আমরা কি এখন ভুল ঈশ্বরে বিশ্বাস করছি?

লেখক : অভি সেখ

একসময় মানুষ জঙ্গলে বসবাস করত। ধীরে ধীরে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে উঠল আর তার সাথেই ধর্ম। বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য ধর্ম আছে তবে শুরু থেকে এমনটা ছিল না। মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে সেগুলি আপডেট হয়েছে। আজকের এই প্রবন্ধটিতে আমরা জানবো জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষেরা কীভাবে ঈশ্বরকে জন্ম দিয়েছিলো, কীভাবে মানব সভ্যতায় ধর্ম এল। তো চলুন শুরু করা যাক। ধর্মের জন্ম দেখতে হলে আমাদের যেতে হবে হাজার হাজার বছর আগে, যখন ধীরে ধীরে হোমোসিপিয়েন্স মানে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা নিজেদের গোষ্ঠী বানিয়ে থাকতে শুরু করছে। আর মাস্তিষ্কে হওয়া কিছু জৈবিক মিউটেশনের ফলে তাঁদের বুদ্ধি আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সেই সময় তাদের মাথায় প্রথম কিছু ভাবনা আসে যা পরে আস্থায় পরিণত হয়। ধরা যাক কোনো একটা গোষ্ঠী জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে একটা শূকরকে ধাওয়া করছে এবার তার পিছু করতে করতে তারা এমন একটা জায়গা খুঁজে পেল যেখানে প্রচুর খাবার বা অন্যান্য রিসোর্স আছে তখন তারা ভাবত এটি অবশ্যই কোনো অলৌকিক জীব যে আমাদের জন্য লাকি। তখন থেকে সেই গোষ্ঠী আর শূকর হত্যা করবে না আর শুকর হবে তাদের সৌভাগের প্রতীক l

ঠিক সেই ভাবেই অন্য কোনো গোষ্ঠীর গল্প কথা অনুযায়ী অন্য কোনো বস্তু বা জীব তাদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। এবার সেটা হতে পারে কোনো গাছ, পশু, পাখি আবার পাথরও হতে পারে। বলা যেতে পারে এখান থেকেই সূত্রপাত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম আর সহজ সরল ধর্মের – যেটা হল Animism . যেখানে মানুষ শুধু প্রকৃতির উপাসনা করে, আর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীবজন্তুদের সম্মান করে কারণ সেগুলি ছিল তাদের বেঁচে থাকার মূল সম্পদ l

তারপর ধীরে ধীরে মানব সভ্যতা আরো উন্নত হতে থাকল। তারপর চাষবাস, ব্যবসা আর পশুপালন শুরু হলে মানুষ ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক সম্পদ আর জীবজন্তুকে নিজের সম্পত্তি ভাবতে শুরু করল, আর এর প্রভাব পড়ল ধর্মের উপর। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের সম্পত্তি হলেও সেগুলির উপর তাঁদের পুরোপুরি কন্ট্রোল ছিল না। ঝড়বৃষ্টি, খরা, তাছাড়াও অজানা রোগে জীবজন্তুর মৃত্যু, জলের অভাবে ফসল নষ্ট হওয়া, এসব কিছু প্রতিরোধ করা ছিল তাদের ক্ষমতার বাইরে। এই সমস্ত সমস্যার জন্য তারা ভাবল অবশ্যই কোনো শক্তি আছে যা এসবকে কন্ট্রোল করছে? এই ভাবনা থেকে জন্ম নিল পলিথিস্টিক মানে বহুদেববাদী ধর্মের। যেমন হিন্দু ধর্ম একটা পলিথিস্টিক ধর্মের উদাহরণ।

এখান থেকেই ধর্মের একটা জটিল অধ্যায় শুরু হল। জীবজন্তুদের উৎসর্গ করা যাতে রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, চারিদিকে প্রদীপ আর মশাল জ্বালানো যাতে ঝড়বৃষ্টি আর বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, মৃত জীব জন্তুর হাড় দিয়ে ক্ষেতের উপর বিভিন্ন রকম আকৃতি আর মন্দির বানানো যাতে এবার ফসল ভালো হয় মানুষ এরকম আরো অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান করতে শুরু করল সেই অজানা শক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য। তবে এটা সবে শুরু একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছিল এই মানব সভ্যতায়। Animism এ মানুষ নিজের নিজের মত অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি আর polytheism এ অসংখ্য দেবে দেবীর আরাধনা করত আর তাঁদের ভগবানকে কেউ মানুক বা না মানুক তাতে ওদের কিছুই যায় আসত না. কারন যে যার নিজের নিজের মত নিজের নিজের দেবদেবীর আরাধনা করত।

সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সভ্যতা The Great Roman Empire এও এরকম ধর্মেরই প্রচলন ছিল, তবে এর পরে মানুষের উন্নতির সাথে সাথে ধর্ম আরো বেশি জটিল হতে শুরু করল। একটা ধর্মের বিকাশের জন্য দুটো জিনিস প্রয়োজন – এক ধর্মটা এমন হতে হবে যেটা মহান ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে লজিক দেবে, যার বাণী সেই মহান শক্তির নাম নিয়ে অনেক মানুষকে একত্রিত করবে আর দুই সেই ধর্মের নিয়মিত প্রচার আর মানুষকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ধর্মান্তরিত করতে হবে। এখানে একটা চেন সিস্টেম থাকবে যেখানে একজন আরেকজনকে এই ধর্মের বৈশিষ্ট্য আর লাভ বুঝিয়ে নিজেদের ধর্মে নিয়ে আসবে। এই ভাবেই জন্মহয় monotheism বা মিশনারি ধর্মের।

1812 খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিডিল ইষ্টের যে জায়গায় আজ ইসরাইল, সেখানে ইব্রাহিম নামক এক জন মানুষকে Yahweh বা ঈশ্বর দেখা দেয় এবং তাকে জীবন আর মহাবিশ্বের কিছু জ্ঞান দেয় যেটা ইব্রাহিম সবাইকে জানায় আর সেই জ্ঞান প্রচার করে আর এখানেই জন্ম হয় ইহুদী ধর্মের। যার প্রমাণ ইসলাম আর খ্রিস্টান ধর্মেও পাওয়া যায় কারণ এই দুই ধর্মের মূলে আছে এই ইহুদি ধর্ম, তাই ইসলাম আর খ্রিস্টান ধর্মকে Abrahamic Religion বলা হয়। কয়েক যুগ পরে ইসরাইলে এক দল ইহুদি এটা প্রচার করা শুরু করল যীশু ঈশ্বরের পুত্র আর ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী এই পৃথিবী যীশুর জন্মের অপেক্ষা করছিল আর মানব সভ্যতার মুক্তির জন্যই জন্ম নিয়েছেন তিনি। এর আগে পর্যন্ত ইসরাইলে একমাত্র ভগবান হিসাবে yahweh র পুজো করা হত তবে এই মান্যতার পর কিছু মানুষ যীশুকে নিজের ঈশ্বর মানতে শুরু করে আর এখানে জন্ম হয় খ্রিস্টান ধর্মের, যা সেই সময়ের সমস্ত ধর্মের থেকে একদম আলাদা ছিল কারন অন্যান্য ধর্মে একাধিক ঈশ্বরের পুজো করা হত। শুরুর দিকে খ্রিস্টানরা নিজের মত করে নিজেদের ধর্মকে মানত আর নিজেদের সমাজেই সীমাবদ্ধ থাকত তাদের ধর্ম প্রচার l কিন্তু তারপর প্রতিষ্ঠিত হয় Paul of tarsus, যাদের মতে এত বড় একটা ঘটনা সবার কাছে প্রচার করা উচিত, তাই তারা যীশুর বাণী চারিদিকে প্রচার করতে শুরু করল। প্রথম শতাব্দীতে খুব কমের ভাগ মানুষ ছিল যারা মনোথিস্ট মানে একেশ্বরবাদী ছিল , তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর মানুষ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করল, যার প্রভাব সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সভ্যতা The Roman Empire এও পড়ে। আর মানব ইতিহাসে ধর্মে ধর্মে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঠিক এখান থেকেই। অসংখ্য রোমান আর ইজিপশিয়ান ভগবানের ছবি হয়ত আপনারা দেখেছেন বিভিন্ন জায়গায়, কেন এখন আর তাদের পুজো করা হয় না কেন তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল? আসলে রোমান সভ্যতা একটা পলিথিস্টিক সভ্যতা ছিল এবং তাদের অসংখ্য দেবে দেবী ছিল, তবে তারা অন্যান্য সভ্যতার দেবদেবীদেরও নিজেদের সভ্যতায় স্থান দিত এমনি কি তারা কখনোই নিজের আস্থা অন্যের উপর চাপিয়ে দিত না। এটাও জানা যায় কিছু এশিয়ান দেবদেবীকেও তারা নিজেদের ভগবানের তালিকায় স্থান দিয়েছিলো। তবে যীশুকে এরা নিজেদের ঈশ্বর মেনে নেয়নি কারণ যীশুকে মানতে হলে তাদের সমস্ত ভগবান এর উপর থেকে নিজেদের বিশ্বাস মুছে দিতে হবে আর শুধু যীশুকেই মানতে হবে। খ্রিস্টানদের বলা হল তোমাদের ঈশ্বরকে আমাদের সভ্যতায় স্বাগত কিন্তু তোমাদেরকেও আমাদের ঈশ্বরের সম্মান করতে হবে। খ্রিস্টানরা সেটা মেনে নেয়নি ফলে রোমান শাসকরাও খ্রিস্টানদের ধর্ম প্রচারে বাধা দিতে শুরু করল। তবে তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত রোমান সভ্যতার অনেক মানুষ ভিতরে ভিতরে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছিল। আর 312 খ্রিস্টাব্দে একটা ইতিহাসিক ঘটনা ঘটল যা ইতিহাসে The Constantine Shif নামে পরিচিত। চল্লিশ বছর বয়সে রোমের শাসক Constantine রোমের পুরোনো ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে নেয়। খ্রিস্টানদের কাছে এটা একটা বিরাট বড় জয় ছিল কারণ এর পর থেকে খ্রিস্টানরা স্বাধীন ভাবে নিজেদের ধর্ম প্রচার করতে পারতো। ফলে এই ধর্ম ছড়িয়ে পড়ল আরো বহু গুন, মনোথিস্টিক ধর্মগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে আপগ্রেডেড ধর্ম যারা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে আর ধর্মের প্রচার করে মানুষকে ধৰ্মান্তরিত করে। তবে এর সবচেয়ে কম জোর দিক হল এই ধরনের ধর্ম যত দ্রুত ক্ষমতায় আসে এদের নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগিও হয়ে যায় তত বেশি আর সেটা হয় সামান্য কিছু মান্যতার তফাৎ এর জন্য। কিন্তু এই ভাগাভাগি ডেকে আনে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। খ্রিস্টান ধর্মেও এরকম হয়েছে একবার, খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করত ঈশ্বর আমাদের ভালোবাসেন আর আমাদের পাপের জন্য নিজে ক্রুশে চড়েছেন তাই আমাদের উচিত তার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখা। তখন আর এক দল বলল শুধু মানলেই হবে না আমাদের উচিত নিয়মিত চার্চ যাওয়া আর প্রার্থনা করা। এই দ্বিতীয় দলটি পরিচিত হল রোমান ক্যাথলিক নামে। এবার প্রথমের দলটি বলল যীশু আমাদের পাপের জন্য নিজের প্রাণ দিলেন এর পরেও যদি তার অসীম ভালোবাসাকে না বুঝে শুধু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান গুলোকে গুরুত্ব দিই তাহলে সেটা ভুল হবে। এই ভাবধারা থেকে জন্ম হল আর এক গোষ্ঠী The Protestants এর।

