ইসলাম ভাগাভাগির সম্পূর্ণ ইতিহাস

লেখক : অভি সেখ

আমার আগের প্রবন্ধ “আমরা কি এখন ভুল ঈশ্বরে বিশ্বাস করছি“তে আমরা জেনেছিলাম কীভাবে পৃথিবীতে প্রথম ধর্মের জন্ম হয়েছিল আর কিভাবে তাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছিল আজকের প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কি ভাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিশনারি ধর্ম ইসলামের মধ্যেও ভাগাভাগি হয়েছিল।

632 খ্রিস্টাব্দে যখন হজরত মোহাম্মদের মৃত্যু হয় তখন একটা বিষয় নিয়ে সকলেই খুব চিন্তায় পড়ে যায় – সেটা হল এর পর ইসলামের লিডার কে হবে, কারণ মোহাম্মদ তাঁর মৃত্যুর আগে কোনো উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে যাননি। কিছু ইসলামিক ঐতিহাসিক বলে থাকেন হজরত মোহম্মদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় আর এই ঝামেলা চলতে থাকায় মহাম্মাদের দেহকে তিনদিন পর মাটি দেওয়া হয়, তবে অনেক ইসলামিক ধর্মগুরু এই ঘটনাকে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে সেই সময় কেউ নবীর জানাজার নামাজ পড়ানোর সাহস পাচ্ছিলেন না কারণ নবী মৃত্যুর আগে বলে গেছিলেন “আমার জানাজা সাধারণ মানুষের জানাজার মত হবে না,” তাই তাঁর দেহ তিনদিন পর্যন্ত পড়েছিল। শুরুতে এটা নিয়ে সবার মধ্যে প্রচুর মতবিরোধ এবং তর্ক বিতর্ক হয় তারপর অধিকাংশ মানুষ আবুবক্করকে খালিফা হিসাবে বেছে নেয়, কারণ তিনি শুধু নবীর ঘনিষ্ট বন্ধুই ছিলেন না তিনি সেই সমস্ত প্রথম সারির মানুষদের একজন যারা আরবের বুকে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। মানুষ এটাও বিশ্বাস করত যে তিনি ইসলামের বিস্তারের জন্য অনেক বড় বড় কাজ করেছিলেন, ওখানে  আর একটা ছোট দল ছিল যারা মোহাম্মদের জামাই এবং ভাইপো হজরত আলীর সমর্থনে ছিল, আর তাঁদের কথা অনুযায়ী নবী তাঁর শেষ হজে আলীর হাত ধরে বলেছিলেন, যাদের জন্য আমি মৌলা তাঁদের জন্য আলিও মৌলা, এর থেকেই প্রমাণিত হজরত আলী হল সঠিক উত্তরাধিকারী, কিন্ত এখানে সমস্যা মৌলা হল একটা উর্দু শব্দ যার অনেকগুলো মানে হতে পারে, হজরত আলীর শিয়া সমর্থকরা এই শব্দের অর্থ ভেবেছিল লিডার, ওপর দিকে আবুবক্কর এর সুন্নি সমর্থকরা বলল না ওটার মানে হল বন্ধু, এখানেই ইসলাম এর মধ্যে প্রথম ভাগাভাগি হয় যেটা ছিল শিয়া আর সুন্নি, শুরুর দিকে এই ভাগাভাগি শুধু রাজনৈতিক ভাবেই হয়েছিল, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এর কোনো প্রভাব পড়েনি, তবে ধীরে ধীরে এই দুই গোষ্ঠীর বিবাদ এত বাড়তে থাকে যে ধর্মীয় রীতি নীতি যেমন নামাজ পড়ার ধরন আর বেসিক কিছু মান্যতার মধ্যেও অনেক পরিবর্তন চলে এল।

নামাজ ইসলামের প্রধান একটা অংশ, শিয়া এবং সুন্নী দুজনই নামাজ পড়ে তবে যেখানে সুন্নীরা দিনে 5 বার নামাজ পড়ে সেখানে শিয়ারা দিনের 1-2 বারের নামাজ একসাথে পড়ে নিয়ে দিনে শুধু 3 বার নামাজ পড়ে, এমনটা সুন্নিরাও করে থাকে যদি কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় বা দূরে কোথাও জার্নি করায় সঠিক সময়ে নামাজ পড়তে না পরে শুধু তখনি। সুন্নিরা নামাজ পড়ার সময় একটা হাত আরেকটা হাতের উপর রেখে নাভির কাছে রাখে, কিন্তু শিয়ারা দুটো হাত দুই দিকে রাখে। সেজদা করার সময় সুন্নিরা মাথা মাটিতে ঠেকায় কিন্তু শিয়ারা মাটির তৈরি একটা চাক্তির উপর রাখে যেটার উপর ইমাম হুসেন ও তাঁর অন্যান্য বংশধরদের নাম লেখা থাকে।

