জন্ম>রহস্য>জীবনধারা

লেখক : রতন চক্রবর্তী

জন্ম বলতে আমরা এই গ্রহের প্রাণসম্পন্ন কোন বস্তুর প্রকাশকে বুঝব। অবশ্য নিবন্ধটির বিস্তার ঘটবে মানুষ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে। এই বিষয়গুলি হ’ল দেহ-প্রাণ-অনুভূতি, বোধ-বুদ্ধি-মনন, চেতন-চিন্তন-চৈতন্য, অনুভূতি সঞ্জাত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, যৌনানুভূতি সঞ্জাত সম্পর্ক, প্রজাতি বিস্তার, পরিবার-কৌম-সমাজসহ বিভিন্ন অনুশাসন-শাসনতন্ত্র সংগঠন। দৈহিক-বৌদ্ধিক শ্রমে মানব সমাজের বিকাশে উৎপাদন-উৎপাদনশীলতা সংক্রান্ত ব্যক্তিগত ও যৌথ সম্পর্ক নির্মাণ। সৌন্দর্যানুভূতি সঞ্জাত সাহিত্য-শিল্পকলা সৃজন, স্বার্থবোধের নানা সংঘাত ইত্যাদি বিষয়গুলিকে উপাদান হিসেবে দরকার মত ব্যবহার করে বা কিছু কিছু প্রসঙ্গের কেবল উল্লেখ করে এই নিবন্ধটির ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে। লেখাটির উদ্দেশ্য হবে এই সব বিষয় নিয়ে নতুন নতুন দৃষ্টিকোণে, নানা লেখকের নানা ভাবনার বা প্রতর্কের ইন্ধন যোগানো।

জন্ম শব্দটির বাংলা ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে আমরা পাব জন্+মন্ এই দুটি শব্দ – জন্ =হওয়া, মন্=হওয়া। মন হ’ল কর্ম পদ। এই যে, হওয়া – এর যেমন একটা বাস্তবিক দিক অর্থাৎ বস্তুগত তাৎপর্য আছে, তেমনই আছে এক ভাবগত তাৎপর্য (অবজেক্টিভ, সাবজেক্টিভ)। যেমন মাতৃগর্ভ থেকে হওয়া এবং মনের কোন ধারণা বা কল্পনার সৃজন। বিস্তারিত কিছু না বললেও এইটুকু বলতেই হবে যে, বিষয়ীগত ও বিষয়গত ‘হওয়া’ – এই দুটিরই পৃথক পৃথক কিন্তু সম্পৃক্ত আধার রয়েছে। অবজেক্টিভ ক্ষেত্রে ‘মাতৃগর্ভ’, সাবজেক্টিভ ক্ষেত্রে বিমূর্ত ‘মন’ (ভার্চুয়াল) – এই দুইয়ের সংযুক্ত ক্ষেত্র হ’ল মানব দেহ। এই দেহেরও জন্ম আছে। সেই জন্মবৃত্তান্ত বিস্তৃত ও বিজ্ঞানের তত্ত্বে বিধৃত। আবার তা বিভিন্ন ধর্মের ভাবমূলক কল্পকথায়ও কথিত আছে। যেমন, প্রথম বেদের একটি ব্রাহ্মণ অংশে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর প্রথমে অবয়ব নির্মাণ করেন, পরে তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন। জন্ম নিল প্রাণী মানব। অতঃপর জীবনধারণের নিমিত্তে তিনি প্রাণীদের ক্ষুধাবোধ দিলেন। ক্রমে ক্ষুধার তাড়নায় মানব সকল প্রকৃতি থেকেই খাদ্য সংগ্রহে তৎপর হ’ল। অন্যান্য ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বেও অনুরূপ কিছু পাঠ আছে। তবে এই লেখায় সেই ধর্মবাণী না ধরে আমরা বিজ্ঞান ঘেঁষে এগোব। দেহতত্ত্ব আলোচনায় বিজ্ঞান কী বলে, এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক। ক্রমে প্রাণ প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলি ঘিরে রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করা যাবে। অতঃপর জীবনধারার কথা। আগেই বলা হয়েছে, এই সবই হবে মানব সম্পর্ক বিষয়ক।

দেহ আছে, কিন্তু দেহে প্রাণ নেই, এমন কিছুকে প্রাণী বলা যাবে না। মানুষের ক্ষেত্রে এই অবস্থাকে বলা হয় মরদেহ। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জন্মকে যদি শুধু হওয়াই বলা হয়, তবে তর্কশাস্ত্রের একটি শাখার চলনের বিশেষ সূত্রে বলতে হয়, “মর দেহর জন্ম হ’ল”। কিন্তু বাস্তবে তো মৃতসন্তানও প্রসব হয়। এবার বাক্যটিকে লেখা যেতে পারে – প্রসবকালের পূর্বেই প্রাণের অনুপস্থিতিতে মরদেহের ‘জন্ম’ হ’ল! এটাই কী জন্মের আঁধারঘন রহস্য? হবেও বা! আবার একটু ভাবলেই আমরা বুঝব যে, প্রাণ ছাড়াই বহু বস্তুর জন্ম বা রূপান্তর হয়েছে এবং হচ্ছেও। যেমন প্রাণ শব্দটির বাস্তব অস্তিত্ব দূরস্থান, এই ধারণাটি ধারণ করার মত কিছুই যখন ছিল না, সেই সময়ে আমাদের এই গ্রহটির ‘জন্ম’ হয়েছিল। একদা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও এমনই কোন কালপর্বে জন্ম নিয়েছিল। কীভাবে? এই সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর, কিছুটা নানা গবেষণা ও প্রয়োগ-পরীক্ষায় জানা গেলেও, সম্যকভাবে বিজ্ঞান এখনও তা জানায়নি। তবে এটা জানিয়েছে যে, নির্দিষ্ট কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়া কোনও কিছু জন্মায় না। সব কিছুই নিয়তি অর্থাৎ নিয়মের অধীন। বস্তুবাদী দর্শনের ভাষায় বিশ্ববিধান, কার্যকারণের দ্বান্দ্বিকতার নিয়তি সঞ্জাত। মার্ক্সীয় তাত্ত্বিকদের ভাষায় “ডেস্টিনি অফ মার্ক্সিজম”। এটাও এক জন্ম রহস্য! (নিয়তি বা নিয়ম শব্দদুটি ইয়ম্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। এই সূত্রেই এসেছে যম শব্দ। যমকে ধর্মীয় শাস্ত্রকারদের কথায়, কেবল মৃত্যু না ধরে কার্যকারণের পরিণাম অর্থে ধরলে বিজ্ঞানের পথরেখা স্পষ্ট হবে।) যেহেতু এই নিবন্ধের ভিত্তি প্রস্তাব রচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে লেখাটি মানুষের জন্ম ও তৎসংক্রান্ত হবে, তাই মানুষের দেহের জন্ম-নিয়তির একটা হদিস নিতে হবে। কারণ দেহ না হলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবার জো নেই। দেহ হ’ল আধার এবং প্রাণ হ’ল আধেয় (ফর্ম-কন্টেন্ট)। বিজ্ঞানের পথ ধরে এগোলে ‘দেহে প্রাণ সম্পন্ন মানুষের’ জন্ম-রহস্য ও জীবনধারার বহুধা প্রসারিত কর্মতৎপরতা এবং সৃষ্টির উল্লাস সংক্রান্ত তথ্য তল্লাশ খানিকটা স্বচ্ছন্দ্য হলেও হতে পারে।

এবার একটু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেহকে দেখে নেওয়া যাক। দেহ যে জৈবিক বস্তুগত বিষয়, এটা সবাই জানেন। একাধিক কোষের বহু বহু বিন্যাসে নানা আকার প্রকারের দেহ গঠিত হয়। বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ সূত্রে এটা স্বীকৃত সত্য যে, অজস্র কোষের সমন্বয়ে আবদ্ধ ধাঁচায় (ফর্ম্যাট), অসংখ্য কোষের পরস্পরের প্রতি নির্দিষ্ট নিয়মের নির্ভরতায় নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, তন্ত্রাদি ও অন্যান্য বস্তুতে দেহযন্ত্র নির্মিত হয়। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে বৃদ্ধি বা বিকাশের বিবিধ উপাদান এবং একই সঙ্গে শক্তি সংগ্রহ চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়াটির চলনের পরিণাম হ’ল প্রতিলিপি তৈরি। এটাই দেহ। দেহের ভিতরের যাবতীয় সক্রিয়তা হ’ল আসলে ইলেক্ট্রো-রাসায়নিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার পরিণতি। দেহ প্রকৃত প্রস্তাবে একটি জৈব মৌলিক পর্যায়ের যন্ত্র। দেহযন্ত্রটির ডিএনএ ও আরএনএ-তে স্বয়ং উদ্ভুত প্রোটিন পলিমার তন্তু জালিকার নানান সেট সৃষ্টি করে এবং তাতে সংরক্ষিত থাকে নানা স্মৃতি-সংকেত। এই সেটগুলি মৌলিক পদার্থের বিভিন্ন হাইড্রোজেন আয়নিক সজ্জা। ইলেকট্রিক আয়ন একটি মৌলের সঙ্গে আর একটি মৌলের যোগ ঘটাতে দীর্ঘ আরএনএ চেন তৈরি করে। এই সজ্জা ‘কোড’ হিসাবে ক্রিয়াশীল থাকে। এমনই হরেকরকম প্রক্রিয়ায় নানা এনজাইম তৈরি হয়। স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে বাহিত স্মৃতিধারক কিছু কিছু কোষ একত্রিত হয়ে গঠন করে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলিকে দেহ রক্ষণাবেক্ষণ, বিকাশ সাধন কল্পে নানাবিধ কাজের নির্দেশ পাঠায়। বিজ্ঞান কিন্তু এটাও জানাচ্ছে যে, দেহস্থ জিনে বিধৃত সমস্ত স্মৃতি দেহভাণ্ডের সমস্ত কোষ ও অঙ্গের যৌথ নিয়ন্ত্রক হিসেবেও কাজ করে। ফলে বিভিন্ন অঙ্গের অবস্থান অনুযায়ী কাজও হয় বিভিন্ন। এটাই হোল কোষের যৌথ জ্ঞান। এই জ্ঞান, কোষেই থাকে। তাই পৃথক কোনও জ্ঞানকোষের দরকার হয় না মস্তিষ্কের। একটি ভ্রূণ ভেঙে কোন কোষ কোন অঙ্গে সংস্থাপিত হবে, তা নির্ধারণ করে কোষের যৌথ স্মৃতি। বিভিন্ন অঙ্গের কাজও ইলেকট্রিক আয়নে স্বয়ংক্রিয় সংকেতে চলে। এরা সবাই মিলে তাদের নিয়তি (বাঁধা নিয়ম শৃঙ্খলা) মেনে তাদের জীবনচক্র চালায় এবং বংশবিস্তার ঘটায়। এভাবেও বিষয়টি হয়ত বলা যায় যে, মস্তিষ্কের স্মৃতি হ’ল ভার্চুয়াল। বস্তু জগত থেকে সে সংকেত গ্রহণ করে ও তার মত সেইসব সংকেত অনুবাদ করে নেয়। নির্দেশ পাঠায়। নির্দিষ্ট এই প্রক্রিয়াই হ’ল দেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠার অতি সাধারণস্তরের কথন। এই কথন বিজ্ঞানের তত্ত্ব চলনের সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় মিলবে না। কেবল দৃষ্টিভঙ্গির আভাস দিতে এই বিষয়ে সামন্যতম চর্চা পেশ করতে হ’ল। জৈব দেহযন্ত্রের অন্তস্থঃ ও বহিঃস্থ পর্যায়ে অনবরত যে জটিল ও বহুল প্রক্রিয়া চলছে, তার নানাবিধ স্পন্দনই হ’ল প্রাণের বাহ্যিক প্রকাশ। মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রকাশ বিচিত্রতর ও নবনবরূপে আগত, প্রকাশিত। এই যে সব কাণ্ডকারখানা চলতে থাকে, তারই নানা খাঁজে থাকে চেতন-চৈতন্য, বোধ-বুদ্ধি-মনন ইত্যাদি বিকশিত হওয়ার অঙ্কুর। চেতন যে জীব (পড়ুন মানব), তার ‘মন’ (ভার্চুয়াল) আছে। এর সাহায্যে সে কল্পনা, চিন্তাভাবনা করতে পারে, নানা অনুভূতি অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি ঘটায়। পাপপুণ্য, ভালমন্দর ধারণা করতে পারে। তার বোধ বস্তুবাদী এবং ভাববাদী – উভয় ধারণায় পুষ্ট হতে পারে। কেউ এই দ্বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটিকে শ্রেয় মনে করতে পারে, কেউ বা এই দুইয়ের মধ্যে অল্পবিস্তর সমঝোতা করে নিতে পারে। এই সব কিছু ধারণার বশবর্তী হয়ে ব্যক্তিমানুষ ক্রমে ক্রমে নিজের মরদেহের পরিণতির (জন্ম!) আগে পর্যন্ত নানান অবস্থার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে, নিজেকে একটু হলেও নবায়ন করতে করতে। এই প্রক্রিয়ার বশবর্তী হয়ে সে বা তারা বয়স, প্রকৃতি-পরিবেশ, চর্চা, শ্রম, অভিপ্রায় অনুযায়ী পারিবারিক, সামাজিক, জাতিক, রাষ্ট্রিক, আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে। কেউ কেউ প্রচলিত কোনও না কোন ধর্মবিশ্বসী, ঈশ্বরে অস্তিত্ববাদী, নাস্তিকতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী, কোনও না কোন রাজনৈতিক মতাদর্শবাদী, নীতিবাদী হয়ে উঠতে পারে। কেউ কেউ নতুন কোন বিশ্বাস বা মতাদর্শর প্রবর্তকও হতে পারে। আবার কোনও কিছু না হওয়া বা সব কিছুর অথবা কিছু কিছুর ঘোর বিরোধী, এমনকি ধ্বংসাত্মক আগ্রাসীও হয়ে উঠতে পারে। বিপরীতে চেতন-চৈতন্যে অনেক কিছুর (বিষয় ও বিষয়ীগত) অভাবে সে শ্লথ, বিবশ, বিমুখ জীবন যাপন করতে পারে। পারে জরদ্গব হতে। এই যে এতগুলি স্তরের কথা বলা হ’ল এবং না বলা বহু স্তর রয়ে গেল, এর প্রতিটি পর্বেই কিন্তু মানুষ, মানুষ হয় – মানে, ইতি বা নেতিবাচক হয়ে ওঠে, অর্থাৎ জন্মের ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘হওয়া!’ মানুষের বয়স, চেতনা, অভিজ্ঞতা অর্জনের তালে তালে একই মানুষের এই পর্বান্তরও এক রহস্যময়তার লীন-অঙ্গ, যার মধ্যে বহুল ক্ষেত্রে থাকতে পারে বিপুল বিরোধাভাস। যে মানব নিয়ে এত রহস্যময়তা, সেই মানব প্রজাতির জন্ম তো হঠাৎ হয়নি! কী ভাবে মানুষ, মানুষ হয়ে উঠল – রূপান্তরের পথে, তার কিঞ্চিৎ হদিস নিতে চার্লস ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ তত্ত্বটির একটু আভাস পেতে হবে। অতঃপর জেনে নেওয়ার প্রয়োজন হবে, মানুষের স্বরূপের একটা সামগ্রিক সাধারণ পরিচয়।

চার্লস ডারউইনের প্রজাতির বিবর্তনতত্ত্ব আসলে কেমন তত্ত্ব? এটা কী বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা থিওরি? এর জবাব স্টিফেন হকিংয়ের ‘কালের সংখিপ্ত ইতিহাস’ বইটি থেকে দেওয়া যেত পারে। তাঁর অভিমত “একটা তত্ত্বকে ভাল তত্ত্ব বলা যেতে পারে, যদি সে তত্ত্ব দু’টি প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে। অল্পকিছু স্বীকৃত নিয়মের ভিত্তিতে দাঁড় করানো কোন মডেল যদি পর্যবেক্ষণের একটা বিরাট অংশকে নির্ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, এবং যদি সেখান থেকে ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কেও নিশ্চিত ও নির্ভুল ভবিষ্যৎবাণী করা যায়।” বস্তুতই বিবর্তন তত্ত্ব প্রকৃতির এক বাস্তবতা বা ফ্যাক্ট। সেটা এই অর্থে যে, জীবন প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃতিতে প্রজাতিসমূহের বৈশিষ্ট্যগুলি প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে, নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব (জন্ম) হচ্ছে। বিবর্তন তত্ত্ব মৌলিক ও ফলিত জীববিদ্যার এমন বেসিক প্রিন্সিপাল হয়ে উঠতে পেরেছে যে, বিজ্ঞানের নানা শাখা তো বটেই, এই তত্ত্বটি ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, নৃতত্ত্ববিদ্যা, প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা, তুলনামূলক শারীরস্থানবিদ্যা, বায়োজিওগ্রাফি, জেনেটিক্স, মলিকিউলার বায়োলজিসহ ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ নিয়ে গবেষণায় অপরিহার্য। ‘বিবর্তন’ এই শব্দের এই ক্ষেত্রে অর্থ হ’ল – এক জীবের পপুলেশনে পরিবর্তনের ফলে অন্য জীবের জন্ম সম্ভাব (উদ্ভব) ‘হওয়া’! একদা এই গ্রহে জীব উদ্ভবের মত সমস্ত জৈবিক প্রকৃতি পরিবেশ রচিত হওয়ার পর জলের আধারে (ফর্ম) জন্ম হয়েছিল এককোষী প্রাণী (কন্টেন্ট)। অতঃপর বিবর্তনের শর্ত (নিয়তি মেনে) ক্রমান্বয়ে জন্ম হতে থাকে জীব সকল। মানব প্রজাতির জন্মও এই শর্তে। সাদা কথায় এই হ’ল ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বের সারাৎসার। এই বিবর্তন শৃঙ্খলে কিছু কিছু মিসিং লিংক এখনও অনাবিষ্কৃত। কিন্তু তাতে মানব আগম তত্ত্বের কোনও ব্যত্যয় ঘটার সম্ভাবনা নেই। কারণ বিবর্তনবাদ অজস্র পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষায় সিদ্ধ। কোনও অলৌকিক নয়, লৌকিক আধারেই মানুষের জন্ম।

সদ্য ‘সায়েন্স’ জার্নালে একটি অসাধারণ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সিঙ্গাপুর নানইয়াং টেক্নোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল লাইফ সায়েন্সের একটি গবেষণা প্রকল্পতে এশিয়া, ইয়োরোপ, এবং আমেরিকার ২২টি প্রতিষ্ঠানের ৪৮ জন গবেষক অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ২০ হাজার কিলোমিটার পদযাত্রার একটা হদিস পেয়েছেন। গবেষণাপত্রে জানানো হয়েছে, ১৩৯ টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ১৫৩৭ জনের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে তাদের পরিযানের পথ। উল্লেখ্য, একেবারে আদিপর্বে লক্ষ লক্ষ বছর (২০ লক্ষ বা তার কিছু বেশি) আগে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সম্ভবত জাভা দ্বীপে (ফসিল প্রাপ্তির নিরীখে) পিথেকানথ্রোপাস বা বানর-মানুষের জন্ম। হোমো ইরেক্তুস-হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের পরিযান শুরু হয়েছিল আফ্রিকা থেকে সাড়ে সতের লক্ষ বছের আগে। এই গবেষণায় দীর্ঘতম যে পরিযানের সন্ধান মিলেছে, সেটা হয়েছিল প্রগৈতিহাসিক পর্বে। আফ্রিকা থেকে কয়েকটি জনগোষ্ঠী চলে আসে উত্তর এশিয়ায়। সেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়ে তা শেষ হয়েছিল টিয়েরা দেল ফুয়েগায় (বর্তমান আর্জেন্টিনার অংশ)। এটাই আপাতত পরিযানের শেষ সীমা হিসেবে স্বীকৃত। বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় এটাও দেখিয়েছেন, কীভাবে এই পরিযানপর্বে সংশ্লেষ হেতু জিনগতভাবে বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে, মানুষ কীভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ হয়েছে, কীভাবে বিভিন্ন দিকে পরিযান চলে, কীভাবে এই পরিযানজনিত স্থানান্তরণের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে জিনের উপর ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে, দীর্ঘ যাত্রায় ইমিউনিটি হ্রাস পাওয়ায় কীভাবে ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বাহিত ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ার কবলে পড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আয়ুষ্কাল হ্রাস পেয়েছে। এও তো বিবর্তনবাদের সত্যতার একটি হালফিল পর্যবেক্ষণের প্রমাণ, এবং একই সাথে জীবন প্রবর্ধন ও জীবন যন্ত্রণা যাপনের রহস্য উন্মোচন!

জন্মের বহিঃস্থ রহস্যময়তার জাল বহু আগেই উন্মোচিত হয়েছে। অন্তঃস্থ রহস্যের যেমন বস্তুগত দিক রয়েছে, তেমনই রয়েছে অন্তর্গত সত্তায় ভাববাদী দিক। এটা কল্পসৃজনের নিভৃত যাপনের দিক। এর উদ্ভবকালও মানব প্রজাতির বিবর্তিত জন্ম-ক্রান্তি লগ্নের সমকালীন যাপনের মধ্যে নিহিত। এই যাপন ব্যক্তিগত থেকে সামগ্রিকতায় অভিযাত্রা। “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া”-তে না পারলে কেউ কি পারে আপন স্বরূপ জানতে? কিন্তু বাইরে দাঁড়ানো তো সহজ নয় মোটেই। কারণ, ব্যক্তি মানুষের প্রকৃতির মধ্যে যে মায়া-মমতার অনুভূতি একটা অতি সূক্ষ্ম দেওয়াল তুলে রেখেছে, সেটা ভেদ করা তত সোজা ব্যাপার নয়। মায়া-মমতা মানুষের সহজাত। মানুষ হয়ে ওঠার প্রথম পর্যায়ের বিবর্তন থেকেই মমতা ও মননের বৈপরীত্য মানুষের বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে বা ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ায় মানুষের চৈতন্য বিবর্তিত হয়। জীবনের কাছে মানুষের চাওয়ার পরিমাণ বিপুল। মায়া-মমতায় ঘেরা মানুষ সংসারকে স্বার্থের দৃষ্টিতে দেখে। কাজেই তার চাওয়াটা একরৈখিক বা সামগ্রিক নয়, বরং খণ্ড খণ্ড। সামঞ্জস্যহীন চাওয়ায় সব সময় সবার সবকিছু, এমনকি বড় গোছেরও কিছু, পাওয়া হয়ে ওঠে না। কারও জোটে কিছু কিছু, কারও অতি অল্পস্বল্প, কারও বা নামমাত্র। কারও বাসনাই সুতৃপ্ত হয়না। এই বিফলতা ডেকে আনে ভয়, যন্ত্রণা, হিংসা। চৈতন্যের বিবর্তনের মধ্যবর্তী পর্বে মানুষ বেশি মাত্রায় সাবধানী, স্বার্থান্ধ, সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। যে জৈবরস থেকে স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালবাসার জন্ম, তাকেই এই পর্বে মানুষের একটা অংশ আধিপত্য বিস্তারের উপাদান হিসাবে চতুরতার সঙ্গে ব্যবহার করতে থাকে। বৈষম্যের যতগুলি উৎস আছে, এটা তার মধ্যে বিশিষ্টতম। এর আর একটা দিক হ’ল রক্তের বন্ধনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে স্বার্থের বন্ধনের জন্ম। এর ফলে জড় জগতের উপর আধিপত্য বাড়তে থাকে। আবার মানুষের অন্তরে রিক্ততার অনুভবও এই পর্বে জন্ম নেয়। ”মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব পরস্পর” এই রিক্ততারই প্রকাশ। এই দ্বন্দ্ব কখনও স্বার্থ ভিত্তিক, কখনও সংঘবদ্ধ মমত্বের সংঘাতে জর্জরিত। দ্বন্দ্বের এই যে বিচিত্র প্রকৃতি, তার নিরসনের উপায় উদ্ভাবনের প্রকৃতিও হয়ে ওঠে বিচিত্রতর। এই দ্বন্দ্ব বস্তুগত, ভাবগত বিষয় তার প্ররোচক হিসেবে জন্ম নেয়।মনুষ্যজন্মের পর থেকে এই দ্বন্দ্ব সংঘাতে ব্যক্তিগত ও সমাজগত মানুষ হিসেবে হয়ে ওঠার কোনও না কোন সময়ে, সকলকেই কিছু না কিছু দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে হয়। তবুও মানুষ আনন্দবিহারী। “আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে” – আনন্দের মধ্যেই বেঁচে থাকাই মানুষের অভীপ্সা। এটাই জীবন-রহস্য।

হয়ত বা নিবিড় আত্মমগ্ন সময়ে অবচেতনে লগ্ন কোন প্রত্নস্মৃতি বিলগ্ন এই রহস্যময়তা, যা মানুষকে অলৌকিক ভাবনার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় অজান্তেই। লৌকিক শিল্পকলা সাহিত্য সৃজনের বহু ক্ষেত্রে তারই মিস্টিক ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়, যার মানসিক প্রতিফলন ব্যক্তিভেদে হয়ে যায় কৌণিক। অর্থান্তর ঘটে নানাবিধ। সে সব শিল্পকলা দর্শন ও পাঠের অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণ অসম্ভব, কারণ পাঠক পাঠকালে বা দর্শক দর্শনকালে যেসব যাপিত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সমসাময়িক অবস্থানে এসেছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে এই সব মিস্টিক, বিমূর্ত বা বাস্তব আধারের আদলে সৃজনকে সে লক্ষ্য করতে চাইবে। এ’তো আমকে আম, লোহাকে লোহা, অথবা মানবকে মানব বলে শনাক্তকরণ নয়! পাঠ বা দর্শনে তার যে অনুভব, সেটা একান্তই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির। ব্যক্তিটি এমন যে, তার দৈনন্দিন বাস্তব যাপন, যৌনসঙ্গী নির্বাচনের পছন্দের নিরীখ, রিপ্রোডাকশনে প্রজাতিগত বিস্তারের স্বাভাবিক মিলন আকঙ্ক্ষা ও নিবৃত্তির অভিজ্ঞতাসহ, মগ্ন চৈতন্য, চেতন-চৈতন্যে জারিত হয়ে, পাঠ বা দর্শনের এক নব অভিজ্ঞতা পায় সে। সেই ব্যক্তিটি স্বয়ং তাৎক্ষণিকভাবে নিজের কাছেই হয়ত অচেনা, আপেক্ষিকভাবে। এও এক জন্মক্ষণ। বস্তুজগতে দাঁড়িয়ে এ হয়ত তার মায়াভিভূতধারা স্নান বা অন্য কোন রহস্যময় অনাস্বাদিত কাঙ্ক্ষিত জলাশয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত তীব্রতর আকর্ষণে অনাদরে অবগাহন। তা সুখের, অ-সুখের, আশ্লেষ, আনন্দঘন, নিরানন্দ, বিষাদময়, বিবমিষা, জিগীষা প্রভৃতি যে কোন রকমের উদ্দীপক বা অবসাদক্লিষ্ট হতে পারে। যাই হোক না কেন, তা রহস্যময় যাপনেরই এক খণ্ড অলীক-বাস্তবতার অঙ্গ!

জন্ম, জন্মের সুখ যাপন, জন্মযন্ত্রণাভোগ, যন্ত্রণাভোগ উত্তরণের বিজয়ী যাপন – এই সব কিছু নিয়েই জীবন এবং জীবন বড় সুন্দর। কেননা সে নানা রসের রসায়ন। এই জীবনধারা বেয়েই কবির “মন চলে শূন্য পানে চেয়ে”। তিনি অনুভব করেন, “রাজছত্র ভেঙে পড়ে; রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে; /জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে; /রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি /শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি। /ওরা কাজ করে /দেশে দেশান্তরে, /অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে, /পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে।”

এই শ্রমই “বিবর্তিত প্রজাতি” রূপে হয়ে ওঠা মানুষকে মানুষ করেছে। অপার রহস্যমণ্ডিত অজস্র সুখ-দুঃখ যাপনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করে জন্ম চরিতার্থ করেছে।


লেখক পরিচিতি : রতন চক্রবর্তী
অর্ধশতক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। দৈনিক, সাপ্তাহিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চাকরির পাশাপাশি কাজ করেছেন বিদেশি দূতাবাসের কলকাতা তথ্য দপ্তরে। তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। লিখেছেন ছোট গল্প, নাটক চিত্রনাট্যও। মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী। জন রিডের টেন ডেজ দ্যাট স্যুক দ্য ওয়ার্ল্ড নামে রুশবিপ্লবের দশ দিনের কাহিনি নিয়ে বিশ্বখ্যাত রিপোর্টাজ গ্রন্থ অবলম্বন করে লিখেছেন নাটক অভ্যুত্থান যা ৭৪ জন কুশীলব নিয়ে অভিনীত হয়।

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।