বেশ্যার চিঠি

লেখক : ইচ্ছেমৃত্যু

মাননীয় শুভব্রতবাবু,

     কালকের কাগজে আপনার লেখা ‘শাকিলা’ গল্পটি বেরিয়েছে। আপনার সাবলীল লেখনী পাঠকচিত্ত হরণ করে রেখেছে বিগত কয়েক বছর। এই লেখাও সমস্ত পাঠকের, বিশেষ করে নারীদের মন জয় করে নেবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। আপনি এখনও শাকিলাকে মনে রেখেছেন দেখে অবাক লাগল; নাকি প্লটের অভাব পড়েছিল? দ্বিতীয়টি সত্যি হবার সম্ভবনাই বেশি, কিন্তু ভাবতে বড় ভাল লাগছে প্রথমটি যদি সত্যি হত! কিন্তু তা নয়, নইলে আপনি এত কিছু ঘটনা গুলিয়ে ফেলতেন না। আপনি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে বলে চালাতে চাইলেও ভাল করেই জানেন এর বেশিটাই আপনার কল্পনা। আর যেটুকু সত্যি ছিল তার অনেক কিছু গোপনও করে গেছেন। নিশ্চয় ভাবছেন আমি কে, কেন এসব লিখছি। আমিই শাকিলা। পরিচয় যখন দিয়ে দিলাম, তখন আর আপনি-আজ্ঞে করছি না।

শুভদা, প্রায় বাইশ বছর আগে তোমাকে শেষবার দেখেছিলাম, দূর থেকে। তুমিও আমাকে দেখেছিলে, সে কথা তোমার গল্পেও আছে। তখন আমি এক মেয়ের মা, তোমাদের ভাষায় তখন আমি ‘খারাপ’ হয়ে গেছি। না, না; এখান থেকে শুরু করব না; বরং প্রথম থেকে শুরু করি। তোমার মত সাজিয়ে লিখতে তো পারি না, কিন্তু তোমার গল্পে যে ফাঁকগুলো আছে বা যে ঘটনাগুলো তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলতে পারি না সেগুলোর কথা বলি।

গরীব মুসলমান পরিবারের মেয়ে আমি। আমার ‘বুড়োটে’, ‘দড়ির মত’ চেহারার বাবা আমার মায়ের মত কম বয়সী সুন্দরীকে কোথায় পেল তোমার জানার কথা নয়, তাই লিখতেও পারোনি। শোন, বলি, মাকে তার আগের পক্ষের স্বামী সামান্য রাগের বশে তিন তালাক দেয়। কেউ আর মায়ের দায়িত্ব নিতে চায়নি; তখন এগিয়ে আসে আমার বাবা। বাবার তখন আগের পক্ষের স্ত্রী মারা গেছিল, আর তখন অতটাও গরীব ছিল না। যাই হোক বিয়ের পর অবস্থা আরও পড়ে এলে তোমাদের পাড়ায় একটা এক দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে ভাড়া নিয়ে আসে। তখন আমার বয়স কতই বা, বড় জোর ছয়। তুমিও বোধ আট-নয় হবে।

তোমরা মধ্যবিত্ত তাই আবার হিন্দু ব্রাহ্মণ। তবু জেঠুমা আমাকে খুব ভালবাসতেন – তোমার লেখা অনুযায়ী ‘ফুটফুটে সুন্দরী’ ছিলাম বলেই হবে হয়ত। জানো, তোমার বইগুলো দেখে খুব লোভ হত, কত সুন্দর রঙচঙে ছবিওলা বই, কিন্তু কোনদিন সাহস করে হাত দিতে পারিনি। তুমি তো লিখেইছো, আমাকে স্কুলে ভর্তি করেনি, তাই বইগুলোতে কি ছিল তাও জানা হয়নি কোনদিন। তবে তুমি আমাকে মাঝে মাঝে তোমার খেলনাগুলোয় হাত দেওয়ার সুযোগ দিতে; তুমি অবশ্য লেখোনি – শুধু সেই দিনগুলোতেই এই সুযোগ দিতে যেদিন তোমার আর কোন বন্ধু আসত না বা বৃষ্টিতে বেরোতে পারতে না ঘর থেকে; তখন তো এই অভাগীই তোমার…

কিন্তু এই করে করেই আমাদের কেমন বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিল, তাই না শুভদা? আমি কিন্তু তোমাকে মোটে কয়েকদিন পেয়ারা চুরি করে এনে খাইয়েছি, তুমি বাড়িয়েই লিখেছ যে প্রায়ই নাকি তোমাকে পেয়ারা চুরি করে খাওয়াতাম। আর তুমি আমাকে ইস্কুল থেকে এনে দিতে রঙ্গিন চক, পালক, ভাঙ্গা পেন। আমার কাছে সব রাখা ছিল; জানো, অনেক বছর ছিল। আচ্ছা তুমি যখন এগারো-বারো ক্লাসে পড়তে, তোমার কি সত্যি সত্যি রোজ মাথাব্যথা করত, নাকি…? সত্যি করুক আর মিথ্যে, আমার বেশ ভাল লাগত, তোমার ঝাঁকড়া চুলে হাত বোলাতে পেতাম, তোমার কপালে হাত রাখতে পারতাম… তোমাকে ছুঁতে পারতাম। তখন আমরা বড় হচ্ছি, মা বেশিক্ষণ থাকতে দিত না তোমাদের বাড়ি; ঘরের কাজের দায়িত্বও তো আমারই ছিল, সে তো তুমি গল্পে লিখেওছো। বাবা মারা যাওয়ার পর সব্জির দোকানটা মাকেই চালাতে হত। পরের তিনটে ভাই ইস্কুলে পড়ে আর বোনটাও যে বড্ড ছোট। তবু দিনে দশ মিনিটের জন্যে তোমার কাছে যেতে না পারলে মন কেমন করত। তোমার করত, শুভদা?

তখন বুঝিনি তোমার মন কেমন করত কিনা, বুঝছিলাম আরো বছর কয়েক পর। তুমি তখন কলেজে পড়ো, হোস্টেলে থাকো। মাসে একবার বাড়ি আসতে; ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়, প্রথম স্কলারশিপের টাকা পেয়ে আমার জন্যে একটা শৌখিন ক্লিপ কিনে এনেছিলে। গরীবের মেয়ে, অত দামী, শৌখিন ক্লিপ পরলে লোকে কি বলবে বল! আর তুমি দিয়েছ বললে তোমার যে সম্মান যাবে! তুমিও তাই লুকিয়েই পরতে বলেছিলে, শুধু তোমার জন্যে। তোমার জন্যেই তো পরতাম, তুমি এলে লুকিয়ে ওড়নায় বেঁধে তোমার বাড়ি নিয়ে যেতাম, তোমার ঘরে ক্লিপটা পরে আবার ওখানেই খুলে চলে আসতাম। কী অদ্ভুত তাই না?

দেখতে দেখতে আরও তিন বছর পেরিয়ে গেল, তখন তুমি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, চাকরি পেয়ে গেছ পড়তে, পড়তেই। আমিও তখন সংসার জীবনে বেশ অভিজ্ঞ – বিশেষত গরীবের বাড়ির মেয়েরা অল্পতেই বেশ অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা যে পরিণতি পেতে পারে না তা বেশ বুঝে গেছি – লোক দেখানো ‘দাদা-বোন’ সম্পর্কটাই টিকে যাবে নিশ্চিত। তুমিও কোনদিন আমাকে বলনি ‘ভালবাসি’ বা এরকম কিছু। অবশ্য তুমি চিরকালই মুখচোরা, চুপচাপ, একটু বোকাও! এখন যে কি করে এত গল্প, উপন্যাস লেখো কে জানে! সে যাই হোক, সেবার পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছিলে। যথারীতি, আমি হাজির তোমার ঘরে। তুমি সেবার এনেছিলে লিপস্টিক, পুজোর উপহার। তোমার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, জীবনের প্রথমবার ঠোঁটে রঙ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেমন লাগছে?’ সেই তুমি,  সেই বোকা, লাজুক শুভদা বলা নেই কওয়া নেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে গেছিলে; হ্যাঁ, মানছি, আমি একটু জোরেই বলে উঠেছিলাম ‘নাঃ’; আসলে মনে প্রাণে চেয়েছিলাম তুমি আমাকে জোর করে টেনে নাও, জোর তো লাগবেই বলো… হিন্দু-মুসলিম, বড়লোক-গরীব লোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এত এত বিভেদের বেড়াজাল ভাঙ্গতে জোর লাগবে না? কিন্তু তুমি আমাকে ছেড়ে দিলে, তোমার চুম্বনোদ্যত ঠোঁট আমার ঠোঁটে নেমে আসেনি। তুমি চুপচাপ তোমার শামুকখোলে ঢুকে গিয়েছিলে। আমি বেশ কয়েক মুহূর্ত নড়তে পারিনি। তারপর আস্তে আস্তে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। তুমি অবশ্য এই ঘটনাটা গল্পে লেখনি, বরং এর পরবর্তী জীবনের লোকমুখে শোনা ঘটনাগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মুখরোচক গল্প বনিয়েছো। জানো শুভদা, সেই লিপস্টিকটা এখনও আছে, কিন্তু আর কোনদিন ওটা মাখতে পারিনি।  

সেই ঘটনার পর, তুমি আর মাস ছয়েক বাড়ি আসোনি; জেঠুমা বলতেন শেষ বছরের পড়ার চাপ – আমি জানতাম কেন! পড়াশোনা শেষ করে তুমি যখন এলে তার দিন পনেরো আগে আমার বিয়ে হয়েছে, অনেকটা হঠাৎ করেই। আসলে গরীবের বাড়ির মেয়ে, বয়সও তখন প্রায় কুড়ি; বিয়েতে বাধা দেবার মত ভরসাও তো কিছু ছিল না। সে যাই হোক, ছেলে গুজরাটে না কোথায় চাকরি করত। বিয়ে করে তিন মাস আমাদের বাড়িতেই ছিল। সে সময় জেঠুমা ওকে দেখেছিলেন, সে ঘটনার উল্লেখ অবশ্য তোমার গল্পে আছে। তিনমাস পর, সে তার কর্মক্ষেত্রে গেল, যোগাযোগের জন্য একটা ফোন নম্বর দিল – মালিকের নম্বর, খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে যেন ফোন না করি। কথা ছিল, ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে কয়েক মাস পর নিয়ে যাবে আমাকে। মাসের পর মাস কাটতে থাকে, কোন যোগাযোগ নেই। আমিও তখন গর্ভবতী; বাধ্য হয়ে একদিন ফোন করলাম, ফোন নম্বরে রিং হয় না, একটা ভুয়ো নম্বর। যারা সম্বন্ধটা এনেছিল তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারাও অনেক খোঁজ খবর নিয়ে শেষে জানালো ছেলেটি গুজরাটে বিয়ে থা করে সংসার করছে। কিছুদিনের মধ্যে আমার একটা বাচ্চা হল – মেয়ে; তার কথাও আছে তোমার গল্পে। এদিকে মায়ের দোকান ঠিকঠাক চলে না, ভাইগুলো কেউ পড়ে, কেউ বেকার – খরচ বাড়ছে কিন্তু আয় বাড়ছে না। ফলত, মেয়েটা একটু বড় হতে আমাকে নিতে হল আয়ার কাজ – তাতে আর কটা টাকাই বা ইনকাম, পড়াশোনাও জানি না। সারা রাত ডিউটি সেরে সকালে ফিরতাম। লোকজন ফিসফাস করত পিছনে, কান দিতাম না। তখন থেকে পড়াশোনাও শেখার চেষ্টা করতে থাকি, ওই নিজে নিজে যতটুকু হয় আর ছিল সামিমের প্রেরণা। ডিউটিতেই পরিচয় হয়েছিল সামিমের সাথে। আমার সব কথাই বলেছিলাম, সব জেনেই সে সারাজীবনের সঙ্গী হতে চেয়েছিল, কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই তার কথাও পাল্টে গেল। ভেঙে পড়েছিলাম খুব, মরে যাবার কথাও ভেবেছিলাম। আসলে সেই কয়েকটা মাসেই সামিমকে বড় বেশি অবলম্বন অরে ফেলেছিলাম। তখন আয়া সেন্টারেরই এক দিদি নিজের মত বাঁচার কথা বলে – সমাজের তোয়াক্কা না করে; আর মেয়েটাকেও তো বড় করতে হবে। রূপ ছিল, তাই এ লাইনে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগল না। উপরি টাকায় মায়ের ব্যবসাকে দাঁড় করালাম। ভেবেছিলাম, লাইনটা ছেড়ে দেব আর ঠিক তখনই মা-ও ‘খারাপ’ মেয়ে নাম দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল। বলেছিল, আমার মুখ দেখতেও ঘেন্না লাগে। মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম এক কাপড়ে। মেয়ের তখন বছর চারেক বয়স। কিছুদিন পর মেয়েকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলাম, ও বড় হতে থাকল; আর আমি নিজের মত বাঁচলাম – শরীর বিকিয়েছি, কিন্তু মন না।

