লেখক : অর্দ্ধেন্দু গায়েন
কবি জীবনানন্দের কাব্য সাধনায় কখনও প্রকৃতি মানবীয় সত্ত্বায় উপস্থিত হয়েছে, আবার কোথাও প্রেমকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে কবোষ্ণ ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে ঢেলে দিয়েছেন বাংলার আকাশে-বাতাসে। বাংলাদেশের প্রকৃতির মধ্যে দোয়েল, ফিঙে, মাছরাঙাদের সঙ্গে তিনি তাঁর প্রেয়সীর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন। বিশেষ করে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতার ছত্রে ছত্রে আমরা দেখেছি প্রেম, পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, বিক্ষুব্ধ মানসিক যন্ত্রণা। আমরা আজ পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, অন্তহীন লাবণ্য সাগরের দিকে বিরামহীন যাত্রা ও যাত্রার লক্ষ্যই কবির মানস বৈশিষ্ট্য। কবি জানতেন যে, ‘ভালবাসা’ আর ‘আলো’, এই দু’টি শক্তির জোরেই আমরা মানুষেরা নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাই বহুদূরে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে আলোক শিখা আমাদের পথের দিশা দেখায়, সেই আলোক শিখাই কিন্তু আগুন হয়ে আমাদের পোড়াতেও পারে। এত কিছু জানার পরেও কবি জীবনানন্দ সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁর কবিতার উপাদান। তাঁর প্রেমকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দিতে পারেন না তিনি। তার জন্য যদি তাঁকে এই রক্ত- হত্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতাময় সময়ের মধ্যেও পৃথিবীর সব যন্ত্রণা, সব আঘাত, সব ব্যথা সহ্য করতে হয়, তিনি তাই করবেন। উদভ্রান্ত যান্ত্রিক সভ্যতার কন্টকাকীর্ণ কর্দমাক্ত পথ হাঁটার পরেও তিনি ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতই মুক্তিদাতা—
“পৃথিবীর যত ব্যথা-বিরোধ বাস্তব
হৃদয় ভুলিয়া যায় সব।”
কবি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘সুরঞ্জনা’ কবিতায় আমরা দেখেছি প্রকৃতির সঙ্গে প্রেয়সী, প্রেম মিশে গেছে। প্রকৃতি যখন তারই কদর্যতায় সবকিছু ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, কবির মানসচিত্ত তখন সেই নিশ্চিত পতনের হাত থেকে তাঁর প্রেয়সীকে চিরদিনের জন্য বাঁচিয়ে রাখার সাধনায় মগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি বিশ্বাস করেন ভালবাসা, সত্যিকারের প্রেমের মৃত্যু নেই; তারা মরতে পারে না। অনেক যন্ত্রণার আগুনে পুড়েও কবির ভালবাসা চির নবীন – যেন গোলাপের সদ্য প্রস্ফুটিত কু্ঁড়ি। যে কুঁড়ি প্রকৃতির জল, আলো-বাতাসের সান্নিধ্যে এসে ক্রমশ তার নিজস্বতা নিয়ে পাপড়ি মেলে দিয়েছে চরম প্রশান্তিতে। ঐ নীল আকাশের যাওয়া-আসার মধ্যে কবি তারই গন্ধ পান।
কবি জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির মধ্যেই চিরদিনই সেবা-সুশ্রূষা, শান্তি, ধ্যান ও রহস্যময়তা খুঁজেছেন। আর প্রেমের মধ্যে খুঁজেছেন আশ্রয়, স্বপ্ন ও নিজের জগতের উদ্যান। যা তাঁর নিজের হাতে সাজানো থাকবে। কিন্তু জাতি বিদ্বেষ, বর্ণবৈষম্যের দমকা হাওয়ায় কবির স্বপ্নেরা কোথায় মুখ থুবড়ে পড়েছে, তা তিনি নিজেও জানেন না। কিন্তু তিনি এটা জানেন যে, আমাদের বয়স বাড়বে, সূর্যের মত আমরাও একদিন অন্ধকারের চোরাবালিতে ডুবে যাব। তবুও তাঁর প্রেয়সীর মত সমুদ্রের নীল আভা, ঝিনুকের গায়ের আলপনা, তরুণ পাখিদের গাওয়া গান চির নতুন। কবি জীবনানন্দের মনে গভীর ভালবাসা ছিল, আর স্বাভাবিক কারণেই নৈরাশ্য ও বিভ্রান্তিও বাসা বেঁধেছিল তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে। এই নৈরাশ্য, বিভ্রান্তিবোধের মধ্যেও কবির স্বপ্নেরা গভীর বিশ্বাস, আশা ও প্রত্যয়ের বোধে পরিপূর্ণ ছিল। তাই বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক অরুণ ভট্টাচার্য বলেছেন—
“জীবনানন্দের কাব্যে আশাবাদ আছে।
আর সেই আশাবাদ মানুষের সর্বকালীন
পটভূমিতে, সময়ের পরিমাপেই যার হিসেব
করা যুক্তিসঙ্গত— খন্ডিত মৃত্যুর এড়িয়ে
যাবার স্বপ্ন তিনি দেখেছেন।”
একথা আমরা অনেকেই জানি যে, জীবনানন্দের কাব্যের প্রধান উপকরণ হ’ল ক্লান্তি, ধূসরতা, নির্জনতা ও শিশিরের শব্দহীনতার মত বোবা যন্ত্রণাবোধ। প্রকৃতির মধ্যে চলতে চলতে তিনি অজান্তেই প্রবেশ করেছেন তার প্রেয়সীর মধ্যে। আবার অতি সন্তর্পণে সেখান থেকে তিনি প্রকৃতির মধ্যে ফিরেছেন। আর এই প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই তাঁর উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছে। নির্জনতা, অন্ধকার ও মৃত্যুর মধ্যে তিনি পরিপূর্ণভাবে হারিয়ে যেতে চান নি। অন্ধকার আর নির্জনতার মধ্যে থেকেও জীবনকে নতুনভাবে দেখতে চেয়েছেন, পেতে চেয়েছেন। কবি জানতেন যে, একমাত্র প্রেম, ভালবাসাই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের জীবনের দুঃখ, দুর্দশা, ছোট ছোট জীবন ও মৃত্যুই সর্বশেষ কথা নয়। অবশ্য বর্তমান পৃথিবীকে অক্টোপাসের মত গ্রাস করেছে এই দুঃখ-দুর্দশা। যন্ত্রণার বেড়াজাল ডিঙিয়ে এক নতুন প্রাণশক্তিতে, নতুন উদ্মাদনায় অক্ষয় সৌন্দর্যালোকে আমরা মানুষেরা পৌঁছাতে পারবো বলে কবি বিশ্বাস করেন। যন্ত্রণার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতেও ‘পাখির নীড়ের মত’ বনলতা সেনের চোখে চোখ রেখে কবি দু’দণ্ড শান্তি পেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন প্রেম’ই পৃথিবীকে অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্ত করতে পারে। এখানে কবি জীবনানন্দের ভাবনার সঙ্গে ইংরেজ কবি শেক্সপীয়রের ভাবনার মিল লক্ষ্য করা যায়—
“From women’s eyes this doctrine I derive. They sparkle still the right promethean fire. They are the books, the arts, the academes, that show, contain, and nourish, all the world.”
কবি জীবনানন্দ পুরোহিতের মত প্রেমের আগুন জ্বেলে প্রতীক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রেয়সীর জন্য। আসলে তিনি নিজেকে ভালবাসতেন, ভালবাসতেন মানুষ- মানুষীকে। আর এভাবেই তিনি প্রত্যেকের প্রেমে পড়েছেন। সেই প্রেম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। তাই আগাগোড়াই তিনি ভালবাসার কবি, প্রেমিক হৃদয়ের মহান মানব। জীবনানন্দের কবিতার স্রোত ঝর্ণার মত ক্ষীনধারায় পাহাড়ের শীর্ষচূড়া থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে তা বড় হতে হতে বিরাট নদী হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে। এই নদী যতোই দীর্ঘায়িত হয়েছে ততোই তার গতিবেগ বেড়েছে, বিস্তার পেয়েছে, বেড়েছে তার ঢেউয়ের আস্ফালন। কিন্তু যখনই তা মহাসমুদ্রে পড়েছে সব মুখরতা স্তব্ধ হয়েছে। আর স্তব্ধতার মূল লক্ষ্য পরম প্রাপ্তি। তাই সমস্ত কবি-সাহিত্যিকদের থেকে স্বতন্ত্র হয়েও তিনি সবার থেকে বিচ্যুত নন। সবার আড়ালে থেকে তিনি সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেছেন, ভেবেছেন অন্য আর এক পৃথিবীর কথা। যে পৃথিবীতে ভালবাসাই শেষ কথা বলবে।
হিংসা, মারামারিতে ভরা গ্লানিময় এই পরিবেশ থেকে তিনি তাঁর সুরঞ্জনাকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছেন, বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন এই যন্ত্রণার বন্ধন থেকে। দারুচিনিসহ অজস্র বনানীর যে পরম পবিত্র নির্জনতার অগাধ বিচরণ, সেখানেই তিনি মগ্ন হয়েছেন সুচেতনার প্রেমে। তিনি বুঝেছিলেন ভালবাসা, প্রেম ছাড়া পৃথিবীর গভীর অসুখের কোন চিকিৎসা নেই। একমাত্র ভালবাসাই অসহায় অসুস্থ মানুষের কাছে বিশল্যকরণীর মত কাজ করে। ‘ভালবাসা’ কোন এক জীবনের পুণ্য সাধনার ফসল বলে মনে করেন তিনি। তাইতো তিনি বলেন, ‘মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।’ ‘ভালবাসা’ আর ‘আলো’কে তিনি এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছেন, যার উপর নির্ভর করে গভীর প্রত্যয়ে আমরা এগিয়ে যাব সম্মুখ পানে।
সেই কারণেই বোধহয় ঈশ্বরের পরিবর্তে তিনি প্রেমের সাধনা করেছেন। তাঁর আফসোস, তিনি কাউকে বোঝাতে পারেননি যে, প্রেমের মধ্যেই ঈশ্বর থাকেন, সত্যের মধ্যেই ঈশ্বরের শুভ শক্তিরা লুকিয়ে আছে। তিনি বোঝাতে পারেননি যে, তাঁর ইচ্ছা ‘সংঘ নয় শক্তি নয়, কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়’। তাঁর বড় ইচ্ছে ছিল ভালবাসার আলো দিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করার। তিনি চেয়েছিলেন, প্রত্যেকের আভ্যন্তরীণ প্রেমের স্ফুলিঙ্গ বাইরে বেরিয়ে এসে সবাইকে নতুন করে বাঁচতে শেখাক। জীবনানন্দ তাঁর প্রেম ও প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘তোমাকে দেখার মত চোখ নেই।’ কবির মৃত্যুর একাত্তর বছর অতিক্রান্তের পরও আমাদের চোখ নেই তাঁকে দেখার মত। এখনও তিনি আমাদের কাছে অচেনা। একটা সময় তাঁকে নির্জনতার কবি, প্রকৃতির কবি বলে অভিহিত করলেও এখন আর তাঁকে ঐ নির্জনতা আর প্রকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। এখন তিনি মানুষের কবি। আগামী দিনের আলোকবর্তিকা রূপে আমাদের সামনে দণ্ডায়মান।
প্রেম আছে বলেই কবির কাছে জীবন ধরা দিয়েছে ‘প্রার্থনা’ রূপে। তাই এই কবিতায় আমরা দেখি যে তাঁর প্রেয়সী সুরঞ্জনার বয়স কখনও বাড়ে না। বহুদিনের পুরনো হয়েও মনে-প্রাণে, আন্তরিকতায় চির নতুন হয়ে বিচরণ করছেন কবির সুরঞ্জনা। ভালবাসায় যন্ত্রণা আছে, একথা জেনেও অহরাত্রি তিনি প্রেমেরই সাধনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।’ পূর্ব আকাশে সূর্য প্রকাশিত হওয়ার সময় যেমন দেখা যায় রঙের সাথে রঙের অপূর্ব উপস্থিতি, ঠিক তেমনই জীবনানন্দের কবিতায় অজস্র নারীর উপস্থিতি— সুরঞ্জনা, বনলতা সেন, অরুনিমা সান্যাল, সুজাতা, সুচেতনা, সবিতা,এবং আরও অনেকেই আছেন, যারা সকলেই নাম ও পদবী পেয়ে একেবারে বাস্তবের নারীরূপে প্রতীয়মান হয়েছেন। জীবনানন্দের মানসচিন্তায় সুচেতনা, সুরঞ্জনারা চিরদিন নবীন। তাদের প্রতি কবির প্রেম কখনও ক্ষীণ হবে না। সারা বিশ্বজুড়ে ঘন ঘন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে থেকেও কবির চিন্তাভাবনাগুলো সর্বদাই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। যখন সমস্ত কবিরা গ্রাম-বাংলার চিরপরিচিত জগৎকে উপেক্ষা করে, তাদেরকে অবহেলার মধ্যে নিমজ্জিত করেছিল; ঠিক তখনই কবি জীবনানন্দ তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের স্পষ্ট ছবি। তীব্র ইতিহাস চেতনার বোধ দিয়ে কবি অতীতের স্বপ্নগুলোকে বর্তমানের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন।
সময়ের হাত ধরে মৃত্যুর মত এ পৃথিবীর ধ্বংসও অনিবার্যভাবে প্রকাশ হয়ে উঠবে একদিন। কবি জীবনানন্দের জাগ্রত মনীষা সদা সচেতন ছিল বলেই, আন্তরিকভাবে সবকিছু উপলব্ধি করতে পারতেন তিনি। তিনি জানতেন, ভালবাসা মিলনস্পৃহা নিয়ে আসে আমাদের মনে। চোখের সামনে মনোরম প্রকৃতির মধ্যে ভোরের মায়াবী আলোয় সুশ্রী প্রেয়সীকে ভাল না বেসে থাকা যায়? প্রেমহীন অন্ধকার জীবনে ডুবে যাওয়া মানুষেরা চলার পথে জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে। এলোমেলো বাতাসের বিদ্রুপ থেকে মুক্ত হয়ে সেইসব মানুষেরা আবারও ফিরে আসতে চায় আজকের সভ্যতায়। কবি জীবনানন্দও ফিরে আসেন সুরঞ্জনাকে ভালবেসে। তাঁদের ভালবাসা অবিনশ্বর। তাঁদের শরীরী মৃত্যু হ’লেও প্রেমের আলোয় সমস্ত অন্ধকার ধুয়ে মুছে গেছে। কবি বলেছেন, ‘আমরা অন্তিম মূল্য পেতে চাই প্রেমে।’ জীবনানন্দ সম্বন্ধে সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন—
“শান্তিকামী, প্রেমের পুরোহিত, সময়
সমুদ্রের নাবিক জীবনানন্দ দাশই আমাদের
মধ্যে সৎ বিজ্ঞতা, যিনি পৃথিবীতে
জন্মলাভের অন্তিম মূল্য নির্ণয় করেছেন
প্রেমে এবং জীবন-সমুদ্রকে শান্ত হতে বলে
সময়ের সমুদ্রকে জীবনের দিকে যাবার
নির্দেশ রেখে গেছেন।”
তাই বলা যায় যে, নারীই তাঁর জীবন, নারীই তাঁর মৃত্যু। আর এই জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়েই কবি উপলব্ধি করেছেন পাওয়া আর না পাওয়ার যন্ত্রণা। তিনি বুঝতে পেরেছেন, না পাওয়া ভাল; কিন্তু পেয়ে হারিয়ে ফেলার ব্যথা কত গভীর, কত যন্ত্রণাদায়ক। তাই তিনি তাঁর সুরঞ্জনার প্রেমকে কখনও ম্লান হতে দেননি। এই পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়া নানারকম দুর্যোগের পরেও কবির ভালবাসা পূর্বের ন্যায় চিরনতুন রূপেই ধরা দিয়েছে পাঠক সমাজের কাছে।
কবি জীবনানন্দের সুরঞ্জনা রক্তেমাংসে বেড়ে ওঠা মানবীরূপেই ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে। প্রকৃতিরূপ প্রেয়সী কবির কাছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন নামে এসে ধরা দিয়েছে। অতীত ইতিহাসের পাতাগুলোকে ভিজিয়ে কবির অনাসক্ত প্রেম ঝরতে থাকে পৃথিবীর বুকের উপর। কন্টকাকীর্ণ পথে চলতে চলতে কবি ক্লান্ত হয়ে পড়ার পরেও আবার সুচেতনা, সুরঞ্জনার স্বপ্নে মগ্ন হয়ে পড়েন। সৌন্দর্যই এখানে একমাত্র ধর্ম, সেই ধর্মই তাঁর কাছে একমাত্র চরম সত্য। হাজার হাজার বছর ধরে সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারের মধ্যে কবি অনেক ঘুরেছেন, ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন—তারপরেও শুধুমাত্র শান্তির জন্য কবি বনলতা সেনের চোখে চোখ রেখে একটু প্রশান্তির প্রশ্বাস ফেলেছেন। কবি জীবনানন্দ আপাদমস্তক প্রেমিক কবি, ব্যর্থ প্রেমিকও বটে। তাঁর ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব কটি কবিতা জুড়ে নারীর জন্য হাহাকার পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। কবি জীবনানন্দ নারীকে কখনও দেখেছেন নিজের প্রেরণারূপে, কখনও ছলনাময়ী আবার কখনও দেখেছেন রক্তে-মাংসে গড়া দেহসর্বস্ব প্রেমের আধার রূপে। কবির ভালবাসার মূল্য তারা কেউই বোঝেনি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ আমাদের স্বপ্ন, কল্পনা, আশা-ভালবাসাগুলোকে নষ্ট করে দিয়েছে বলেই আরেকটি অন্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি জীবনানন্দ। ঘোর তমানিশার অন্ধকার কেটে গিয়ে ‘শুভ্র মানবিকতার ভোর’ আসবে বলে তাঁর বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসেই তিনি সুরঞ্জনার প্রেমকে বুকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চান, বেঁচে থাকেন এবং বাঁচার আশ্বাস পান বুক ভরে।
লেখক পরিচিতি : অর্দ্ধেন্দু গায়েন 
 জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনার যোগেশগঞ্জের মাধবকাটী গ্রামে।পেশায় সরকারী চাকুরী হলেও নেশা পড়াশোনা , ইচ্ছে হলেই লেখা-সে কবিতা, ছোটগল্প, অণুগল্প, প্রবন্ধ যা কিছু হতে পারে, অবসরে বাগান করা,ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা ইত্যাদি।তবে সব পরিচয়ের সমাপ্তি ঘটে সৃষ্টিতে --পাঠক যেভাবে চিনবেন আমি সেভাবেই থেকে যাবো।

 
			