তাজ মহলের গোপন কথা

লেখক : অভি সেখ

এখন আমরা সে ভাবে তাজ মহলকে দেখতে পাই না যে ভাবে শাহজাহান চেয়েছিলেন, বর্তমানে আমরা তাজ মাহলে যেদিক থেকে প্রবেশ করি সেটা আসলে তাজ মহলের পিছনের দিক। মোগল আমলে তাজমহল পর্যন্ত যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল নদী, বাদশা এবং তাঁর রাজ রাজ কর্মচারীরা নৌকা করে তাজমহল পর্যন্ত যেতেন, নদীর তীরে একটা ঘাট ছিল যেখান থেকে রাজা তাজমহল পর্যন্ত যেতেন। নদীর জল বাড়তে থাকায় অনেক আগেই সেই ঘাট ধ্বংস হয়ে গেছে। ছোট থেকেই আমাদের বলা হয়েছে তাজমহল তৈরির পর শ্রমিকদের হাত কেটে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সে কথা শুধু মাত্র একটা মিথ, ইতিহাসে এই কথার কোনো প্রমান পাওয়া যায় না, বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন তাজমহলের শ্রমিকদের শাহজাহান সারা জীবনের পারিশ্রমিক দিয়ে একটা এগ্রিমেন্ট সাইন করিয়েছিলেন যাতে লেখা ছিল যে এরকম কোনো স্থপত্য তাঁরা কোনোদিন তৈরি করবে না। তাজ মহলের চার কোনে যে চারটি উঁচু স্তম্ভ আছে সেগুলি বাইরের দিকে হালকা ঝুঁকে থাকে, এমন ভাবে তাদের ডিজাইন তৈরি করা হয়েছিল যাতে ভূমিকম্প হলে মূল সমাধি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কুতুব মিনার ভারতের সবচেয়ে উঁচু মিনার কিন্তু জেনে অবাক হবেন, তাজ মাহলের উচ্চতা কুতুব মিনারের চেয়েও বেশি, তাজমহলের উচ্চতা 73 মিটার, আর কুতুবমিনারের উচ্চতা হল 72.5 মিটার। পৃথিবীতে যত স্থাপত্য আছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ক্যালিগ্রাফি করা আছে তাজমহলে, আপনি যখনি তাজ মহলে প্রবেশ করবেন দরজায় লেখা এই শব্দ গুলো আপনাকে মুগ্ধ করবে, “হে আত্মা তুমি ঈশ্বরের কাছে বিশ্রাম কর, ঈশ্বরের কাছে শান্তিতে থাকো, আর ঈশ্বরের পরম শান্তি নেমে আসুক তোমার উপর,” এই কিলিগ্রাফিটি থুলুট লিপিতে লেখা আর এটি করেছিলেন আব্দুল হক, যিনি এসেছিলেন ইরান থেকে, তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে শাহজাহান তাঁকে আমানত খান উপাধি দিয়েছিলেন। শাহজাহান এর সময় কাল ছিল মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্নযুগ, চারিদিকে খুশি আর শান্তির পরিবেশ ছিল, সেই সময় কোনো যুদ্ধ বা বিদ্রোহ হত না আর প্রজারা থাকত শান্তিতে, শাহজাহান নিজের সময়কালে অসংখ্য নির্মাণ কাজ করিয়েছিলেন, আর সেই সময় প্রথম মোগল বাস্তুকলার সাথে ভারতীয় বাস্তুকলাকে মিলিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। তাজমহল তৈরির জন্য যে সাদা মার্বেল পাথর ব্যবহার হয়েছিল সেগুলো আনা হয়েছিল রাজস্থানের মকরানা থেকে, Jade আর Crystal আনা হয়েছিল চিন থেকে, lapislazuli এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে Turquoise আনা হয়েছিল তিব্বত থেকে এভাবেই Jasper পাঞ্জাব থেকে, Sapphire শ্রীলংকা থেকে আর আরব থেকে আনা হয়েছিল Carnelian, সবমিলিয়ে এরকম আঠাশ রকম বহু মূল্যবান পাথর সাদা মার্বেলে বসিয়ে তাজমহলকে সাজানো হয়েছিল, এই সমস্ত পাথর আর অন্যান্য সামগ্রী বিদেশ থেকে আনতে এক হাজারেরও বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল।

তাজ মহল নির্মাণ শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় 400 বছর আগে, আর সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হতে সময় লেগেছিলো 22 বছরেরও বেশি 1631 সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল আর শেষ হয়েছিল 1653 সালে, কুড়ি হাজার কারিগর আর মজদুর কাজ করেছিল সেই সময়। তাজমহলের দেওয়ালে যে সুন্দর কারুকার্য করা আছে সেগুলি করেছিলেন ইতালির কারিগরেরা। Ujbekisthan এর Bukhara থেকে এসেছিলেন মার্বেল এর কারিগরেরা, ইরান থেকে আনা হয়েছিল ক্যালীগ্রাফি আর্টিস্ট দের, আর পাথর খোদাই করে কারুকার্য করার জন্য শিল্পীদের আনা হয়েছিল বালুচিস্তান থেকে, 1857 সালে সংঘর্ষের সময় ইংরেজরা তাজ মহলের বেশ ক্ষতি করেছিল, তাজমহলের উপর থেকে তাঁরা lapizlazly র মত দামি দামি পাথর খোদাই করে বের করে নিয়েছিল। তাজমহলের মুখ্য গোম্বুজ এর উপরের যে ধাতুর দন্ডটি লাগানো আছে এক সময় সেটা সোনার ছিল, উনিশ শতকের শুরুর দিকে সেটা পাল্টে তামার দন্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়।

