লেখক : অভীক সিংহ
বিকেলবেলাটা হলেই আমার ক্ষুদ্র সংস্করণটিকে বগলদাবা করে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় পাশের পার্কটিতে। আমার অর্ধাঙ্গিনীর মতে বাইরে না বেরোলে নাকি নবাবপুত্তুরের পেটের ভাত হজম হয় না। তো একদিন তাঁকে লুকিয়ে আমার ক্ষুদ্র সংস্করণটির দুপুরবেলার খাওয়ার পরিমাণটা মেপে আসলাম। না, ওইটুকুন পেটের মধ্যে এইটুকুন খাদ্য তো আরামসেই সেঁধিয়ে যাওয়ার কথা, বদহজম হওয়ার কোন সম্ভাবনা তো ত্রিসীমানায় দেখতে পেলাম না। ভাবলাম একবার, গিন্নিকে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল, নবাব থেকে নবাব গেঞ্জী হয়ে যাওয়াটা কি খুবই কাজের কথা? কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা না করার মধ্যেই জীবনে শান্তি পাওয়া, সে শান্তি বলে কেউ থাকুক আর না-ই থাকুক। সেই প্রশ্নকে একটা শান্তিপূর্ণ নবাবী ভাতঘুমের নীচে মোটে তিনঘণ্টা হ’ল চাপা দিয়েছি, হঠাৎ যেন মনে হ’ল পেটের উপর ভুঁড়িকম্প, থুড়ি, খাটের নীচে ভূমিকম্প চলছে। দুদ্দাড় করে উঠতে গিয়ে দেখি আমার ক্ষুদ্র সংস্করণটি আমার মধ্যপ্রদেশকে বাপের সম্পত্তি ভেবে তার উপরে বসে নির্দ্বিধায় নাচন-কোঁদন করে চলেছে। ভাতঘুমটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভাতার মতই উবে গেল। অগত্যা একটা জামা গলিয়ে তেনাকে কুক্ষিগত করে বেরোতে হ’ল পার্কের উদ্দেশ্যে। পার্কে এনার মত সাইজের হরেক মাল বর্তমান। তারা সবাই নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির করতে ব্যস্ত। অন্যান্য অভিভাবকেরা নিজেদের মত জটলা পাকিয়ে বসে, আমি একটু আলাদা হয়ে বসলাম পার্কের অন্যদিকটায়, ক্ষণিক শান্তির খোঁজে।
কিয়ৎকাল পরেই অনুভব করলাম আমার প্যাণ্টে একটা টান। তাকাতেই নীচ থেকে আধোআধো স্বরে ভেসে আসল, “বাবা, বালতিতা পেলে দাও।” বালতি? কোন বালতি? আমি তো পার্কে এনাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই এসেছিলাম, বালতিতে পুরে তো আনিনি। আর বালতিটা কোত্থেকেই বা পাড়ব? মুরগির ডিম পাড়ে বলে কি আমাকেও বালতি পাড়তে হবে? আমি নিউটনের মত মাথায় আপেল পড়ার অপেক্ষা করছি, প্যাণ্টে পড়ল আবার টান। “বাবা, বালতিতা পেলে দাও।” বলে তিনি হাত তুলে দেখালেন পার্কের মধ্যে একটা গাছের দিকে। চোখে পড়তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হ’ল। কচিদের মধ্যে একজন একটি ছোট্ট প্লাস্টিকের বালতি এনেছিলেন, নুড়ি একত্রিত করার জন্য। অন্য এক কচি উৎসাহের বশে সেটিকে ছুঁড়েছিলেন উপরে দিকে, আর ফলতঃ বালতির হ্যাণ্ডেলটি গিয়ে আটকেছে গাছের ডালে। বেচারা ত্রিশঙ্কু বালতি এবং আমি একে অপরের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে। কারণ আমার সুবিশাল উচ্চতা নিয়ে বালতি নামাতে গেলে আমাকে অন্তত বিশ-ত্রিশ বছর তপস্যা করতে হবে। একটা উপায় হাতড়ে বেড়াচ্ছি, এমন সময় পিছন থেকে একটা চেনা গলার আওয়াজ আসল, “হাইট কম পড়ে গেল নাকি?”
পিছন ফিরে দেখি, সান্যালদা। আমি একটু অসহায়ভাবেই বললাম, “মাইরি এই অবস্থায় বডিশেমিং করছ? মাথার উপরে দেখছ উঠে বসে আছে, মানে বালতিটা –”
“দাঁড়াও, আমি দেখছি।” বলে সান্যালদা গাছের দিকে তাকিয়ে উচ্চতাটা জরিপ করে অন্যদিকে চলে গেল। কয়েক মিনিট পরে ফিরে আসল একটা বেশ লম্বা ঝুলঝাড়া জাতীয় জিনিস নিয়ে। আমার হাতে দিয়ে বলল, “দেখো তো একবার, এতে হয় কি না?”
আমি সেটা হাতে নিয়ে তাক করে তিন-চারবার লম্ফঝম্প করতেই বালতি বাবাজী মর্ত্যে অবতীর্ণ হলেন। কচিদের দল তৎক্ষণাৎ বালতি নিয়ে আবার হৈ-হৈ করে কিচিরমিচিরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমরা গিয়ে বসলাম আমার সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানেই।
“তা, তুমি আজ গুরু এদিকে?” আমি সান্যালদাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“আরে তোমার বৌদি গিয়েছেন বাপের বাড়ি, সাথে আমার জুনিয়রটিকেও। বাড়িতে একা বসে থাকতে থাকতে একেবারে হেদিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, তুমি তো তোমার জুনিয়রকে নিয়ে পার্কে আসবেই। তাই আমিও চলে আসলাম।”
“ভালই করেছ গুরু। এদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতে সময়টা কিন্তু কেটে যায়, মন্দ লাগে না।”
“আরে বলতে ভুলে গিয়েছি। তোমার জন্য কী জিনিস এনেছি দেখো।”
এই বলে সান্যালদা নিজের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রাখল। এতক্ষণ জিনিসটা খেয়াল করিনি। ব্যাগটা নামিয়ে রেখে সান্যালদা ভিতর থেকে বের করে আনল একটা ফ্লাস্ক আর সাথে দু’টো ছোট থার্মোকলের কাপ।
“তোমার বৌদি নেই, তাই আজ বিকেলের চা টা আমিই বানালাম। একবার খেয়ে দেখো দিকি, কেমন হয়েছে ব্যাপারটা?” সান্যালদা বেশ গর্বের সাথে কাপে চা ভরে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি চায়ে একটা চুমুক দিতেই বিদ্যাসাগর মশাইয়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল। “কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না।” ঠিক সেইরকম বিকেলে পার্কে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত গরম চায়ের গুণবিচার করবার ধৃষ্টতা করতে নেই।
“বেড়ে বানিয়েছ কিন্তু গুরু। বৌদি যেতেই তো শোলের সঞ্জীব কুমার থেকে একেবারে শেফ সঞ্জীব কাপুর হয়ে গিয়েছ।” বলে চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিলাম।
বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় আমাদের এক অধ্যাপকের আবির্ভাব। ওনার জুনিয়রও এই পার্কেই খেলছে। আমার পাশে ধপাস করে বসে পড়ে বলতে শুরু করলেন, “আরে, এ তো দেখি আমাদের জয়-বীরু।” বলে চায়ের ফ্লাস্ক এবং আমাদের হাতে ধরা কাপের দিকে সপ্রেম দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “কিছু বাকি আছে নাকি? এই এক কাপ মত?”
“আরে হ্যাঁ, অবশ্যই।” বলে সান্যালদা ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢেলে ওনাকে দিলেন। উনি একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “বাহ, দারুণ। কে বানাল? সান্যাল নাকি?”
সান্যালদা হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে তিনি বললেন, “বেশ বেশ, খাসা। তা এতক্ষণ কী নিয়ে কথা হচ্ছিল?”
সান্যালদা গাছ আর বালতির উপাখ্যানটা বলতেই ভদ্রলোক হো-হো করে হাসতে হাসতে বললেন, “আর বলো না, আজ ক্লাসে যেতে গিয়ে সে কী নাজেহাল অবস্থা হ’ল।”
আমি চায়ের কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন, কি হ’ল?”
“আরে সবে ক্লাসে ঢুকতে যাচ্ছি, এক মক্কেল পিছন থেকে কাঁধে হাত রেখে বলে ‘কি গুরু, কেমন আছো বাওয়া।’ আমি তার দিকে ঘুরে তাকাতেই সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে ‘ও স্যার আপনি! পিছন থেকে ঠিক বুঝতে পারিনি।’ কি যাচ্ছেতাই অবস্থা মাইরি। শালা একটু হাইটটা কম বলে পাবলিক পিছন থেকে তাদের প্রফেসর বলে চিনতেই পারল না।”
এই শুনে আমরা তিনজনেই হো-হো করে হেসে উঠলাম। সত্যিই যাচ্ছেতাই অবস্থা। হাসতে হাসতে আমি চায়ের কাপটা আবার তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “আপনাকে তো তবুও হাইট দেখে নিজেদের ব্যাচমেট বলে ভেবেছে। আমাকে তো জামাপ্যাণ্টের চক্করে একেবারে মেসের চাকর বানিয়ে দিয়েছিল।”
“অ্যাঁ? বলো কি। কোথায়? কবে?”