ইসলামে তাকাইয়া শব্দের অর্থ হল, ধর্মের জন্য যদি প্রাণ হানির আশঙ্কা হয়, উদাহরণ স্বরূপ ধরুন আপনি একজন মুসলিম এবার আপনি এমন কোনো একটা জায়গায় গেছেন যেখানে মুসলিমদের দেখলেই মেরে ফেলা হয় বা অত্যাচার করা হয় সেখানে আপনি নিজের ধর্ম গোপন রাখতে পারবেন, তবে শর্ত একটাই সেটা হল মন থেকে আপনাকে ইসলাম কেই মানতে হবে, শিয়ারা তাকাইয়া ব্যবহারে বিশ্বাসী তবে এই বিষয়ে সুন্নিদের মান্যতা হল – এমন অবস্থায় নিজের ধর্ম লুকানো বা পরিবর্তন করার চেয়ে নিজের প্রাণ দিয়ে দিলে সরাসরি স্বর্গে যাওয়া যাবে আর এমটা করলে আল্লা তাঁকে ভালো উপহারও দেবে, তবে যদি কেউ জোর করে শুওরের মাংস বা মদ খেতে বলে আর না খেলে মেরে ফেলার হুমকি দেয় সেই অবস্থায় যে খাবে তার কোনো পাপ হবে না। এগুলো শুধুই আমার মুখের কথা নয়, এই সমস্ত তথ্য আপনারা Fath al-Bari নামক ইসলামিক গ্রন্থে পেয়ে যাবেন।

আপনি হয়ত ভাববেন একই ধর্মের মধ্যে এত বড় তফাৎ কীভাবে সম্ভব ? একটু আগেই আমি বললাম হজরত আলীর পক্ষের শিয়া সম্প্রদায় সুন্নিদের তুলনায় সংখ্যায় খুবই কম ছিল সেই সময় যখন হজরত আলী খালিফা হলেন না তখন শিয়াদের উপর বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার শুরু হল আর সংখ্যা লঘু শিয়ারা সেইসময় বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিল, সেই সময় আব্বাসিদ খলিফত মানে আজকের ইরাকের শিয়াদের বাঁচানোর জন্য ইসলামের ষষ্ঠ ইমাম jafar al-sadik তাকাইয়া প্রচলন করেন। তাই বলা যেতে পারে শিয়ারা শুরুর থেকেই তাকাইয়া ব্যবহার করে এসেছে, যার জন্য সেটা শিয়া সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে গেছে। তবে সুন্নি সম্প্রদায়ের নয়।

হাদিস হল মুসলিমদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যাতে হজরত মোহাম্মদের জীবনীর সাথে সাথে সাধারণ মানুষের কি কি করণীয় সব লেখা আছে, তবে শিয়ারা সুন্নিদের হাদিস Kutub Al-Sittah কে পুরোপুরি অস্বীকার করে এবং সুন্নিরা শিয়াদের অন্যান্য সমস্ত হাদিসি গ্রন্থকে ভুল বলে মনে করে, কিন্ত নবী তো একজনই ছিলেন তাহলে দুই রকম হাদিস কি করে সম্ভব ? আসলে হাদিস বা নবীর বাণী প্রথমে লিখিত অবস্থায় ছিল না, নবীর সাহাবা এবং সঙ্গীসাথী রা মুখে মুখে নবীর কাজকর্ম এবং বাণী একে অপর কে শোনাতেন ফলে আলী এবং ইমাম হুসেনে বিশ্বাসী শিয়ারা শুধুমাত্র সেই সমস্ত হাদিসেই বিশ্বাস করত যেগুলো আলী এবং মোহাম্ম এর ঘনিষ্ঠ সাহাবা দের দাড়া বর্ণিত হত, আর সুন্নিরা নবীর সমস্ত বারো হাজার সাথির বর্ণিত হাদিস কে সমান ভাবে গুরুত্ব দিত, ফলে শিয়ারা নিজেদের গ্রন্থে শুধু হজরত আলী এবং ইমাম হুসেনের পরিবারে সদস্যদের দ্বারা বর্ণিত হাদিসগুলোকেই নিজেদের গ্রন্থে জায়গা দিয়েছে এবং সুন্নিরা সমস্ত সাহাবা আর নবীর সঙ্গীসাথীদের বর্ণিত হাদিসকে নিজেদের গ্রন্থে স্থান দিয়েছে।

শেষে সেই পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করবো যেটা প্রত্যক্ষ ভাবে লক্ষ করা যায় সেটা হল মহরম পালনের ধরন, মহরম শিয়া সম্প্রদায়ের অনেক বড় অংশ, মহরম মাসের 9 এবং 10 তারিখ হল অসুরার দিন ও রাত যেদিন ইমাম হুসেন সহ তাঁর পুরো বংশকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছিল। মহরম মাসের 1 থেকে 10 তারিখ পর্যন্ত শিয়ারা খুবই কঠোর ভাবে সমস্ত নিয়ম পালন করে আর 9 এবং 10 তারিখে কিছু সংখ্যক শিয়া বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের পিঠ বুক কেটে রক্ত ঝরিয়ে ইমাম হুসেনের মৃত্যুর শোক পালন করে কারবালার ঘটনা কে মনে রাখার জন্য এবং রাস্তায় নেমে মাতম করে। সুন্নিরা এই রক্তপাতকে হারাম বলে মনে করে, তাঁদের মতে কোরানে বা হাদিসে এর কোনো উল্লেখ নেই বরং ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজের রক্ত ঝরানো হারাম, তবে সুন্নিরাও মহরমের সময় শোক পালন করে এবং ইমাম হুসেন ও কারবালার অন্যান্য শাহিদদের স্মরণ করে কিন্তু সেটা শিয়াদের মত এত তীব্র হয় না।  সব শিয়া নিজেদের আঘাত করে রক্ত ঝরায় না বরং অনেকে এমনটা করতে বারণ করে, শিয়া মেজরিটি দেশ ইরানে মহরমের সময় নিজের শরীর কেটে রক্ত ঝরানো ব্যান হয়ে গেছে, ওখানকার মুসলিমরা ওই দিন অকারনে রক্ত না ঝরিয়ে রক্ত দান করে। আমার মতে ধৰ্মকে এভাবেই সময়ের সাথে আপডেট করা উচিত।

এগুলো ছাড়াও শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে কিছু তফাৎ আছে হজ এবং বিবাহ নিয়ে, সাধারণ হজের ব্যাপারে আমরা সবাই জানি যেখানে মুসলিমদের জীবনে একবার মক্কা মদিনা গিয়ে হজ করতে হয় তবে শিয়াদের মধ্যে আরো এক প্রকার হজ আছে সেটা হল আরবাহীন হজ যেখানে একজন শিয়া মুসলিমকে জীবনে একবার হলেও ইমাম হুসেনের মাঝারে যেতে হয়, 2018 এ একই সময়ে মোট এক কোটি সত্তর হাজার লোক গেছিল সেই হজে আর প্রত্যেক বছর প্রায় এই সংখ্যক শিয়া মুসলিম যায় ওখানে হজ করতে তাই এটাও পৃথিবীর বৃহত্তম হজ গুলোর মধ্যে একটা।

Nikah muttaah হল সেই ধরনের বিয়ে যেখানে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা বিয়ের আগেই ঠিক করে নেয় তারা কতদিন পর্যন্ত একসাথে থাকবে, আসলে সেই সময়ে পুরুষ দের প্রায় যুদ্ধে চলে যেতে হত আর বিভিন্ন কাজে সূত্রে বছরের পর বছর দেশের বাইরে থাকতে হত তাই এই অবস্থায় যেকোনোদিন আইনি তালাক না দিয়ে তারা আলাদা হয়ে যেতে পারত আর যতদিন সেই পুরুষটি বাড়িতে থাকতো সারিয়া আইন না ভেঙেও তারা একে অপরের সাথে সহবাস করতে পারত। শিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ এখনো এইধরনের বিবাহে বিশ্বাসী, তেরো হাজার বছর পুরোনো এই বিয়েকে শিয়া মুসলিমরা সঠিক বলে থাকে তবে সুন্নিদের মতে হজরত মোহাম্মদ এই ধরনের বিবাহ করাকে হারাম বলেছিলেন।

বর্তমানে এই দুই আলাদা মতবাদে বিশ্ববাসী মানুষদের ভিতরেও অসংখ্য ভাগাভাগি হয়ে গেছে (সেই তালিকা প্রবন্ধের শেষে পেয়ে যাবেন)। যারা নিজের নিজের মত করে ধর্ম পালন করে তাই এই প্রবন্ধে আলোচিত সমস্ত কাজ আর নিয়ম সব শিয়া বা সুন্নি যে একরকম ভাবে পালন করে এমনটাও নয়, প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য কোনো ধর্ম বা মান্যতায় আঘাত করা নয়। এই প্রবন্ধের মাধমে আমি শুধু এই তথ্য আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই যে কিভাবে কিছু পলিটিকাল ভাবধারা ধীরে ধীরে ধর্মের রূপ নিয়েছে আর মানুষে মানুষে ভাগাভাগি করিয়েছে, যার ফল আমরা ভোগ করছি এখনো। আগের প্রবন্ধে এটাও বলেছিলাম যে একই ধর্মের অন্তর্গত দুটি আলাদা মান্যতায় বিশ্বাসী মানুষদের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব সমাজ তথা পৃথিবীর বুকে কি সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে, মনে রাখবেন আমাদের হাতেই আছে রয়েছে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
আমি অভি, গানবাজনা এবং ছবি আঁকা নিয়েই বেঁচে থাকা, এছাড়া আমার ইউটিউব চ্যানেল আছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন