লেখক: রানা চক্রবর্তী
দশমী কথাটির প্রাসঙ্গিক তাৎপর্য সহজবোধ্য। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী কৈলাস পাড়ি দেন। সেই কারণেই ‘বিজয়া দশমী’ নাম।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দিনটিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয় কেন? কোন ‘বিজয়’-কেই বা চিহ্নিত করে দিনটি?
দশমীকে ‘বিজয়া’ বলা হয় কেন, তার পৌরাণিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে একাধিক কাহিনী সামনে আসে। পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনিতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিন ও নয় রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূতা হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে।
তবে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই দিনে যে দশেরা উদযাপিত হয়, তার তাৎপর্য অন্য। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘দশহর’ থেকে, যা দশানন রাবণের মৃত্যুকে সূচিত করে। বাল্মীকি রামায়ণে কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই রাবণ-বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ, তুলসীদাসের রামচরিতমানস, কিংবা কেশবদাসের রামচন্দ্রিকা-য় এই সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ-বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ। রাবণ-বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষেই যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে।
আবার মহাভারতে কথিত হয়েছে, দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীতেই পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ-মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এই উল্লেখও বিজয়া দশমীর তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।
দুর্গা পূজার শেষ দিন হিসেবে বিজয়া দশমী পূর্ব ভারতে শোকাবহ হলেও শাস্ত্রে বিষয়টিকে সেইভাবে দেখা হচ্ছে না। প্রসঙ্গত রামকৃষ্ণদেবের একটি কাহিনি স্মরণীয়। রানী রাসমনির জামাতা মথুরবাবু একদা আবেগ-বশীভূত হয়ে বিজয়ার দিনেও দেবীকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসেন। তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁকে বোঝান যে, বিজয়ার অর্থ দেবী-মা এবং সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। মা কখনই সন্তান ছেড়ে থাকতে পারেন না।
ঠাকুর বলেন, ‘একদিন বাইরের দালানে বসে মা পূজা নিয়েছেন, আজ থেকে মা হৃদয়মন্দিরে বসে পূজা নেবেন।’ এই ব্যাখ্যায় মথুরবাবুর মনের আঁধার দূরীভূত হয়।
‘প্রাধানিক রহস্য’ গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হয়েছে ‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব…।’ অর্থাৎ যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার। দেবী সাকার রূপে মর্ত্যে পূজা গ্রহণ করেছেন, তারপর নিরাকার রূপে ফিরে গিয়েছেন কৈলাসে। তার অর্থ সন্তানের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ নয়। মা-সন্তানের চিরমিলনের এই শাস্ত্রীয় তত্ত্বই প্রাঞ্জলভাবে মথুরবাবুকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
এই বিজয়া দশমীতে দেবী সপরিবারে ফিরে যাবেন কৈলাসে। মাকে প্রদক্ষিণ করা সন্তানের স্বাভাবিক রীতি। মা আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। এই আমাদের আকাঙ্ক্ষা। প্রদক্ষিণ করে ভক্তরা স্তব করতে থাকেঃ‘দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, তুমি শিবা অর্থাৎ মঙ্গলকারিণী।
তুমি বিশ্বের ঈশ্বরী, সর্বদেবময়ী। তুমি সকল ভয় ও রোগ হরণকারিণী।তুমি ঔষধিরূপে সকল রোগ নাশ করে থাক।তুমি যোগমায়া, তুমি দুঃখময় সংসার সমুদ্র পার করে দাও। আয়ু, আরোগ্য, বিজয় দাও। তোমাকে নমস্কার। ভূত, প্রেত, পিশাচ, রাক্ষস, দেবতা, মানুষ, সকলের ভয় থেকে সর্বদা আমাদের রক্ষা কর।
তোমার নাম ভগবতী, তুমি ভয় দূর কর।তোমার নাম কাত্যায়নী, তুমি বাসনা পূরণ কর।তুমি পুত্রকামীকে পুত্র দান করে থাক।উগ্র তোমার রূপ, তুমি সর্বত্র জয় দান কর।তুমি বিজয়া।
‘দুর্গোত্তারিণী দুর্গে ত্বং সর্বাশুভবিনাশিনী। ধর্মার্থকামমোক্ষায় নিত্যং মে বরদা ভব।…তুমি সকল অশুভবিনাশকারিণী, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের বরদানকারিণী।
মহিষাসুর আজ তোমার হাতে নিহত।তুমি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হও। আমাদের পাপ হরণ কর, ক্লেশ হরণ কর, অশুভ হরণ কর, রোগ হরণ কর, ক্ষোভ দূর কর।তুমি যাঁর মাথায় তোমার কল্যাণহাত রাখ, সে প্রভুত্ব লাভ করে।
শক্তিহীন, গুণহীন, সত্যাচারবর্জিত মানুষ তোমার কৃপায় পৌরুষ লাভ করে।ক্ষুধা, পিপাসা, আর্তি তুমি নাশ কর।
তোমাকে পূজা করে আমরা ধন্য।আমরা কর্তব্য শেষ করেছি, সফল আমাদের জীবন।হে দুর্গে, মহেশ্বরী, তুমি এসেছ,অর্ঘ্য, পুষ্প, নৈবেদ্য, মালা গ্রহণ করে আমাদের কল্যাণ করো। আয়ু, যশ, ভাগ্য, ভক্তি, জ্ঞান, সকল আমাদের হোক।
তোমার কৃপায় আমাদের বার্ষিক পূজা সাঙ্গ হোক। মন্ত্রহীন, ক্রিয়াহীন, ভক্তিহীন আমরা, তোমার কৃপায় সব পূর্ণ হোক।তোমার আবাহন জানি না, বিসর্জন জানি না, পূজার ভাবও জানি না, তুমিই আমাদের গতি।
‘হে জননী, পুত্র-আয়ু-ধন বৃদ্ধির জন্য তোমার পূজা হল।
আজ দশমীতে পূজাশেষে যেখানে নিরাকার পরমব্রহ্ম আছেন সেখানে তুমি যাও। আমাদের সুখ দান করার জন্য আবার এস, শত্রুর দর্প বিনাশ করার জন্য পুনরায় আগমন কর।
আমাদের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে তুমি নিজের স্থানে যাও। এক বছর গেলে তুমি আবার এস।
জয়ন্তী বৃক্ষে তোমার পূজা হল, তুমি সর্বত্র আমাদের জয়ী কর। তুমি সংসার-বন্ধনমুক্তির জন্য কৃপা কর।
অশোক বৃক্ষে তুমি ছিলে। তুমি আমাদের শোকরহিত কর। মানবৃক্ষে তোমার পূজা হল, তুমি আমাদের সর্বত্র মান ও সুখ দাও।ধানরূপে তোমার পূজা হল, তুমি লোকের প্রাণ ধারণ কর, আমাদের প্রাণে শান্তি দিয়ে প্রাণ ধারণ করাও। হে পরমেশ্বরী, আমরা তোমার দাস।জ্ঞানভক্তি বৃদ্ধির জন্য তোমাকে জলে স্থাপন করা হলো।’
দশমীতে এই কারনেই জলে বিসর্জন।
প্রতিমা থেকে ঘটে, এবং ঘট থেকে ভক্তের হৃদয়ে। ভক্তের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি তাদের অসুরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন।
মাকে হৃদয়ে অনুভব করে আনন্দে ভক্তরা পরস্পর কোলাকুলি করে। পরস্পর আপন বোধ করে। এত দিন অন্তরে হিংসা, গর্ব, নিন্দা, ক্রোধ নামক অসুর থাকায় সকলকে আপন বোধ করতে পারেনি। এবার সেসব অসুর ধ্বংস হল মায়ের কৃপায়। সমস্ত ভেদ উঠে গেল। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেন, ‘ভক্তিতে সব জাতিভেদ উঠে যায়। ভক্তের কোনও জাত নেই।’ তাই সকলেই আমরা আপন। বিজয় হল আসুরিক শক্তির ওপর দৈব শক্তির। মা দুর্গার নামও তাই বিজয়া।
বিসর্জন ও বিজয়ার তাৎপর্য বুঝে ভক্তের মনের শোক কেটে যায়। মায়ের পূজার বিসর্জনমন্ত্রেও বলা হয়,
‘ওঁ গচ্ছ দেবি পরং স্থানং যত্র দেব নিরঞ্জনঃ। অস্মাকং তু সুখং দত্তা পুনরেস্যসি সর্বদা।’
তুমি নিরাকার স্বরূপে ফিরে যাও। সব সময় তুমি অবশ্য আসবে আমাদের আনন্দ দিতে। কাম, ক্রোধ, লোভ নামক শত্রুর দ্বারা সব সময়ই মানুষ আক্রান্ত।
মায়ের নিজ স্থান ভক্তের হৃদয় মন্দিরে। ভক্ত নিজ হৃদয়েই মাকে ফিরে যেতে অনুরোধ জানায়।
‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ পরে স্থানে স্বস্থানে পরমেশ্বরী। যত্র ব্রহ্মাদয় সর্বে সুরাস্তিষ্ঠন্তি মে হূদি ’
অর্থাৎ, হে মা, তুমি আমার হৃদয়েই থাক, যেখানে ব্রহ্মা এবং সব দেবতা বিরাজ করেন।
বিজয়ায় বিসর্জন মাকে ত্যাগ নয়, বিশেষরূপে অর্জন। এই কদিনের পূজাশেষে যে জ্ঞান অর্জিত হল, তা হচ্ছে, মা স্বস্থানে কৈলাসে ফিরে গেলেন। এ অবস্থায় মা নিরাকারা। চর্মচক্ষের বাইরে চলে গেলেন। ‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব…।’ (প্রাধানিক রহস্য-২৯, চণ্ডী)
আবার মা সন্তান তথা আমাদের কল্যাণে আবারও আসবেন বছরান্তে রূপাধারে। এভাবে মা ভক্তের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অবস্থান করবেন। এ প্রতিষ্ঠাই আমাদের জ্ঞানার্জন। বিসর্জন অর্থে আত্মপ্রতিষ্ঠ। বিজয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জ্ঞান অর্জন দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে। এ শুভদিনে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পণ্ডিত-মূর্খ, উঁচু-নিচু বিচার না করেই সকলে একাত্মবোধে আবদ্ধ। সকল ক্ষুদ্রতা ও পাশবিক বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে আজ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সহাবস্থানের ভাবনা জাগ্রত হয়ে মানবকল্যাণে সকলে ব্রতী। দুর্গাপূজার বিজয়ার তাত্পর্য এটাই।
বিজয়ার শুভ এই দিনে দুঃখ নয়, বেদনা নয়, সকলে আনন্দে মুখরিত এবং সকলের মধ্যে প্রেমের বন্ধনে আকৃষ্ট। এই দিনে পাড়া-পড়শি সকলকে নিয়ে প্রেমালিঙ্গন একটি বিশেষ দিগ্দর্শন। তাই ভক্ত আকুতিতে প্রার্থনা জানায়—
‘ওঁ দেবি ত্বং জগতাং মাতঃ স্বস্থানং গচ্ছ পূজিতে।
সংবত্সর ব্যতিতে তু পুনরাগমনায় চঃ”
হে দেবী, জগজ্জননী, পূজিতা হয়ে তুমি নিজ স্থানে গমন কর এবং এক বছর পরে আবার তুমি অবশ্য আসবে।
লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।
ভালো লাগলো পড়ে..