লেখক : অভি সেখ
(অন্তিম পর্ব)
তারা দু’জন নিঃশব্দে করিডরের দিকে এগিয়ে গেল, আর তার সাথে সাথে, নরকের দরজাও খুলতে শুরু করল। অরিন্দম আর বৃদ্ধ নিঃশব্দে লিফ্টের দরজা খুলতে দেখল, তারা তৃতীয় তলায় পৌঁছেছে। কিন্তু দরজা পুরোপুরি খুলতেই তারা যা দেখল, তাতে শরীর হিম হয়ে গেল। সামনে পুরো করিডর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র আর্মি ইউনিট। তারা হাসপাতালের চারপাশে ঘিরে রেখেছে, যেন এই জায়গাটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র। কিছু সৈন্য ব্যস্ত হয়ে হাসপাতালের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কি যেন নির্দেশ নিচ্ছিল। আর কয়েকজন স্ট্রেচারে কিছু একটা রাখছিল। অরিন্দম ও বৃদ্ধ চোখ সরু করে তাকিয়ে বুঝতে পারল, ওটা সেই উন্মাদ ডাক্তার। তার শরীর একেবারে বিকৃত, তার মুখে অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ, যেন মরে গিয়েও সে ভয় পেয়ে আছে।
“এরা এখানে কী করছে?” বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল।
অরিন্দম চোখ ঘুরিয়ে দেখল, কিছু সৈন্য করিডরে টহল দিচ্ছে। তারা কথা বলছে—
“উপর থেকে নির্দেশ এসেছে, সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করতে হবে।”
অরিন্দমের মনে আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল। “ওরা হয়ত পুরো হাসপাতাল উড়িয়ে দিতে এসেছে!”
বৃদ্ধের মুখ কঠিন হয়ে উঠল। “আমাদের দ্রুত সার্ভার রুমে যেতে হবে। যদি আমরা দেরি করি, তাহলে কিছুই বাঁচবে না!”
“কিন্তু এত আর্মির মাঝ দিয়ে যাব কীভাবে?”
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর নিচু গলায় বলল, “ওদের ফাঁকি দিতে হবে। এখানে লুকিয়ে থাকার সময় নেই।”
অরিন্দম করিডরের বাঁদিকে তাকাল, সেখানে একটা কাচের দরজা দেখা যাচ্ছে, যেটা একটা পুরনো স্টোররুমের। “ওখানে ঢুকে পাশ কাটানো যাবে?”
“হতে পারে, কিন্তু আমাদের খুব সাবধানে যেতে হবে।”
তারা নিঃশব্দে লিফ্টের পাশ থেকে বেরিয়ে একজন সৈন্যের গতির দিকে লক্ষ্য রেখে এগোল। যেই মুহূর্তে সে উল্টো দিকে ঘুরল, অরিন্দম আর বৃদ্ধ স্টোররুমের দিকে ছুটে গেল। কাচের দরজা আস্তে খুলে তারা ঢুকে গেল ভিতরে। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে দরজা লাগিয়ে দিল, যাতে শব্দ না হয়। তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে সৈন্যদের বুটের শব্দ ভেসে আসছে।
“এখান থেকে বেরিয়ে আমাদের করিডর পেরোতে হবে, তারপর ডানদিকে একটা জরুরি সিঁড়ি আছে। সেখান দিয়ে গেলেই আমরা সার্ভার রুমে পৌঁছতে পারব।”
অরিন্দম ধীরে মাথা নাড়ছে, কিন্তু তার ভিতরে অজানা একটা আশঙ্কা কাজ করছিল। কেন জানি মনে হচ্ছে, এই সৈন্যদের লক্ষ্য শুধুমাত্র প্রমাণ ধ্বংস করা নয়। তারা যেন কিছু একটা লুকোচ্ছে। কিন্তু কী সেটা? সেই দানব কি এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে? অরিন্দম আর বৃদ্ধ একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর দু’জনেই নিঃশব্দে এগিয়ে গেল।
সার্ভার রুমে পৌঁছনোর জন্য তাদের এখন মৃত্যুর ছায়ার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হবে। অরিন্দম আর বৃদ্ধ নিঃশব্দে স্টোররুম থেকে বেরিয়ে এল। পুরো করিডর জুড়ে আর্মির উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। তারা গা ঝুঁকিয়ে করিডরের কোণায় লুকিয়ে দেখল, সামনে একটা সৈন্যদল অস্ত্র হাতে ঘুরছে।
“আমাদের এখান থেকে ওদের ফাঁকি দিতে হবে,” বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল।
অরিন্দম জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, “কিন্তু কীভাবে?”
বৃদ্ধ পকেট থেকে একটা ছোট্ট ধাতব টুকরো বের করল। ধীরে ধীরে সেটাকে করিডরের উল্টোদিকে ছুঁড়ে মারল।
টংং…
শব্দ শুনে তিনজন সৈন্য চমকে উঠল। “ওদিকে কী?” তারা বন্দুক উঁচিয়ে শব্দের উৎসের দিকে গেল। অরিন্দম আর বৃদ্ধ নিঃশব্দে করিডরের পাশে লুকিয়ে তাদের সরে যাওয়ার অপেক্ষা করল। যে মুহূর্তে সৈন্যরা অন্যদিকে হাঁটল, দু’জনেই নিঃশব্দে দৌড়ে জরুরি সিঁড়ির দিকে ছুটল। ওদিকে অন্ধকার করিডরের আরেক প্রান্তে হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা গেল।
“গ্ররররাহহহ!”
সৈন্যদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।
“ওটা কী??”
ছায়ার ভিতর থেকে দানব আসছে… হত্যার জন্য।
“এখানে এস!”
বৃদ্ধ ইঙ্গিত করল জরুরি সিঁড়ির একটা গোপন দরজার দিকে। তারা দ্রুত দরজাটা খুলে ঢুকে গেল। হাতের কাছে একটা কন্ট্রোল বোর্ড ছিল, বৃদ্ধ সেটা টিপে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
“এখন শুধু সোজা নিচে নামলেই আমরা সার্ভার রুমে পৌঁছাতে পারব,” বৃদ্ধ বলল।
অরিন্দম মাথা নাড়ল, কিন্তু তার মন অন্যদিকে। পিছনে করিডরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে—
“না! না! গড প্লিজ—!”
একটা বিকট চিৎকার ভেসে এল, আর সাথে সাথে সৈন্যদের আর্তনাদে করিডর কেঁপে উঠল। অরিন্দম জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল, একটা সৈন্যের শরীরকে মাঝ বরাবর ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে সেই দানব! তার হাড়-মাংস চারপাশে ছিটকে পড়েছে, বাকি সৈন্যরা পিছন দিকে দৌড়চ্ছে, কিন্তু কেউই বাঁচতে পারছে না। কেউ পেট ফাটিয়ে পড়ে থাকছে, কেউ দেওয়ালে আছড়ে পড়ছে, কেউ দানবের লম্বা ধারালো নখে শরীর বিদীর্ণ হয়ে বাতাসে উড়ছে। এই নরকযজ্ঞের মাঝেই অরিন্দম আর বৃদ্ধ নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগল। তারা নিচের ফ্লোরে পৌঁছতে না পৌঁছতেই হঠাৎ কাচের জানালার ওপারে একটা বিকৃত চেহারার সৈন্যের মৃতদেহ আছড়ে পড়ল। তার চোখদু’টো বেরিয়ে এসেছে, বুকের খাঁচা পুরো ছিন্নভিন্ন। দানব এখন খুব কাছে। বৃদ্ধের মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল, “আমাদের দ্রুত চলতে হবে!”
অরিন্দম দ্রুত জানালার ওপার থেকে সরে গেল। সামনে সার্ভার রুমের দরজা দেখা যাচ্ছে। তারা দরজার সামনে পৌঁছল। বৃদ্ধ পাসকোড দিতে লাগল, কিন্তু তার হাত কাঁপছে। পিছনে করিডরে, সেই দানবের বিশাল ছায়া দেখা গেল, আর সাথে সৈন্যদের শেষ আর্তনাদ! দানব গর্জন করতে করতে সামনে এগিয়ে আসছে। সার্ভার রুমের দরজা এখনও খুলছে না।
“বিপ! বিপ! বিপ!” দরজার স্ক্রিনে ERROR দেখাচ্ছে!
অরিন্দম চিৎকার করে উঠল, “দ্রুত করো!”
দানব এখন একেবারে করিডরের মোড়ে। তার লাল জ্বলজ্বলে চোখদু’টো অন্ধকার চিরে তাকিয়ে আছে অরিন্দম আর বৃদ্ধের দিকে। হাতের বিশাল নখগুলো বাতাসে ঝুলছে, তার গায়ের চামড়ার নিচে মাংসপেশি কাঁপছে। বৃদ্ধ শেষবারের মত পাসকোড দিল।
“ক্লিক!”
দরজা খুলে গেল! দু’জনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ভিতরে। বৃদ্ধ এক ঝটকায় দরজাটা লাগিয়ে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই দানব দরজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিস্ফোরণের মত শব্দ হ’ল, পুরো দরজা কেঁপে উঠল। দানব বাইরে থেকে প্রচণ্ড জোরে দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। অরিন্দম আর বৃদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে পিছিয়ে গেল।
তারা অবশেষে সার্ভার রুমে প্রবেশ করেছে। এটাই পুরো প্রোজেক্টের মস্তিষ্ক। এই জায়গাটা ধ্বংস করতে পারলেই এই ভয়ঙ্কর হাসপাতালের অস্তিত্ব চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু, বাইরে দরজা ভেঙে ফেলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সেই দানব। এখন তারা এখানে ফেঁসে গিয়েছে। কোন পালানোর পথ নেই। অরিন্দম আর বৃদ্ধ এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করল না।
“ওটা কোথায়?” অরিন্দম হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
বৃদ্ধ দ্রুত হাতের স্ক্যানার বের করল, স্ক্রিনে লাল রঙে “LIFE SUPPORT SYSTEM – ACTIVE” ভেসে উঠল। “ওইখানে,” বৃদ্ধ একটা কাচের ঘরের দিকে ইঙ্গিত করল। ঘরটার ভিতরটা দেখা যাচ্ছে—একটা বিশাল কন্ট্রোল প্যানেল আর তার সাথে সংযুক্ত অনেকগুলো মোটা কেব্ল। কিন্তু প্রবেশপথের সামনে বায়োমেট্রিক লক। বাইরে, করিডরে দানবের পায়ের শব্দ একটা ভারী ঢেউয়ের মত এগিয়ে আসছে! ধাক্কা… ধাক্কা…
“শীঘ্রই ওটা বন্ধ করো!”
বৃদ্ধ দ্রুত তার হাত স্ক্যানারে রাখল।
“বিপ! বিপ! বিপ!” “ERROR – UNAUTHORIZED ACCESS”
“আমার অ্যাক্সেস বন্ধ করে দিয়েছে!” বৃদ্ধ চিৎকার করল। “অরিন্দম, ওই ডিভাইসটা মেইন কম্পিউটারে যুক্ত করে দাও।” অরিন্দম দ্রুত আশেপাশে তাকিয়ে দেখল—একটা সার্ভার টার্মিনাল। সে সেদিকে ছুটে গেল।
দানব এবার দরজার উপর আছড়ে পড়ল!
“গড়রর্রর্রহহহ!”
দরজা কেঁপে উঠল, ভিতরের বাতিগুলো একবার ঝলসে উঠল। অরিন্দম দ্রুত কম্যাণ্ড প্রম্পট চালু করল।
“LIFE SUPPORT ROOM – OVERRIDE ACTIVATED”
“কাজ হচ্ছে!”
বৃদ্ধ দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলল। ভিতরে লাইফ সাপোর্ট মেশিনের সামনে লাগানো বড় একতা মনিটরে তারা দেখল, একটা বিশাল টিউবের ভিতর কাঁপছে সবুজ তরল। তার ঠিক মাঝখানে ছোট্ট ছেলেটা এখনও অচেতন অবস্থায় ভাসছে। বৃদ্ধ ছুটে গিয়ে সেই মনিটরের গায়ে হাত রাখল। তার চোখ জলে ভরে গেল।
“আমার ছেলে…”
“এই প্রোজেক্ট বন্ধ করতে হ’লে,” অরিন্দম কঠিন কণ্ঠে বলল, “তোমায় ওকে বিদায় জানাতেই হবে।”
বৃদ্ধের মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে লাইফ সাপোর্টের কন্ট্রোল বোর্ডের সামনে দাঁড়াল। বাটনগুলো ঝলসে উঠছে—”TERMINATE LIFE SUPPORT?”
বাইর-দানব এখন দরজার ঠিক বাইরে! একবার… দু’বার…
“গড়রর্রর্রহহহ!”
দরজা ফাটতে শুরু করেছে! বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা হাতে স্ক্রিনের দিকে তাকাল।
“CONFIRM TERMINATION?”
তার আঙুল একবার থেমে গেল। অরিন্দম চিৎকার করল, “তাড়াতাড়ি করো!”
বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করল। গভীর একটা নিঃশ্বাস নিল। তারপর… সে চাপ দিল লাল বাটনে। এক সেকেণ্ডের জন্য সব কিছু থেমে গেল। তারপর…
“****WARNING! WARNING! SYSTEM FAILURE!****”
টিউবের সবুজ তরল আস্তে আস্তে লাল হয়ে গেল। ছেলেটার শরীর ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেল। তার চোখ কাঁপল, একটা ধূসর নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। তারপর সে থেমে গেল। বাইরে দানব যন্ত্রণায় গর্জন করে উঠল। তরলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই সে ছটফট করতে লাগল, তার মাংসপেশি মোচড়াতে লাগল, বিকৃত মুখের চোয়াল খুলে গেল, বিশাল দাঁত বেরিয়ে এল। সে হাত বাড়িয়ে কিছু ধরতে চাইল, তারপর এক ঝটকায় মেঝেতে আছড়ে পড়ল। তার শরীর কাঁপল, তারপর একেবারে নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল।
দানব মৃত। হাসপাতালের ভিতর দীর্ঘ নিঃস্তব্ধতা নেমে এল। শুধু বৃদ্ধ হাঁটু গেড়ে বসে রইল। তার চোখ বেয়ে জল পড়ছে।
“আমার ছেলে…”
অরিন্দম তার পিঠে হাত রাখল, কিন্তু কোন কথা বলল না। এখানেই এই বিভীষিকার সমাপ্তি। অরিন্দম দ্রুত বৃদ্ধের দিকে তাকাল। “তুমি ঠিক আছো?”
বৃদ্ধ কোন কথা বলল না। সে নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল।
পেনড্রাইভটা শক্ত করে ধরে রাখল অরিন্দম। এতে আছে হাসপাতালের ভয়ঙ্কর এক্সপেরিমেন্টগুলোর সমস্ত প্রমাণ—সুপার সোলজার প্রোজেক্টের আসল সত্য। আরেকটি ব্যাগে তারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে নিল। বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “আমরা এবার বেরিয়ে যেতে পারি।”
তারা করিডরের দিকে পা বাড়াতেই—
“ব্যাং!”
একটা ধাতব শব্দে মেইন গেট খুলে গেল! হাসপাতালের নিঃস্তব্ধতা মুহূর্তে ভেঙে গেল। চারপাশের বাতিগুলো আবার জ্বলে উঠল, লাল সতর্ক সংকেতের আলো পুরো করিডরজুড়ে নেচে উঠল। অরিন্দম আর বৃদ্ধ থমকে দাঁড়াল। ২০-২৫ জন সশস্ত্র আর্মি অফিসার একসাথে ভিতরে ঢুকল! তাদের সবার পরনে কালো ইউনিফর্ম, হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। তারা নিখুঁত সামরিক কায়দায় মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল, সবগুলো করিডর এক সেকেণ্ডের মধ্যে তাদের দখলে চলে গেল। একজন অফিসার, যাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে উচ্চপদস্থ, সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখ সরাসরি অরিন্দমের দিকে। তার বাঁ চোখে একটা লাল স্ক্যানার লেন্স, যা দ্রুত চারপাশ বিশ্লেষণ করছে। সে ধীর কণ্ঠে বলল, “তোমাদের তো বেঁচে থাকার কথা নয়।”
অরিন্দম ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসতে লাগল। বৃদ্ধ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “পিছনে একটা সার্ভিস ডোর আছে, কিন্তু আমাদের সময় খুব কম।”
অফিসার তার রাইফেলটা সামান্য নামিয়ে এনে শান্ত স্বরে বলল, “পেনড্রাইভটা দাও।”
অরিন্দম তার মুষ্টি শক্ত করল। সে জানে, এটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারলে এই সব ভয়ঙ্কর এক্সপেরিমেন্ট চলতেই থাকবে। আরও মানুষ দানব হয়ে যাবে, আরও রক্তের নদী বইবে। বৃদ্ধ আস্তে আস্তে তার পকেটে একটা ছোট ডিভাইস বের করল। সে খুব আস্তে করে বলল, “যখন তোমায় বলব, তখন দৌড়বে।”
অরিন্দম চোখের ইশারায় সম্মতি দিল। অফিসার এবার গর্জন করল, “পেনড্রাইভ দাও, নাহলে…”
ঠিক তখনই বৃদ্ধ ডিভাইসের সুইচ টিপে দিল।
“বিপ!”
সাথে সাথে পুরো হাসপাতালের আলো নিভে গেল! চারপাশে গভীর অন্ধকার নেমে এল।
“ছড়িয়ে পড়ো!” অফিসার চিৎকার করল।
“চলো!” বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল।
অরিন্দম আর বৃদ্ধ এক ঝটকায় ছুটে গেল পিছনের সার্ভিস ডোরের দিকে! হাসপাতাল থেকে পালানোর লড়াই শুরু হ’ল। অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথেই চারপাশে লাল সতর্ক সংকেতের আলো জ্বলে উঠল।
“অল ইউনিটস, নাইট ভিশন অন!”
অফিসারের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই আর্মির সবাই তাদের নাইট ভিশন গগলস অ্যাক্টিভেট করল। চোখের সামনে সবুজ আলোয় করিডর ঝলমল করে উঠল। এখন আর অন্ধকার তাদের জন্য বাধা নয়।
“ওরা ওখানে!”
একজন আর্মি অফিসার অরিন্দম আর বৃদ্ধকে দেখতে পেল। অরিন্দম বুঝতে পারল, পালানোর পথ নেই। তারা করিডরের একদম মাঝখানে আটকে গিয়েছে। সামনে-পিছনে আর্মি অফিসারদের ঘিরে ফেলা রিং-একটা নিখুঁত ফাঁদ! বৃদ্ধের মুখ থমথমে। “এবার মনে হয় শেষ” সে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল।
উচ্চপদস্থ অফিসার ধীর পায়ে এগিয়ে এল। “আমি বলেছিলাম, তোমাদের বাঁচার কথা নয়।” সে বন্দুক তুলল, “গুডবাই।” ঠিক তখনই…
একটা অস্বাভাবিক শব্দ বাতাসে ভেসে এল।
একটা ভারী শ্বাস টানার শব্দ…
কোথাও যেন কিছু একটা জেগে উঠছে।
গগলসের সবুজ আলোয় সেনাদের মুখের বিভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল। হঠাৎ একটা কম্পন পুরো হাসপাতালজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। মেঝে কেঁপে উঠল, দেওয়াল কাঁপল। তারপরই একটা কাচ ভাঙার প্রচণ্ড শব্দ! ধুলো, ধ্বংসাবশেষ আর কাচের টুকরো উড়ে এলো চারদিকে। আর তার সাথেই দেখা দিল…
সেই দানব! যে হাসপাতালে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। যাকে মৃত ভেবেছিল সবাই।
অরিন্দম হতবাক। “এটা… এটা সম্ভব কী করে?”
বৃদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করল, “এটা অসম্ভব! আমরা তো লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করে দিয়েছিলাম! তাহলে… সে বেঁচে রইল কীভাবে?”
এই দানব কি কখনই পুরোপুরি মৃত ছিল না? নাকি তার শরীরে এমন কিছু আছে, যা তাকে সত্যিকারের মৃত্যু থেকে রক্ষা করে? বৃদ্ধের চোখ বড় হয়ে গেল। “আমরা শুধু ওর শারীরিক লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু ওর মস্তিষ্ক, ওর চেতনা এখনও জীবিত! ওর শরীরের কোষগুলো নিজেই নিজেকে পুনর্গঠন করছে, সেল রিজেনারেশন। আমি নিজের হাতেই এটা তৈরী করেছিলাম, কিন্তু এটা এত শক্তিশালী?”
অরিন্দম ভয় পেল। “মানে এটা থামবে না?”
বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। “না। এটা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে!”
সেনারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। একজন অফিসার চিৎকার করল, “ফায়ার!”
গোলাগুলির ঝড় উঠল করিডরে! বুলেট ছুটল দানবের দিকে—কিন্তু সে থামল না! তার বিশাল শরীরের ক্ষতগুলো নিজে নিজেই সেরে উঠতে লাগল! এক সেনা হতভম্ব হয়ে চিৎকার করল, “ওর গায়ে বুলেটের কোন প্রভাব নেই!”
দানব তীব্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল! তার বিশাল হাত একটা সৈনিকের মাথার ওপর পড়ল—
“স্প্ল্যাট!”
মাথা থেঁতলে গেল! একজন পালানোর জন্য ঘুরতেই দানব তার হাত ধরে টেনে তুলল। তার পেশল হাত শরীরটাকে দু’ভাগ করে ছিঁড়ে ফেলল! রক্তের বৃষ্টি ছিটকে পড়ল করিডরের সাদা দেওয়ালে! অফিসার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। “এটা… এটা অসম্ভব!” তার মুখ থেকে শব্দ বের হতে না হতেই দানব তার সামনে এসে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য অফিসার তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করল—সে পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু দানব তাকে ছাড়ল না। একটা লৌহকঠিন হাত তার কোমর চেপে ধরল—এবং সে অফিসারকে ছুঁড়ে মারল করিডরের শেষ প্রান্তে!
“ক্র্যাশ!”
শরীরটা গিয়ে আঘাত করল ধাতব দেওয়ালে—এবং সেখানেই চেপ্টা হয়ে গেল! বাকি সেনারা আতঙ্কে দৌড়তে শুরু করল! কিন্তু দানব থেমে থাকল না। সে একের পর এক সেনাকে পিষে ফেলতে লাগল! একজনের মাথা, আরেকজনের পা, আরেকজনের বুক—সব কিছু গুঁড়িয়ে দিতে লাগল! করিডর এক মুহূর্তেই রক্তে লাল হয়ে গেল! অরিন্দম আর বৃদ্ধ হতবাক হয়ে দেখল পুরো দৃশ্য। বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “এটা আমাদের শেষ সুযোগ! পালাও!”
অরিন্দম দ্রুত তার হাত টেনে ধরল। তারা করিডরের উল্টো দিকে দৌড়তে শুরু করল। হাসপাতাল থেকে পালানোর শেষ সুযোগ! অরিন্দম আর বৃদ্ধ করিডর দিয়ে দৌড়চ্ছিল। পিছনে শুধু মৃত্যুর চিৎকার আর মাংস ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ। চারদিকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাসপাতালের দেওয়াল আর মেঝে। তারা একমাত্র জানত, থামা মানে মৃত্যু।
কিন্তু হঠাৎ করেই তারা দু’জন থমকে গেল। সামনে সেই দানব তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন্দমের শ্বাস বন্ধ হয়ে এল। “শেষ… সব শেষ…”
বৃদ্ধের ঠোঁট কাঁপছিল। “এবার পালানোরও পথ নেই।”
কিন্তু… এবার দানবের চোখে আগের মত হিংস্রতা নেই! তার বিশাল শরীর নড়ছে না, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে, কিন্তু সে কোন আক্রমণ করছে না! তার চোখের লালচে ভাবটা কেটে এখন সবুজ হয়ে আছে। অরিন্দম অবাক হয়ে দেখল, দানব স্থির দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখের ভিতরে যেন এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। তার বিশাল বুক ওঠানামা করছে, কিন্তু সে কিছু বলছে না, কোন হিংস্রতা নেই। বৃদ্ধ ফিসফিস করল, “এটা সম্ভব না। ও… ও আমাদের মারছে না?”
অরিন্দম সাহস করে এক পা এগোল। “তুমি আমাদের আক্রমণ করছ না কেন?”
কোন উত্তর এল না। কিন্তু দানবের চোখের গভীরে যেন এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। হঠাৎ বৃদ্ধ চমকে উঠল। “এটা আমার ছেলে! ওর শরীরের নিয়ন্ত্রণ ছিল হাসপাতালের হাপাতালের কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণে, যা ওকে কন্ট্রোল না করতে পারলেও ওকে উন্মাদ করে দিয়েছিল প্রবল যন্ত্রনা দিয়ে। কিন্তু পুনরায় ওর শরীর নতুন করে গঠন হওয়ায় আর ওর হিলিং এবিলিটির কারণে ওর আসল চেতনা ফিরে পেয়েছে।” বৃদ্ধ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল। “বাবা! তুমি ওদের তৈরি অস্ত্র নও! তুমি আমার ছেলে!” বৃদ্ধের চোখ জ্বলজ্বল করছিল।
“ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে!” অরিন্দম দ্রুত বলল, “আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে! আমাদের সাহায্য করো!”
দানব ধীরে ধীরে মাথা তুলল। তার বিশাল হাত তুলে বৃদ্ধের দিকে ইশারা করল। বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “ও আমাদের পথ দেখাবে!”
অরিন্দম আর বৃদ্ধ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে দানবের পিছনে হাঁটতে লাগল। দানব সামনে এগিয়ে চলল, হাসপাতালের অন্ধকার করিডরের ভিতর দিয়ে, তাদের পালানোর পথ দেখাতে দেখাতে। দানবের বিশাল শরীর করিডরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলছিল, পিছনে অরিন্দম আর বৃদ্ধ। চারপাশের দেওয়ালে রক্তের ছোপ, মেঝেতে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ, এমনকি কিছু সৈন্যের আধা-ছেঁড়া শরীর এখনও নড়ছিল, কিন্তু তাদের চোখে আর কোন জীবন নেই। তারা এগিয়ে চলল হাসপাতালের মেইন গেটের দিকে।
হঠাৎ দানব থমকে দাঁড়াল। তার বিশাল কাঁধ শক্ত হয়ে উঠল। অরিন্দম কিছু বুঝে ওঠার আগেই—দুর্গন্ধময় বাতাসে কেঁপে উঠল হাসপাতাল। পিছনে করিডরের অন্ধকার থেকে একটি বিকৃত মুখ উঁকি দিল। আরও এক মিউট্যান্ট! সেই জলের নিচের বিরাট মিউটেন্ট এখন আরও বড় হয়ে গিয়েছে। শরীর জুড়ে কাটাছেঁড়া, হাড়ের গাঁটগুলো উল্টো হয়ে আছে, এবং এর মুখ থেকে গরগর শব্দ বেরিয়ে আসছে। তার চোখদু’টি ফাঁকা, শূন্য, কিন্তু ক্ষুধার্ত।
দানব এক মুহূর্ত দ্বিধায় থাকল, তারপর গর্জন করে সামনে ঝাঁপ দিল। সে অন্য মিউট্যান্টটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, মাটিতে ফেলে তার মাথা ধরে দেওয়ালের সঙ্গে আছাড় মারল! একবার, দু’বার, তিনবার—শেষ পর্যন্ত মিউট্যান্টটির খুলি গুঁড়িয়ে গেল! দেওয়ালে রক্তের বিশাল দাগ ছিটকে পড়ল। বৃদ্ধ দ্রুত অরিন্দমের হাত টেনে ধরে বলল, “এটাই সময়! আমাদের বেরোতে হবে!”
দানব তাদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, সে হাসপাতালের ভিতরে থেকে সব মিউট্যান্টদের আটকে রাখবে। অরিন্দম আর বৃদ্ধ ছুটে গেল মেইন গেটের দিকে। বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস স্পষ্টভাবে অনুভূত হ’ল, তারা মৃত্যুপুরী থেকে মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু…
ঠিক তখনই বৃদ্ধ থমকে দাঁড়াল। অরিন্দম অবাক হয়ে বলল, “চলে আসুন! আমরা বেরিয়ে যাব!”
“আমি যাব না।”
অরিন্দম বিস্মিত হয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাল। “কিন্তু কেন?”
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে হাসল। “ওকে একা ফেলে যেতে পারি না, বাবা। ও আমার সন্তান। আমি জানি, সে এখনও পুরোপুরি মুক্তি পায়নি, ওর লড়াই এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আমি ওর পাশে থাকব, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।”
অরিন্দম নির্বাক হয়ে গেল। সে জানত, বৃদ্ধ ঠিক বলছে। তবে এর মানে একটাই—বৃদ্ধ এই হাসপাতাল থেকে কখনই বেরোতে পারবে না।
বৃদ্ধ এগিয়ে গিয়ে দানবের কাঁধে হাত রাখল। “আমি তোমার পাশে আছি, বাবা।”
দানব ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তার বিশাল হাত বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে দিল, তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। অরিন্দম চোয়াল শক্ত করল। সে জানত, এই মুহূর্তে কিছু বলা অর্থহীন। সে ধীরে ধীরে পিছোতে লাগল, তারপর শেষবারের মত বৃদ্ধের দিকে তাকাল। বৃদ্ধ মৃদু হাসল, তারপর হাত তুলে বিদায় জানাল। “বেঁচে থাকো। এই দুঃস্বপ্ন শেষ করো।”
অরিন্দম এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের প্রধান ফটক পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। পিছনে মৃত্যুর নগরী, ভয়ঙ্কর সেই হাসপাতাল ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে গেল।
ভিতরে দানব আর বৃদ্ধ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল ।
লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
সঙ্গীতচর্চা করতে ভালবাসেন। গান লেখা, তার সুর দেওয়া, এবং নিজে গাওয়া এর মধ্যেই মনের তৃপ্তি খুঁজে পান। এর সাথে রং-তুলির সাথে নির্জীব কাগজের প্রেক্ষাপটে প্রাণসঞ্চার করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পান।