লেখক: দামিনী সেন
গত পর্বের লিঙ্ক এখানে
পরিচ্ছদ ২
বাগানের গেটে একটা শব্দ পেয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায় অপর্ণা। “উফফ! আবার সেই গেছো বাঁদরটা।” সুচির মুখের এই ঠাট্টার নামটাই এখন এ বাড়িতে অনির পরিচয়। সুচির মুখে মাঝে মাঝে প্রকাশ্যেই। বাকিদের মুখে অবশ্য আবডালে। তবে মানেটা অবশ্য সকলের ক্ষেত্রে এক নয়। সুচির কাছে তা একটা সহজ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্বোধন, অনি যে তাতে একফোঁটাও রাগ করবে না এই আস্থা নিয়েই সে প্রকাশ্যেই তাকে মাঝেমাঝেই ঐ বলেই ডাকে। বাবা সুজয় অবশ্য অনি যখন আসে তখন প্রায় কোনও সময়ই বাড়িতে থাকেন না। তবু তিনিও মেয়ের কাছে ওকে ঐ নামেই ডাকেন। ডাকটার মধ্যে যে লুকিয়ে আছে একটা স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়, সেটা সুচিও বোঝে। কিন্তু অপর্ণা যখন ঐ একই নাম ব্যবহার করেন, বুঝতে হবে একরাশ বিরক্তি উগড়ে দিচ্ছেন তিনি।
আজও ওই ঝড়টাকে তাঁর মনের মতো করে সাজানো বাগানে প্রবেশ করতে দেখেই মেজাজটা একটু বিগড়েই গেল তাঁর। সপ্তাহের এই একটা ছুটির দিন। মেয়েকে নিয়ে একটু পার্লারে যাবেন ঠিক করে রেখেছেন সেই কবে থেকে। দিনের পর দিন ঐ কলেজ আর কি ছাতার মাথা রিহার্সালের ধাক্কায় তাঁর মেয়ের অমন সোনাগলা রংটা কেমন যেন মাজা মাজা হয়ে গেছে। একটু পালিশ করার প্রয়োজন। নিয়মিত ঠিকঠাক পালিশ না করা হলে সবকিছুই তো ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যেতে বাধ্য। মেয়েও তো তাঁর এমনিতে খুব বাধ্যই ছিল। এই ভূতটা জোটার পর থেকেই কেমন যেন বিগড়োতে শুরু করেছে। এসব অপর্ণার এক্কেবারে পছন্দ নয়।
বলতে না বলতেই ভেজানো বাইরের দরজাটা ঠেলে ঝড়টার প্রবেশ। একরাশ এলোমেলো চুল বাঁধন আলগা করে যথারীতি এসে ঝুলে পড়েছে কপালের উপর। কোনোরকম আঁটোসাঁটো বাঁধনেই তারা আটকে থাকতে নারাজ। তাতে অবশ্য মেয়ের থোরাই কেয়ার। ডানহাতে অবাধ্য চুলের গোছাটাকে কানের পেছনে ঠেলে দিতে দিতেই তার মুখে খেলে গেল সারা ঘরে আলো ছড়িয়ে দেওয়া এক গাল হাসি। “কাকীমা, সুচি?”
এই হাসিটার সামনে ভারী অসহায় অনুভব করেন অপর্ণাও। তাঁর মনে জমে থাকা অত বিরক্তি সত্ত্বেও তিনি টের পেলেন, তিনি নিজেও হেসে ফেলেছেন। “কোথায় আবার, ওর ঘরে।” কথাটা বলতে গিয়েও বুঝতে পারলেন যে ঝাঁঝটা উগড়ে দেবেন বলে মনে মনে জমিয়ে রেখেছিলেন, সেটাও যেন ঠিক সময়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে। মনে মনে আরও বিরক্ত হয়ে উঠলেন অপর্ণা।
গেছো বাঁদর ততক্ষণে মাত্র কয়েক লাফেই সিঁড়িগুলো টপকে পৌঁছে গেছে উপরে শুচিষ্মিতার ঘরে। এসি ঘরের দরজা ভেজানো। দরজায় টোকা না দিয়ে ঘরে ঢোকা এ’ বাড়ির নিয়ম বিরুদ্ধ। কিন্তু দমকা হাওয়া আবার কবে কোথায় নিয়মের ধার ধারে। অতএব চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই অনি ঘরের ভিতর।
“সুচি, এই সুচি!” ডাকটা শুনে বিছানায় একটা বই নিয়ে উপুড় হয়ে থাকা সুচি ঘাড় ঘোরায়। অনিকে দেখেই তার মুখেও খেলে যায় অনাবিল এক হাসি। “আরে অনি! বোস, বোস।” তাড়াতাড়ি উঠে বসে সুচি বিছানাতেই একটু জায়গা করে দেয় অনিকে। পাশে টেবিলের সাথে রাখা ও কম্পিউটারের সামনে থাকা দু-দু’টো চেয়ারকে বেমালুম অগ্রাহ্য করে ঐ বিছানারই এক কোণে ধপাস করে বসে পড়ে অনিও। “এই, কী করছিস রে?”
“আর বলিস না। কাল তো এ কে জি ক্লাসে পরীক্ষা নেবেন। কিসসু মাথায় ঢুকছে না রে। তাই একটু বই ঘাঁটছিলাম।” হতাশাটুকু প্রকাশ পায় সুচির সোজা করে পাতা হাতের ভঙ্গিমাতেও।
“আরে ঐ লাকঁর ফিলজফি তো। হ্যাঁ রে, একটু মাথা ঘুলিয়ে দেয়। তবে কাল রাতে মোটামুটি একটা সাম আপ তৈরি করে ফেলেছি। তোর দরকার হলে নিয়ে নিস।” বলতে বলতেই সুচির পাতা হাতে এক চাপড় কষায় অনি।
সুচিও অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করে। অনির তৈরি সাম আপ মানে ও জানে সেটা যথেষ্ট ভালোই হবে। ওটা পেয়ে গেলে, বিষয়টা ওর বুঝতেও সুবিধে হবে, আর তার থেকেও যেটা ভাইটাল, কালকের পরীক্ষাটুকু তো উতরে যাওয়া যাবে।
“সত্যি দিবি! কখন?” অনিকে এ’ ক’দিনে আদ্যপান্ত চিনে ফেলেও সুচির গলায় ঝরে পড়ে একটু অবিশ্বাস। আসলে নিজে খেটেখুটে কোনও পড়া তৈরি করে অক্লেশে সেটা বন্ধুকে বিলিয়ে দেওয়া চলে, এমন সংস্কৃতিতে খুব একটা অভ্যস্ত নয় সে।
“সে নিবিখন। ফেরার সময়?”
“ফেরার সময়! এখন আবার কোথায় ছুটতে হবে!”
“এই তুই বলেছিলি না তোর রক্ত ‘ও’ পজিটিভ?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“এই অপরেশদার বৌদির আজ একটা অপারেশন আছে। ‘ও’ পজিটিভ রক্তের ডোনার তৈরি রাখতে বলেছে। একটু যাবি?”
“মানে! আমায় রক্ত দিতে হবে? ওরে বাবা।”
“ওরে বাবা মানে! রক্ত দিতে আবার ভয় কিসের রে?”
“না মানে, ছুঁচ ফোটাবে তো। তার থেকে কত ধরনের ইনফেকশন হতে পারে জানিস? তাছাড়া কতটা রক্ত নিয়ে নেবে।” নিজের মনের ভয়টাকে আড়াল করতে দেওয়া এক্সকিউজগুলো যে ধোপে টেকে না, সেটা নিজেও বেশ টের পায় সুচি।
“এই, তুই না কলেজে পড়িস। এ’সব কী বলছিস! আজকালকার ডিস্পোজেবল সিরিঞ্জে ইনফেকশন ছড়ায়! আর তাছাড়া কত লোকই আকছার রক্ত দিচ্ছে। কার কত ইনফেকশন ছড়িয়েছে শুনেছিস রে?” বলতে বলতেই আবার হেসে ফেলে অনি। “চল, চল, রেডি হয়ে নে। তাছাড়া রক্ত যে লাগবেই, তারও তো কোনও কথা নেই। জাস্ট সতর্কতা। আর তোদের বাড়িতে যা খাওয়া দাওয়া, সাতদিনেই তুই আবার কাকীমার সেই লালটুস মেয়েটি হয়ে যাবি। সিওর।” কপট রাগে সুচির ছুঁড়ে মারা টেডি বিয়ারটার থেকে নিজের মাথা বাঁচাতে বাঁচাতে বলে ওঠে অনি।
অবাক অপর্ণার চোখের সামনে দিয়েই লাফাতে লাফাতে উপর থেকে নেমে আসে দুই মেয়ে। “মা, একটু আসছি”, এর বেশি আর কিছু বলবারও প্রয়োজন বোধ করে না মেয়ে। গেছো বাঁদরটার সাথেই আরেকটা বাঁদর হয়ে কথাক’টি উচ্চারণ করতে করতেই লাফিয়ে নেমে যায় বাগানে। “আরে, আরে, যাস কোথায়। আমাদের দুজনের তো বেড়োনোর কথা একটু পরেই।” উদ্বিগ্ন অপর্ণা চেঁচিয়ে মরেন। “সে হবে এখন। একটু আসছি।” উত্তরটুকুর সাথেই ভেসে আসে ঝড়াং করে গ্যারেজের শাটার ওঠার শব্দ। আবার সাথে সাথেই একইরকম শব্দ করে নেমে আসে ওটা। তারপরই স্কুটির শব্দটা সামনের গলিটুকুর মোড়টা ঘুরে বড় রাস্তায় পড়েই মিলিয়ে যায় দূরে।
পরিচ্ছদ ৩
রাতে খাবার টেবিলে অপর্ণার মুখ ভার দেখেই সুজয় বুঝতে পারে মেয়ের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আবার কোনও অভিযোগ। এই হয়েছে এক মুশকিল সুজয়ের। সেই কোন সক্কালবেলা সে বেড়িয়ে পড়ে, সুজয়ের পছন্দের ভাষায় দু’মুঠো ভাতের ধান্দায়। অবশ্য সুজয় নিজেও জানে, দু’মুঠো ভাতের অভাব আর কোনোদিনই হবার কোনও সম্ভাবনা নেই তার। এতবড় ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের এক অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে ইতিমধ্যেই সে যা করে ফেলেছে, তাতে সে কেন, পরবর্তী জেনারেশন, মানে তার ঐ আদরের মেয়ের জীবনটাও বেশ আয়েসেই কেটে যাওয়াই উচিত। তবুও অপর্ণার উদ্বেগের শেষ নেই।
তা মা-মেয়ের দ্বন্দ্ব বেশ উপভোগই করে সুজয়। একগাল হেসে সে জিজ্ঞেস করে মাকে, “কী হল! গৃহকর্ত্রীর মুখে আজ এত মেঘ জমেছে যে!”
প্রত্যাশিত ঝাপটাটা আসে সঙ্গে সঙ্গেই। “হ্যাঁ, আমার মুখে তো মেঘ দেখবেই। ওদিকে মেয়েটা যে গোল্লায় যেতে বসেছে, কোনোদিন ফিরে তাকিয়ে দেখেছ সে’দিকে?”
সুজয় ফিরে তাকায় এবার মেয়ের দিকে। কাঁটা চামচটা হাতে সে এখন নুডলস ঘাঁটছে। মুখ নীচু। তবু চোখে তার খেলে যাওয়া হাসিটুকু নজর এড়োয় না সুজয়ের। পুরো সমস্যাটাই মোটামুটি বোঝা হয়ে যায় সুজয়ের এক লহমাতেই। চোখগুলো পাকিয়ে গলার স্বর গম্ভীর করে তুলে সে এবার হাঁক দেয় মেয়ের দিকে, “কী করেছিস রে পুট্টুস?”
ব্যস। দমাস একটা শব্দ। “ও! আমার সঙ্গে ঠাট্টা হচ্ছে! বাপ আর মেয়েতে মিলে মজা করা হচ্ছে আমাকে নিয়ে! ঠিক আছে। থাকো তোমরা দু’জনে।” হাতের বোলটা ঠকাস করে টেবিলের উপর নামিয়ে উঠে দাঁড়ায় অপর্ণা। উন্মত্ত রাগে চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে সোজা পা বাড়ায় উপরের তলায় নিজের বেডরুমের দিকে।
“এই তো বাবা!” অনুযোগের সুরে গলা তোলে এবার মেয়ে। “রেগে গেলে তুমি কখনও আমায় পুট্টুস ডাকো! কখন কোথায় কী বলতে হয় সেটাও খেয়াল থাকে না তোমার?” দুষ্টু হাসিটা জোর করেই চেপে মুখটা আবার কাঁচুমাচু করে তোলে সে।
“তাই তো রে! আচ্ছা, সরি সরি। আবার বলছি।” আবার চোখটা কটমট করে তুলে খুবই গম্ভীর গলায় হাঁক পাড়ে সে, “আজ আবার কী কাণ্ড ঘটিয়েছ শুচিস্মিতা? মার কথার অবাধ্য হয়েছ কেন?”
সিঁড়ির বাঁকটা থেকে এবার যে রাগত দৃষ্টিটা ছুঁড়ে দিয়ে অপসৃয়মান পাদু’টো আরও উপরে অদৃশ্য হয়, সত্য দ্বাপর বা ত্রেতা যুগ হলে তা থেকে নিশ্চিত কোনও একটা অঘটন ঘটে যেত। ভাগ্যিস এটা ঘোর কলি।
“এই, এবার ঠিক করে বল তো, ঠিক কী হয়েছে?”, গলাটা নামিয়ে এবার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে বাবা। “আর বোলো না। মা বলেছিল, আজ মার সাথে পার্লার যেতে হবে। কিন্তু অনিটা …” বাক্যটা শেষ করার আগেই হেসে ফেলে সুজয়। “ও, ঐ গেছো বাঁদরটা! তাহলে তো ঠিকই আছে। যা করেছিস, বেশ করেছিস।” একটা প্রশ্রয়ের হাসির সাথে ঐ গেছো বাঁদরের বাঁদরামির প্রতি তার অগাধ আস্থা প্রকাশ করে বসে এবার নিশ্চিন্তে খাওয়ায় মন দেয় সুজয়। তারপর জিজ্ঞেস করে, “তা কোথায় গিয়েছিলি ওর সাথে?”
“নার্সিং হোমে। একজনের একটা অপারেশন ছিল। রক্ত দরকার হতে পারত। ‘ও’ পজিটিভ। তাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।”
“তাই নাকি! তা রক্ত দিয়েছিস? তাহলে তো ক’দিন তোর একটু ভালো খাওয়া দাওয়া করা দরকার রে।” এবার সুজয়ের গলাটা একটু উদ্বিগ্ন শোনায়।
“আরে না না। শেষপর্যন্ত রক্ত তো লাগেইনি।” তাড়াতাড়ি বাবাকে আশ্বস্ত করে মেয়ে। “আর তাছাড়া, এমনিতেই যা খাওয়ায় মা, এর থেকে আবার ভালো কী খাবো বল তো।” বলেই পাশে রাখা দুধের গ্লাসটার দিকে একটা বিষদৃষ্টি হানে সুচি।
সুজয় হেসে ফেলে। “যাক গে, যাঁর অপারেশন ছিল, তিনি এখন ভালো তো?”
“অপারেশন তো ঠিকঠাকই হয়েছে। তবে ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখবে।”
“ও”, এবার আরেক গ্রাস খাবার মুখে তুলে নিয়ে আধভর্তি ডিশটাই নামিয়ে রাখে সুজয়। “যাই, এবার গিয়ে ওদিক সামাল দিই গিয়ে।” উঠে পড়েও আরও একবার মেয়ের দিকে ফিরে চোখ টেপে সুজয়, “ও হ্যাঁ। রক্ত দেওয়া খুব ভালো কাজ। শুধু প্রয়োজনীয় সতর্কতাটুকু নেওয়া ভালো। খেয়ে নে।” দুধের গ্লাসটার দিকে চোখের ইঙ্গিতে দেখিয়ে হেসে মেয়ের মাথার চুলগুলো আলতো করে একটু ঘেঁটে দিয়ে উঠে পড়ে সুজয়।
আগামী পর্বের লিঙ্ক এখানে
অলংকরণ – শর্মিষ্ঠা দেবযানী
লেখক পরিচিতি: দামিনী সেন
গত শতাব্দীর শেষ পাদে জন্ম। ছেলেবেলা কেটেছে মফস্সলে। সেখানেই পড়াশুনো — স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ঘুরতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পড়তে। জানেন একাধিক বিদেশি ভাষা। আগ্রহ বহুমুখী, কলমের অভিমুখও। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সাবলীল তাঁর কলমের গতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। কাব্যগ্রন্থ “ভাঙা সে সাম্পান” প্রকাশের পথে। ধারাবাহিক উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী”-র মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ।
চলুক। ভালো লাগছে পড়তে। লেখিকার আর তার লেখার সুস্হতা কামনা করি।