16 -17 শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এরকম শান্তি পূর্ণ একটা ধর্মেও লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যায় শুধু মাত্র এই দুই আলাদা মতবাদে বিশ্বাসীদের গোষ্ঠী দ্বন্দ আর যুদ্ধের কারণে। 23সে আগস্ট 1572 ক্যাথলিকরা প্রোটেস্টিয়েন্টসদের উপর হামলা করে 24 ঘন্টার মধ্যে 30-50 হাজার Protestants কে মেরে দেয়, যেখানে বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো এবং মেয়েরাও ছিল। এই ঘটনা ইতিহাসে Saint Bartholomeo’s day নামে পরিচিত। শুধু এই এক দিনে এই একেশ্বরবাদী ধর্মের পুরোহিতরা নিজেদের ধর্মের এত বেশি মানুষকে হত্যা করে, একাধিক ঈশ্বরের বিশ্বাসি রোমানরা যা ভাবতেও পারত না।

তারপর খ্রিস্টান ধর্মের জন্মের প্রায় 700 বছর পরে সৌদি আরবে ইসলামের জন্ম হল যেটা আরো একটা মিশনারি ধর্ম ছিল। হজরত মোহাম্মদ ছিলেন এই ধর্মের প্রবর্তক যিনি বলেছিলেন আল্লা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। ইসলামের ইতিহাস লিখতে গেলে প্রবন্ধটি অনেক বড় হয়ে যাবে সেটা নিয়ে আলাদা করে একটা প্রবন্ধের সিরিজ আমি লিখবো। এর পরের ইতিহাস মোটামুটি আমাদের সবার জানা। ইসলামের ইতিহাসেও নিজেদের ধর্মের মধ্যে অসংখ্য যুদ্ধ আর দাঙ্গা হয়েছে শুধু মাত্র ছোট ছোট কিছু মত বিরোধের জন্য যা এখনো চলছে। কখনো শিয়া সুন্নী, কখনো সুন্নি দেওবন্দি, আপনার কি মনে হয় এই সব যুদ্ধ বা দাঙ্গা কেন হয়? আসলে এগুলো করানো হয় যেমন ভাবে এক শ্রেণীর অসাধু নেতা মন্ত্রী হিন্দু মুসলিমে দাঙ্গা করিয়ে থাকে তেমনি নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য ধর্মের ব্যবসায়ীরা এই কাজ করায়। তো চলুন আমরা সবাই মিলে এমন একটা সমাজ গড়ী যেখানে ধর্ম তো থাকবে তবে কট্টরতা নয়। চলুন পরের প্রজন্মের হাতে একটা সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ তুলে দিই… চলুন মানুষ হই ধার্মিক নয়।


বিজ্ঞাপন:


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
ভবঘুরে গাইয়াল, এটাই পেশা, গান লিখি সুর করি, দিয়ে নিজেই গাই। ছবি আঁকি, কারো ভালো লাগলে কিনে নেয়। লেখালিখি বলতে বেশিরভাগ গানই লেখা হয়। তাই এত গুণী লেখকদের মাঝে এসে বেশ ভয় ভয় করছে!

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

4 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।