পুজোসংখ্যা

লেখক: জুবিন ঘোষ

শারদীয়াতে যেমন উমা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে কৈলাস থেকে মর্তে আসেন, তেমনি লেখকরাও পুত্র-কন্যা স্বরূপ তাঁদের মানস পর্বত থেকে উদ্ভূত গল্প-কবিতা-উপন্যাস নিয়ে শারদীয়াতে নব-নব রূপে আবির্ভূত হন। এটাই সেই মহেন্দ্রক্ষণ যখন লেখকরাও পাঠকদের কাছে পূজিত হন। পুজো সংখ্যা মানে অল্প টাকায় অনেকগুলো উপন্যাস, কবিতা, গল্প, আমার পুজো সংখ্যা কেনা মানে সারা বছরের অনেকটা খোরাক। তাই পারলে সব কটা পুজো সংখ্যা কিনে ফেলি। এমনিতে আমি খুব দ্রুত পড়ি, আর কোনও কিছু পড়া মানে আমার তার সঙ্গে মুখরোচক কিছু লাগবেই। তবে যেন পড়াটা জমাট বাঁধে। ইদানীং পুজো সংখ্যার লেখা নিয়ে একটা হা-হুতাশ চলছে। জমাট উপন্যাসের আকাল নিয়ে অনেকে বলছেন। স্বর্ণযুগের লেখকদের প্রয়াণের পর নতুন লেখকরা সেই জায়গা পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তবে আমার মনে হয় না এখনকার পুজো সংখ্যাগুলো এখনও অতীতের গরিমা হারিয়েছে, বরং লেখকদের উপন্যাসের প্লটের অভিনবত্ব এসেছে অনেক। ইদানীং নতুন লেখকদের উপন্যাসের মধ্যে আমি হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, উল্লাস মল্লিক, সৌরভ মুখোপাধ্যায় পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকি। এনাদের প্লট মেকিং ও গল্প বলার ঢং-টা আমাকে খুব শিহরিত করে। আজ থেকে ১৯ বছর আগে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একটি গদ্যে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আগেকার পুজো সংখ্যাগুলো ছিল প্রসাদ, এখন হরির লুট। প্রসাদের সঙ্গে হরির লুটের যে তফাত, আগের পুজো সংখ্যাগুলোর সঙ্গে এখনকার সেই অমিলটা ইদানীং বড় চোখে লাগে।” পুরোনো দিনের পুজো সংখ্যাগুলোতে উপন্যাস লিখতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮ বছর আগে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই নিয়ে বেশ মজার একটা কোথা বলেছিলেন, “পুজো সংখ্যার জন্য লেখকদের কাছ থেকে লেখা আদায় করা নিয়ে সম্পাদকের তো তাড়া থাকেই। লেখকদের সঙ্গে তাঁর তখন একটা বেশ মনোরম লুকোচুরির খেলা চলে।” শারদ সংখ্যা বললে বড় পত্রিকাগুলোর লেখকভারে প্রথমেই দেশ, আনন্দমেলা, শুকতারা ইত্যাদির কথা মনে হয়। তবে ছোট পত্রিকাগুলোউ শারদীয়া সংখ্যা খুব ভালো করে। ছোট পত্রিকা প্রখ্যাত ‘পরিচয়’-তে শারদীয়া সংখ্যায় ‘আদাব’ নামে গল্প লেখার মাধ্যমেই ১৯৪৬ সালে বিখ্যাত লেখক সমরেশ বসু তাঁর লেখক জীবন শুরু করেছিলেন। দেশ পত্রিকার প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক সাগরময় ঘোষ যে বছর থেকে দেশ পত্রিকায় যোগদান করেন সেই বছর থেকেই দেশ পত্রিকার পুজো সংখ্যা শুরু হয়, তবে সেটা কোনও আলাদাভাবে প্রকাশ পেত না, সাধারণ সংখ্যাকেই একটু বাড়িয়ে-গুছিয়ে শারদ সংখ্যা বলে প্রকাশিত হতো। ১৯৪৩ সালে দেশ পত্রিকার প্রথম স্বাতন্ত্র শারদ সংখ্যা প্রকাশ হয়। কিছু ১৯৪৩ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত কোনও সম্পূর্ণ উপন্যাস ছাপা হয়নি দেশ শারদীয়াতে। তখন থাকত অজস্র গল্প আর প্রবন্ধ, রম্যরচনা, কবিতা। ১৯৫১ সালে দেশ পত্রিকার শারদীয়াতে প্রথম উপন্যাস ছাপা হয়, সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’ উপন্যাস। ১৯৫২ সালে তারাশঙ্করের ‘রাধা’ উপন্যাস, এইভাবেই ১৯৫১ থেকে ১৯৬২ সাল কেটে গেল, ১৯৬৩ সাল থেকে একটি উপন্যাসের জায়গায় দুটি উপন্যাস ঠাঁই পেল দেশ শারদীয়াতে। একজন প্রতিষ্ঠিত একজন নবীন। তখন কাচ-এ চন্দ্রবিন্দু বসাবার যুগ। প্রতিষ্ঠিত হিসেবে প্রবোধকুমার সান্যালের ‘কাঁচ কাটা হীরে’ আর সমরেশ বসুর ‘দুই অরণ্য’। পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সালে দেশ শারদীয়াতেই সমরেশ বসুর প্রবল আলোড়িত ‘বিবর’ উপন্যাস প্রকাশ পেল। ১৯৭৫ সাল থেকে সমরেশ বসু দেশের পাশাপাসি শারদীয়া আনন্দবাজারেও উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতাটা শারদীয়া ‘দেশ’-এ বেরিয়েছিল ১৯৫৭-৫৮ সালে, পরে ১৯৬৬ সালে দেশ শারদীয়াতে তাঁর ‘আত্মপ্রকাশ’ নামে প্রথম উপন্যাস বেরোয়। সেদিক দিয়ে এটা সুনীলের উপন্যাস জীবনের সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ অমর উপন্যাসগুলো শারদ সাহিত্য উপলক্ষ্যেই রচিত যেমন- প্রজাপতি, বিবর, আত্মপ্রকাশ, শাম্ব, ঘুণপোকা, বাহিরি, দহন, ফেলুদার উপন্যাসগুলো। পুরোনো যুগে দেবসাহিত্যকুটির থেকে প্রকাশিত হতো নানান নামের পুজোসংখ্যা, যেমন মধুমতী, …।। পঞ্চাশের দশকে উল্টোরথ পত্রিকা শারদ সংখ্যা হিসেবে খুব নামডাক করল। ৫/৬ টা বড়গল্প উপন্যাস বলে চালিয়ে দেওয়া শুরু করল উল্টোরথ, সেই মত বিজ্ঞাপন দিত, মানুষ কিনত হামলে পড়ে। সিনেমার জগৎ নামে আর একটা পত্রিকা অনুসরণ করল উল্টোরথের ফরম্যাট। ছোটদের পুজাসংখ্যা মানে একটা আলাদা চাহিদা। আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোরভারতী তো আছেই, সঙ্গে এখন চির সবুজ লেখা, মায়াকানন, আমপাতা-জামপাতা, ঝালাপালা, ডিঙিনৌকো, আলোর ফুলকি, রামধনু, শিশুমেলা, কলকাকলি, চাঁদের হাসি প্রভৃতি নামে ছিমছাম শিশু-কিশোর পুজো সংখ্যাগুলোর চাহিদা এখনও রয়েছে।


লেখক পরিচিতি: জুবিন ঘোষ জুবিন ঘোষ শূন্য দশকের শব্দশিল্পী । শিক্ষাগত যোগ্যতা- BHM, MBA এবং MBMTech, নিখিল ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলন থেকে ২০০৪  সালে “সর্বভারতীয় প্রীতিপ্রসার পুরস্কার” ও ‘একাডেমী অফ বেঙ্গলি পোয়েট্রি ‘ থেকে “সারস্বত সন্মান ২০০৯” পুরস্কারে সন্মানিত। এছাড়াও জেলাগুলি এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুরস্কার ও সন্মান পেয়েছেন। বিভিন্ন সময় কবি সম্পাদনা ও সহসম্পাদনা করেছেন – ক্ষেপচুরিয়াস, হৃৎপিণ্ড, সংবাদ সাতদিন, আমাদের পরিবার, এক্সক্লুসিভ হেডলাইনস, স্পার্ক, লেখালিখি সববাংলায় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা ও সংবাদপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনে। জুবিন ঘোষ কে নিয়ে ৭০ দশকের একজন স্বনামধন্য কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত প্রায় ২০০টির বেশি কবিতা লিখেছেন যা জুবিন পর্ব ও জুবিনের নিভৃতগৃহ নাম দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গের একটি ঝিলের নাম জুবিন ঝিল বলে একটা গুজব রটেছে। জুবিন কোনও দল করে না, দল বলে একমাত্র বোঝে ফুলের পাপড়ি। বাংলার সব চেয়ে পুরনো ব্লগজিনগুলির মধ্যে জুবিন ঘোষ সম্পাদিত ক্ষেপচুরিয়ানস্‌ অন্যতম। কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প, উপন্যাস এবং নিবন্ধ লেখেন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকাগুলিতে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।