ইকেবানা শিল্প

লেখক: পর্ণা সেনগুপ্ত

ইকেবানা এক ধরণের জাপানি শিল্পকলা। জাপানি পরিভাষায় ইকারু- অর্থ, দীপ্ত বা উদ্ভাসিত এবং হানা- অর্থ ফুল, দুই মিলে ইকেবানা। এই শিল্প প্রকৃতির  সতেজতা আর মানবিকতাকে এক শৃঙ্খলায় বাঁধে। কিছু ক্ষেত্রে ইকেবানা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ শিল্পরূপ হলেও এর প্রতিটি বিন্যাসে শিল্পীর অভিপ্রায় অন্তর্নিহিত থাকে। এ শুধু  ফুলদানিতে ফুল সাজানোর জন্য নয়, এর মধ্যে নিহিত আছে এক দার্শনিক ভাবধারা।

ইকেবানার প্রথম রূপ কুজ  নাম পরিচিত। এর বিন্যাস ছিল খুব সাধারণ, ফুল এবং গাছের শাখা-প্রশাখা নিয়ে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ইকেবানা শিল্পের পরিবর্তন ঘটে ও ধীরে ধীরে জাপানের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিলেমিশে যায়। জাঁকজমকবিহীন হলেও স্বল্প- সুন্দরী এই ইকেবানা জাপানের কারুশিল্পে প্রভাব বিস্তার করে। সময়ের সাথে সাথে এর শৈলী ও সজ্জার আঙ্গিকেও রদবদল ঘটে। ধীরে ধীরে জাপানের বাইরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে এই শিল্পকলা।
 
জাপানিরা পুষ্পসজ্জাকে প্রধানত ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করে। এই ঐতিহ্যটি সপ্তম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে শুরু হয় যখন পূর্ব পুরুষের উদ্দেশ্যে বেদীতে ফুলের উৎসর্গ করা হত। পরবর্তীকালে সেই সৌন্দর্য বাড়ির টোকোনামা (অ্যালকোভ)-তে স্থান পরিবর্তন করে। জাপানি পরিভাষায় টোকোনামা এর অর্থ অভ্যর্থনা কক্ষের একটি নির্দিষ্ট স্থান – যেখানে সৌন্দর্য এবং শিল্পের সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে।  

চীন ও বৌদ্ধ দর্শনের সঙ্গে, ফুলের বিন্যাস ও এর বিভিন্ন আঙ্গিক জড়িত; সেইজন্য চীন থেকে ইকেবানা জাপানে এসেছিল বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সঙ্গে। চীনে বৌদ্ধ পুরোহিতরা ফুলের বিন্যাসের প্রথম প্রশিক্ষক ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে শিল্পটির তেমন কোনও অর্থ ছিল না এবং কোনো রকম পদ্ধতি ছাড়া ফুলের ফুলদানিতে অথবা মন্দিরে পুজোয় ব্যবহার করা হত। এখানে ফুলদানি কেবলমাত্র ফুলের ধারক ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব বহন করে। জীবন দর্শনের অনেক রূপ ফুটে ওঠে ফুলের বিন্যাস এবং ফুলদানির আকারের উপর ভিত্তি করে। জাপানে বিভিন্ন মরশুমি ফুল – গ্রীষ্ম, শীত, বসন্ত প্রভৃতি বিভিন্নকাল অনুযায়ী আলাদা ভাবে ব্যবহৃত হয়, এবং প্রতীকীস্বরূপ এই শিল্পে স্থান পায়। ফুল সাজানোর বিভিন্ন শৈলীর মধ্যে একটি হল স্বর্গ, মানুষ ও পৃথিবী রীতিতে ফুল সাজানো। এই সজ্জাশৈলীর র মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ভাবধারা, প্রকৃতির ও আত্মিক শান্তির মেলবন্ধন রচনা করে।

(ইকেবানার আরেক আঙ্গিক শিন-নো-হানা নামে পরিচিত, যার অর্থ “কেন্দ্রীয় ফুলের বিন্যাস”। ওপরের ছবিটিতে এই শিল্পর মূল শৈলীর ধাঁচে, নিজস্ব কিছু ভাবনা নিয়ে আমার একটি প্রচেষ্টা ধরা পড়েছে। বাড়িতে পিন হোল্ডার না থাকায় প্রায় ফেলে দেওয়া মাটির ভাঁড়কে রঙিন করে এবং পেপার কাপকে  শুকনো পাতায়  মুড়িয়ে ফুলদানি হিসাবে ব্যবহার করেছি। কার্টন বক্স, প্লাষ্টিকের ব্যাগ, পুরানো স্পঞ্জ ইত্যাদি ব্যবহার করেছি  ফুল সামগ্রী রূপে।)


লেখকের কথা: পর্ণা সেনগুপ্ত
পর্ণা সেনগুপ্তের জন্ম পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড মধ্যবর্তী এক ছোট মফঃস্বল -এ। বর্তমানে তিনি পুনে নিবাসী। কর্মসূত্রে একটি স্কুলের শিক্ষিকা। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তার বড় হওয়া তাই সংস্কৃতি অনুরাগী পর্ণার কাছে সংস্কৃতির প্রতিটি রূপ-বিন্যাস সমানভাবে সমাদৃত। দেশীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাংলা পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশ পায়। কাজের ব্যস্ততার মাঝে বিভিন্ন সাস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কখনও আবৃত্তিকার, গ্রন্থিক বা অনুষ্ঠান সঞ্চালিকা রূপে, কখনও গায়িকা বা নাট্য- জগতে শিল্পী হিসাবে অংশ গ্রহণ করেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।