লেখক : শিখা চক্রবর্তী
ভাবনার স্রোতে নৌকো ভাসিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। লক্ষ্য ছিল দেখি সে কোথায় যায়। দেখি, আমায় নিয়ে সেই নৌকোর মাঝি পাড়ি জমালো অনেক দূরের পথে। দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে থেকে মানুষজন, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, যানবাহন – সব অদৃশ্য হয়ে গেল। অবশেষে নদীর ধারে বনের মধ্যে এক পর্ণকুটিরের সামনে সেই নৌকো থামতে দেখতে পেলাম ময়লা কাপড় পরা একটা লোককে। মুখ তার মলিন। হাতে দু’টো মৃত পাখি নিয়ে সেই কুটিরে সে ঢুকতে যাচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়ে শীর্ণকায় দু’টি বাচ্চা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পিছনে দু’টি স্ত্রীলোক – প্রথমজন তার স্ত্রী। সে বলল, “আজ কি আর কিছুই পাওনি? শুধু এই দু’টো পাখি?”
লোকটা হতাশ গলায় উত্তর দিল, “অনেক চেষ্টার পর এই দু’টো মাত্রই পেলাম। চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি রাখিনি । কিন্তু কিছু না পেলে কি করব বল?”
দ্বিতীয় স্ত্রীলোকটি তার মা। সে বলল, “বাবা, এ’রকম করে আর কতদিন চলবে বলতে পারিস? আমরা তো তবু খিদের জ্বালা সহ্য করতে পারি। কিন্তু তোর এই অবোধ বাচ্চা দুটো? এদের কি সেই ক্ষমতা আছে? এরা রাতের বেলা খিদের জ্বালায় উঠে কান্নাকাটি করে। সেই কান্না যে আর সহ্য হয় না।”
লোকটা কোনও উত্তর দেয় না। তার দৃষ্টি মাটির দিকে। মনে হয় লজ্জায় আর গ্লানিতে যেন সে ওই মাটির মধ্যে মিশে যেতে চাইছে। এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে তার বৃদ্ধ পিতার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। “কে? রত্নাকর এলি নাকি রে? আজ কি কোনও শিকার পেলি?” বলতে বলতে বেরিয়ে এসে সেই মৃত পাখি দুটোর দিকে চোখ পড়ে তাঁর। “এত ছোট দু’টো পাখি? এই দিয়ে কি এতগুলো মানুষের পেট ভরবে?”
রত্নাকরের স্ত্রী বলে, “এভাবে আর কতদিন চলবে বলতে পার?”
নিঃশব্দে পাখি দু’টোকে ঘরের দুয়ারে রেখে রত্নাকর সেখান থেকে আবার বনের পথ ধরে।
এরপর নদীতে নেমে অঞ্জলি ভরে জল পান করে একটা গাছের তলায় গিয়ে সে বসে থাকে অসহায়ের মতো। মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে বলতে থাকে, “এ’ভাবে আর কতদিন? আর কত দিন?” তার চোখ মুখ ক্রমশ শক্ত হয়ে ওঠে। এমন সময় হঠাৎ দূর থেকে কিছু মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে সে উঠে দাঁড়ায়। দেখতে পায়, কয়েকজন পথিক এদিকেই আসছে। হাট থেকে কেনাকাটা সেরে জিনিসপত্র হাতে তারা তখন বাড়ি ফিরছিল। তারা কাছে আসতেই রত্নাকর হঠাৎ একটা হুংকার দিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “ভাল চাও তো তোমাদের সব জিনিসপত্র, টাকাকড়ি যা আছে, সব আমায় দিয়ে দাও। না দিলে এখনই তোমাদের সবাইকে আমি হত্যা করব।” পথিকরা তার সেই ভয়ানক মূর্তি দেখে প্রাণের ভয়ে তাদের সব কিছু সেখানে ফেলে রেখে ছুটে পালাল।
সেইদিন থেকে দস্যুবৃত্তিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিল সে। পথিক দেখলেই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের যথাসর্বস্ব সে লুঠ করে। কেউ বাধা দিলে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতেও তার হাত কাঁপে না। রত্নাকর আর সেই আগের রত্নাকর থাকল না। সে হয়ে গেল দস্যু রত্নাকর।
অনুভব করলাম, কতখানি নিরুপায় ও অসহায় হলে একজন সৎ মানুষ তার সততা ত্যাগ করে দস্যুতে পরিণত হয়।
তার সেই দস্যুবৃত্তি এভাবেই চলছিল। এমন সময় একদিন পথিকের আশায় অপেক্ষারত রত্নাকরের চোখে পড়ল, দু’জন মুনি মালা জপ করতে করতে সেদিকেই আসছেন। সে যথারীতি তাঁদের ওপর চড়াও হয়ে হুকুম করল, “ঠাকুর, ভাল করে বলছি, তোমাদের কাছে যা আছে সব দিয়ে দাও। নাহ’লে আমার হাতে কিন্তু মারা পড়বে তোমরা।”
তাঁরা বললেন, “বেশ কথা। আমাদের কাছে তো কিছুই নেই ভগবানের নামটুকু ছাড়া। তাই আমাদের না হয় তুমি মেরেই ফেল। কিন্তু আগে একটা প্রশ্নের জবাব দাও দেখি। এই যে নিরীহ মানুষদের এমন করে লুটপাট করছ, তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করছ, এর জন্য তো তোমার অনেক পাপ হচ্ছে। এত পাপের বোঝা পরে বইতে পারবে তো? তোমার এই পাপের ভাগ কেউ নেবে কি?”
রত্নাকর অম্লানবদনে বলল, “আমি তো আর এ’সব আমার একার জন্য করছি না। আমার পুরো পরিবারের জন্য করছি। তাই আমার পাপের বোঝা আমি একা কেন? তারাও বহন করবে।”
মুনিরা বললেন, “বেশ। তবে এক কাজ কর। বাড়ি গিয়ে পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞাসা করে জেনে এস, যে তারা সবাই এতে রাজি, কি না। তুমি আমাদের এখানে বেঁধে রেখে যাও। কথা দিচ্ছি, আমরা কোথাও পালাব না।”
রত্নাকর তখন বাড়ি গিয়ে পরিবারের সকলকে একে একে জিজ্ঞাসা করল, তার কৃতকর্মের পাপের ভাগ তারা নেবে কি না। প্রত্যেকের মুখ থেকে সে একই জবাব পেল, “তোমার পাপের ভাগ আমরা খামোকা নিতে যাব কেন? তোমার পাপের ভাগ বহন করতে হবে তোমাকেই। আমরা কেউ তা করব না।”
পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তান – সকলের মুখে এই একই উত্তর শুনে রত্নাকর বিহ্বলচিত্তে ফিরে এসে সেই মুনিদের শরণাপন্ন হয়ে বলল, “তোমরা তবে আমায় এই পাপের বোঝা থেকে মুক্তির উপায় বলে দাও।”
মুনিরা তখন বললেন, “শোন রত্নাকর, আজ থেকে একাগ্রচিত্তে তুমি রামনাম জপ কর। এতেই তোমার উদ্ধার হবে।”
তাঁদের আদেশমত যখন সে মাটিতে বসে সেই জপ শুরু করতে গেল, তখন ঘটল অদ্ভুত এক ব্যাপার! যতবার সে রামনাম উচ্চারণ করতে যায়, ততবারই তার মুখ দিয়ে ‘মরা মরা’ শব্দ বেরোতে থাকে। তার এই অবস্থা দেখে মুনিরা বললেন, “ঠিক আছে, তুমি এই নামেই রামনাম জপ কর। এই নাম বারংবার উচ্চারণ করতে করতেই রামনাম আসবে, এবং এতেই তোমার উদ্ধার হবে।”
দেখতে দেখতে বহুদিন অতিক্রান্ত হল। রত্নাকরের শরীর ঘিরে তখন বল্মীক, অর্থাৎ উইপোকার ঢিপি তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার ভেতরে বসেই সে একভাবে একমনে রামের নাম জপ করে চলেছে। একদিন সেই মুনি দু’জন আবার সেখানে এলেন, আর সেই উইঢিপির ভেতর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণকণ্ঠের রামনাম ধ্বনি শুনতে পেয়ে সেই ঢিপির সামনে গিয়ে তাঁরা রত্নাকরকে ডাকলেন। তখন বল্মীকের স্তূপ ভেঙে তিনি বেরিয়ে এলে মুনিরা বললেন, “ধন্য তুমি। সার্থক তোমার সাধনা। আজ তোমার পুনর্জন্ম হ’ল। যেহেতু এই বল্মীকের স্তূপ থেকে তোমার এই নবজীবন লাভ, তাই আজ থেকে তুমি আর দস্যু রত্নাকর নও। তোমার নাম হ’ল বাল্মীকি। মহর্ষি বাল্মীকি।”
তাঁরা তাঁকে আশীর্বাদ করে আরও বললেন, “তুমি যাঁর নাম নিয়ে এতদিন তপস্যা করলে, সেই ভগবানস্বরূপ শ্রীরামচন্দ্রের জীবনকথা নিয়ে এবার কাব্য রচনা কর। মা সরস্বতীর কৃপায় তোমার সেই সৃষ্টি এ জগতে চিরদিনের জন্য শাশ্বত ও অমর হয়ে থাকবে। এ জগতের আদিকবি রূপে তুমি সর্বত্র সমাদৃত হবে”। এই বলে মুনিদ্বয় প্রস্থান করলেন।
বাল্মীকি তখন তাঁর শরীরে জমে থাকা সমস্ত মাটিময়লা ধুয়ে নদীতে স্নান করে একটি গাছের তলায় গিয়ে বসলেন। আর তখনি ঘটল সেই ঘটনাটি। তিনি দেখলেন, মৈথুনরত দুটি ক্রৌঞ্চ অর্থাৎ বক – তাদের মধ্যে একটি এক ব্যাধের নিক্ষিপ্ত তীরে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে করতে প্রাণত্যাগ করছে। এই দৃশ্য দেখে আবেগতাড়িত বাল্মীকির মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হল একটি শ্লোক:
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাঙ ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমবধীঃ
কামমোহিতম।।”
“হে নিষাদ, তুমি চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না, কারণ কামমোহিত ক্রৌঞ্চযুগলের একটিকে তুমি বধ করেছ।”
এই শ্লোক, জগতের প্রথম তথা আদি মহাকবির উচ্চারিত পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য রামায়ণের প্রথম শ্লোক, যা স্বকণ্ঠে উচ্চারিত হতে দেখে তার রচয়িতা স্বয়ং বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলেন, এবং এই হ’ল একই সঙ্গে দস্যু রত্নাকরের নবজন্মলাভ করে মহর্ষি বাল্মীকিতে পরিণত হওয়ার ও রামায়ণ মহাকাব্যের জন্মকাহিনী।
ফেরার সময় নৌকোর মাঝি জিজ্ঞাসা করেছিল, “কী গো, যাবার সময় তো খুব অস্থির ছিলে! এখন কেমন লাগছে বল দিকি?”
উত্তর দিতে পারিনি। শুধু দুইহাত জোড় করে প্রণাম করেছিলাম।
লেখক পরিচিতি : শিখা চক্রবর্তী
গৃহবধূ, নিবাস কোন্নগর, শ্রীরামপুর কলেজের স্নাতক। স্বামীর কর্মসূত্রে ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে বসবাস করার সৌভাগ্য এবং তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। বইপড়ার ভীষণ নেশা ছিল, কিন্তু শারীরিক কারণে বর্তমানে তাতে ছেদ পড়েছে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই একটু ছড়া লেখার অভ্যাস ছিল, তারপরে সব বন্ধ। এতদিন পর কন্যা ও জামাতার উৎসাহে, প্রেরণায় পুনরায় লেখার শুরু। দেশকাল বলে একটা ম্যগাজিনে আমার একটা লেখা বেরিয়েছিল ১৯৯৫-এ।