অদ্বৈত

লেখক : সিদ্ধার্থ

বরাহনগরের বাড়িটার সামনে যখন এসে দাঁড়ালাম, সূর্য তখন পরপারে।অন্ধকার নেমে আসছে,বাসায় ফিরতে দেরি করে ফেলা পাখিরা ব্যস্ত হয়ে উড়ে যাচ্ছে ঘরের দিকে।
 
বাড়িটা চারতলা, বেশিরভাগ রেলের শ্রমিকদের, গ্রাম থেকে দূরে থাকা দোকানের কর্মচারীদের বাস।সকাল নয়টার মধ্যে সকলে নিজ নিজ কর্মস্থলে পৌঁছে গেলে এই বাড়ি মৃতের নিঃস্তব্ধতাকে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে থাকে।কখনো-সখনো একটি দুটি মানুষ, ঝি-চাকর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণের প্রমাণ দিয়ে যায়।
 
সন্ধ্যাবেলার ছবি আবার আরেক রকম।কলকাতা শহরের হৃদপিণ্ডের উপর বসে থাকা অফিসপাড়ার বাতিগুলো যত নিভে আসে, যত নিঝুম হয়ে আসতে থাকে, তখনই সেজে ওঠে এই বাড়ি।সারাদিন জন্তুর মতো খেটে আসা মানুষগুলির হৃদয় আবার জেগে ওঠে, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ সব রকমের আবেগ এসে গ্রাস করতে থাকে।
 
উদ্বাস্তু সমস্যা চরমে উঠেছে।রাস্তায় হাঁটলেই একটি-দুটি মৃতদেহ, চোখভর্তি ক্ষুধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখা যায়।বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এই রকমই কয়েকটা ভিখারি ছেলে দাঁড়িয়েছিল।পাছে ভিক্ষা চায়, ছোট্ট দরজা পেরিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলাম।
 
ঘরে ঢুকতেই হল্লার আওয়াজ পেলাম।ঘরে-ঘরে তাসের আসর বসে গেছে।দেশি মদের গন্ধও নাকে এল।রবীন্দ্রনাথ, চটুল হিন্দি কিছু গানের শব্দ কানে এলো।বাঙালি কেরানি, বিহারি মুটের পাশাপাশি অবস্থানের প্রমাণ পেলাম আবারও একবার।
 
সোজা উঠে এলাম ছাদে। রেলশ্রমিকদের সাথে হই-হুল্লোড় করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, রুচিতে বাঁধে।পুরো বাড়িটা জুড়ে কোলাহল সত্ত্বেও ছাদ মন্দিরের মতোই শান্ত।এখানে একতলার শব্দ দু’তলায় পৌঁছায়, দুইতলার শব্দ তিনতলায়, কিন্তু সমগ্র বাড়ি চেষ্টা করেও ছাদের এক সাধকের ধ্যান ভাঙাতে পারে না।
 
হাতে থাকা পাণ্ডুলিপিটা আরেকটু শক্ত করে ধরলাম। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা হেমন্ত, বসন্ত গঙ্গার হওয়া এই ছাদে সর্বদাই থাকে। অন্ধকার অপরিষ্কার সিঁড়ি বরাবর উঠে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, অনেকটা পথও হাঁটতে হয়েছিল, হাওয়ার ঠান্ডা স্পর্শে হারিয়ে যাওয়া শক্তি ফিরে আসলো।
 
ছাদের একমাত্র ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা বাতিও জ্বলছে না। ছোট্ট ঘরের বেশিরভাগ জুড়ে থাকা খাটিয়ার উপর শীর্ণ চেহারার উপস্থিতি টের পেলাম সন্ধ্যার নীল আলোতে। এই মানুষটাকেই চাইছিলাম।
 
প্রায়ান্ধকার ঘরটিতে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম না অচিন্ত্য ঘুমিয়ে আছে কিনা। রোগ সরিয়ে ওঠা সত্ত্বেও এখনো তার শরীর যথেষ্ঠ কাহিল। সারাদিন কাজের পর ঘুমিয়ে পড়াই স্বাভাবিক। ঘুমিয়ে না পড়লে হয়তো এখন লণ্ঠনের নিভু নিভু হলুদ আলোর সামনে বসে নতুন কেনা বই পাঠ করতো।
 
অচিন্ত্য ঘুমায়নি। এক মহাযজ্ঞ সম্পূর্ণ করার পর খানিক বিশ্রাম নিচ্ছিল। ঘরের বাইরে আমার উপস্থিতি টের পেয়েই তার টানা দুই চোখ মেলে তাকালো। বহুদিনের আধপেটা খাওয়ায় আর যক্ষার আক্রমণে তার চোখদুটো ঢুকে গেছে প্রকোষ্ঠের আরও ভিতরে।
 
আমাকে দেখে উঠে বসল। বসন্তের রাতেও গায়ে চাদর জড়ানো। হাতের কাছে লণ্ঠনটা আমিই জ্বালালাম।আমার হাতে পাণ্ডুলিপি দেখে কিছু না বলে সেটাই টেনে নিল।
 
অচিন্ত্য-আমি বহুদিনের বন্ধু। ক্যাপ্টেন সত্যেন্দ্র মিত্রের সাথে কলকাতা আসার পর পরই। এক পত্রিকার আপিসে প্রথম দেখা হয়। বয়সে সে আমার থেকে বছর তিনেক বড়ো। পূর্বে প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ছাদের এই ঘরে সাহিত্য চর্চা হতো, বই পড়া হতো কিন্তু বছর দুই সংসারধর্ম পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অচিন্ত্যের সাথে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। শেষ তাকে দেখতে এসেছিলাম কাঁচড়াপাড়া থেকে ফিরে আসার পর। অর্থাভাব ঢাকতে অচিন্ত্য বিশ্বভারতীতে কাজ জুটিয়েছে একথা জানা ছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তু মালো পরিবারগুলোর পাশে সে দাঁড়িয়েছে এই কথা সে নিজে চিঠিতে জানিয়েছিল। এই কাজে একদিন আমিও তার পাশে ছিলাম।
 
আমার পাণ্ডুলিপি অচিন্ত্যর হাতেই ছিল। কয়েক পাতা পড়ার পর তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কঙ্কালসার হাত দিয়ে আমার এক হাত ধরে বলল, ‘বেশ লিখেছ ভায়া, এ লেখা দেশ ছাপবেই।’ সামান্য এই কয়েকটা কথা বলতে গিয়েও সে হাঁপিয়ে পড়ল।
 
আমার হাত ছেড়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে আমার দিকেও একটা খাতা এগিয়ে দিল সে।বুঝতে কষ্ট হলো না এটা নতুন পাণ্ডুলিপি। খুলতেই চমকে উঠলাম।বুঝলাম সে কেন বিশ্রাম নিচ্ছিল।
 
নিজের লেখাকেই সে আবার লিখেছে। একটি নদীকে নিয়ে গল্প। কুমিল্লায় থাকতে হারিয়ে ফেলা লেখা সে আবার লিখেছে।
 
আমাকে আরও বিস্মিত করে অচিন্ত্য জানাল তার যক্ষা আবার ফিরেছে। কাশি এবং সেই সাথে রক্তপাত আবার শুরু হয়েছে। শেষ কিছুদিন জ্বরের ঘোরে বিছানা ছেড়ে বিশেষ উঠতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে কেবল পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ করেছে।
 
অচিন্ত্যর কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছিল। ওঠার সময় আমাকে কিছুটা বিস্মিত করেই সে পাণ্ডুলিপি আমার হাতে তুলে দিল। সঙ্গে দিল বেশ কিছু টাকা। দূরসম্পর্কের বিধবা বোনের সেই মাসের খরচ যোগানোর জন্য টাকা।
 
অচিন্ত্য ছিল এই রকমই। পরের দুঃখে তার মন কাঁদত। উপবাস ছিল তার সহচর। মালো পরিবারের ছেলেদের মতো তাঁরও বেশিরভাগ দিন কাঁটত ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করে। লোকে ভাবে মালোর ঘরে রোজ মাছ ভাত ঢোকে। মাছ মালোর ঘরে ঢোকে। দুর্গম বর্ষার নদী, সাগরের পেট চিড়ে সে মাছ নিয়ে আসে ঘরে কিন্তু ভাত আর রাঁধা হয় না। মাছ বিকিয়ে যে পয়সা হয় তাতে ভাঙা হাঁড়িতে লাল চালই ফোটে, মাছের আঁশটে গন্ধই কেবল মালোর গায়ে লেগে থাকে।
 
ছোট থেকেই ক্ষুধা তার পরম মিত্র। ক্লান্ত শরীরে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে সে ইস্কুলে যেত। ভাতের অভাব তাকে জ্ঞান লাভ থেকে বঞ্চিত করতে পারেনি।
 
নিজের পেটের জ্বালা একমাত্র পেটই জানতে পারে। কিন্তু যখন ভাতের হুতাশে চোখের সামনে লোক মরে, তখন চোখ ফেটে কান্না আসে। সাংবাদিকতার পেশায় আয় ভালো নয় তবুও অচিন্ত্য বিলোতে লাগলো।পিসির অসুখ, মেসোমশাইয়ের মেয়ের বিয়ের যৌতুকের খরচ সব হলো তার দেওয়া পয়সা থেকে। মধ্যে থেকে চিঠি এলো বিধবা বোনের। ছোট দুটি সন্তানের পেট ভরাতে যার কাছে বেশ্যাবৃত্তি ব্যতীত উপায় নেই। অচিন্ত্য সবাইকে দেখল, কিন্তু নিজের সংগ্রহে রাখা অজস্র বইয়ের মলাটে নিজের শুকিয়ে প্রতিচ্ছবি পড়তে পারলো না।
 
আত্মীয়দের সাহায্য করে, নিজের জন্য বই কেনার পরে মাছ-ভাত না হোক শাক ভাত সে জুটিয়েই নিতো, কিন্তু মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এসে পড়ল উদ্বাস্তু সমস্যা। উদ্বাস্তু মালোদের দুর্দশা দূর করতে গিয়ে অচিন্ত্য বিশ্বভারতীর হয়ে সাংবাদিকের কাজ আরম্ভ করলো। নিজের অন্ন যে সবাইকে দিতে পারে সেই তো অচিন্ত্য।
 
আধপেটা খেয়ে হাড়ভাঙা খাটনিই কাল হলো। যক্ষার জীবাণু বাসা নিলো তার শরীরে। প্রথমবার সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও দ্বিতীয়বার পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারলো না।
 
আমার সাথে দেখা হওয়ার কিছুদিন পরেই আবার কাঁচড়াপাড়ায় ভর্তি হয় অচিন্ত্য। সাংসারিক ঝামেলায় আটকে পড়ায় তার সাথে দেখা করারও সুযোগ হয়নি। কেবল যেদিন মণিলাল খবর দিলো অচিন্ত্যর নদীর মতো উদার জীবন সাগরে পতিত হয়েছে, সেই দিন চিতার আগুনে তাকে জ্বলতে দেখেছিলাম।
 
পরদিন সকালে আমরা বন্ধুরা তার ঘরে গিয়েছিলাম। চারতলা বাড়ির উপরের ছাদ তখন নির্জন। মৃত্যুর আগে সে হাসপাতাল থাকে পালিয়ে এসেছিল এখানে। তার আজীবন ভালোবাসার বস্তু বইগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল বিছানার উপর। কেউ যেন আপ্রাণ চেষ্টা করছিল সেগুলো আরেকবার পড়ে ফেলার।
 
বইয়ের ভিড়ে ছিল কয়েকটি আনা-আধুলি। সাথে ছিল শেষবারের মতো বিধবা বোনকে টাকা পৌঁছে দেওয়ার করুণ আর্তি।
 
(ব্যক্তিগত ভাবনা থেকে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবন ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা)

লেখক পরিচিতি : সিদ্ধার্থ
বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র। অল্প কিছু কবিতা-গল্প কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেয়েছে।প্রিয় লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য, সমরেশ বসু।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।