন থেকে পাহাড়কে বাঁচাবার প্রাণপণ লড়াই। অবশ্য প্রকৃতিও কিছুটা সহায় হল এবার। ভোরের দিকে বাতাসের বেগ কমতে লাগল। তিনটে নাগাদ তারা বুঝতে পারল আপাতত আর সেরকম বিপদ নেই।

গায়ে মাথায় ছাই-কালি মেখে বিধ্বস্ত অখিলেশবাহিনী খোলা মাঠের মধ্যে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল। পাশেই একইভাবে শুয়ে পড়ল জয় ও ফয়েজ। সারারাতের ক্নান্তি নেমে এল চোখে। ঘুমিয়ে পড়ল সবাই।

ভোরের দিকে পরিচালক মশাই শুটিংয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। কিন্তু হিরো? হিরো কোথায়?

জয় ও ফয়েজের খোঁজে বসাকবাবু যখন টোলার কাছাকাছি মাঠে এলেন তখন তাঁর মনে হল, কেউ একজন নন। এরা সকলেই হিরো। তবে রূপালী পর্দার হিরো নয়, বাস্তবের কঠিন ও শক্ত গ্রানাইটের উপর লড়াই করা হিরো এরা। এদের মিলিত চেষ্টার ফলেই গত রাত্রে বেঁচে গেছে নিরীহ গ্রামবাসীরা।

তারপর কী মনে হতেই তিনি বলে উঠলেন, “ক্যামেরা!”

ক্যামেরাম্যান এগিয়ে এলে তিনি বললেন, “নিন, শুরু করুন। মাঠ যেসব বীর সৈনিক ঘুমিয়ে আছেন তাদের ছবি নিন। সিনেমার গল্পটা একটু অন্যরকমভাবে সাজাতে হবে।”

ক্যামেরাম্যান তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখানে ওখানে রাশি রাশি কাঁচা শাল ও পলাশের পাতা থেকে যে ধোঁয়া উঠছিল তা ভোরের আবছা আলোয় ক্যামেরাবন্দি করতে লাগল দ্রুত।

হৃদয়ে মানবিক মূল্যবোধ না থাকলে এভাবে আগুনের সঙ্গে কেউ লড়াই করতে আসত না। গল্পের হিরো আর বাস্তবের হিরো এই দুয়ের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে এটাই তুলে ধরবেন পরিচালকমশাই তাঁর নবাগত ছবিতে। তার হিরোবাহিনীর চোখমুখের ঝলসে যাওয়া অবস্থা দেখে গত রাতের লড়াইটা যে কত পরিমাণ তীব্র ছিল তা তিনি অনুভব করতে লাগলেন।

ছবি তোলা হয়ে গেলে তিনি নীরবে সরে গেলেন সেখান থেকে। তাঁদের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তিনি মনে মনে একখানা স্যালুট জানালেন তাদের।

খোলা আকাশের নিচে ক্লান্ত সৈনিকের দল তখন ভোরের মহুল-গন্ধ মাখানো বাতাস আর পাখিদের গান শুনে দ্রুত উজ্জীবিত হয়ে উঠতে লাগল। ঠোঁটের কোণে তাদের বিজয়ের হাসি। মাথার মধ্যে জমে থাকা ছাইয়ের গুঁড়ো যেন জলপাইলতার সাদর সম্ভাষণ! যেন বলতে চায়, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই!’


লেখকের কথা: তরুণকুমার সরখেল
গল্পকার তরুণকুমার সরখেলের জন্ম পুরুলিয়ার এক গ্রামে। শিশুমনের উপযোগী করে লেখায় তাঁর লেখনী যেমন শক্তিমান, পুরুলিয়া জেলার গল্পকার হিসাবে তাঁর উত্তরণও তেমনি আশাপ্রদ। মফঃস্বল বাংলার যে ক-জন লেখক ছোটদের গল্প সৃজনে বিশেষ উল্লেখনীয়, তরুণকুমার সরখেল তাঁদেরই একজন। তাঁর রচনায় একটি অভিনব ও অননুকরণীয় শৈলি তিনি নির্মাণ করেছেন। গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতিই তাঁর গল্পের প্রধানতম উপকরণ। তাঁর গল্পের পরতে পরতে থাকে পুরুলিয়া জেলার প্রাকৃতিক বর্ণনা, জেলার জনজীবন ও সমাজমনস্তত্বের অকপট বিবরণ। তাঁর এযাবৎ ছোটদের বইয়ের সংখ্যা প্রায় তিন ডজন।
প্রকাশিত গল্প: আনন্দবাজার (রবিবাসরীয়), ডিঙিনৌকো, কিশোরভারতী, শুকতারা, চির সবুজ লেখা, ছেলেবেলা প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়।
পুরস্কার ও সম্মান: পূর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি পুরস্কার (উলুবেড়িয়া), নির্মাল্য চ্যাটার্জী স্মৃতি পুরস্কার (কিশোর ভারতী পত্রিকা আয়োজিত), ভাস্করলাল রায় পুরস্কার (বিজ্ঞান ভিত্তিক সেরা লেখার জন্য), রেণুবালা স্মৃতি পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার (আসার্তি, আদ্রা)। এছাড়া কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের পুরস্কার যেমন: শঙ্খ পত্রিকা, বাইদ বহাল পত্রিকা, ভোরের সানাই পত্রিকা প্রভৃতি।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।