বাংলার কবিগান ও কবিয়ালদের ইতিবৃত্ত

লেখক : রানা চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হয় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি সময়কালের ব্যাপ্তিকে বলে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ। এর পরবর্তী দেড়শ বছর, অর্থাৎ ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত ছিল বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ। এই বিশাল সময়কালের কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, সেই সময় মানুষ মুখে মুখে সাহিত্য রচনা করতো, একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে সেই সাহিত্যকর্মের পরিচলন হতো, মানুষের মস্তিষ্কেই তা স্থায়ী হতো। লেখার চল ছিল না বললেই চলে। আর সে কারণেই কোনো মানুষের বিস্মৃতি বা মৃত্যুর মাধ্যমে সাহিত্যরাও হারিয়ে যেতো। এই বিস্মৃতির আঁধার হাতড়ে ঐতিহাসিকরা কিছু খুঁজে পাননি। আর তাই এ যুগের নাম হয়েছে ‘অন্ধকার যুগ’।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরও একটি অন্ধকার যুগ রয়েছে। তবে এই অন্ধকারের ধরণ ও নামকরণের কারণ আলাদা। ১৩৫০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত হলো বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ। এই মধ্যযুগের শেষের দিকে নামে সেই দ্বিতীয় আঁধার। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ বণিকদের হাতে বাংলা হারায় স্বাধীনতা। ১৭৬০ সালে মৃত্যু হয় মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের। সেই ভারতচন্দ্র, যিনি অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছিলেন, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।” ব্রিটিশ বণিকরা যখন শাসকে রূপান্তরিত হয়, তখন সুদীর্ঘকাল ব্যাপী স্থিতিশীল সমাজের ভিত্তিটি নড়ে ওঠে। আগে যারা ছিল সমাজের মাথা, তারা যশ আর প্রতিপত্তি হারিয়ে পিছিয়ে পড়ে। পিছিয়ে থাকা নিম্নস্তরের মানুষগুলো ব্যবসার সুবিধা নিয়ে আর ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়। সমাজে উদ্ভব হয় নতুন ধনিকশ্রেণির। কিন্তু রাতারাতি আর্থিক মানদণ্ডের পরিবর্তন হলেও রাতারাতি এই শ্রেণিটির রুচির পরিবর্তন হয়নি। এই নব্য ধনিক গোত্র চাইতো উন্মত্ত আনন্দ। আর সেই চাহিদা পূরণ করতে উদ্ভূত হয় কবিগান ও কবিয়ালদের। বিশেষ কোনো সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য না থাকায় কবিগানের সময়টিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিতীয় অন্ধকার যুগ বলা হয়।

কবিয়ালরা ছিলেন কবিদের থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা। তারা বিশেষ গাম্ভীর্যপূর্ণ কোনো কবিতা তৈরি করতেন না। ক্ষণিকের আনন্দ দানের উদ্দেশ্যেই হতো তাদের কাব্য সৃজনের প্রয়াস। তারা কবিতা লিখতেন না, বিপক্ষের ছোঁড়া কটাক্ষ বা প্রশ্নের জবাব হিসেবে তাৎক্ষণিক মুখে মুখে রচনা করতেন কয়েকটি পংক্তি। কবিগানের পালায় থাকতো দুটি করে দল। প্রতি দলে থাকতো একজন করে কবি। এছাড়া দুই দল মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাতজনের মতো দোহার ও তিন-চারজন বাদক থাকতো। দুই দলের দুই কবি মুখোমুখি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অবতীর্ণ হতেন কবিতাযুদ্ধে। এক কবি প্রথমে অপর দলের কবিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নাকারে কোনো পদ্য ছুঁড়ে দিতেন। অপর কবি সে অনুযায়ী তাৎক্ষণিক একটি ছন্দ বানিয়ে পাল্টা জবাব দিতেন। প্রথম দলের কথাকে বলা হতো ‘চাপান’, আর দ্বিতীয় দলের কথাকে বলা হতো ‘উতোর’। পাঁচালি, খেউড়,আখড়াই, হাফ-আখড়াই, বসা কবিগান, দাঁড়া কবিগান, ঢপ, টপ্পা, কীর্তন, তর্জা প্রভৃতি ছিল কবিগানের বিভিন্ন ধরন। এসব পদ্যে রুচির খুব একটা চিহ্ন থাকতো না। একে অপরকে কথার আক্রমণে পর্যুদস্ত করে ক্ষণিকের আনন্দ লাভই ছিল মূল লক্ষ্য।

তবে কবিগানের শিল্পগুণও একেবারে অবহেলা করার মতো না। কবিগান একাধারে গান, কবিতা, বিতর্ক, সমালোচনা ও পর্যালোচনাও বটে। সাধারণ মানুষের নানা দ্বন্দ্ব, সমস্যা ও ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতেন কবিয়ালরা। শাস্ত্রীয় বহু প্রসঙ্গের মধ্যকার পরস্পরবিরোধী, অসামঞ্জস্যপূর্ণ উক্তি ও বক্তব্যগুলো দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করে কবিয়ালরা বিষয়বস্তুর সত্যতার কাছে শ্রোতাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। আজও অধিকাংশ কবিয়ালদের মধ্যে ভাববাদের প্রাধান্য রয়েছে ও বিষয়বস্তুর মধ্যে আধ্যাত্মবাদ প্রধান স্থান দখল করে আছে। কবিগান আমাদের লোকসাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি লোকশিক্ষায় রেখেছে মূল্যবান অবদান। বাঙালির প্রাণের সামগ্রী, মানস সম্পদ, বাস্তব জীবানুভূতিসম্পন্ন লোকায়ত কবিগান গ্রামীন মানুষের  সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সামগ্রিক পরিমণ্ডল ব্যাপ্ত করে অবস্থান নিয়েছে। দেশপ্রেম আর মানবপ্রেম নিয়ে কবিগানে প্রচুর আলোচনা হয়। ভালো আর মন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মানুষের চিন্তাজগৎকে আলোড়িত করে এসব কবিগান। প্রকৃতি, পরিবেশ, নৈসর্গিকতা নিয়েও কবিগানে যথেষ্ট আলোচনা হয়। তবে সবার উপরে অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি কবিগানে বরাবর বহুলচর্চিত ও গীত হয়েছে। কবিগানের ধারাটি এখনও দুই বাংলায় গ্রামে ও শহরে প্রচলিত রয়েছে।

কবিগানের বিকাশ হয় ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে। এ পর্যন্ত একশ’রও বেশি কবিয়াল কবিগানের বিকাশে অবদান রেখেছেন। সবচেয়ে প্রাচীন যে কবিয়ালের নাম শোনা যায়, তিনি হলেন গোজলা গুঁই। এরপর নাম আসে রাম বসু, নৃসিংহ, রাসু, ভবানী, ভোলা ময়রা, হারু ঠাকুর, নিধুবাবু, কেষ্ট মুচি, হরিহরণ আচার্য, রামানন্দ নন্দী, রমেশ শীল, নকুল দত্ত, বিজয় সরকার, বিজয় নারায়ণ আচার্য, কালিদাস সরকার, রসিকলাল সরকার, নারায়ণ বালা, নিশিকান্ত সরকার, রাজেন্দ্র সরকার প্রমুখের নাম। একজন পর্তুগিজ বণিকও বাংলার নামজাদা কবি হয়েছিলেন। তিনি হলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি।

কবিয়াল নিধুবাবুর পুরো নাম রামনিধি গুপ্ত। তার একটি বিখ্যাত গানের পংক্তি-

“নানান দেশের নানান ভাষা

বিনে স্বদেশী ভাষা,

পুরে কি আশা?”

রাম বসু ছিলেন হাওড়া জেলার মানুষ। তাকে প্রথম যুগের প্রতিনিধি বলা হয়। তার গুরু ছিলেন নিতাই বৈরাগী। রাম বসুর গানগুলো বেশ মানোত্তীর্ণ বলা চলে। যেমন-

“যৌবন জনমের মতো যায়

আশাপথ নাহি চায়।

কী দিয়া গো সখী বাঁধিবো হিয়ায়।।”

ঠাকুর সিংহ আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি একই মঞ্চে প্রতিযোগিতায় নামতেন। তাদের একটি লড়াইয়ের নমুনা এরূপ-

ঠাকুর সিংহ বলছেন-

“বলো হে অ্যান্টনি, আমি একটি কথা জানতে চাই

এসে এদেশে তোমার গায়ে কেন কুর্তি টুপি নাই।।”

আন্টনির জবাব-

“এই বাংলায় বাঙালির বেশে আনন্দে আছি,

হয়ে ঠাকরে সিংহের বাপের জামাই কুর্তি টুপি ছেড়েছি।”

অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির আরেকটি বিখ্যাত গানের পঙক্তি যা তিনি ভোলা ময়রার গানের জবাবে দিয়েছিলেন-

“খ্রিস্ট আর কৃষ্ণ কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই

শুধু নামের ঘোরে মানুষ ফেরে, এও কোথা শুনি নাই।

আমার খোদা যে, হিন্দুর হরি সে

ঐ দেখ শ্যাম দাঁড়ায়ে রয়েছে…”

সেই আমলে এমন কথা সুনিশ্চিতভাবে অনেক বেশি গভীর আত্মোপলব্ধি ও অনুধাবনের পরিচায়ক।

কবিয়াল রাজেন্দ্র সরকার জন্মেছিলেন নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ে। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গোষ্ঠীর ঘৃণার শিকার ছিল এই সম্প্রদায়। বাংলার অন্যতম উৎপাদক শ্রেণি ছিল তারাই। তাদের ঘৃণা করার প্রতিবাদে রাজেন্দ্র সরকার তৈরি করেন এই গানটি-

“কত মদের নেশায়, বদের দশায়, ব্রাহ্মণে খায় বেশ্যাদিগের ভাত,

বেশ্যারা কি ঠাকুর জগন্নাথ?

নটির হুক্কার তামাক খেয়ে, কুলিনকবলায় বাড়ি যেয়ে,

এইসব ব্রাহ্মণকে না প্রণাম দিয়ে-

নটির পদে কোটি দন্ডবৎ।”

উদ্ভবকালের কবিগান পরিবেশনার সাথে এখনকার পদ্ধতির বেশ কিছু ফারাক রয়েছে। ঢোল আর কাঁসি এখনকার কবিগানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। উদ্ভবকালে কবিগানের মূল অনুষঙ্গ ছিল খোল আর করতাল। আধুনিককালে কৌশলপূর্ণ কথা কাটাকাটির মধ্যে দিয়ে জিতে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আগেকার সময়ে গানেই সবকিছুর সমাধান হতো। ডাক, মালসি, সখীসংবাদ, কবি, টপ্পা, ধুয়া, প্যার ও পাঁচালি এই আটটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কবিগান পরিবেশিত হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কবিগানে অশ্লীলতা প্রবেশ করে। পূর্ববঙ্গের কবিগানের যুগস্রষ্টা নরসিংদীর হরিচরণ আচার্যের রচিত কবিগানের আংশিক সংকলন গ্রন্থ ‘কবির ঝংকার’ এর ভূমিকায় উল্লেখিত হয়েছে,

“কবিগানের গৌরবময় দিনের পর এক ঘোর অবনতির যুগ আসিল। ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির রুচি পরিবর্তিত ও সংস্কৃত হইতে লাগি। বিলাতি ফ্যাশানের থিয়েটার প্রভৃতি আসিয়া শিক্ষিত ও ভদ্র সম্প্রদায়ের চিত্ত বিনোদনে ব্যাপৃত হইল। কবিগান তখন একমাত্র অশিক্ষিত সাধারণ সম্প্রদায়ের আমোদ যোগাতেই ব্যাপৃত রহিল ও সঙ্গে সঙ্গে অশ্লীলতা দোষে এত জঘন্য হইয়া পড়িল যে ভদ্র গ্রামে পর্যন্ত তাহা গাওয়া অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। ভদ্রলোক তাহা শুনিতেনই না।”

এইকালে কবিগান গ্রামের ভেতরে না হয়ে ফাঁকা ভিটায়, বটতলায় বা শ্মশানঘাটে অনুষ্ঠিত হতো।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কবিগানকে ‘নতুন সামগ্রী, নষ্ট পরমায়ু’ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক ও প্রাবন্ধিক যতীন সরকার বলেন, “উদ্ভব থেকে পরিণতি পর্যন্ত সব সময়েই এ অঞ্চলের কবিগান ছিল আবহমান কালের লোকসংস্কৃতির মধ্যে দৃঢ়মূল।” তাই রবি ঠাকুরের উক্ত কথাটি তার ভাষ্যমতে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যায় না। কবিগানের পক্ষ ও বিপক্ষ নিয়ে গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই। অনেকের কাছে এ এক অনন্য সম্পদ, অনেকের কাছে রুচিহীনদের সময় কাটানোর অনুষঙ্গ। তবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে গেলে বলা যায়, কবিগানের সাগর মন্থন করে দু’চারটে মুক্তা নিশ্চয় পাওয়া যায়।

কবিগান ও তরজাগান -এর মধ্যে সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি থাকলেও কবিগান এবং তরজাগান এক গান নয়। ডঃ সুকুমার সেন বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন –

“উনবিংশ শতাব্দের মধ্যভাগ কবিগান তরজা লড়াই-এ পরিনত হয়েছিল।”

ডঃ সেনের এই মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কবিগানের জন্ম তরজার আগে এবং দুটো ভিন্নরীতির গান। তা নাহলে পরিনত হওয়ার কথা উঠতো না। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে তরজাকে কবিগান এবং পাঁচালি গানের সংমিশ্রণে উদ্ভূত লোকরঞ্জনকারী নতুন রীতির গান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রাচীনত্বের দিক থেকে কবিগান তরজা গানের থেকে এগিয়ে। শ্রীচিত্তরঞ্জনের দেব মহাশয় তাঁর ‘বাংলার পল্লিগীতি গ্রন্থে বলেছেন –

“তরজার ইতিহাস খুব বেশী দিনের যে তা নয়।’ শ’ খানেক বছর আগে হাওড়ার শালকিয়া অঞ্চলের মধু ঠাকুর ও তারক পাল নামক দুই ব্যাক্তিই বাংলার প্রথম তরজা গানের প্রচলন করেন।”

কিন্তু এই মন্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত তাতে সন্দেহ আছে। কোনও কোনও সাহিত্যের ইতিহাসকার বলেন – মুর্শিদাবাদের হোসেন খাঁ তরজার প্রচলন করেন। কে বা কারা তরজার প্রচলন করেন সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা নিশ্চিত যে কবিগান থেকেই তরজার জন্ম। যদিও অন্যান্য গানের রীতিও তরজায় মিশেছে। কবিগান এবং তরজা গানের মধ্যে সাদৃশ্য এবং পার্থক্য দুই-ই বিদ্যমান। কবিগান ও তরজাগানের মধ্যে অনেক মিল দেখা য়ায়। কবিগানের মতো তরজাগানেও দুটি পক্ষ থাকে। দুটো পক্ষেই একটি করে মূল গায়ক থাকে। বাদ্যযন্ত্রের সামান্য ফারাক বর্তমানে পরিলক্ষিত হয়।কবিগানে বর্তমানে ঢোল এবং জুড়ির ব্যবহার দেখা যায়। তরজা গানে ঢোল কাঁসির ব্যবহার দেখা য়ায়। তরজা গানে আর একটি অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। মূল গায়ক সাধারণত পায়ে ঘুঙুর পরে গান করেন। গানের তালে তালে পা নাচিয়ে বাজান। পোশাকের দিক থেকেও সামান্য ফারাক দেখা য়ায়। কবিগানে কবিয়াল যেভাবে পরিপাটি পোশাক পরিধান করে থাকেন তরজা গানে অতটা দেখা য়ায় না। কবিয়ালরা সাদা ধুতি এবং সাদা অথবা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরেন। তরজা গানে গায়ক ফতুয়া এবং হাফ হাতা গেঞ্জি পরে তরজা গান করে থাকে। কবিগান ও তরজা গান ভিন্ন হলেও তাদের গায়কী রীতির মধ্যে অনেক অংশে মিল পাওয়া য়ায় বলেই অনেক কবিকে তরজা গান করতেও দেখা য়ায়। কবিগানের আদিপর্বে প্রখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রাও দক্ষতার সাথে হোসেন মির্জার সাথে অনেক তরজা গান করেছেন।

কবিগান বাঙালির হৃদয়ের সামগ্রী। জনসাধারণের মনোরঞ্জন ও লোকশিক্ষা এগানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলা লোকায়ত সাহিত্যের এক বিপুল সম্পদ কবিগানের খনিতে রয়েছে। কবিগানের উৎস ও উৎপত্তিকাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।

কবিগানের আদি বীজ কবির কাব্যশক্তি পরীক্ষার মধ্যে থাকলেও আমরা যে কবিগানের প্রচলন দেখি তার সূচনা পর্বের ভূমি হলো শান্তিপুরের  কবিগান। গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর ভট্ট্যাচার্য মহাসয় আঁখড়াকেই সংগীত সংগ্রমের কবিগানের আদিরূপ বলে ব্যাখ্যা করেন – “শান্তিপুর ও ফুলিয়া গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় সংগীত সংগ্রামের অভিনয় উৎসাহের সহিত আরাম্ভ হয়ে গেলো ” — এইরূপ বহুকাল ধরিয়া কৃষ্ণলীলার অপূর্ব মাধুর্য আস্বাদনের জন্য আঁখরাই পাড়ার সংগীত সংগ্রামে চলতে লাগলো। কালস্রোতে কবিগানের মাধুর্য ,রীতি বিকৃত হতে লাগলো। অর্থের প্রলোভনে কিছু কবিয়ালেরা  ভাষার নিয়ম ও ভাবসম্পদ উলঙ্গন করতে থাকে এবং কবিগান ব্যবসায়িক  স্বার্থে ব্যবহার হতে থাকে। সংগীত সংগ্রাম নাম পালটে হয়ে যায় কবির লড়াই বা তরজার লড়াই।

দেশ কালের সহিত সামঞ্জস্য রেখে কবিগান শান্তিপুর থেকে নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র হুগলি -চুঁচুড়ার পথ ধরে কলকাতা নগরে পৌঁছায়। ইংরেজ অনুগ্রহে পুষ্ট, নববীয়ানার বার্থ অনুকরণ প্রয়াসী যে জনসমাজ তখন সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তাদের মধ্যে দিয়ে কবিগানের প্রসার ঘটেছিলো। “মহারাজ বাহাদুর “নবকৃস্নাদেব এই শ্রেণীর অন্যতম আগ্র-প্রথিক। আচার্য দীনেশচন্দ্রে সেন মনে করেন যাত্রা থেকে কবিগানের উৎপত্তি হয়েছে। তার মতে পূর্বে কবিগান যাত্রার অংশ ছিল, তারপর এই হালকা ধরণের গান যাত্রা থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে ‘কবিগান ‘নামে পরিচিতি লাভ করে এবং লোকরঞ্জনের একটি বিশেষ রূপ ধারণ করে। ডঃ সুশীলকুমার দে এর প্রতিবাদ করেন। তিনি তিনটি বিরোধী কারণ প্রতিস্থাপিত করেন। প্রথম কারণ, কবিগান যে যাত্রার অংশ ছিল, এ ধরণের প্রমান দেবার মতো কোনও নতুন পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, কবিগান ও যাত্রার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। তৃতীয়ত, একই সময়ে যখন কবিগান ও যাত্রার অস্তত্ব পাওয়া যাচ্ছে, তখন এক থেকে অপরের উৎপত্তি হয়েছে, একথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। ডঃ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত ঝুমুর থেকেই কবিগানের উৎপত্তি হয়েছে। সংলাপধর্মী বা প্রশ্নোত্তরমূলক রচনা, যাতে নৃত্যগীতের প্রচুর ব্যবহার ছিল, মধ্যযুগে তাকে বলা হতো ঝুমুর। আদিরস ঘটিত ঝুমুর কালক্রমে পরিবর্তিত হতে হতে কবিগান নামে পৃথক আরেকটি লোকনাট্যের রূপ দেয়। ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র পাল মহাশয় মনে করেন, সপ্তদশ শতাব্দীতে কবিগানের কোনরূপ অস্তিত্ব ছিলনা। এ মন্তব্য কোনোমতেই শরিকের করা যায়না। কবিগানের মতভেদ নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বেও যে কবিগানের চল ছিল তাতে সন্দেহ নেই। ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ খিষ্টাব্দের মধ্যে ঘটেছিলো বলে ডঃ দে অভিমত দিয়েছেন। অধ্যাপক দে কবিগানের যে তিনটি পর্যায় করেছেন তাতেও দেখা যায় প্রথম পর্যায় ১৭৬০ এর পুর্ববর্তী কালকে চিন্তিত করেন। সুকুমার সেনের মতো সুশীলকুমার দে কবিগানের কোনো প্রাচীনতম নিদর্শনের উল্লেখ করেননি এবং এই প্রসঙ্গে জানিয়েছে যে, উপযুক্ত তথ্যাদির অভাবে প্রাচীনতম কবি সংগীতের প্রসঙ্গে কিছু বলা সম্ভব না।

‘It is very difficult in the absence of materials to trace the origin of this peculiar from of literature …most of the songs which have come down us belong to a date posterior to middle of the 18th century.

কবিগানের পর্ব  –

প্রথম পর্ব ;-অষ্টাদশ শতাব্দীর পুর্ববর্তী যুগ। এসময়ের কবিগান ও কবিয়াল সম্পর্কে  কিছুই জানা ছিল না। অনুমান করা হয় এযুগেও কবিগানের অস্তিত্ব ছিল।

দ্বিতীয় পর্ব – অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে মধ্য ভাগ পর্য্যন্ত। গোঁজলা গুই এবং তার তিন শীষের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের জীবন সংকান্ত কিছু তথ্য ও কয়েকটি গান পাওয়া গেছে।

তৃতীয় পর্ব – অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে থেকে ঊনবিশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক। হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী ও রাম বসু এসময়ে শ্রেষ্ঠ কবিয়াল।

চতুর্থ পর্ব – ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। এযুগে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী কবিয়াল জন্মেছিলেন। এঁদের মধ্যে ভোলা ময়রা, এন্টিনি ফিরিঙ্গি অন্যতম ছিলেন।

তথ্যসূত্র:

১- কবিগান ও কবিয়াল, শ্রী রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

২- লাল নীল দীপাবলি, শ্রী হুমায়ুন আজাদ।

৩ – https://roar.media/bangla/main/literature/kobigaan-bangla-literature


লেখক পরিচিতি : রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন