গল্প হয়েও সত্যি

লেখক : দেবজিত ঘোষ

২৬ শে নভেম্বরঃ
“হ্যালো, মিস্টার শ্রীবাস্তব? হা, মেই দেবমাল্য চ্যাটার্জী বোল রাহা হু। হা, সার, ম্যায় সারে চার বাজে তাক্ পোঁহচ জায়ুঙ্গা! ওকে সার, ওকে।”
 
ফোন টা কেটে দেবমাল্য চায়ের কাপে চুমুক দিল।
 
(প্রাক কথা)
দেবমাল্য চ্যাটার্জী; কলকাতার ছেলে। ছোট থেকেই ইচ্ছে সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার; আরো ভাল ভাবে বলতে গেলে সিনেমা পরিচালনার অদম্য বাসনা। তার থেকেই কলকাতার এক নামী প্রতিষ্ঠান থেকে সিনেমা পরিচালনার খুঁটিনাটি শেখার পর নিজের নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা!
 
কিন্তু কলকাতায় ওর গল্পের প্লট টাকে চলচ্চিত্রের রূপ দেওয়ার জন্য কোনো প্রযোজককে-ই ও পাশে পাচ্ছিল না। সবার মতেই নাকি গল্পে রিয়েলিটি থাকলেও প্লটটা খুব ঘ্যানঘ্যানে টাইপের! তাই সিনেমাটা যদি তৈরি হয়, তাহলে অ্যওয়ার্ড পেলেও অর্থনৈতিক লাভ নাকি হবে না। তাই কোনো প্রযোজক ছবিটায় টাকা ঢালতে রাজি নয়। অবশ্য ২০০৮ সালে টলিউডে বাংলা সিনেমার অবস্থা যে খুব একটা ভাল ছিল না, তা দেবমাল্যও বুঝতে পেরেছিল।
তাই মুম্বাইতে কর্মসুত্রে থাকা দাদা যখন পুজোর ছুটিতে বাড়িতে এল, বুদ্ধি করে দেবমাল্য ওর দাদাকে স্ক্রিপ্টের এক কপি দিয়ে রাখল। কারণ ও জানত, দাদাদের কোম্পানি বলিউডের বিভিন্ন এলিট পার্টি আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত থাকে, ফলে ইন্ডাস্ট্রির অনেকের সাথে ওর দাদার ভাল-ই যোগাযোগ আছে; তাই সে সুযোগে যদি দাদা কোনো প্রযোজককে স্ক্রিপ্টটা দেখিয়ে রাজি করাতে পারে! অবশ্য ও আর ওর দাদা বিলক্ষণ জানে যে, কাজটা মোটেই সহজ নয়; কারণ বলিউডের কোনো প্রযোজক কোনো নতুন আনকোরা বাঙালী পরিচালকের ছবিতে টাকা ঢালবে, এমনটা ভাবাটা সহজ হলেও, হওয়াটা বেশ কঠিন। তবু দেবমাল্যকে ফিরে যাওয়ার সময় ওর দাদা আশ্বাস দিয়ে গেছে যে, সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে কাজটা করার। এখন এই আশ্বাসটা-ই দেবমাল্যর কাছে সবকিছু, এই আশ্বাসের সার্থকতার উপরেই তো নির্ভর করছে ওর স্বপ্নের সার্থকতা। তাই দাদার ওপর বিশ্বাস রেখে অপেক্ষা-ই ওর ধৈর্যের পরীক্ষা।
 
১১ ই নভেম্বরঃ
আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/ আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি/ যেটা ছিল না ছিল না সেটা না পা… – ফোন টা তুলল দেবমাল্য।
 
“হ্যাঁ, দাদা, বল। কেমন আছিস? কি খবর?”
 
“আরে আমার খবর পরে হবে দেবু, আগে তোর সুখবর টা শোন। আমাদের এখানে ‘ডেল্টা প্রোডাকশান’-এর মতো নামী প্রযোজনা সংস্থার তোর স্ক্রিপ্টটা পছন্দ হয়েছে খুব। ওনারা খুব ব্যস্ত শেডিউল থেকেও ২৬ তারিখ দেখা করবার ডেট দিয়েছে; তাই তুই তাড়াতাড়ি এখানে চলে আয় দেবু। এখানে কবে কোন ট্রনে আসছিস সেটা একবার বলে দিস। কেমন? বাকিটা তোকে এখানে আসার পরে বলব। এখন আমার তাড়া আছে, রাখছি রে। ভালো থাকিস, আর সাবধানে আসিস।”
 
দাদা ফোনটা রাখার পরে দেবমাল্য কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওর যেন নিজের কানকে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও ভাবতেই পারেনি, এত তাড়াতাড়ি এই ধরনের একটা খবর ও পাবে! যাই হোক, কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়ানোর পর ওর সম্বিত ফিরল। তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়ে ও ওর মাকে খবর টা দিল। ওর মা যেমন খুশি হল, তেমনই ভয়-ও পেল, কারণ, ও আগে কখনও একা এত দূরে যায়নি। তবে দেবমাল্য ওর মাকে আশ্বস্ত করল, যে ও খুব তাড়াতাড়ি-ই ওর মায়ের কাছে ফিরে আসবে। এই বলে ও তাড়াতাড়ি সব যাবার ব্যবস্থা করবার কাজে লেগে গেল। বেরোনোর আগে বান্ধবী শ্রীতমাকেও জানাল খবরটা। শ্রীতমা বরাবর-ই ওর ইচ্ছে-স্বপ্নকে সমর্থন করেছে; এবারও তার কোনও খেলাপ হল না।
 
“আমি শুধু তোকে খুশি দেখতে চাই, এটা জানবি আমি সবসময় তোর সাথে আছি। যা, দৌড়ো নিজের স্বপ্নকে ধরতে। আই লাভ ইউ দেব।”
 
২৩ শে নভেম্বরঃ
হাওড়া থেকে দুপর তিনটে আট-এ ট্রেন। দেবমাল্য অবশ্য দেড়টার এর মধ্যে স্টেশনে চলে এসেছে। এখনও যেন দেবমাল্যর পুরোটা স্বপ্নের মতো লাগছে। ও আর তর-ই সইছে না, কতক্ষণে ও মুম্বাই পৌঁছবে।
 
২৫ শে নভেম্বরঃ
এই কিছুক্ষণ আগে দেবমাল্য ওর দাদার বাড়ি পৌঁছেছে। ওর দাদা দীপ্যায়নের বাড়ি মুম্বাইয়ের বান্দ্রা এলাকায়। দাদার কাছ থেকে সব ডিটেলস্ নিয়ে নিয়েছে ও। ডেল্টা প্রোডাকশানের প্রতিনিধি মিস্টার ভিক্টর শ্রীবাস্তব-এর সাথে ওকে দেখা করে কথা বলতে হবে। স্থানটাও যথেষ্ঠ আভিজাত্যে পূর্ণ। মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ‘হোটেল তাজমহল প্যালেস’। সময় বিকেল পাঁচটা। দেবমাল্য ওর ঘড়িটা দেখল, পুরো পাঁচটা বাজে। তার মানে আর মাত্র ২৪ ঘন্টা – এটা ভেবেই ওর মনের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেল অনাবিল আনন্দের স্রোত।
 
২৬ শে নভেম্বরঃ
আজ সকাল থেকেই দেবমাল্য প্রচন্ড পরিমাণে খুশি। তার একটা কারণ যদি মিঃ শ্রীবাস্তবের সাথে দেখা করা হয়, তাহলে অন্য কারণটা হল, আজ ওর ২৮ তম জন্মদিন। ও তাই নিজেকে মনে মনে এটাই বলে চলছে, আজকের দিনটা-ই বোধহয় ওর জন্মদিনের সেরার সেরা গিফ্ট হয়ে উঠবে। চা-এর কাপে এক চুমুক দিয়ে ও ফোন করল মিঃ শ্রীবাস্তবকে।
 
“হ্যালো, মিস্টার শ্রীবাস্তব? হা, মেই দেবমাল্য চ্যাটার্জী বোল রাহা হু। হা, সার, ম্যায় সারে চার বাজে তাক্ পোঁহচ জায়ুঙ্গা! ওকে সার, ওকে।”
 
ফোন টা কেটে দেবমাল্য চায়ের কাপে চুমুক দিল।
 
ইতিমধ্যেই মা,দাদা, বৌমণি আর শ্রীতমা ওকে উইস করে শুভেচ্ছা জানিয়েছে আজকের দিনটার জন্য। ওর বাবা বছর চারেক হল, একটা পথদুর্ঘটনায় পরলোক গমন করেছেন। ওর বাবা সবসময় ওকে উৎসাহ দিয়ে এসেছে। আজকে তাই ওর বাবাকে খুব মনে পড়ছে।
 
সবার শুভেচ্ছা আর নিজের আত্মবিশ্বাকে সঙ্গে করে নিয়ে দেবমাল্য হোটেল তাজমহল প্যালেস-এ যখন পৌঁছোল, তখন বিকেল সাড়ে চারটে। মিঃ শ্রীবাস্তবকে ফোন করায় উনি ওকে ঘরের নম্বরটা দিয়ে দিলেন। নির্ধারিত সময়ের আগে আসার জন্য মিঃ শ্রীবাস্তব স্বভাবতই খুশি হয়েছেন।
 
“গুড ইভনিং মিস্টার দেবমালিয়া। আজ ইহা পার রাত মে হামারা এক পার্টি হে, তো সোচা আপকো আজ হি বুলালু। রাত ৮ বাজে সে পার্টটি হে। আপ ভি জারুর রাহেনা। চালো বাত করতে হ্যায়।”
 
“ঠিক হে, স্যার, জায়েসা আপ কাহে।”
 
দেবমাল্যর এসব পার্টি খুব একটা ভাল লাগে না, কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই না বলাটা অভদ্রতা; তার উপর যদি কাজটাই হাত থেকে চলে যায়, তাহলে? মনে মনে ঠিক করল, পরে কিছু একটা বাহানা বানিয়ে ঠিক বেরিয়ে যাবে।
মিটিং শেষ হতে হতে ৭:৩০ বেজে গেল। মিঃ শ্রীবাস্তব বলেছেন, আবার ৩০ তারিখে পরবর্তী আলোচনা হবে। রবে মিঃ শ্রীবাস্তব এটা নিশ্চিন্ত করেছেন যে, ওনার প্রোডাকশন হাউস এই ছবি স্পন্সর করবে। দেবমাল্য ভাবছে যে, এই কদিন ওর দাদার বাড়িতেই থেকে যাবে, এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠল। দেখল দাদার ফোন।
 
“হ্যাঁ, দাদা বল, এই মিটিং শেষ হল।”
 
“যাক্ ভালই হল তালে! আমি এটাই ভাবছিলাম, মিটিং টা শেষ হল কিনা!”
 
“কেন, কিছু হয়েছে দাদা?”
 
“বেশি কিছু বলতে পারব না এখন, তোর বৌমণির বাবার হঠাৎ বুকে ব্যথা উঠেছে, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এক্ষুনি যেতে হবে। তোকে একা রেখে যাব না, তুই-ও আমাদের সাথে চ। তুই তাড়াতাড়ি ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে চলে আয়, ৯:১০ এর ট্রেন। আমি গিয়ে তোকে ফোন করব। ট্যাক্সি করে চলে আয়, কেমন? ওখানে দেখা হবে। এখন রাখছি রে।”
 
“ঠিক আছে দাদা।”
 
ওর বৌমণি এখানকার-ই বাসিন্দা। মুম্বাই থেকে ৭০ কিলোমিটার মত দূরের এক মফঃসলে থাকে। দাদা যখন এখানে কাজের সূত্রে আসে, তখন আলাপ। তবে হিন্দিভাষী হলেও দাদার সাথে থেকে থেকে বাংলা ভাষা অনেকটা-ই আয়ত্ত করেছে। দেবমাল্যকেও ওর বৌমণি খুব-ই স্নেহ করে। তাই খবর টা পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই ওর-ও খুব চিন্তা হতে শুরু করল। তাই আর দেরি না করে সটান মিঃ শ্রীবাস্তবের কাছে গিয়ে সব খোলসা করে বলল।
 
“আরে কেয়া বোল রাহে হো? জায়ো জায়ো, ফ্যমিলি হার চিজ্ সে আগে হে। পার্টি তো ফির হোগি। তাব তুম রেহে লে না, ঠিক হ্যায়! তিষ তারিখ কো মিলতে হেয়।”
 
“থ্যাঙ্ক ইউ সার। গুড নাইট, সি ইউ এগেন।” – বলে দেবমাল্য দৌড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে ট্যাক্সি ধরে রওনা দিল। রাস্তায় ভিড় হওয়ার জন্য স্টেশনে পৌঁছতে প্রায় ৯ টা বাজল। স্টেশনে ঢুকে কিছুটা এগোতেই দাদার ফোন। ফোনটা তুলতে যাবে, ঠিক তখনই চারিদিকে হঠাৎ-ই গাঁ গাঁ করে মেশিগানের মতন শব্দ আর সাথে মানুষের আর্তনাদের শব্দ!
টি-স্টলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা দেবমাল্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে কিছু বুঝে ওঠবার আগেই একটা নয়, বেশ কয়েকটা বুলেট এসে গেঁথে গেল ওর পিঠে। হাত থেকে ফোন পরে গেল। দেবমাল্য লুটিয়ে পড়ল নীচে। এক নিমেশে নিষ্প্রাণ হয়ে গেল তরতাজা একটা দেহ। শুধু দেবমাল্য-ই নয়, ওই স্টেশনে থাকা প্রতিটা মানুষের দেহ কয়েক মুহুর্তের মধ্যে পরিণত হল মৃতদেহে।
 
যে দুজন হাতে বন্দুক নিয়ে নির্বিচারে এই হত্যালীলা চালিয়েছিল, তাদের সঙ্গীরা দেবমাল্যর তাজ হোটেল থেকে বেরোনোর কিছু পরেই সেখানেও ঢুকে কাড়তে শুরু করে দিয়েছে একের পর এক প্রাণ। নিস্তার পান নি মিস্টার শ্রীবাস্তব-ও। শুধু তাই-ই নয়, মুম্বাইয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গাতেও তারা শুরু করে দিয়েছে তাদের হত্যা তান্ডব।
 
(শেষের কথা)
এই গল্পের সব চরিত্র-ই কাল্পনিক; তবু এটা নিয়ে কারোর-ই আশা করছি দ্বিমত থাকবে না যে, এই দেবমাল্য-এর মতোই কয়েকশো সাধারণ মানুযষের জীবন-ই শুধু নয়, তাদের স্বপ্নকেও এক চুটকিতে টোকা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল ২০০৮ সালের ২৬ শে নভেম্বর মুম্বাইয়ের এই সন্ত্রাসবাদী হামলা। আজ ৭ টা বছর পেরিয়ে সেই সন্ত্রাসবাদ হয়ে উঠেছে আরও নির্মম, আরও মারাত্মক।
 
কিন্তু তাই বলে আমাদের ভয় পেলে কখনো-ই চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শেষ পর্যন্ত সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে জয়ী হয় শুভ শক্তি। তাই শুভ শক্তি মানবিকতা আর সৌভ্রাতৃত্ববোধকে ঢাল করে আমাদের এগোতে হবে, করতে হবে কঠোর প্রতিবাদ এই ধরনের নির্মম ঘটনার, যা মানবিকতাকে পদে পদে ভূলুন্ঠিত করে চলেছে। তাই আসুন সকলে, আজ আবারও জানাই ২৬/১১ -এর সন্ত্রাসবাদীদের নির্মম হত্যালীলার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ আর কামনা করি যে, নিশির কুচকুচে অন্ধকার চিঁড়ে একদিন আলোর রোশনাই চারিদিককে উজ্জ্বল দ্যুতিতে ভরিয়ে তুলুক, যাতে দেবমাল্য-এর মতো কোনো মানুষের-ই জীবন আর তার স্বপ্ন সন্ত্রাসবাদের নির্মম রক্তাক্ত হাতে পড়ে অপূর্ণ না থেকে যায়।

লেখক পরিচিতি : দেবজিত ঘোষ
কবিতা লিখি - সিনেমা দেখি - গান গাই - স্বপ্ন দেখি। নিজের একান্ত একটা জগৎ নির্মাণে সদা সচেষ্ট থাকি। নতুন পরিচয়ে একটু গম্ভীর হই, কিন্তু বন্ধুত্ব গভীর হলে চূড়ান্ত ছ্যাবলামো করা থেকে পিছপা হই না। কষ্ট হলে ভেঙ্গে পড়ি, একটু কেঁদে আবার মনটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পড়ি। আর এই সমস্ত ধুসর - রঙিন অধ্যায়গুলোর মাঝেই দু - এক লাইন মনের কথা লিখে ফেলি।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।