“এই তো গেলবার পুজোর সময় বাড়ি গেলাম, তখনই খেলাম কেসটা।”
“এই এটা আমাকে বলনি তো।” সান্যালদা বলল।
“আরে সব গল্পের নিজস্ব সময় আছে গুরু।” আমি চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললাম।
“তাহলে আর কি, বলে ফেল দিকি কেসটা হালকা করে।” ভদ্রলোক বললেন।
আমি চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে শুরু করলাম।
এই গল্পটা বলতে গেলে প্রথমে একটু পিছিয়ে যেতে হবে, এই ধরে নাও ২০০৫-এ। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরে তখন কলকাতায় চাকরি খুঁজছি, থাকতাম লেকটাউনে। আমাদের লেকটাউনের ফ্ল্যাটটা তখন প্রায় বন্ধই পড়ে থাকত বলে সেখানে আস্তানা গেড়েছি। আর আমার ফ্ল্যাটের গলির ঠিক পাশের গলিতেই ছিল একটা মেসবাড়ি। আমার ছোটকাকার এক বন্ধুর মেস। তিনতলা বাড়ি, একতলা আর দোতলায় থাকত বোর্ডাররা, আর তিনতলায় মেসের মালিক। আমার বেশ কিছু বন্ধুও থাকত সেখানেই। তাদের মধ্যে কেউ চাকরি খুঁজছে, আর কেউবা সদ্য চাকরি পেয়েছে। সারাদিন সেক্টর ফাইভে জুতো রগড়ানোর পরে নিজের বাড়ি ফিরলে তো সেই একা একা ভূতের মতই থাকতে হত। তাই স্বভাবতই ফি সন্ধ্যেবেলায় আমি সেই মেসবাড়িতেই যেতাম আড্ডা মারতে। চা-সিগারেট মারতাম, প্রাণভরে সুখ-দুঃখের কথা হত। রাতের খাওয়াটাও প্রায়শয়ই সেখানেই সেরে ফিরতাম। প্রায় একবছর যাবৎ ওটাই ছিল আমার “সেকেণ্ড হোম”। আর সেই মেসের মধ্যমণি ছিল সবার সিনিয়র – বাপ্পাদা। আড্ডা, গান, রান্না, পার্টি, ঢ্যামনামি – যাই হোক না কেন, বাপ্পাদাকে ছাড়া কোন কিছুই ঠিকভাবে সম্পূর্ণ হত না। এখনও মনে আছে, যেদিন ক্যাট পরীক্ষার ফলপ্রকাশ হ’ল, সেদিন রাতে ওই মেসেই জমিয়ে পার্টি হয়েছিল। বাপ্পাদাই পার্টি দিয়েছিল। সারারাত ধরে সবাই মিলে হৈহুল্লোড় করেছিলাম, মেসের কাকুও ছিলেন। তারপরে তো এমবিএ পড়তে মুম্বাই বেরিয়ে গেলাম, সেখান থেকে চাকরি, তারপরে বিয়ে, পিএইচডি, আবার চাকরি – এক শহর থেকে অন্য শহর, এক জীবন থেকে অন্য জীবন। এইসবের চক্করে আস্তে আস্তে কলকাতায় যাওয়াটাও কমে গেল। সব বন্ধুরাও আস্তে আস্তে কলকাতা ছেড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, বাপ্পাদার সাথেও আর দেখা হত না। আর মেসবাড়ির স্মৃতিগুলোও আস্তে আস্তে মনে আলমারিতে যত্নে রাখা অ্যালবামের মত হয়েই রয়ে গেল।
তো এই সময়টার মধ্যে জীবন অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল। অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছি, অনেক ধাক্কা খেয়েছি। এই সবের মধ্যে বাড়ি আসাটার পথটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তারপরে তো একদিন ভরা কোভিডের বাজারে ধরায় আগমন করলেন আমার এই জুনিয়রটি। তখনই প্ল্যান করলাম, এই কোভিডের ধাক্কাটা কাটলে বাড়ি যেতেই হবে। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। তো বহু কাঠখড় পুড়িয়ে গেলবার পুজোতে বাড়ি গেলাম। তাও প্রায় পাক্কা ছ’বছর পরে, একেবারে ছেলেকে কোলে নিয়ে। তো বলাই বাহুল্য, মা-বাবা নাতিকে কাছে পেয়ে খুব খুশি। বাড়িতে তো প্রায় একেবারে উৎসবের মেজাজ। পুজোর ক’টা দিন বেশ হৈ-হৈ করেই কেটে গেল। ঘুরতে যাওয়া, খেতে যাওয়া – সব মিলিয়ে জম্পেশ কাটল পুজোটা।
তো পুজোর রাশটা একটু কেটে যেতেই আমার নবাবপুত্তুরের বাই উঠল – বিকেল হলেই ঘুম থেকে উঠে আমার পেটের উপরে লাফাতে লাফাতে বলা “বাবা, পাক্কে যাব।” ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বাড়ির পিছন দিকে একটু দূরেই একটা চিলড্রেন্স পার্ক আছে বলে জানি। অগত্যা কী আর করা, মক্কেলকে নিয়ে বেরোতেই হ’ল। সারা বিকেল ওর পিছনে ছুটে, ধুলো ঘেঁটে, ঘেমে নেয়ে একশা দশা। সন্ধ্যে হয়ে আসছে দেখে তাকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ সেই মেসবাড়িটার গলির সামনে এসে একবার থমকে দাঁড়ালাম। কোত্থেকে সব পুরনো স্মৃতিগুলো ভিড় করে আসতে লাগল। চেনা রাস্তা, বাড়ির এত কাছে, তবুও যেন কত দূরে। মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন আসল, ‘এখনও কি কেউ ওখানে থাকে?’, ‘পুরনো আড্ডার ঠেকটা কি আগের মত আছে?’ এইসব ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে মেসবাড়িটার দিকে এগোলাম। মনে হ’ল, ঠিক যেন অন্য একটা টাইম জোনের মধ্যে প্রবেশ করছি। সময়টা পিছিয়ে গিয়েছে প্রায় ষোল বছর, কানের মধ্যে চেনা আওয়াজ, চোখের সামনে চেনা মুখগুলো এক এক করে ভেসে উঠতে লাগল। পায়ে পায়ে এসে পৌঁছলাম আমার সেই স্মৃতিঘেরা মেসবাড়ির সামনে। এতবছরে বাড়িটার বহিরঙ্গে কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে চেনা আস্তানা চিনে নিতে কোন অসুবিধে হ’ল না। গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। বুকটা উত্তেজনার বশে একটু দুরুদুরু করছে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে আমাদের সেই চেনা পুরনো ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে একটা টোকা দিলাম দরজায়। কয়েক সেকেণ্ড পরেই একটা পনের-ষোল বছরের বাচ্চা মেয়ে এসে দরজা খুলল। দরজায় অচেনা লোক দেখে আমাকে আপাদমস্তক জরিপ করে বেশ সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, “কাকে চাই?”
আমিও একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। বুঝলাম যে মেসের পুরনো বাসিন্দারা এখন আর কেউ এখানে থাকে না। তবে এই মেসের সবচেয়ে পুরনো বোর্ডার, মানে বাপ্পাদার কথা কি এই মেয়েটা জানতে পারে? এই ভেবেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “আচ্ছা, এখানে তো আগে একটা মেসবাড়ি ছিল, তাই না?”
“হ্যাঁ, কেন?” মেয়েটা একইরকমভাবে ভ্রূ কুঁচকে সন্দিগ্ধগলায় উত্তর দিল।
“সেখানে বাপ্পাদা বলে একজন থাকতেন। তুমি জান উনি এখন কোথায় থাকেন?”
“না, জানি না। আপনি ওনাকে খুঁজছেন কেন?” মেয়েটা একটু অসন্তোষের সাথে উত্তরটা দিল।
“আমি তো কলকাতায় থাকি না। তাছাড়া ওনার সাথে অনেকদিন দেখা বা কথা হয়নি। ওনার ফোন নম্বরটাও আমার কাছে নেই। যেহেতু উনি আগে এখানেই থাকতেন, তাই ভাবলাম উনি যাওয়ার আগে যদি ওনার নতুন ঠিকানাটা তোমাদের দিয়ে যান।”
“আমার কাছে নেই।” মেয়েটা সেই একভাবেই বলল।
আমি মাথাটা যথাসাধ্য ঠাণ্ডা রেখে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “বাড়িতে যদি বড় কেউ থাকে, তাঁদের একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো না, প্লিজ। একটা কাজের ব্যাপারে ওনার সাথে দরকার আছে। প্লিজ, একটু জিজ্ঞাসা করে দেখোই না।”
মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা, দেখছি।”
এই কথাটা বলার পরে মেয়েটা যে কান্ডটা করল, সেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েটা ঘরের ভিতর দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে বলল, “দাদু, একটা দাড়িওয়ালা লোক এসেছে বারমুডা পরে, কোলে বাচ্চা নিয়ে। আগে এখানে মেসে কাজ করত, এখন আবার কাজ খুঁজতে এসেছে।”
মনে আছে, ফরেস্ট গাম্প সিনেমাতে টম হ্যাঙ্কস কী বলেছিলেন? “Life is like a box of chocolates”। কিন্তু সেই টম বুড়োর চকলেট যে আমার পিছনে বুড়িমার চকলেট বোম হয়ে ফাটবে, তা তো স্রিপ্টে কোথাও লেখা ছিল না। এর চেয়ে যদি বলত সিঙ্গুরে টাটার ফ্যাক্টরি খুলে গিয়েছে, তাহলেও হয়ত এতটা চমকাতাম না। আমি হাঁ, মানে একেবারে বেবাক ঢ্যাঁড়শ চচ্চড়ির মত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বলে কী! আমি মেসে কাজ খুঁজতে এসেছি! একবার ভাবলাম বলি, “আমি অর্থনীতির অধ্যাপক”। কিন্তু পরের মুহূর্তেই খেয়াল পড়ল যে আমার ঘামে ভেজা শার্টের উপরে পার্কের ফ্রেশ ধুলোর রঙ্গোলী, মুখে ক্যাপ্টেন হ্যাডক-মার্কা দাড়ি, আর পরণে একটা হাফ লুঙি-মার্কা ঢোলা বারমুডা। এইরকম কিম্ভূতকিমাকার চেহারায় ওই কথাগুলো বললে আর কিছু না হোক, হয় চূড়ান্ত খিল্লি হয়ে যেতে পারে, নাহলে ছেলেধরা ভেবে কান ধরে পুলিশে নিয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে মেসবাড়ির পুরাতন ভৃত্য হয়ে থাকাটাই আপাতত সম্মানজনক। আমি আড়চোখে একবার কোলে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে ধুলোকাদা মাখা নিষ্পাপ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ফোকলা হাসি হাসছে, কি যে বুঝেছে সেই জানে। হয়ত মনে মনে বলছিল, “কেমন আছো বাওয়া?” আমি আর দাদুর অপেক্ষা না করে সেখান থেকে সটান হাওয়া, আর জিন্দেগিতে ওই চত্বর মাড়াইনি।
এই অবধি বলে চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিলাম। সান্যালদা এবারে মুখ খুলল। “তা বলে শেষ অবধি মেসের চাকর বানিয়ে দিল?” বলে হো-হো করে হেসে উঠল।
“তোমার তো প্রেস্টিজ নিয়ে একেবারে চু-কিৎ-কিৎ খেলেছে হে,” বলে অন্য অধ্যাপকও হেসে উঠলেন।
“তার মানে মেসে গিয়ে কেস খেলে বলতে চাইছ?” সান্যালদা হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল।
“কোথায় মাইরি একটু সান্ত্বনা দেবে, পাশে দাঁড়াবে, তা না করে –”
আমাকে শেষ করতে না দিয়েই সান্যালদা বলল, “পাশে দাঁড়াতে হবে? কেন, তুমি বাংলা সিনেমা নাকি?”
“বাংলা সিনেমাই তো,” বলে অন্য অধ্যাপকটি হাসতে হাসতে বললেন, “বাবা কেন চাকর।”
ইতিমধ্যে আমার প্যাণ্টে আবার টান। আমার ক্ষুদ্র সংস্করণটি খেলা শেষ করে আমার কাছে এসে হাঁটু জড়িয়ে ধরে আব্দারের সাথে নিজের দাবি রাখল, “বাবা, কিতমিত খাব।”
সান্যালদা অন্যদিক থেকে হাসতে হাসতে বলে উঠল, “তোর বাবার কাছে কিশমিশ নেই রে বাবু, কেস মেস আছে।”
সেই শুনে আমার জুনিয়রটি আমার কোলের মধ্যে ঢুকে হাসিমুখে বলে উঠল, “বাবা, কেত মেত খাব।”
শুনে আমরা তিনজনেই হো-হো করে হেসে উঠলাম।
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
খুব মজার। উপভোগ করলাম😊👍
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে রুমাদি 😊😊😊