লেখক : গৌতম ঘোষ-দস্তিদার
পকেটে হাত ঢুকিয়ে কামসূত্রের প্যাকেটটার কলার চেপে ধরে কোনোমতে ওটাকে টেনে হিঁচড়ে বার করল উদ্দালক। প্রাণপণ দলামোচা কোরে সেটাকে যতদূর ছুঁড়ে ফেলা যায়, ফেলে দিল আদিগঙ্গার জলে। একটানা কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইল এক কালের ওই একটা অপরিহার্য বস্তুর পানে। একটা সময় ছিল নিনার সঙ্গে কতো মজাই না করেছে এই বস্তুটা নিয়ে । আজ ওটাই পড়ে ছিল নিনার শেষ স্মারক। ভাসিয়ে দিল উদ্দালক। ভাসিয়ে দিল আদিগঙ্গার পঙ্কিল জলে। অধুনার অস্বচ্ছ জীবনের মতো ওই জল। পাগলের মতো উদ্দালক একবার হোহো করে হেসে উঠছিল আবার পর মুহূর্তেই বুকের ভিতর ঘুষি মারতে মারতে কেঁদে উঠছিল। কী করবে ভেবেই পাচ্ছিল না। জীবনটা একদম মানে-ছাড়া হোয়ে গেল। কে জানি কোথায় বসে কলকাঠি নেড়ে চলেছে, কে তার খবর রাখে…
একটা সময় ছিল যখন মানুষের গতরটাকে কেন জানি না হুবুহু এই গ্রহের শরীরটার একটা পকেট-সংস্করণ বলে মনে হত উদ্দালকের। পর্বতমালারা সেখানে নক্ষত্রকে ছুঁয়ে দেখবে বলে রাতকে রাত জেগে থাকে অতন্দ্র। নদি এসে কোথাও বা সমতলের বুক ছুঁয়ে যায়। আবার অন্য কোনোখানে হয়তো বা অরণ্য অপেক্ষা করে থাকে সাগরের নোনা জলে নিজেকে চুপচুপে কোরে নেবে বলে…
মহাতসিমগঞ্জের এক মুঠো সেই ভাড়াবাড়িটার মধ্যে এক চিলতে আকাশ যেখানে জমা ছিল তার কাছেই পাওনা ছিল উদ্দালকের আস্ত একটা গল্প। পাশের গলিটা ধরে দুপা এগিয়ে গেলেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে গঙ্গা। বাড়ির কাছাকাছিই একটা প্রকাশনা সংস্থায় উদ্দালক একটা চাকরি জোগাড় করেছে স্থানীয় এক দাদার মধ্যস্থতায়।
এইরকম একটা খবরের জন্যই কতোগুলো জন্ম ধরে অপেক্ষা করে ছিল নিনা। খবরটা শুনতে না শুনতেই ওর অফিসের মধ্যেই কখন উদ্দালকের গাল ভরে গহিন একটা চুমু এঁকে দিয়েছিল উদ্দালক কিছু বুঝে ওঠার আগেই,”এক্ষুনি চলো, মা কালীর সামনে আমায় শাখা-সিঁদুর পরিয়ে দেবে”। দুজনে সটান একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল। উদ্দালক বলল,“কিন্তু উনি তো উলটোদিকের রাস্তা নিয়েছেন”। বিরাট একফালি দুষ্টু রোদে আকাশের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত ছড়িয়ে দিয়ে নিনা বলল,“বাঃরে , তোমার দেবীর কাছে আমি মাথা নুইতে যাবো আর তুমি আমার দেবতার সঙ্গে একবারটি দেখা করে আসবে না?”
সন্ত পলের ক্যাথেড্রালের সামনে ট্যাক্সি দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই নিনা উদ্দালককে প্রায় টানতে টানতেই নিয়ে চলে গেল ক্যাথেড্রালের উঠোনে। মাঝ দুপুর পেরিয়ে গেছে কখন। গির্জার ফাটক বন্ধ হয়ে গেছে সময়ের দাসত্ব মেনে। নিনা বন্ধ দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়েই প্রার্থনা সেরে নিল। ডান হাতে যোগ চিহ্ন এঁকে নিল মাথায় বুকে আর দুই স্কন্ধে।
পড়ি কি মরি করে ট্যাক্সি চেপেই আবার কালীঘাট। মায়ের মন্দিরও দোর দিয়েছে ততক্ষণে। সামনে সাজানো দশকর্মা-ভাণ্ডার থেকে শাখা-পলা-লোহা সব পরে নিলো নিজের দুহাত জুড়ে। সিঁদুরের কৌটোটা এগিয়ে দিল উদ্দালকের সামনে। উদ্দালক নিনার সিঁথি লাল কোরে দিল। দুজনের হাতে পাণ্ডা দোকানদার লাল সুতো বেঁধে দিয়ে বললেন, ব্রাহ্মণ-ভোজনের জন্য কিছু দক্ষিণা দেবেন। পাণ্ডাকে একটা বেশ বড় নোট ধরিয়ে দিয়েই দুজনে মিলে এক দৌড়ে গিয়ে আবার ট্যাক্সিতে পুনরুত্থান…
যথাযোগ্য দেরি করে কালকা মেল এসে দাঁড়াল এলাহাবাদ স্টেশনে। দু-দুটো ভারি ভারি স্যুটকেস আর নিনাকে বগলপাঁজা করে ওভারব্রিজের চড়াই-উৎরাই বেয়ে নেমে এল উদ্দালক। ভূভারত-চষা উদ্দালক এখনো হিন্দি বলতে পারেনা বললেই প্রায় চলে। নিনা অবাঙালি-প্রধান মিশনারি স্কুলে পড়ে হিন্দি বেশ ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। উদ্দালক নিনার হিন্দি শুনে বাকরুদ্ধ আর নিনা ততোধিক বাঙময়। কলকাতা যাবার আগেই উদ্দালক তিনশো টাকায় ঘর ভাড়া ঠিক করে গেছে। একটা ঘরেই থাকা-খাওয়া মায় রান্না পর্যন্ত। পাশেই ছোট্ট একচিলতে কলঘর। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কোনোমতে স্যুটকেস দুটো হাত থেকে নামিয়েই উদ্দালক নিনাকে বুকে টেনে নিল। বলল, একঘরে জীবন কাটাতে কষ্ট হবে না, সোনু?
নিনা আনন্দে কেঁদে উঠল। উদ্দালকের কানের লতিতে চুমু দিয়ে বলল, এই তো আমার স্বর্গ – আমার অফুরন্ত স্বর্গ – আমার চার আনা জীবনে ষোলো আনা উশুল। তারপর এক ঝটকায় খুলে ফেলল স্যুটকেস। উদ্দালকের জামাকাপড়, টুকিটাকি বাসনপত্র যা এনেছিল নামিয়ে ফেলল মেঝেতে। কলকাতা যাবার আগেই উদ্দালক একটা স্টোভ কিনে কেরোসিন ভরে রেখে গেছিল। তাতেই চোখের নিমেশে সিদ্ধ ভাত, ডাল আর আলুর দম তৈরি হয়ে গেল।
নাকে-মুখে কোনোমতে গুঁজে অফিসের পথে হাঁটা মাড়ল উদ্দালক। সই করে সোজা চলে গেল নিজের বিভাগে। এলাহাবাদের এই প্রকাশন সংস্থার দেশজোড়া খ্যাতি। বাঙালির এ একটা উপনিবেশ যেন। বাংলার এরকম উপনিবেশ তো আজ পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গাঁয়ের যোগীর তবু কেন যে ভিখ জোটে না!
তাই মাধুকরীর ঝুলি নিয়ে উদ্দালকরা গোটা ভারত চষে খায়। কখনো বেঙ্গালুরু, কখনো দিল্লি, কখনো চেন্নাই, কখনো আজমের, কখনো আমেদাবাদ, কখনো… উদ্দালকদের ফর্দ দীর্ঘতর হয়েই চলে। ওর চেয়ে অনেক খারাপ মার্কশীট নিয়েও দিব্বি সবাই খাস কলকাতায় চাকরি জোগাড় কোরে নিয়েছে। শুধু ও-ই পারেনি। চাটতে শেখেনি।
জ্যোতিষ-দাদা বলেছিলেন, এভাবেই লেখা হয় নতুনের ইতিহাস। কেন্দ্রাভিগ বল এভাবেই হার মানে কেন্দ্রাতিগের হাতে! গোটা এই গ্রহটাই একদিন সূর্যের বুকের মধ্যে আগুন হয়ে জ্বলছিল। অত উষ্ণতা হয়তো তার আর সইল না। গরমের একঘেয়েমি ছেড়ে পৃথিবীও একদিন তাই এসেছিল একান্নবর্তি পরিবারের বাইরে। বিবাহের ঠিক পরেই কিম্বা কিছুটা আগেই যেমন সবাই যেতে চায় অজানা বা এখনো অপেক্ষাকৃত কম-জানা কারো হাতে হাত রেখে। যেমন এসেছে আজ নিনা আর উদ্দালক – যেমন এসেছিল একদিন ওদেরই কোনো পূর্বপুরুষ মহাকুম্ভের এই পুণ্যতোয়ার তীরে।
দপ্তর থেকে বেরোতে বেরোতে সেই সন্ধেই পেরিয়ে যায়। কী আর করা? শুধু অনুবাদক বা সম্পাদকের কাজ হলে তবু ধরা-বাঁধা একটা গণ্ডিতে চলা যেত। কিন্তু ছোট প্রতিষ্ঠান। সেখানে রিপোর্টিং থেকে শুরু করে গেট-আপ পর্যন্ত আগাপাস্তলা সব প্রায় একা হাতেই করতে হয় উদ্দালককে। সবে পাঁচজন মাত্র কর্মচারী। সুকুমার আর সুব্রত ডিটিপি-র কাজ করেই কূল পায় না। হারুনদা আর শুক্লাদি ডেস্ক-ওয়ার্কটা সামলে দেয়। আর উদ্দালক অল ইন অল।
পা চালায় উদ্দালক। নিনা একা বাড়িতে। সারারাত কালকা মেলে আলো-পাখা কিছুই ছিল না ওদের বগিতে। ট্রেন চললে গরম তেমন লাগছিল না ঠিকই তবে একবার দাঁড়িয়ে গেলেই সর্বনাশ। তাকে নাড়ায় কার সাধ্যি? যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়। ওদের একটা মিডল বার্থ, আরেকটা আপার। বার্থ দুটোই কিনা পড়েছে ট্রেন যে মুখে ছুটছে তার উল্টো দিকে। ফলে চললেও হাওয়া ঢুকছে না জানালা দিয়ে।
মহাতসিমগঞ্জের সিংগলরুমের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে মিনিট দশেকও লাগে না উদ্দালকের লম্বা পায়ে। ঘরে ঢুকে তো অবাক হবার পালা। রীতিমতো ফুলশয্যা সাজিয়ে একেবারে দোরগোড়ায় এসে ফুটে আছে নিনা। কোত্থেকে একটা গাঁদার মালা নিয়ে এসে আবার খোঁপায় গুঁজে নিয়েছে দেখছি। সারাটা দিন কলম পিষে এসেও উদ্দালকের মনে হল রোববার আজ যেন, এই সবে ঘুম ভাঙলো বুঝি! কফি আর ঝুড়িভাজা নিয়ে এল নিনা। কলকাতা থেকেই সব নিয়ে এসছিল সঙ্গে করে। এই তো সবে গেল অগস্টে আলাপ হয়েছে একদিন গোলপার্কের লাইব্রেরিতে। নিনা গেছিল ওর চলতি এমবিএ পড়ার কিছু রেফরেন্সের কাজে আর উদ্দালক সাংবাদিকতার উপর কিছু পড়াশুনো করতে। উদ্দালক কী খেতে কী পরতে ভালোবাসে এর মধ্যে সবই ওর নখদর্পণে। কফি খেলে সবার ঘুম ছেড়ে যায়। কিন্তু কফি খেলে উল্টো ঘুমে ধরে উদ্দালককে – এটা জানত বলেই গরমাগরম খিচুড়িও বানিয়ে রেখেছে। খিচুড়ির মধ্যে আলু আর ফুলকপি। এরকম খিচুড়ি খেলে নাকি উদ্দালকের মনে হয়, পুরীর স্বর্গদ্বারে বসে মহাপ্রসাদ পাচ্ছে। সঙ্গে পাঁচমিশেলি ছ্যাঁচড়া পেলে যেন ব্যাপারটা আরও অনেক বেশি জমত। নিনা বলে, যা খুঁজছো, তা পারিনি বানাতে। কাল বাজার করে নিয়ে আসব।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিনা সিভিল লাইন্স এরিয়ার দিকে একটা বেশ বড় হোটেলে গেস্ট রিলেশন একজিকিউটিভের কাজ পেয়ে গেল। কলকাতা থেকে আসার আগেই কার কাছ থেকে ফোন নম্বর পেয়ে আগেভাগেই কথা বলে নিয়েছিল। শুরু হয়ে গেল রোজ আনা রোজ খাওয়া জীবন। অধিকাংশ সপ্তাহান্তেও কাজ থাকে দুজনেরই। নিনার ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হোয়ে যায়। ওর ডিউটি পড়ে সাধারণত দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা। রিক্সা একটা ঠিক করা হয়েছে আপাতত কাজ চলার মতো। দু-তিন মাস বাদে হোটেল থেকেই দিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার জন্য পাকাপাকি ভাবে গাড়ির বন্দোবস্ত করে দেবে বলেছে। এখন কয়েক মাস রিক্সা ছাড়া গতি নেই। মহাতসিমগঞ্জ থেকে সিভিল লাইন্স বেশ অনেকটা পথ। রাত দশটার পর চারিদিকে শুনশান হয়ে যায়। তখন একজন মহিলার পক্ষে হেঁটে আসা অসম্ভব শুধু নয়, অকল্পনীয়।
বেশ কেটে যাচ্ছিল প্রয়াগরাজে। শনিবার করে নিনার ছুটি থাকত। ইমেডিয়েট বসকে বলে উদ্দালকও এসে যেত এই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। তারপর দুজনে সোজা চলে যেত গঙ্গার ধারে কিছুক্ষণ হাওয়া খেয়ে আসার নাম করে। মাসে একদিন উদ্দালকের অফিস পিকনিক। সেদিন নিনাও ছুটি নিত। ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য সবাইই তো বাঙালি। কিন্তু হলে হবে কি, ওঁরা সবাই এলাহাবাদের স্থায়ী বাসিন্দা। কথায় বেশ হিন্দি টান। তার মধ্যে হারুনদা অবিবাহিত। শুক্লাদি স্বামি পরিত্যক্তা। সুকুমারদা আর সুব্রতদা দুজনেই কলকাতার কাছের লোক। তবে দুজনেই বিয়ে করেছেন প্রবাসী পরিবারে। সুব্রতদার বউ বাংলা প্রায় বলতেই পারে না। তবুও মোটের উপর ঠিকই ছিল প্রায়। চলে যাচ্ছিল যেমন সবার যায়…
গেল না। নিনার কী খেয়াল হল, কলকাতায় ফিরে যাবে। এখানে চাকরিতে উন্নতির সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কলকাতার কস্মপলিটান ব্যাপারটা এইটুকু শহরে আশা করা বৃথা। কলকাতায় গেলে উদ্দালকের কাজের পরিধিও বাড়বে। ওখানে গিয়েই কাজ জোগাড় করে নেবে নাহয়। চাইলে এমনকি যে হোটেলটায় কাজ করছিল সেখানেই আবার জয়েন করে নিতে পারবে।
আজ একতিরিশে মে – নিনার জন্মদিন। কপালগুণে আজ আবার রবিবার পড়েছে। উদ্দালক সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিনাকে অনেক আদর করল। নিনাও সুদে আসলে ফিরত দিল। একটা গান শোনাল নিনাকে – কিশোরকুমারের – “আমার মনের এই ময়ূর-মহলে এসো আজ প্রেমের আতর ঢেলে দাও/ বেগম রাতটার গায়ে তারা ওড়নার দুচোখে আজ নয় ঝাড়বাতি জ্বেলে যাও !” এবার তাহলে নিনার পালা। নিনা শোনাল – আশা ভোঁসলের – “চোখে নামে বৃষ্টি বুকে ওঠে ঝড়/ তুমি তো আমারই ছিলে আজ কতো পর !” শুনে উদ্দালকের চোখে সত্যি সত্যি বৃষ্টি নেমে এল। নিনা অনেক বোঝাল, আর কোনো বাংলা গানের কথা পুরোপুরি জানে না বলেই এ গানটা গাইতে একরকম বাধ্য হল। কিন্তু অনেকদিনের রৌদ্রদগ্ধ রুক্ষ মরুদেশ আজ যেন আবার জলের ছোঁয়া পেয়েছে। সে কি আর ছাড়ে তাকে এতো সহজে? সে তখন নদী আপন বেগে পাগলপারা। উদ্দালককে বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে নিনা অনেক বোঝাল, “না বলে এসেছি, তা বলে ভেবোনা, না বলে বিদায় নেবো।“
অদৃষ্ট তবু সবসময়েই অদৃশ্য। সে তো শুধুই নিয়তির খেল – কেউ তাকে চেনে না, জানে না – আমি না, তুমি না, নিনা না, উদ্দালক না, দেবা ন জানন্তি, কুত্রাপি মনুষ্যাঃ? গ্রিক নাটকের ডেস্টিনির মতো সে আমাদের পৌঁছে দেয় তার ইচ্ছে মতো ডেসটিনেশনে।
ফরাসি বিপ্লবের দিন মানে এক চোদ্দই জুলাই কালকা মেল আবার ফিরে এল হাওড়া স্টেশনের বড়ঘড়িটার তলায়। কলকাতা ফিরে এল নিনা আর উদ্দালক। নিনার পেটের ভিতর ওদের আগামী প্রজন্ম – অনাগত ভবিষ্যৎ। এই সবে এক মাস মতো হল নিনার গর্ভাবস্থা। গলফগ্রিনের গুলাম মহম্মদ শা রোডের ডেরায় সোয়া দুখানা মানুষ এসে হাজির হল। নিনার এক বন্ধু শালিনীর ফ্ল্যাটে আপাতত একটা মাথা গোঁজার মতো ব্যবস্থা হয়েছে। শালিনীকে ভাড়া দিতে হবে না। ও রাজস্থানে গেছে। বাপ-মায়ের কাছে মাস দুয়েক মতো কাটিয়ে ফিরে আসবে। তখন অবশ্য ওর ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে। ঠিক আছে , কিছু না কিছু ব্যবস্থা তার মধ্যে একটা ঠিক হয়ে যাবে, নিনার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। প্রার্থনা আর পরিশ্রম কোনোটাতেই তো খামতি রাখছে না ওরা – না উদ্দালক না নিনা। সমস্যা শুধু যে এখনো এসে ওদের কাছে পৌঁছয় নি সেই তাকে নিয়েই। এখনই নিনা আবার নতুন একটা চাকরি ধরতে চাইছে না। পরিস্থিতিটা তার মধ্যে একটু থিতু হয়ে নিক আগে। যা আছে, তাই নিয়েই বেশ চলে যাবে…
কিন্তু ভাবি এক, হয় আর এক। নিনা কয়েকদিন থেকেই আওড়াচ্ছিলো একই কথা উদ্দালকের কানে – নাহ, আরেকটা মানুষকে একরকম জোর করে পৃথিবীতে এইভাবে টেনে আনাটা বোধয় এখনি উচিত হবে না। তার চেয়ে বরং আমি কোথাও একটা জয়েন করে তোমার পাশে দাঁড়াবার একটা চেষ্টা করে দেখি না হয়; এখনই কাউকে জোরজবরদস্তি এভাবে টেনে নিয়ে আসার কোনো মানে হয়না; কয়েকটা বছর অপেক্ষা করে তারপর এসব কথা ভাবা যেতেই পারে।
খুব বেশিরকম ক্লান্ত লাগে নিজেকে। উদ্দালক শুয়ে পড়তে চায়। নিনা বলে চলে, কাল প্লীজ কাজ সেরে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা কোরো; কালই অ্যাবরশন করে নেব; এক হপ্তা মতো আমার রেস্ট নিয়ে শালিনীরা ফেরার আগেই সব সেটল কোরে ফেলব; ঠিক আছে?
নিনা উদ্দালককে জড়িয়ে ধরতে চায়। ক্লান্ত প্রাণ কোনোমতে পাশ ফিরে তন্দ্রার পৃথিবীতে হারিয়ে যায়। আজ সে সত্যিই বড় হতাশ। লম্বা টানা একটা ঘুম ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাছাড়া কাল সকাল না হতেই আরামবাগ ছুটতে হবে। পুরোনো এক ক্লাসমেট ওখানে ডাক্তার। আশিস কথা দিয়েছে, আরামবাগের অনতিদূরে কামারপুকুরে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবে।
ডাক্তার আশিস কথা রাখে। উদ্দালককে কামারপুকুরে ডাক্তারবাবুর নার্সিং হোমের রিসেপশনে বসিয়ে দেন। ন্যাংটো বয়সের বন্ধু বলে কথা। বেঈমানি করবে না কোনোভাবেই। উদ্দালক কথাচ্ছলে নিনার প্রসঙ্গটা তোলে। আশিস বলে, এ আবার এমন একটা কী ব্যাপার? কালই নিয়ে আয়, নিজে হাতে সব করে দেব।
উদ্দালক আমতা আমতা করে তবু। আশিস বলে, তুই আমার কর্মচারী নোস যে তোর কাছে পয়সা চাইব; আজ রাতটা তুই থেকে যা; কাল সকালে ড্রাইভার এলেই গাড়ি নিয়ে চলে যাবি; নিনাকে নিয়ে চলে আসবি; বাকি চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দে।
আশিসের পরিকল্পনা মাফিক সব ঠিকঠাক মতোই হয়ে যায়। পরদিন বিজয়া দশমী। আশিস তবু সব সামাজিকতা ফেলে এসে নিনাকে অ্যাটেন্ড করে। মাইনর ব্যাপার। লোকাল আনেস্থেশিয়া করলেই কাজ হয়ে যাবে। সামান্য একটু কমপ্লিকেশন আছে – এই যা। নিনা একটু অ্যানিমিক। রক্তের দরকার হলেও হতে পারে। লোকাল ব্লাডব্যাঙ্কে কথা বলে নেয় আশিস। রক্ত রেডি রাখতে হবে। ড্রাইভার উদ্দালকক নিয়ে ব্লাডব্যাঙ্কে চলে যায়। আশিস ফোন করলেই ওরা এ প্লাস গ্রুপের রক্ত নিয়ে চলে আসবে…
কিন্তু রক্ত লাগেনা শেষ পর্যন্ত…
কিছুই লাগে না। উদ্দালকের কাছে গোটা আকাশটা জমা রেখে নিনা চলে যায় ওর স্থায়ী ঠিকানায়। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে। কত দিন আর ভিটেমাটি ছেড়ে এভাবে ভাড়াবাড়িতে পড়ে থাকা যায়?
লেখক পরিচিতি : গৌতম ঘোষ-দস্তিদার
প্রাক্তনী - প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, স্ত্রাসবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতবর্ষে ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাড়ে তিন দশক জুড়ে বাংলা ইংরেজি ও ফরাসি পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজিতে শখের সাংবাদিকতা। অধুনা অবসরে সৃজনশীল লেখা, সম্পাদনা ও অনুবাদ।