উল্কা ও উল্কাবৃষ্টি

লেখক: হৃদয় হক

অন্ধকারাচ্ছন্ন চাঁদবিহীন কোনো এক রাতে আপনি কখনো বাহিরে বেরিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালে কয়েক মিনিটের ভেতরেই দেখবেন এই বুঝি কোনো এক আলোকরখা সাঁই করে ছুটে গেল। এই ঘাটনাকে অনেকে বলে থাকেন নক্ষত্র-পতন বা তারা-খসা। তবে সত্যি বলতে কি, এরা নক্ষত্র নয়, এদের নাম উল্কা। উল্কারা আসলে খুবই ক্ষুদ্র মহাজাগতিক ধূলিকণা। অতিক্ষুদ্র মহাজাগতিক পাথর বা বরফ কিংবা ধাতু। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা বাতাসের অণুগুলোর সাথে যখন এই ধূলিকণাগুলোর ঘর্ষণ ঘটে তখন এরা বাতাসের অণুগুলোকে উত্তপ্ত ও আন্দোলিত করে, আর সেই সাথে এরা মাটির উদ্দেশ্যে নেমে আসার সময় জ্বলে ওঠে।
আসলে উল্কা বিষয়টি মূলত তিন অবস্থার একটি। কোনো মহাজাগতিক ধূলিকণা যা উল্কায় পরিণত হবে তাকে বলা হয়, “মিটিয়রয়েড” বাংলায় “উল্কাধারী” বলা যেতে পারে। এরা যখন পৃথিবী বা কোনো গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলের টানে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে জ্বলে ওঠে তখন এদের নাম হয় উল্কা বা মিটিয়র। বেশীরভাগ উল্কাই আকাশে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে যদি নেমে এসে মাটিতে ধরা দেয় তাদের নাম হয়ে যায় উল্কাপিণ্ড বা “মিটিয়রাইট”। বছরের কিছু কিছু সময় পৃথিবী তার চলার পথে ঢুকে পড়ে নানান ধূমকেতুর কক্ষপথে। আর ধূমকেতু চলার সময়, বস্তুত সূর্যকে পরিভ্রমণ করার সময় তার কক্ষপথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয় তার গা হতে নানান ক্ষুদেকণা। ধূমকেতুর কক্ষপথের বাহিরে এসব ক্ষুদেকণাদের সংখ্যা অনেক কম। তাই পৃথিবী যখন ধূমকেতুর কক্ষপথে ঢোকে এসব ক্ষুদেকণার সংখ্যাও অনেক বেশি হওয়ায় উল্কার সংখ্যাও বেড়ে যায়। উল্কারা যেন তখন বর্ষাকালের বৃষ্টির মতন চারিদিকে ঝরে পড়ে। তাই এই বিশেষ ঘটনাকে বলা হয় উল্কাবৃষ্টি। পৃথিবী প্রতিবছরই এদের কক্ষপথ দিয়ে যায়। তাই যেসব ধূমকেতুর কক্ষপথ বেশি স্থিতিশীল তাদের সাথে প্রতিবছরই পৃথিবীর দেখা হয়। সেই সাথে আমাদের দেখা মেলে উল্কাবৃষ্টির। আর এই প্রতিবছর ঘটিত উল্কাবৃষ্টিদের বলা হয় বার্ষিক উল্কাবৃষ্টি।

উল্কাবৃষ্টি

উল্কাবৃষ্টির নামকরণ
যদিও মহাজাগতিক ধূলিকণার ফলে উল্কাবৃষ্টি ঘটে থাকে তবে এদের নাম রাখা হয় অন্য উপায়ে। যে নক্ষত্র মন্ডল থেকে বৃষ্টি পড়ছে বলে মনে হয় সেই নক্ষত্র মন্ডলের ভিত্তিতে এদের নাম দেওয়া হয়। যেমন জেমিনিডস (Geminids)। জেমিনিডস ঘটে মিথুন (Gemini) নক্ষত্র মন্ডলে। এখানে উল্কাবৃষ্টির নামের শেষে “id” মানে হল “বোন” বা “এর সন্তান”। তাহলে জেমিনিডস অর্থ দাঁড়ায় – মিথুনের বোন বা মিথুনের সন্তান। তবে মাঝে
মাঝে এ নিয়ম মানা হয় না। সেদিকে আজ আর এগোব না।

Shower Radiant (বর্ষণ বিচ্ছুরক) ও ZHR (জেড.এইচ.আর.)
শাওয়ার রেডিয়েন্ট বা বর্ষণ বিচ্ছুরক হল ঠিক ওই বিন্দুটি যেখান থেকে উল্কাবৃষ্টির উল্কাগুলোর জন্ম হচ্ছে বা বিচ্ছুরিত হয়ে ঝরে পড়ছে বলে মনে হয়। এটি শুধুই তারামণ্ডল দিয়ে নির্ধারণ করা হয় না, সেই সাথে উক্ত মন্ডলের একটি নির্দিষ্ট তারাকে দিয়ে নির্ধারণ করা হয়।

বর্ষণ বিচ্ছুরক

যখন কোনো উল্কাবৃষ্টির কথা বলা হয় তখন আপনি শুনে বা পড়ে থাকবেন যে, ঘণ্টায় ১২০টি জেমিনিডস উল্কা দেখা যাবে। আর এই হিসেবটাই হল ZHR বা (Zenithal Hourly Rate)। “ZHR” প্রথমত “Zenith”- এর সাথে সম্পর্কযুক্ত, নাম দেখেই বোঝা যায়। “Zenith” মানে আকাশের সর্বোচ্চ স্থান অর্থাৎ আপনি মাটিতে সোজা হয়ে লম্বভাবে বা ৯০° হয়ে দাড়ালে ঠিক মাথার উপর আকাশের যে বিন্দুটির অবস্থান তাই হল “Zenith”। এখন, যে মন্ডলে উল্কাবৃষ্টি হবে সেই মন্ডলের Shower Radiant বা বর্ষণ বিচ্ছুরক যখন “Zenith” – এ অবস্থান করে সে সময়ে আকাশের আদর্শ অবস্থার ভিত্তিতে আপনি বা একজন মানুষ প্রতি ঘণ্টায় কটি উল্কা দেখবেন তার হার কে বলা হয় ZHR বা (Zenithal Hourly Rate)। তবে আপনি সবসময়ই ZHR এর দেওয়া মানের চেয়ে কম উল্কা দেখবেন। এর কারণ – আপনার অবস্থান ও পরিবেশ।

উল্কাদের দেখতে হলে……
প্রায় যতগুলো মহাজাগতিক ঘটনা রয়েছে তাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে রোমান্টিক হল উল্কাবৃষ্টি। এর অনেক কারণও আছে বটে। এর জন্য অতো উপকরণের প্রয়োজন হয় না। আবার রাতের আকাশ নিয়ে নূন্যতম জ্ঞান থাকলেই উল্কাবৃষ্টি উপভোগ করা যায়। নব জ্যোতির্বিদ বা আকাশপ্রেমীদের রাতের আকাশে তারকা মন্ডলের এবং সেই সাথে নানান তারার সাথে পরিচিত হবার জন্যেও উল্কাবৃষ্টি একটি খুব ভালো মাধ্যম। অনেকেরই উল্কাবৃষ্টির মাধ্যমে জ্যোতির্বিদ্যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। যদিও আমার সাথে এর সাক্ষাৎ অন্যভাবে ঘটেছিল তবে আমি পুরোপুরি জ্যোতির্বিদ্যাপ্রেমী হয়েছি উল্কাবৃষ্টির ছোঁয়ায়। ছোটবেলায় গ্রামবাংলার অনেকেই হয়তো রাতের বেলা উঠানে বসে তাদের মা-বাবা কিংবা আত্মীয়দের সাথে আড্ডা দেবার সময় মাথার উপরে আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখতো। তখনই অনেকের পরিচয় হত গ্রামবাংলার বিখ্যাত তিন তারা বা কালপুরুষের নয়তো বা সপ্তর্ষির সাথে। আবার অনেকের ঘটত তারা-খসা কিংবা উল্কার সাথে। এটি যেন প্রকৃতির আতশবাজি। কৃত্রিম আতশবাজির মত এরাও নানান রঙের হয়। এক একটি উল্কাবৃষ্টি দেখা যেন এক একটি অভিযানের মতন। একটি উল্কা দেখার পর অপরটি দেখার জন্য যে অধীর আগ্রহ বা আকাংখা, আর দেখা মেলার পর যে আনন্দ তা আপনি কখনো কৃত্রিম আতশবাজিতে পাবেন না।
জ্যোতির্বিদরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করেন কোনো উল্কাবৃষ্টির সুনিশ্চিত সময়, অবস্থান ও মানের পূর্বাভাস দেয়ার। তবে তারা কতটুকু সঠিক তা আপনি কখনোই বুঝবেন না যতক্ষণ না আপনি এটি নিজ চোখে উপভোগ করছেন। উল্কাবৃষ্টি আপনি মনের আনন্দের জন্য দেখতে পারেন, বিজ্ঞানের জন্যও দেখতে পারেন। আবার উভয়ের জন্যই দেখতে পারেন। তবে এখানে শুধু মনের আনন্দে এটি উপভোগের জন্য লিখছি। একাকী কিংবা সংঘবদ্ধ হয়েও উল্কাবৃষ্টি উপভোগ করা যায়। বিজ্ঞানের জন্য না হলে একাকী কিংবা সংঘবদ্ধ অবস্থায় উপভোগ করায় কোনো সমস্যা নেই। নানা ধরনের উল্কাবৃষ্টি রয়েছে, আবার নানান ভাবে এটি উপভোগ করা যায়। যেমন – খালি চোখে, টেলিস্কোপে, ছবি তুলে, ভিডিও করে, আবার রেডিও ভিত্তিকও রয়েছে। সকলের সুবিধার্থে এখানে শুধু খালি চোখে উল্কাবৃষ্টি দেখা নিয়ে আলোচনা করব।

খালি চোখ যেন ভরে উল্কাবৃষ্টির দানে
আসলে উল্কাবৃষ্টি দেখার জন্য সহজে একলাইলের উপদেশ হল : বাহিরে যান, আরামে বসুন আর উল্কাবৃষ্টি উপভোগ করুন। আর বাকি সব হল এদের বিশদ আলোচনা। একাকী উল্কাবৃষ্টি দেখা যেন প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া। একাকী দেখার একটি সুবিধা হল, অতো প্ল্যান করা লাগে না। মনে রাখা দরকার যে, সম্পূর্ণ আকাশকে একসাথে দেখার চেষ্টা বাদ দিতে হবে। আর, রেডিনেন্ট এর দিকে সরাসরি তাকানো উচিত নয়। এর কারণ, বিশাল আকাশে রেডিনেন্ট ক্ষুদ্র হলেও আপনার সাপেক্ষে তা একটু বড়। তাই সরাসরি তাকালে অনেক উল্কা আপনার দৃষ্টিগোচর হবে। ভাল হয় রেডিনেন্ট হতে ৬০°-৯০°’র আশে পাশে তাকানো। খালি চোখে দেখার জন্য একটি বিষয় অবশ্যই মানা জরুরি তা হল, উল্কাবৃষ্টি দেখার ৩০ থেকে ১ঘণ্টা আগে মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ ইত্যাদি প্রকারের জিনিস ব্যবহার থেকে দূরে থাকুন, আরো ভালো হয় রুমে শুধু ডিম লাইট ব্যহার করলে। এতে চোখ কিছু স্বস্তি পাবে এবং অন্ধকারের সাথে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়।

উল্কা দেখা

খালি চোখে দেখবেন ভালো কথা, তবে সেই সাথে নিচের উপকরণগুলো থাকা জরুরি :

১. হেলানো চেয়ার : আপনার পিঠের সাথে মানান সই একটি হেলানো চেয়ার উল্কাবৃষ্টি উপভোগের জন্য একটি ভালো উপকরণ। কারণ, বিভিন্ন দিকে কোণ করে তাকানো যায়। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত চেয়ার ব্যবহার করা মোটেই উচিত নয়। এতে করে আপনার ঘাড়ে অনেক চাপ পড়বে তাই বেশিক্ষণ আকাশে তাকিয়ে থাকতে পারবেন না। দাঁড়িয়ে দেখার তো কোনো মানেই হয় না। তবে শুয়ে দেখাও উচিত নয়। হেলানো চেয়ারের
সাথে বালিশও রাখা যায়৷ এতে মাথা আরামে রাখা যাবে। তবে ঘুমিয়ে গেলে চলবে না।

২. কম্বল বা চাদর: রাতের বেলা এমনি গরম কম থাকে, সাথে শীতকাল হলে তো কথাই নেই। তাই শরীর গরম রাখতে চাদর থাকা জরুরি। সেই সাথে এটি মশার কামড় থেকে কিছু ছাড় দেবে।

৩. পোকামাকড়ের জ্বালা: একটি মশাই আপনার পুরো উল্কাবৃষ্টি উপভোগের বারোটা বাজাতে পারে। তাই আপনার প্রিয় পোকা দমনের ওষুধ ব্যবহার করুন। কয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কিছু পেস্ট টাইপের বা ক্রিমের মত পোকানাশক আছে যা শরীরে লাগানো যায়। তবে ভেজলিন বা শীতকালীন লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. খাবার ও পানিয়: ইচ্ছামত এক ফ্লাক্স চা কিংবা কফি আর সেই সাথে কিছু হালকা নাস্তা (শুকনো হলে ভালো) রাখা যেতে পারে। এতে উপভোগের মাত্রা বেড়ে যায়। বিশেষ করে মধ্যরাতের পর এর আনন্দ অন্যরকম।

৫. জামাকাপড়: রাত হিসেবে একটু ভারী জামা পড়া উত্তম। শীতকাল হলে উষ্ণ কাপড় পরিধান করে যেতে হবে। না হলে প্রচুর ঠান্ডায় জমে যাবেন। এতে পরের দিন ঠান্ডা-জ্বর হয়ে দৈনন্দিন জীবনের কাজে ব্যঘাত ঘটবে।

৬. লাইট : লাইট এর জন্য একটি লাল লাইট ব্যবহার করতে হবে। লাল আলোতে অন্ধকারে চোখে তেমন প্রভাব পড়ে না। লাল লাইটের অনুপস্থিতিতে সাদা লাইটে কোনো লাল বাক্সে কিংবা সাদা লাইটের উপর লাল টেপ বা তারপাল দিয়ে মুড়িয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

৭. রেডিও বা অডিও: দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষমান থাকার মাঝে প্রিয় গানবাজনা শোনার আনন্দই আলাদা। বাসায় অডিও প্লেয়ার থাকলে সেটি নিয়ে যেতে পারেন নাহলে রেডিও, মোবাইলের আলো ঝামেলা করবে তাই মোবাইল সাথে নিতে নিরুৎসাহিত করব।

কোথা থেকে ও কীভাবে দেখবেন?
রাতের সবচেয়ে অন্ধকার জাগাটি উল্কাবৃষ্টি দেখার জন্য উত্তম। গ্রামবাংলায় উঠান থেকে দেখা যেতে পারে। তবে আশে পাশে গাছপালা না থাকলে ভালো হয়। নাহলে তা প্রতিবন্ধকতার তৈরি করে। শহর হলে সবচেয়ে অন্ধকার জাগাটি বেছে নিতে হবে। আর বিল্ডিং খুব কম বা নেই এমন জায়গা হতে দেখতে হবে। বিল্ডিং থেকে ভালোই দেখা যায় তবে, আশপাশের অন্যান্য বিল্ডিংগুলো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বিল্ডিং থেকে দেখলে সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং হতে দেখা উত্তম। আরো ভালো হয় যদি সমুদ্রসৈকত (যেমন: কক্সবাজার, পতেংগা, সেইন্ট মার্টিন) কিংবা পাহাড়ি অঞ্চল (যেমন: সাজেক) থেকে দেখা যায়। তবে শহর বা গ্রামে বাসা থেকে অনেক দূরে গেলে কাউকে সাথে নিয়ে যাওয়া উত্তম। অন্ততপক্ষে, আপনি ভুলে অসতর্ক হয়ে গেলেও উনি সতর্ক থাকতে পারেন। রাস্তা কিংবা রাস্তার আশেপাশে উপভোগের জন্য অবস্থান করা মোটেই উচিত নয়। আশপাশে খোঁজ নিয়ে দেখুন কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞান ক্লাব বা শুধু বিজ্ঞান ক্লাব আছে কিনা। এরা মাঝে মাঝে উল্কাবৃষ্টি উপভোগের জন্য ক্যাম্প করে। আর ক্যাম্প না করলেও অন্তত ভালো আঁধারের নিরাপদ স্থানের সন্ধান দিনে সক্ষম হবে। বড় বড় উল্কাবৃষ্টি দেখার জন্য অনেকেই বেরোন। তাই আশপাশে খোঁজ নিয়ে দেখলে অনেককেই পাবেন। এদের সাথে আপনার উল্কাদেখার আবেগ শেয়ার করতে পারেন, এতে করে আপনার সাথে একজন সাথীও জুটতে পারে। অন্ধাকারাচ্ছন্ন জাগায় নির্ধারনের জন্য ভালো সীমা হল +৫.০ ম্যাগনিটিউড* বা আপাত উজ্জ্বলতার তারা। যদি কোনো জায়গা থেকে +৫.০ ম্যাগনিটিউড এর তারা দেখা যায় তাহলে সেই স্থান উল্কাবৃষ্টি দেখার জন্য উত্তম ধরা হয়। এক্ষেত্রে চোখে জোর দিয়ে তারাটিকে খোঁজার দরকার নেই। নাহয় কিছু কম অনুজ্জ্বল উল্কার দেখা না মিলতে পারে। তবে আকাশের অবস্থা বা আপনার অবস্থান বেশি খারাপ হলে উল্কাবৃষ্টির কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা ভালো, নাহলে শুধুই সময়ের অপচয় হবে। উল্কাবৃষ্টির সময় আপনাকে নির্দিষ্ট মন্ডল বা রেডিয়েন্ট খুজে পেতে হবে। তাই একটি তারার মানচিত্র সাথে রাখা জরুরি। লাল লাইট দিয়ে আকাশের সাথে মানচিত্র মিলিয়ে রেডিয়েন্ট খুজে পাওয়া যায়। স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে বের করতে চাইলে অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে লাল বা রেড ফিল্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সে সময়ে মোবাইল থেকে দূরে থাকাই ভালো।

কখন দেখবেন?
যে মন্ডলে উল্কাবৃষ্টি হবে সে মন্ডল উঠলেই উল্কা দেখা যায়। তবে রাত ১২টার পর উল্কাবৃষ্টি বেশি এক্টিভ হতে থাকে। এর কারণ, তখন মিটিয়রয়েডগুলো যেদিকে পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ করছে আমরা তখন সেদিকে অবস্থান করি। তবে রাত ৩টা বা এরপর হলে বেশি ভালো হয়। যেকোনো উল্কাবৃষ্টির ক্ষেত্রে রেডিয়েন্ট যত উপরে উঠতে থাকে উল্কা দেখার সম্ভাবনাও তত বাড়তে থাকে। তবে সাধারণত ভোরের আলো হানা দেবার আগের কিছু ঘণ্টা উল্কাবৃষ্টি তুলনামূলক বেশি এক্টিভ হতে দেখা যায়। তাই আপনার হাতে যদি কম সময় থাকে তাহলে ভোরের আগের ১ ঘণ্টা উল্কা দেখতে যেতে পারেন। তবে যদি কোনো উল্কাবৃষ্টির রেডিয়েন্ট ভোরের আগে বেশি নিচে অর্থাৎ দিগন্তের বেশি নিকটে নেমে
আসে তাহলে মধ্যরাতের বেশ কিছুক্ষণ পর দেখতে যাওয়া উত্তম।

ফায়ার বল (অগ্নি গোলক), বোলাইড ও অন্যান্য…..
ফায়ার বল হল একপ্রকার উল্কা যাদের ম্যাগনিটিউড বা প্রভা -৫.০০ হয়। অর্থাৎ এরা অনেক উজ্জ্বল হয়, প্রায় শুক্র গ্রহের মত৷ অনেক সময় এরা শুক্রের উজ্জ্বলতাকেও হার মানায়। এরা আবার অনেক রেয়ার কেসে চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতাকেও হার মানায়, এমনকি সকালে সূর্যের আলোতেও এদের দেখা যায়। এত উজ্জ্বলতার ফায়ার বল অনেক রেয়ার। ফায়ার বলের ক্ষেত্রে প্রাক-উল্কা বা মিটিয়রয়েডটি অন্যান্য মিটিয়রয়েড থেকে আকারে একটু বড় হয়। অনেকে মনে করেন এরা বুঝি অনেক বড় আকারের হয়। আসলে এরা ক্রিকেট বল আকারের উল্কা। অনেক দূর থেকেও এদের দেখা যায়। ফায়ার বল সচরাচর দেখা যায় না বা কমন না, তবে এরা রেয়ারও না। অনেক বড় বড় উল্কাবৃষ্টির সময় এদের দেখা যায়। জেমিনিডস, পারসিডিস, লিওনিডস, কোয়াড্রান্টডিস ও লাইরিডস উল্কাবৃষ্টির সময় এদের দেখার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

অগ্নি গোলক

গবেষণা করে দেখা যায়, ১,২০০টি উল্কার মধ্যে ১টি ফায়ার বল দেখা যায় যার উজ্জ্বলতা হয় -৫.০০ প্রভা এবং ১২,০০০টি উল্কার মধ্যে ১টি হয় -৮.০০ প্রভার। উল্কাবৃষ্টি বাদে বেশিরভাগ ফায়ার বল হানা দেয় সন্ধ্যার সময় বা তার একটু আগে, যখন অনেকেই বাহিরে কাজে ব্যাস্ত থাকেন। তবে দক্ষিণ-গোলার্ধে এর সংখ্যা একটু কম।
বিভিন্ন সময় নানান স্পেইস ক্রাফট বা মানব প্রেরিত নানান স্যাটেলাইট বা এর টুকরো পৃথিবীতে উল্কার মত নেমে আসে। এরাও ফায়ার বলের মত উজ্জ্বল হয়। ফায়ার বল উল্কা থেকে একটু আস্তে ছোটে, মানে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। মাঝে মধ্যে ফায়ার বল উজ্জ্বল অবস্থায় ভেঙ্গে যায়। এরা ভেঙ্গে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে, এই ভাঙা অংশগুলিকে তখন বলা হয় বোলাইড। কিছু কিছু বোলাইড মাঝে মাঝে উল্কায় পরিণত হয়। বোলাইড ভেঙে একটি থেকে কয়েকটি উল্কার জন্ম দিতে পারে। ফায়ার বল ও বোলাইড দেখার ২-৩ সেকেন্ডে পর এদের শব্দ শোনা যায়।

কিছু শর্তমালা বা প্রভাবক…..
উল্কাবৃষ্টি বা উল্কা দেখা নানান বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন: রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলো কিংবা উঁচু বিল্ডিং এ রাতে থাকা বাতিগুলো ইত্যাদি। এক কথায় লাইট পলিউশনের মাত্রা। এটি বেশি হলে উল্কা দেখার মাত্রা কমে যায়। বন থেকে উল্কা দেখলে কিছু তুলনামূলক নিচের দিকের উল্কা দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই পাহাড়ি জায়গা ভালো। তবে তা বলে পাহাড়ে যাওয়া আবশ্যক নয়। তবে সম্ভব হলে যাওয়া ভালো। চাঁদ থাকা অবস্থায় দেখতে বের না হওয়া ভালো। বিশেষ করে যখন চাঁদের অর্ধেক বা তার বেশি আলোকিত থাকে তখন দেখা উচিত নয়। এতে মোট যতটি উল্কা দেখা যেত তার ৯০% উল্কা দেখা যায় না। এক্ষেত্রে যদি উল্কাবৃষ্টি দেখেন তাহলে দ্বিতীয় কম একটিভ দিন বা একেবারে শেষের দিনে সেই উল্কাবৃষ্টি দেখা ভালো। এতে চাঁদের আলো অনেকটাই কমে আসে। অনেকসময় ধোঁয়া কিংবা কুয়াশাও আপনার ভাগ্যের অনেক উল্কা কেড়ে নেয়। আর আকাশ মেঘলা হলে তো কথাই নেই। সেদিনের উল্কা দেখা পুরোপুরি মাটি।


পাদটীকা:
* ম্যাগনিটিউড বা আপাত উজ্জ্বলতা বা প্রভা: নক্ষত্রের আকার ছোট বড় হবার কারণ হল তার আপাত উজ্জ্বলতা বা প্রভা, তাই প্রভার মানদন্ডর পরিসর আরো বাড়ানো হয়, মানে স্কেল ঋণাত্মক মানের দিক যেতে শুরু করে । কোন বস্তুর আপাত প্রভার মান যত কম তার উজ্জ্বলতা তত বেশী।


তথ্যসুত্র:
1. Falling Stars – Mike D. Reynolds 
2. Meteors & How to Observe them – R. Lunsford 
3.  David Levey’s Guide to Observing Meteor Showers – D. Levey 


লেখকের কথা: হৃদয় হক
নাম: মো. সাজেদুল হক। ছদ্মনাম: “হৃদয় হক”। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখালিখি পছন্দের। লিখি, বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।