লেখক : অভি সেখ
(চতুর্থ পর্ব)
অরিন্দমের চোখ খুলতে সময় লাগল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। চারপাশে ভেজা, ঠাণ্ডা একটা গন্ধ। সে নড়তে গেল, কিন্তু হাত-পা দুর্বল হয়ে আছে। তারপর সে বুঝতে পারল, সে এখন একটা ছোট্ট, অন্ধকার, ভেজা জেলখানার ভিতরে! সামনে শুধু মোটা লোহার শিক। মেঝেতে শ্যাওলা জমে আছে, স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। পাশেই শত শত এমন ছোট্ট জেলখানা। সবগুলো তালাবন্ধ, ভিতরে কিছু ছায়া নড়ছে, কিছু গলা শোনা যাচ্ছে, ফিসফিসানি, কান্না, কাশির শব্দ।
জেলের ওপারে বিশাল একটা হলঘর। একটা নির্জন, পচা, ভিজে জেলখানার হল। আর হলঘরের ঠিক সামনে আরও সারি সারি লোহার খাঁচা, গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। এ যেন হাসপাতালের নিচে লুকিয়ে থাকা এক ভয়ঙ্কর কারাগার! অরিন্দম ঢোক গিলল।
এটা কি আদৌ হাসপাতাল? নাকি এটা আসলে একটা জেল? সে কি শুধু ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছে? নাকি এতক্ষণ যা দেখেছে, তা ছিল শুধু উপরিভাগ? আসল সত্য লুকিয়ে আছে এখানে, এই অন্ধকার কারাগারে? তার সামনে থাকা ছায়াগুলো ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করল। কেউ কি এগিয়ে আসছে? হঠাৎই অন্ধকারের মধ্যে একটা দৌড়নোর শব্দ! অরিন্দম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখল—একজন রোগা, কঙ্কালসার পাগল ধপধপ করে ছুটে আসছে! তার শরীরে ছেঁড়া হাসপাতালের পোশাক, চোখ দু’টো একদম খোঁচা খোঁচা, যেন কত রাত ঘুমায়নি। তার চামড়া এত শুকনো যে হাড় বেরিয়ে এসেছে, ঠোঁট ফাটা, চোখের কোণে আতঙ্ক জমে আছে। পাগলটা ছুটতে ছুটতে এসে অরিন্দমের জেলের দরজা খুলে দিল!
“পালাও! পালাও! সে আসছে! সে আসছে!”
তারপর দৌড় দিল অন্ধকার করিডরের দিকে! পাগলটার চিৎকার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
“সে আসছে… সে আসছে…!”
একটা গা ছমছমে শীতল বাতাস বয়ে গেল। অরিন্দম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন—
“কে আসছে?”
অন্ধকারের ভিতর কিছু কি নড়ল? কোন এক ভয়ঙ্কর কিছু তার দিকেই এগিয়ে আসছে… এখনই পালাতে হবে! হঠাৎ পুরো কারাগারটা যেন কেঁপে উঠল!
“গরররররররর!”
একটা বিকট গর্জন! মেটালের ওপর ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার বিকট শব্দ! তারপর… চিৎকার! পাশের জেলখানা থেকে রোগীদের আতঙ্কিত আর্তনাদ ভেসে এল। অরিন্দম দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল, আর ঠিক তখনই, দূরে, কারাগারের হলঘরের শেষ মাথায়… একটা বিশাল দানব দাঁড়িয়ে আছে! সেই দানব! হাসপাতালের রিসেপশনের সেই মিউট্যান্ট! এখন সে কারাগারের ভিতরে এসেছে, আর সে মরণ হোলি খেলছে! মিউট্যান্টটা বিশাল লোহার শিক ধরে এক ধাক্কায় ছিঁড়ে ফেলল! ভিতরে থাকা এক রোগী পালানোর চেষ্টা করছিল…
“গড়গড়গড়!”
দানবটা এক ঝটকায় তার গলা চেপে ধরল! লোকটা ছটফট করছে, হাত-পা ছুঁড়ছে, তার চোখে ভয়ের শেষ ছাপ!
“চ্যাঁআআআআহ!”
এক মুহূর্তের মধ্যে মিউট্যান্টটা লোকটাকে ছুঁড়ে মারল! তার শরীর ধাক্কা খেয়ে করিডরের শেষ মাথায় গিয়ে আছড়ে পড়ল। টুকরো হয়ে গেল, রক্তে গোটা মেঝে ভিজে গেল। আরেকটা জেল থেকে কিছু রোগী বেরিয়ে দৌড় দিল। কেউ হাঁটতে পারছে না, কেউ হামাগুড়ি দিয়ে পালাচ্ছে। কিন্তু মিউট্যান্টটা ওদের লক্ষ্য করে তেড়ে এল! তার বিশাল হাত দিয়ে একটা লোকের মাথা ধরে তুলে নিল, চোখের সামনে শক্ত হাতে মাথা ছিঁড়ে ফেলল!
“চপ!”
রক্তের ঝাপটা গিয়ে অরিন্দমের গায়ে পড়ল! অরিন্দম শিউরে উঠল! মিউট্যান্টটা একটা বিশাল ধাতব রড তুলল মাটির ওপর থেকে। এক পাগল ডাক্তার পালানোর চেষ্টা করছিল। সে দৌড়চ্ছিল, কিন্তু…
“শাঁআআআআ!”
মিউট্যান্টটা সেই রড ছুড়ে দিল! রড গিয়ে লোকটার পেটের ভিতর ঢুকে গেল। লোকটা ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, শরীর কাঁপছে, তারপর নিথর হয়ে গেল। পুরো কারাগারে শুধু মৃত্যু! যেদিকেই তাকানো যায়, শুধু রক্ত, ছিন্নভিন্ন শরীরের টুকরো। মিউট্যান্টটা এক এক করে সবাইকে মেরে ফেলছে, কেউ পালাতে পারছে না। আর…
এখন তার চোখ অরিন্দমের দিকে! সে ধীরে ধীরে অরিন্দমের দিকে এগিয়ে আসছে। তার শক্তিশালী হাত রক্তে ভিজে আছে। অরিন্দমের সামনে মাত্র একটাই রাস্তা… পালাতে হবে! মিউট্যান্টটা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। অরিন্দম পিছোতে পারছে না। আর কোন পথ নেই! তার পিঠ ধাক্কা খেল দেওয়ালে। চোখের সামনে মিউট্যান্টের বিশাল হাত উঠল—শেষ! এইবার সে মরবে! ঠিক তখনই…
একটা অদ্ভুত শব্দ!
“শ্রীইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই!!”
একটা তীক্ষ্ণ, প্রচণ্ড উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ করিডরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল! মিউট্যান্টটা এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার বিশাল শরীর কেঁপে উঠল! সে মাথা ধরে চিৎকার করতে লাগল! তার কানের পাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে! সে মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগল! স্পিকারে একটা কর্কশ গলা শোনা গেল।
“ডানদিকে তাকাও, একটা মই আছে! শিগগিরই নিচে নামো! আমি ওখানে অপেক্ষা করছি!”
বৃদ্ধ! অরিন্দম মুহূর্তে তাকাল। সত্যিই তো! একটা জং ধরা লোহার মই! অরিন্দম দেরি করল না। মিউট্যান্টের করুণ চিৎকার উপেক্ষা করে সে মই ধরে ঝুলে পড়ল। নিচে তাকাল—ঘন অন্ধকার! কত নিচে নামতে হবে, কে জানে। কিন্তু পিছনে ফিরে দেখার উপায় নেই। সে নিঃশ্বাস চেপে ধরে নিচের দিকে নামতে লাগল। পিছনে থেকে এখনও শোনা যাচ্ছে মিউট্যান্টের ছটফটানি, তার নখের আঁচড় দেওয়ালের ওপর…
“গরররররররর!”
কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ভয়ানক আওয়াজ মিলিয়ে যেতে লাগল। অন্ধকারের অতল গহ্বরে নেমে যাচ্ছে অরিন্দম। সে কি এবার সত্যিই নিরাপদ?
অরিন্দম মই বেয়ে নেমে এল। পা মাটি ছোঁয়া মাত্রই একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে উঠল। এই জায়গাটা একেবারে আলাদা। এতক্ষণ ধরে যে হাসপাতালের পচা-গলা দেওয়াল, রক্তে ভেজা মেঝে, বিকৃত চিৎকারে গমগম করছিল, এখানে তার ছিটেফোঁটাও নেই। এই জায়গাটা যেন সম্পূর্ণ অন্য জগত! এখানে কোন দুর্গন্ধ নেই, কোন ছেঁড়া শরীরের অংশ নেই, কোন বিকৃত রোগীর আর্তনাদ নেই। এখানে শুধু নীরবতা। এক অস্বাভাবিক, কৃত্রিম নীরবতা। অরিন্দম ধীরে ধীরে সামনে এগোল।
চারপাশে বিশাল বিশাল কাচের ঘর। তার মধ্যে চকচকে স্টেইনলেস স্টিলের টেবিল, অত্যাধুনিক কম্পিউটার, বিশাল বিশাল স্ক্রিনে জটিল সায়ন্টিফিক ডেটা ভেসে বেড়াচ্ছে। ল্যাবের প্রতিটি দেওয়াল সাদা, একদম ধবধবে সাদা, যেন এক ফোঁটা ময়লা পড়লেই কেউ এসে পরিষ্কার করে দেবে। মেঝেতে এক ধরনের স্বচ্ছ, পালিশ করা মার্বেলের মতো কিছু বিছানো, যার ওপরে পা রাখলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। কোথাও একটা দাগও নেই। এখানে আসার আগে পর্যন্ত এই হাসপাতালের প্রতিটি করিডর ছিল মৃত্যুর গন্ধে ভরা। কিন্তু এখানে যেন সবকিছু একদম নির্বিকার, শীতল, নিষ্পাপ। অরিন্দম ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল। এখানে কোন জানালা নেই। কোন দরজাও চোখে পড়ছে না। শুধু বিশাল বিশাল স্বচ্ছ কাঁচের পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা ঘর, যার প্রতিটা ঘরের ভিতরে বসে আছে কেউ কেউ— কিন্তু তারা কি মানুষ?
অরিন্দম একটা ঘরের সামনে থামল। ভিতরে বসে আছে একজন, সে একদম স্থির। নড়ছে না। তার শরীরের গঠন স্বাভাবিক মানুষের মত, কিন্তু তার চামড়া খুবই বেশি মসৃণ, একটা প্লাস্টিকের পুতুলের মতই নিখুঁত। তার চোখদু’টো কৃত্রিম, যেন কোন যন্ত্র বসানো হয়েছে। এটা কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু? তার ঠিক পাশের ঘরে আরেকটি মানুষকে দেখা গেল। না, মানুষ বলা ঠিক হবে না। তার হাতের জায়গায় বিশাল লৌহনির্মিত কাঁটা লাগানো ব্লেড! তার গায়ের চামড়া সাদা পোড়ামাটির মতো শক্ত। সে ধীরে ধীরে অরিন্দমের দিকে তাকাল। তার চোখে কোন আবেগ নেই, শুধু একটা শূন্যতা।
“তুমি এসেছ?”
হঠাৎ পিছন থেকে শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর। অরিন্দম ধাক্কা খেল। সে তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াল। সামনে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধ! কিন্তু এবার তাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে, তার চোখের গভীরে কিছু একটা লুকনো—একটা ভয়ঙ্কর সত্য, যা সে বলতে চায়, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। অরিন্দম জানে, এই বৃদ্ধ তার জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু এখানে সে কেন নিয়ে এসেছে? এটা কী জায়গা? কী হচ্ছে এখানে? এই সাদা, ঝকঝকে, পরিষ্কার ল্যাবরেটরির আড়ালে লুকিয়ে আছে সবচেয়ে অন্ধকার সত্য।
“চলো আমার সঙ্গে,” বৃদ্ধ বলল।
তার কণ্ঠস্বর নিচু, ভারী, যেন দীর্ঘদিনের ক্লান্তি মিশে আছে তাতে। অরিন্দম কিছু না বলে তার পিছু নিল। বৃদ্ধ এগিয়ে চলল হাসপাতালের এই রহস্যময়, ঝকঝকে ল্যাবের মধ্যে দিয়ে। চারপাশের কাচের ঘরগুলোর ভিতর দিয়ে তারা হেঁটে চলল। অরিন্দম দেখল প্রতিটি ঘরের ভিতরেই অদ্ভুত সব মানুষ। কেউ যেন অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক মাংসপিণ্ড। কারও গায়ের চামড়া সম্পূর্ণ উঠে গেছে, তবু সে দিব্যি বেঁচে আছে। কারও মাথার খুলির অর্ধেক জায়গা কেটে খুলে ফেলা হয়েছে, আর সেখানে বসানো হয়েছে ইলেকট্রনিক চিপ। এই জায়গাটা যতই পরিষ্কার আর ঝকঝকে হোক না কেন…
“তুমি কে?” অরিন্দম শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করল।
বৃদ্ধ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমার নাম অনিরুদ্ধ সেন। আমি এই হাসপাতালের একজন কর্মচারী।” তার কণ্ঠস্বরে একটা চাপা যন্ত্রণা ছিল। “আমি এখানে বাধ্য হয়ে আছি।”
অরিন্দম তাকিয়ে রইল তার দিকে। “মানে?”
“মানে, এখানে যা কিছু ঘটছে, তার অংশ আমি হতে চাইনি।”
তারা একটা ছোট্ট কাচের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ একটা আইডি কার্ড বের করে স্ক্যান করল। দরজাটা একটা হালকা শোঁ-শোঁ শব্দ করে খুলে গেল। ভিতরে একটা ছোট্ট কক্ষ। কিন্তু অন্য সব জায়গার মতো পরিষ্কার, ঝকঝকে নয়। এখানে অন্ধকারে কিছু সরঞ্জাম পড়ে আছে। একটা ডেস্কের ওপর পুরনো কিছু কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। একপাশে একটা কম্পিউটার, তবে সেটা বন্ধ। অরিন্দম বুঝতে পারল এই কক্ষটা কোন অফিস নয়, এটা যেন কারও লুকিয়ে থাকার জায়গা। বৃদ্ধ ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর ধীরে ধীরে একটা চেয়ারে বসে একটা গভীর শ্বাস নিল।
“তুমি এখানে কেন আর কী কী জানো এই জায়গার ব্যাপারে ?”
অরিন্দম বলল, “আমি শুধু জানি, এই হাসপাতাল একটা ভয়ঙ্কর জায়গা। এবং এখানে জেলের আসামীদের নিয়ে কিছু ভয়ানক এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে।”
বৃদ্ধ একটু হাসল, তিক্ত এক হাসি। “তুমি যা জানো, তা মাত্র এক কণা। সত্যিটা আরও ভয়ঙ্কর।”
অরিন্দম কিছু বলার আগে বৃদ্ধ বলল, “এই পুরো হাসপাতালটা আসলে একটা সুপার প্রোজেক্টের অংশ।”
“সুপার সোলজার?”
“হ্যাঁ। এখানে আসামীদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে, যাতে তাদের অতিমানবীয় শক্তি দেওয়া যায়। সরকার চাইছে এমন এক আর্মি তৈরি করতে, যারা সাধারণ মানুষের মত নয়—তারা হবে শক্তিশালী এবং আদেশ পালন করার জন্য একদম নিখুঁত।”
অরিন্দম শিউরে উঠল। বৃদ্ধ এবার চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। “তুমি জানতে চাও কেন আমি এখানে?”
অরিন্দম মাথা নাড়ল।
“আমি একসময় এই হাসপাতালের প্রধান গবেষকদের একজন ছিলাম,” বৃদ্ধ বলল। “আমি এখানে যোগ দিয়েছিলাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম, এই গবেষণার মাধ্যমে মানবজাতির উপকার হবে। কিন্তু প্রায় আট মাস এখানে থাকার পর বুঝতে পারলাম, এটা একটা ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরী। তারা মানুষকে মেরে ফেলছে, তাদের শরীরে ভয়ঙ্কর সব পরীক্ষা চালাচ্ছে। আর যারা বেঁচে থাকছে, তারা… তারা আর মানুষ থাকছে না।”
অরিন্দম শুনতে শুনতে অনুভব করল, তার গলা শুকিয়ে গেছে। “তুমি এখানে কাজ করা চালিয়ে গেলে কেন?”
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “কারণ আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি। আমি পালানোর চেষ্টা করেছিলাম একবার,” বৃদ্ধ বলল, “কিন্তু তখনই বুঝলাম, এই হাসপাতাল আসলে একটা খাঁচা। কেউ একবার ঢুকলে, তাকে আর বের হতে দেওয়া হয় না। তারা আমার পরিবারকে হুমকি দিল। আমাকে বলে দেওয়া হ’ল—যদি আমি পালানোর চেষ্টা করি, তবে আমার স্ত্রী আর ছেলেকে খুন করা হবে।”
অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে গেল। “তুমি কি সত্যিই আমাকে সাহায্য করতে চাও?” অরিন্দম জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধ চুপচাপ তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি চাই, তুমি এখান থেকে বের হও, এবং সত্যিটা প্রকাশ করো। তারই সাথে এই ফাইলটা রাখো। এখানে COVID19 সংক্রান্ত কিছু তথ্য আছে। এখানে কী ঘটছে, তা সবার জানা দরকার। কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
বৃদ্ধ এবার তার গলায় চাপা ভয় এনে বলল, “বের হওয়া অত সহজ নয়। কারণ এখানে একজন আছে, যে আমাদের ছাড়বে না।”
“একজন?”
“হ্যাঁ। সে এই হাসপাতালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র।”
“কে সে?”
বৃদ্ধ নিচু স্বরে বলল, “জাগরণ।”
অরিন্দম কেঁপে উঠল। “জাগরণ? সে কে?”
বৃদ্ধ আর কিছু বলল না। শুধু বাইরে তাকিয়ে রইল, যেন মনে মনে কিছু একটা হিসাব কষছে।
“এসো আমার সাথে,” বৃদ্ধ বলল।
অরিন্দম ধীরে ধীরে বিশেষ কক্ষের আরও গভীরে এগিয়ে গেল। ভিতরে আলো অনেক ম্লান। এখানকার পরিবেশ পুরো ল্যাবের মতো ঝকঝকে নয়। দেওয়ালজুড়ে অসংখ্য মনিটর, তার, এবং অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি সাজানো। কিন্তু কক্ষের একদম কেন্দ্রে যা ছিল, তা দেখে অরিন্দমের শ্বাস আটকে গেল। একটা বিশাল কাচের গোল বল, দেখতে যেন কোন বিশাল ইনকিউবেটরের মত। তার ভিতরে একটা তরল সবুজ রাসায়নিক। আর সেই তরলের ভিতরেই ঘুমিয়ে আছে এক কিশোর। তার চোখ বন্ধ, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। তার শরীরে অসংখ্য তার ও সুচ লাগানো, যা ইনকিউবেটরের বাইরে থাকা নানা যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত। সে যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। না, শুধুই ঘুম নয়, এ যেন এক নির্বাক কারাবাস। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল। তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল, যেন কোন অবর্ণনীয় কষ্ট তাকে গ্রাস করেছে।
“এটা আমার ছেলে।”
অরিন্দম বিস্ময়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাল। বৃদ্ধের চোখে ছিল এক অপার যন্ত্রণা। “আমি ওকে এনেছিলাম ওর চিকিৎসা করাতে। কিন্তু ওরা ওকে নিয়ে এসব ভয়ঙ্কর পরীক্ষা চালিয়েছে।” বৃদ্ধ হাত দিয়ে কাচের গায়ে স্পর্শ করল। তার হাত কাঁপছিল। “ওর নাম হ’ল ঈশান। ছোটবেলা থেকেই খুব দুর্বল ছিল, বিরল এক রোগে ভুগত। ডাক্তারেরা বলেছিল, ষোল বছর বয়সের মধ্যেই ও মারা যাবে, এই রোগের কোন ট্রিটমেন্ট নেই। আমি এখানে চাকরি পেয়ে যখন জানতে পারলাম এই হাসপাতালে উন্নত গবেষণা হচ্ছে, ভাবলাম হয়ত ওর জীবনটা বাঁচাতে পারব। কিন্তু… কিন্তু আমি জানতাম না, এটা একটা ফাঁদ।”
অরিন্দম অনুভব করল, তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। “ওরা কী করল ওর সাথে?”
বৃদ্ধ মাথা নিচু করল। “ওরা ওর মস্তিষ্কের সাথে এক ভয়ঙ্কর এক্সপেরিমেন্ট চালায়। ওর consciousness কে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ওকে পরিণত করে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্রে। বাইরের যে দানবটাকে তুমি দেখেছ, সে আর কেউ নয়, সেই ঈশান।”
অরিন্দমের মনে ভেসে উঠল সেই ভয়ঙ্কর দানবের ছবি—যে তার সামনে পড়েছে, তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। তার শক্তি অমানবিক, সে যেন এক নির্বিচার হত্যাযন্ত্র। তবে ঈশানের আসল শরীর এখানে কাচের ভিতর বন্দী কেন? যদি সে এখানে ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে… অরিন্দম কিছু বুঝে উঠতে পারল না। বৃদ্ধ বলে চলল, “ওর শরীর এখানে বন্দী। কিন্তু ওর মন… সেটাকে ওরা এক ভয়ঙ্কর অস্ত্রে পরিণত করেছে।” বৃদ্ধের গলা কাঁপছিল। “ঈশান পুরো হাসপাতালের সর্বোচ্চ হাতিয়ার। ওর চেতনা দখল করে ওকে এক ভয়ঙ্কর জীব বানানো হয়েছে। ও যা করছে, তা ও নিজে করে না, কিন্তু ওর নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ও এখন একটা consciousness-based bio-weapon।”
অরিন্দম শিউরে উঠল। “আমরা কি ওকে মুক্ত করতে পারি?”
বৃদ্ধ মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সেটাই আমার শেষ লক্ষ্য। তার জন্য ঈশানের লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করতে হবে। এই কিশোর, যে এখনও কাচের ভিতরে ঘুমিয়ে আছে, যার শরীর এক জীবন্ত কফিনের মতো পড়ে আছে, তাকে মেরে ফেলতে হবে, যাতে সেই দানব আর কাউকে হত্যা করতে না পারে।”
“তুমি কি জানো এটা কত ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত?” অরিন্দম বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল।
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “জানি। কিন্তু আমি একজন বাবা, আমি জানি আমার ছেলেকে আমি আর কোনদিন ফেরত পাব না। ওরা যা করেছে, তাতে ঈশান আর ফিরতে পারবে না।”
অরিন্দম চোখ বন্ধ করল। তার মনে ভেসে উঠল হাসপাতালের করিডোরের সেই বিভীষিকা—লোহার গন্ধ, রক্তাক্ত মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন শরীর, আর সেই ভয়ঙ্কর ছায়া, যা একের পর এক মানুষকে হত্যা করছিল।
“কিন্তু কীভাবে?”
বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াল। তার চোখে এক রকমের স্থিরতা, যেন সে বহু আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল।
“তুমি যদি সত্যিই এই হাসপাতাল থেকে বাঁচতে চাও, তাহলে আমাকে সাহায্য করতে হবে।”
“তোমার প্ল্যান কী?”
বৃদ্ধ মৃদু বলল। “ওর শরীর এক বিশেষ কেমিক্যাল ট্যাঙ্কে বন্দী। যদি আমরা সেই কেমিক্যালের রাসায়নিক পরিবর্তন করি, তাহলে ওর শরীর আর বাঁচবে না। এটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাদের হাসপাতালের মূল সার্ভার রুমে যেতে হবে। সেখানে গেলে আমরা ওর শরীরের লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করতে পারব।”
অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আচ্ছা, তাহলে আমাদের দেরি করা উচিত না।”
“তবে মনে রেখো, এটা সহজ হবে না।” বৃদ্ধ কাঁধের নিচে রাখা একটা ছোট ব্যাগ থেকে একটা কম্প্যাক্ট ডিভাইস বের করল। “এই ডিভাইস দিয়ে আমি সিস্টেম ব্রেক করতে পারব, কিন্তু আমাদের সময় খুব কম। ঈশানের দানবিক রূপ বুঝতে পারবে, যে আমরা ওর বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করছি। আর তখনই নরক নেমে আসবে।”
অরিন্দম আর বৃদ্ধ দ্রুত ল্যাব থেকে বেরিয়ে করিডোরের দিকে এগোল। চারদিকে নিঃস্তব্ধতা।
“হাসপাতালের সার্ভার রুম কোথায়?”
“তৃতীয় তলায়।”
“কীভাবে যাব?”
বৃদ্ধ পকেট থেকে একটা পুরনো হাসপাতালের ব্লুপ্রিন্ট বের করল। “এই পথে গেলে আমরা দ্রুত পৌঁছাতে পারব, কিন্তু সমস্যা একটাই।”
“কী?”
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বলল, “এই করিডর দিয়ে যাওয়ার মানেই হ’ল দানবের নজরদারির মধ্যে দিয়ে যাওয়া।”
অরিন্দমের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। যদি সেই দানব টের পায়, তাহলে সকল পরিকল্পনা এখানেই শেষ।
“তাহলে আমাদের খুব শান্তভাবে এবং দ্রুত যেতে হবে। একটা ভুল, আর আমরা শেষ।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। “তাহলে চলো, মৃত্যুর মুখে হাঁটা শুরু করা যাক।”
লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
সঙ্গীতচর্চা করতে ভালবাসেন। গান লেখা, তার সুর দেওয়া, এবং নিজে গাওয়া এর মধ্যেই মনের তৃপ্তি খুঁজে পান। এর সাথে রং-তুলির সাথে নির্জীব কাগজের প্রেক্ষাপটে প্রাণসঞ্চার করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান।