নীল খাম ও মিরা…

লেখক : প্রিয়াংকাকলি

ইদানীং ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিস, অফিস শেষে বাসায় আসার পর ফ্রেশ হয়ে খাওয়া শেষে একটু ঘুম। এরপর আবারও অফিসের কাজ নিয়ে ল্যাপটবে বসা। দিন চলে যাচ্ছে এভাবেই। এত ব্যস্ততার মধ্যে একটু প্রশান্তি আনে তিন বছরের রুমঝুম। অনিন্দ্যর ব্যস্ত সময়ের মাঝে যেন অক্সিজেন জোগায় সে। সংসার, অফিস এর মাঝে ডুবে থাকা অনিন্দ্য তবুও মিরাকে ভুলে যায়নি। মিরাকে সে খুঁজেছিল অনেকবার। কিন্তু সেদিন সেই রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের পর আর দেখা হয়নি মিরার সাথে।

অনিন্দ্যরও আর কিছু করার ছিল না। কয়েক মাসের ব্যবধানে মায়ের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করেছে। বলাই বাহুল্য, মেয়ে অসম্ভব রকমের সুন্দরী। সেই হিসেবে সাদা ফর্সা এক কন্যার বাবাও হয়েছে অনিন্দ্য। এ সমাজ মনকে বোঝে না। তাই অনিন্দ্যর মনটাও বুঝতে পারেনি কেউই। অনিন্দ্যও গা ভাসিয়ে দিয়েছে । মেনে নিয়েছে মায়ের পছন্দ করা মেয়েটাকে।

জীবনটা সিনেমেটিক নয়। সিনেমায় নায়িকার খোঁজে নায়ক দুর-দুরান্ত, পাহাড় – পর্বত পাড়ি দেয়। কিন্তু জীবনের বাস্তবতায়!!! এসব কি সম্ভব??? তাইতো অনিন্দ্য  হাল ছেড়ে দিয়েছিল কোন একদিন। কিন্তু তাতে কি? সংসারী হয়েও মিরাকে কি সে পুরোপুরি ভুলতে পেরেছে? পারে নি তো। কারণে – অকারণে মিরা এসে যেন বারবার তার মনটাকে বেপরোয়া করে তোলে। অনিন্দ্যর তখন ভারি রাগ হয় অদৃশ্য মিরার উপর। অবশ্য মিরার কি দোষ? ভাবে অনিন্দ্য। 

আজকাল অনিন্দ্যর খুব জানতে ইচ্ছে করে মিরা কেমন আছে? মিরা ভালো আছে কিনা, বিয়ে করেছে কিনা …………এসব জানার জন্য মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে তার। সেদিনও — যখন ভার্সিটিতে রিইউনিয়ন হয়ে গেল , অনিন্দ্য বন্ধুদের মাঝে মিরাকে খুঁজেছিল বারবার। ভেবে রেখেছিল মিরাকে হয়ত আর একবার কাছ থেকে দেখার। কিন্তু না। মিরা আসেনি। মিরার খোঁজও কেউ দিতে পারেনি। এতটা আড়াল হয়ে যাবে মিরা— কোনদিন ভাবেনি অনিন্দ্য।

বিয়ের প্রথম রাতেই নীলাকে সব বলেছিল অনিন্দ্য। নীলাঞ্জনা নীলা অনিন্দ্যর স্ত্রী। সব শুনে নীলা কষ্ট যে পায়নি তা নয়। স্বামীর প্রথম প্রেমের কথা শুনলে কে না কষ্ট পায়!!! অনিন্দ্যর মনে হয় আজও, নীলা সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু ঐ যে……… গা ভাসিয়ে দিয়েছে। নীলাও কি তার ব্যতিক্রম হবে? সেও তো এই সমাজ – এরই একজন। তাই মেনে নিয়েছে। পরিচিত অথবা অপরিচিত—-এই সমাজ তাকেই  কাছে রাখে যে শুধু মেনে নিতে পারে, মানিয়ে নিতে পারে, গা ভাসাতে পারে। নীলারও কোন দোষ নেই।

কিছুদিন আগেও নীলাকে একদিন অনিন্দ্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিল,“ তোমার কখনও আমার উপর রাগ হয়নি? ”
নীলা তখন বেডরুম পরিষ্কার করছিলো। অনিন্দ্যর কথা শুনে বললো,“ রাগ হবে কেন?”
“ তোমার আগে আমি অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম……”
“ রাগ করে করবো কি? তোমার প্রথম প্রেম তো আর হতে পারবো না। এসব নিয়ে ভেবে ভেবে মাথা নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই।” বলতে বলতে মুখে হাসি আনে নীলা। অনিন্দ্য চুপ থাকে আর হালকা হাসি আনে মুখে। নীলার কথার মাঝে একটা কষ্টের গন্ধ যেন অনুভব করে সে।

আরও একদিন, অনিন্দ্য নীলাকে বলে,“ কোনদিন যদি শুনো মিরা আবার ফিরে এসেছে, তখন কি করবে তুমি? ”
নীলা আর অনিন্দ্য তখন বারান্দায় বিকেলের চায়ে ক্লান্ত শরীরটা জুড়িয়ে নিচ্ছিল। অনিন্দ্যর কথা শুনে নীলা বললো,“ বলবো, আপনাকে ধন্যবাদ আসার জন্য। বসেন , তিনজন মিলে চায়ের কাপের সাথে আড্ডা দেই।” হাসতে থাকে নীলা। হাসে অনিন্দ্যও। অনিন্দ্য পরে বলে,“ তোমার খারাপ লাগবে না ।”
“ খারাপ লাগবে কেন? এমন যদি হয় তাহলে তো নিজে একটু তোমার পছন্দের মানুষটাকে একবার কাছ থেকে দেখতে পাবো।” বলতে বলতে মলিন হাসি দিলো নীলা। একটা চাপা অভিমান টের পেল অনিন্দ্য। কিন্তু কার উপর? বোঝা গেল না। অনিন্দ্যর মনে হলো নীলাকে সে অজান্তেই কষ্ট দিচ্ছে এসব বলে। সেই থেকে এ ধরনের কথাবার্তা থেকে বিরত থাকলো অনিন্দ্য।

নীলা সুখী নয়, নয় অনিন্দ্যও। তবুও খুব সুন্দর একটা সুখের অভিনয় চলছে দিনের পর দিন। অবশ্য সুখী নয় এটাও কি বলা যায়! সুখী তারা অবশ্যই। কিন্তু তবুও কোথায় যেন অজানা একটা ঘাটতি থেকেই যায়! অ-সুখটা যেন ওখানেই চেপে বসে আছে। এর থেকে বের হওয়া যেন বড়ই দুষ্কর।

আজ ছুটির দিন। অনিন্দ্য রুমঝুমকে সময় দিচ্ছে। রুমঝুমও তার বাবাকে ছুটির দিনে পেয়ে খুশি। মেয়েটা  বড্ড দুষ্টু হয়েছে। আর একটু থেকে একটুতেই শুধু খিলখিল করে হাসে। নীলা ব্যস্ত রান্নাঘরে। ছুটির দিন বলে একটু ভাল কিছু রান্না করছে। চেষ্টা করে অনিন্দ্যর পছন্দ অনুযায়ী রান্না করতে। হয়তো হয় , হয়তো বা হয়না। তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই নীলার। অনিন্দ্য রুম থেকেই সরষে ইলিশের ঘ্রাণ পায়। রুমঝুম এদিকে বেশ ছুটাছুটি  করছে। অনিন্দ্যর সামলাতে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু তবুও একটা স্নেহের আনন্দ আর পরিতৃপ্তি অনুভব করে সে।

সরষে ইলিশটা হয়ে এলো বলে। নীলা অনিন্দ্যকে বলতে যাবে। ঠিক তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠে। দরজা খুলে নীলা দেখলো ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে আছে। নীলাকে জিজ্ঞেস করলো,“ অনিন্দ্য চৌধুরী আছেন?”
“হাঁ, আছেন।”
“ একটা খাম আছে ওনার নামে। ওনার সই লাগবে।”
নীলা দেখলো নীল রঙের একটা খাম। একটু বড় সাইজের।

“ দাঁড়ান, ডাকছি।” বলতে বলতে নীলা ভেতরে গিয়ে অনিন্দ্যকে বললো,“ তোমার একটা নীল খাম এসেছে। তোমার সই লাগবে।”
“ নীল খাম! কে দিলো?” কিছুটা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো অনিন্দ্য।
“ জানি না, দেখো। আমার রান্না শেষ। তাড়াতাড়ি টেবিলে এসো।” বলতে  বলতে নীলা আবার রান্নাঘরে গেলো। রুমঝুম তখনও এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে।অনিন্দ্য গিয়ে দেখলো একটা নীল খাম ডাকপিয়নটার হাতে। অনিন্দ্যকে দেখে ডাকপিয়নটা বললো,“ অনিন্দ্য চৌধুরী?”
“হুম।”
“এখানে একটা সই দিন।” একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বললো ডাকপিয়ন। অনিন্দ্য দেখানো জায়গাটাতে সই দিলে ডাকপিয়ন নীল খামটা অনিন্দ্যর হাতে  দিলো। অনিন্দ্য নীল খামটা নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
“ কার চিঠি?” জিজ্ঞেস করলো নীলা।
অনিন্দ্য খামটা উল্টে-পাল্টে বললো,“ জানি না। ঠিকানা , নাম কিছুই দেয়া নেই।”
নীলা যেন একটু সুযোগ পেল । বললো,“ নাম-ঠিকানাহীন চিঠি। তাও আবার নীল খামে। প্রেম করছো না তো! সাবধান কিন্তু। আগেরটা মেনে নিয়েছি। এখনেরটা কিন্তু মেনে নেবো না।”
কথা শুনে নীলার দিকে তাকিয়ে হাসে অনিন্দ্য। নীলাও হাসতে হাসতে বলে,“ খাবার দিয়েছি। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।”
“হুম। আসছি।” বলতে বলতে অনিন্দ্য খামটা খুলতে থাকে।

নীলা খাবার টেবিলে রুমঝুমকে খাওয়ানো শুরু করে। মেয়েটা সহজে খেতে চায় না।  অনিন্দ্য ততক্ষণে খামটা খুলেছে। খামের ভেতর থেকে একটা কার্ড বের হলো। কার্ডে ছোট্ট দুটো লাইন লেখা দেখলো অনিন্দ্য……
অনিন্দ্য, This is MIRA………
দেখা হবে কিছুদিন পর।
অনিন্দ্য তার চোখের চশমাটা একটু ঠিক করে আবার দেখলো। একই লেখাটা আবারও পড়লো অনিন্দ্য। তার যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এতদিন পর মিরা !!!
নীলা তখন ভিতর থেকে আবারও বলছে,“ খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলো তো………”
নীলার আওয়াজে অনিন্দ্য একটু হকচকিয়ে উঠে বললো,“ হ্যাঁ……… আসছি। ”
অনিন্দ্য কার্ডটা নীল খামটার ভিতর ঢুকিয়ে তার ড্রয়ারে রেখে খাবার টেবিলে আসে।
“ কি,জানতে পারলে কে দিলো? ” জিজ্ঞেস করলো নীলা।
“ হু………আমার এক বন্ধু। ”  এড়িয়ে গেলো অনিন্দ্য। নীলাকে সে সত্যিটা বলতে পারতো। কিন্তু নীলা ভেতরে ভেতরে একটা অশান্তি বয়ে বেড়াবে………এটা ভেবে সত্যিটা বলা থেকে বিরত থাকলো অনিন্দ্য।

বিকেলের নরম আলোয় পরিবেশটাকে উপভোগ করছিল অনিন্দ্য। নীলা আর রুমঝুম ঘুমুচ্ছে। অনিন্দ্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আজ তার মনটা বড্ড অশান্ত। এতদিন মিরাকে সে খুঁজেছে। মিরার খোঁজ পেতে চেয়েছে। কোন খোঁজ পায়নি। মনটা তখন বড্ড খারাপ হতো।  কিন্তু আজ মিরার দেয়া নীল খামটা ………। ভাবাচ্ছে অনিন্দ্যকে। এতদিন পর হঠাৎ মিরা কোথা থেকে? সত্যিই কি মিরার সাথে দেখা হচ্ছে? যদি তাই হয় ; তবে সেটা কবে,কোথায়? নাঃ……… কিছুই  দেয়া নেই ঐ নীল খামে। তবে?  অপেক্ষা………!!!
হুম………নীল খামটা নিয়ে মিরার জন্য অপেক্ষা, আর একটি বার……… মিরাকে ……… কাছ থেকে দেখার অপেক্ষা।


লেখক পরিচিতি : প্রিয়াংকাকলি
আমি প্রিয়াংকা।জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছি চট্টগ্রামেই। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। আর ভালবাসি গল্প লিখতে। পড়াশোনা করা অবস্থায় স্কুল,কলেজ ম্যাগাজিনে তিনবার আমার লেখা গল্প ছাপানো হয়েছিল।বর্তমানে বাস করছি ইতালিতে। আমার লেখা গল্প পড়ে ভালো না খারাপ লাগলো তা জানালে অনেক বেশি ভালো লাগবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

6 Comments

  1. অজ্ঞাতনামা কেউ একজন

    শুভ্র, সুন্দর ও গৌরবের কিরণমালায় যেখানে পৃথিবী জাগিয়া ওঠে, সেখানেই মানুষ হাসে। অগৌরবের অন্ধকারে মানুষ নাই। তোমার অসাধারণ লিখা কেমন লেগেছে তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।

    • priyanka

      ধন্যবাদ। এতটা প্রশংসা পাবো আশা করি নি!!!
      ভালো লাগলো জেনে , আমার লেখা গল্প আপনাদের ভালো লাগলো বলে।
      সুন্দর কমেন্টস এর জন্য আমার লেখা গল্পগুলো অপেক্ষায় থাকবে সবসময়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।