লেখক: মিজানুর রহমান সেখ
ফুড সেফটি এন্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (FSSAI)-এর ২০১৮ সালে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাজারে প্রাপ্ত খাদ্যসামগ্রীর প্রায় ২৫% ভেজাল বা যথাযথ গুণমান সম্পন্ন নয়। আমাদের দেশের পি.এফ.এ (Prevention of Food Adulteration) বিধি অনুযায়ী — যদি কোনো খাদ্যদ্রব্যে উপকারী উপাদান অপসারণ, ক্ষতিকর পদার্থ যোগ, নিম্ন মানের বা সস্তার জিনিস আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে মূল বস্তুর স্থান দখল, অননুমোদিত ও অপরিমিত রং ব্যবহার, বেশিমাত্রায় বা নিষিদ্ধ সংরক্ষণকারী পদার্থ ব্যবহার কিংবা রোগাক্রান্ত প্রাণী থেকে খাদ্য সংগ্রহ করা হয় — সেই খাদ্যকে ভেজাল খাদ্য বলে।
এক কথায় খাদ্যদ্রব্যের প্রকৃতি ও গুণগত মান সঠিক না হলেই তা ভেজাল খাদ্যের পর্যায়ে পড়ে। ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে ভেজাল প্রতিরোধী আইন পাশ করান। ১৯৫৫ সালের ১লা জুন থেকে এই আইন কার্যকর হয় । আইন অনুযায়ী প্রত্যেক খাদ্য বা পানীয়ের প্যাকেটে লেবেলের উপর উপাদান সঠিকভাবে লেখা থাকতে হবে।
খাদ্যে ভেজাল দু’ভাবে আসে — ইচ্ছাকৃতভাবে এবং অনিচ্ছাকৃত রূপে। অজ্ঞতা, অবহেলা ও উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে খাদ্যে অনিচ্ছাকৃত ভেজাল মেশে। আবার বাজারে খাদ্যের ঘাটতি ও প্রয়োজনের তুলনায় কম সরবরাহের ফলে এক শ্রেণীর মানুষ অসৎ উপায়ে বেশি মুনাফা লাভের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্যে ভেজাল দেবার মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়।
কয়েকটি ভেজাল খাদ্য:
ডাল ও দানাশস্যে ভেজাল-
চালের মধ্যে ভেজাল হিসাবে কাঁকর, মাটি, ময়লা, ইঁদুরের মল মেশানো হয়। দামি ডালে খেসারির ডাল, বেসনে খেসারির ডালের পাউডার, ভাজা ছোলায় কোলটার ডাই, সুজিতে লোহার গুঁড়ো মেশানো হয়। আটা ও ময়দায় চকের গুঁড়ো, সাজিমাটি ইত্যাদি ভেজাল মেশানো হয়।
তেল,ঘি ও মাখনে ভেজাল-
খাঁটি ঘিতে ভেজাল হিসাবে বনস্পতি, মাখনে আলু সিদ্ধ, পাকা কলা ইত্যাদি মেশানো হয়। বিভিন্ন তেলে নানারকম জিনিস ভেজাল হিসাবে দেওয়া হয়। সর্ষের তেলে শিয়ালকাঁটা বা আর্জিমন অয়েল, অর্থোট্রাইক্রিসাইল ফসফেট (Ortho-TCP), পাম অয়েল, খনিজ তেল, প্রাণীজ চর্বি ইত্যাদি ভেজাল থাকতে পারে। বনস্পতিতে ভেজাল হিসাবে সস্তা ভোজ্য তেল মেশানো হয়।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যে ভেজাল-
দুধে জল, শ্যাম্পু, মিল্ক পাউডার, বিভিন্ন কেমিক্যাল, চুন, স্টার্চ ইত্যাদি ভেজাল হিসাবে মেশানো হয়। সন্দেশ রসগোল্লা ইত্যাদি মিষ্টান্নতে ভেজাল হিসাবে ময়দা, সুজি, রং করতে মেটানিল ইয়েলো বা গ্রিন মেশানো হয়।
পানীয়তে ভেজাল-
চা কিংবা কফির মধ্যে কাঠের গুঁড়ো, ব্যবহৃত চা (extracted tea), খেজুর বা তেঁতুলের বিচির গুঁড়ো ইত্যাদি ভেজাল মেশানো হয়।
মশলায় ভেজাল-
আজকাল মশলায় ভেজাল সব থেকে বেশি থাকছে। হলুদে লেড ক্রোমেড, মেটানিল ইয়েলো, কোলটার মেশানো হয়। গুঁড়ো মশলায় কৃত্রিম নিষিদ্ধ রং, সুগন্ধি বার করে নেওয়া মশলা, ধনের গুঁড়োতে ঘোড়ার মল, কাঠের গুঁড়ো ইত্যাদি ভেজাল মেশানো হয়। সর্ষেতে আর্জিমন বীজ, গোলমরিচে পেঁপের বিচি মেশানো হয়।
এই ভেজাল নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে এবং যতদিন যাচ্ছে নতুন নতুন ভেজাল খাদ্য সামনে আসছে।
স্বাস্থ্যের উপর ভেজাল খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব:
ভেজাল খাদ্য সুস্বাস্থ্যের প্রধান অন্তরায়। শেয়ালকাঁটা বীজের তেল ১-৩ মাস খেলে ড্রপসি বা হাত পা ফোলা বা শ্লথ রোগ, পরিপাক যন্ত্রের গোলযোগ, যকৃতের বৃদ্ধি, হার্টের সমস্যা আসতে পারে। অর্থোট্রাইক্রিসাইল ফসফেট তেলের মতোই দেখতে যা খেলে হাত-পা অসাড় করতে থাকে, এক পর্যায়ে গিয়ে পঙ্গু করে দেয়। ভেজাল তেল শরীরে ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-ডি শোষণে বাধা দেয়। শাক সবজির রং ঠিক রাখার জন্য দেওয়া কপার সালফেট ক্যানসারের সম্ভবনা বাড়িয়ে তোলে। ভেজাল দুধ খেয়ে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে ও নানান রোগের শিকার হচ্ছে। হলুদে থাকা মেটানিল ইয়েলো কারসিনোজেনিক ও পেটের গোলযোগ ঘটায়। কফিতে ভেজাল খাদ্য হিসাবে মেশানো তেঁতুলদানার গুঁড়ো ও চিকোরীর গাছের শিকড়ের গুঁড়ো উদরাময়, পেট ব্যাথা, মাথা ঘোরা ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথার কারণ। এক কথায় ভেজাল খাদ্য পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি করে, লিভারের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। শরীরে বিভিন্ন রাসায়নিক ও বিষাক্ত রঙের কুপ্রভাব মারাত্মক।
ভেজাল খাদ্য চেনার উপায়:
সব ভেজাল খাদ্য চেনা সহজ নয়। তবে একটু সতর্ক হলেই কিছু কিছু ভেজাল খাদ্য চেনা যায়।
১) গোলমরিজে মেশানো পেঁপের বীজ ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে।পেঁপের বীজ বেশি কুঞ্চিত ও বাদামি বর্ণের হয়।
২) দুধের এক ফোঁটা নিয়ে উল্লম্ব মসৃন তলে ফেললে যদি সাদা দাগসহ নামে তাহলে খাঁটি, অন্যথায় জল মেশানো।
৩) লবণ বা চিনিতে চকের বা পাথরের গুঁড়ো আছে কিনা জানার জন্য জলে দ্রবীভূত করলে পাথরের ও চকের গুঁড়ো নীচে থিতিয়ে পড়বে। পরিষ্কার দ্রবণ পাওয়া গেলে বুঝতে হবে চিনি বা লবন খাঁটি।
৪) সবজি বর্ণহীন পরিষ্কার জলে ডুবিয়ে দিলে যদি কিছুক্ষন পরে জলের রং তুঁতের রঙের মতো হতে থাকে বুঝতে হবে ওই সবজিতে কপার সালফেট মেশানো আছে।
৫) চা-এর গুঁড়ো ভিজে সাদা ফিল্টার কাগজে ছড়িয়ে দিলে যদি দ্রুত ফিল্টার কাগজে রং চলে আসে তাহলে বুঝতে হবে ওই চা গুঁড়োতে বাইরে থেকে রাসায়নিক রং মেশানো আছে।
৬) হলুদ গুঁড়ো এক চামচ কাঁচের গ্লাসে জল নিয়ে তার উপরে দিয়ে দিতে হবে। এবার এই জল না নাড়িয়ে ২০ মিনিট পরে যদি দেখা যায় হলুদ গুঁড়ো নীচে নেমেছে ও জল প্রায় পরিষ্কার আছে, তাহলে হলুদ খাঁটি। আর দলা পাকানো থাকলে বুঝতে হবে হলুদ গুঁড়োতে ভেজাল আছে।
৭) ঘি গরম করে গলিয়ে কাঁচের পাত্রে ঢেলে ফ্রিজে রাখতে হবে । কিছুক্ষন পর বের করে আলাদা দুই বা বেশি স্তর দেখতে পেলে বুঝবেন ঘি বিশুদ্ধ নয়।
8) নারকেল তেল কাঁচের পাত্রে নিয়ে ৩০ মিনিট ফ্রিজে রেখে তারপর বের করে যদি পুরোটা জমে শক্ত হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে কোনো ভেজাল নেই।
৯) এক চামচ মধু নিয়ে কাঁচের গ্লাসে হালকা গরম জলে নাড়ালে যদি তাড়াতাড়ি একেবারেই গুলে যায় বুঝবেন ওটা ভেজাল মধু, চিনি বা গ্লুকোজ সিরাপ মেশানো আছে।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে খুব বেশি খাদ্যে ভেজাল পরীক্ষা সম্ভব নয়।রাসায়নিক দিয়ে পরীক্ষাগারেই তা করা সম্ভব । ভারত সরকার খাদ্যদ্রব্যের মান বজায় রাখার জন্য আগমার্ক(Agmark) ও আই এস আই(Indian Standard Institution) সার্টিফিকেশন মার্কস স্কিম প্রবর্তন করেছেন।
ভেজাল খাদ্যের কুপ্রভাব থেকে নিজের পরিবার ও আশেপাশের মানুষদের সতর্ক করতে এগিয়ে আসুন।
তথ্য সূত্র::
1)https://www.newindianexpress.com/nation/2018/nov/05/25-food-samples-found-adulterated-1894393.html
2)Srilakshmi.B,Food Science,Chapter 14,page 313
3)ড.সুনীতি ঘোষ চট্টোপাধ্যায় ও ড. নারায়ণী বসু,উচচমাধ্যমিক খাদ্য ও পুষ্টি,চতুর্থ পরিচ্ছেদ,প-৫১৯
4)https://www.balancenutrition.in/blog/health-reads/health-diet/how-does-food-adulteration-impact-our-health 5)https://www.thebetterindia.com/114412/simple-home-tests-food-adulteration-kitchen-ingredients/
লেখকের কথা: মিজানুর রহমান সেখ
মিজানুর পেশায় শিক্ষক এবং একজন সমাজসেবক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যই মূলত লেখালিখি। লেখক পদার্থবিদ্যা ও শিক্ষাবিজ্ঞানে মাস্টার্স।