শুভদা, একজন বেশ্যার গল্প আর সবাই যেমন লেখে তেমন তুমিও লিখেছ। না জেনেই কল্পনায় মিলিয়ে মিশিয়ে – তাই আর সেসব নিয়ে লিখছি না কিছুই। শুধু তুমি দুটো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গল্পের শেষ করেছ, সেগুলোর উত্তর না দিয়ে তো শেষ করা যায় না, তাই সে প্রশ্ন দুটোর উত্তর দিই। তোমার একটা প্রশ্ন, ‘কি জানি এখন নাম কী ওর… রাত পাখি, সন্ধ্যাতারা, ফুলকি, মধু?’ না শুভদা, আমি শাকিলাই, যাদের সংসার থাকে, পরিচিতদের হারানোর ভয় থাকে অথবা যারা নিজের এই জীবিকাটাকে ঘেন্না করে তারাই নাম পাল্টায়; আমার তো হারানোর কিছু নেই। তুমি মিথ্যে গল্প বেচো, আমি সত্যিকারের শরীর – নাম পাল্টাবো কেন?

আর তোমার শেষ প্রশ্ন, গল্পটাকে যেটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে, ‘ওর মেয়ে কি বেঁচে আছে, সেও কি নেমেছে ব্যবসায়?’ শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে মেয়ে আমার বেঁচে আছে, সে গ্রাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্সের ছাত্রী। ব্যবসায় নামবে কিনা সে তার মর্জি, অন্তত আমার কলকাতা ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মেয়ে এই প্রফেশনটাকে ঘৃণা করতে শেখেনি।

শুভদা, চিঠিটা বেশ বড় হয়ে গেল, আর বাড়াবো না। যে জোরটা সেদিন তুমি দেখাতে পারোনি সেই জোরটা দেখাতে পারলে গরীব, নিরক্ষর শাকিলার এই জীবন নিয়ে তোমাকে গল্প লিখতে হত না। আর সত্যি বলছি, তুমি এখন বুদ্ধিজীবি লেখক হয়ে প্রগতিশীল যেসব কথা আওড়ে যাও তার ধারেকাছে তুমি কেউ নও; হলে সব সত্যি এড়িয়ে যেতে না! তোমার সাংসারিক জীবন সুখের হোক, ঠিকানা দিলাম না – অহেতুক আশায় থাকব না বলে। বরং, পারলে একটা সত্যি গল্প লিখো…

তোমার গুণমুগ্ধ পাঠিকা,
শাকিলা।


লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।

গল্পটি শুনতে এখানে ক্লিক করুন –

 

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

3 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।