এটা এখনো জানা যায়নি তাজমহলের নকশা কে বা কারা তৈরি করেছিলেন তবে এটা জানা গেছে 37 জনের একটা দল একসাথে এই কাজটি করে ছিলেন আর তাঁদের আনা হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তাজমহলের ভিত তৈরি করার সময় বিরাট বিরাট কুঁয়ো খোঁড়া হয়েছিল যাতে ইট, পাথর সহ মেহগিনী আর আবলুস গাছের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছিল ভিতকে মজবুত করার জন্য, মেহগিনী আর অবলুস কাঠের বিশেষত্ব হল এরা যত জল পায় তত মজবুত হয় আর সেই জল আসে যমুনা নদী থেকে। যামুনার জলের স্তর প্রত্যেক বছর কমে আসছে আর এই জন্যই হয়ত 2010 এ প্রথম তাজমহলের গায়ে ফাটল দেখা গিয়েছিল। 1653 তে তাজ মহল তৈরি করতে কোটি কোটি টাকা খরচা হয়েছিল, আজকের দিনে যদি তাজমহল নির্মাণ করা হয় তবে তার খরচ হবে 57আরব 60 কোটি টাকা।

1989 সালে PN OCK নামক একজন ভারতীয় লেখক একটা বই লিখেছিলেন যার নাম ছিল TAJMAHAL THE TRUE STORY সেখানে দাবি করা হয় তাজমহল তৈরির আগে ওই জায়গায় শিব মন্দির ছিল, আর তার নাম ছিল তেজো মহল, এই কথা প্রমান করার জন্য সেই ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিল তাজ মহলের পাশে খনন কার্য করার জন্য, সুপ্রিম কোর্ট সেই এপিল খারিজ করে দেয়।
Archeological Survey Of India র মতে এর কোনো প্রমান নেই যে ওখানে শিব মন্দির ছিল তবে এর প্রামান অবশ্যই আছে যে শাহজাহান তাজ মহল বানিয়েছিল। একটা লোককথা অনুযায়ী যামুনার বিপরীত দিকে শাহজাহান একটা কালো তাজ মহল বানাতে চেয়েছিলেন, তবে ঐতিহাসিকদের মতে এটা একটা মনগড়া গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত সরকার তাজ মহলের গাম্বুজকে চারিদিকে বাঁশ দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলো যাতে জার্মান আর জাপানি এয়ারফোর্স এর আক্রমনে তাজ মহল ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। 1965 আর 1972 এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও এমনটা করা হয়েছিল।
তাজ মহলের জনপ্রিয়তা শুধু মাত্র তার সৌন্দর্যের জন্য নয় এর জনপ্রিয়তার আর একটা কারন হল এটা তৈরির পিছনের অদ্ভুত প্রেম কাহিনী। শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি তে তাজ মহল তৈরি করিয়ে ছিলেন। তাঁর আসলে নাম ছিল Arjumand Bano Begam শাহজাহান তাঁর নাম রেখেছিলেন মুমতাজ মেহেল, যার অর্থ – মহলের সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন। শাহাজান এর 14 তম সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজ মাত্র 38 বছর বয়েসে মারা যান, সেই সময় শাহজাহান একদম ভেঙে পড়েছিলেন, তার পরেই তাজমহল বানানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মমতাজের মৃত্যু হয়েছিল বুরহান পুরে, প্রথমে তাঁকে ওখানেই মাটি দেওয়া হয়, তাজমহলের কাজ শুরু হলে তাঁকে সেখান থেকে তুলে এনে তাজমহলের পাশের একটা বাগানে মাটি দেওয়া হয়, তারপর যখন 22 বছর পর তাজমল এর কাজ শেষ হল তখন ফাইনালি তাঁকে মূল গম্বুজের নিচে সমাধিস্ত করা হয়, তার কিছু সময় পরেই শাহজাহান এর ছেলে আওরঙ্গজেব আগ্রাতে আক্রমন করে শাহজাহানকে বন্দি করে নেয় আর যখন শাহজাহান এর কাছে তাঁর ইচ্ছে জানতে চাওয়া হয়, তখন শাহজাহান বলেছিলেন তিনি এমন জায়গায় থাকতে চান যেখান থেকে তাজমহলকে তিনি দেখতে পাবেন। আওরঙ্গজেব সাহজাহানকে আগ্রফোর্টে বন্দি করে রেখেছিলেন, বন্দি অবস্থায় শাহজাহান ছোট্ট একটা জানালা দিয়ে সারা দিন তাজ মহলকে দেখতেন এবং ওখানেই তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাজমহলের ব্যাপারে বলেছিলেন “কালের কপোল তলে এক বিন্দু জল শুভ্র সমুজ্বল এ তাজমহল”, আজ সেই বাদশা আর নেই, তাঁর রাজাত্ব নেই আর তাঁর সাম্রাজ্যও ধ্বংস হয়েগেছে কয়েক যুগ আগে, তবে তাজমহল এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই বাদশার তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভালোবাসার উপহার হিসাবে।


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
আমি অভি, গানবাজনা এবং ছবি আঁকা নিয়েই বেঁচে থাকা, এছাড়া আমার ইউটিউব চ্যানেল আছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন