ঘুষ

লেখক : অভীক সিংহ

চাকরি পাওয়া কঠিন বলে জানতাম। কিন্তু চাকরি দেওয়াও যে এক প্রকার কঠিন হতে পারে, সে ব্যাপারটা কখনও মাথায় আসেনি। মানে সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে ইণ্টারভিউ নেওয়ার পালা। পালে পালে চাকুরিপ্রার্থীরা আসছে, আর আমরা তাদের যোগ্যতা বিচার করে চলেছি। মনে মনে ভাবছি, এই কয়েকটা বছর আগেও তো আমি ছিলাম টেবিলটার উল্টোদিকে। এই কয়েক বছরে শুধু আমার বসার জায়গাটাই পাল্টেছে। কিন্তু নতুন চেয়ারে বসার সুযোগ পেয়েছি বলে যে আমার কোন বেয়াড়া ল্যাজ গজিয়েছে, সেটা সম্পর্কে তো আমার কোন ধারণাই নেই। আমি জানতাম যে বসার জায়গাটা পাল্টেছে বলে জীবনে একটা বসের আমদানি হয়েছে, আর আমরা তাঁর বশবর্তী হয়েই কাজ করে চলেছি। আমি সমস্ত চাকুরীপ্রার্থীদের মোটামুটি একটা নম্বর দিয়ে সুবিধেমত জায়গায় রেখে চলেছি, অন্যদিকে প্যানেলের অন্যান্য সদস্যরা একেবারে গৌতম গম্ভীর হয়ে মোটা মোটা লাল কালির রেখা দিয়ে নম্বরে কাঁচি করে চলেছেন। আমি ভেবে চলেছি, এত বাড়তি নম্বর এনারা কেটে সাথে করে নিয়ে গিয়ে চেটে খাবেন কি না। কিন্তু নম্বরের স্বাদ সম্পর্কে হাজার ভেবেও বিশেষ কোন সদুত্তর পেলাম না। শেষমেশ সময়টা গড়িয়ে দুপুর বেলা আসতেই কাঁচা নম্বরে কাঁচি দেখার বিরক্তি থেকে একঘণ্টার বিরতি পেলাম। খিদেটা তেমন ছিল না, তাই মেসের দিকে যাব কি না গড়িমসি করছি, এমন সময় পিছন থেকে বজ্রনির্ঘোষ ভেসে আসল, “কী হে, সকালটা কেমন গেল?”
পিছনে ফিরে দেখি, সান্যালদা। আমি কিছুটা ক্লান্তির সুরেই বললাম, “ধ্যুৎ, সকাল থেকে যা চলছে, মাথাফাথা একেবারে ঘেঁটে গিয়েছে।”
“হমম, বুঝতে পারছি। তো, লাঞ্চ করতে যাবে তো?”
“না গুরু, আজ তেমন ক্ষিদে নেই। পেটটা ভার ভার লাগছে।”
“হ’ল তো এবারে? কাল পইপই করে বলেছিলাম, বিরিয়ানির সাথে অতটা মটন চাপ খেও না। এখন চাপ হয়ে গেল তো?”
“তাই তো দেখছি। ভাবছিলাম একটু চা খাব। তুমি আসবে?”
“এখন লাঞ্চটাইমে চা?” সান্যালদা ঘড়ি দেখে কী একটু ভেবে বলল, “দাঁড়াও, গিন্নিকে একটা ফোন করে নিই।” এই বলে একটু দূরত্বে গিয়ে মোবাইলে দু’-তিন মিনিট কথা বলে ফিরে এসে হাসিমুখে বলল, “চল, চা-ই খেয়ে আসি।”
আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, “বৌদির সাথে কী কথা হ’ল?”
“আরে তোমার বৌদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আজ রাতে একটু লুচি-মাংস হবে কী না। ও এককথায় রাজি হয়ে যাওয়াতে ভাবলাম আজ পেটটা একটু খালি রাখলে রাতে তরিবৎ করে সাঁটানো যাবে।” সান্যালদা হাসতে হাসতে উত্তর দিল।
“সত্যি গুরু, তুমি পারোও বটে।” বলে আমরা দু’জনেই হাসতে হাসতে এগোলাম লাউঞ্জের দিকে। এই সময়টায় বেয়ারারা থাকে না, তারাও লাঞ্চ করতে বেরিয়ে যায়। তাই নিজেরাই লাউঞ্জের টেবিল থেকে দু’টো কাপ তুলে নিয়ে তাতে একটু গরম জল, চিনি, আর গুঁড়ো দুধ নিয়ে চামচ দিয়ে গুলে তাতে ফেলে দিলাম একটা করে টি-ব্যাগ। তারপরে হাতে করে চায়ের কাপ নিয়ে এসে আমরা বসলাম লাউঞ্জের বাইরে সোফায়। প্রথম চুমুকটা দিয়েই আমার মুখ দিয়ে বেরোল, “আহহ, এবারে শান্তি। মাথাটা যেন একটু ছাড়ল।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সানালদাও বলল, “সত্যি বলেছ, শান্তিই বটে।”
“তারপরে বলো, তোমার প্যানেলে কেমন যাচ্ছে?”
“মন্দ না, পাবলিক মোটামুটি ভালই উত্তর দিচ্ছে। তোমার প্যানেলের খবর কী?”
“বলো না মাইরি, আমার প্যানেলের বাকি মেম্বাররা তো ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচ সবাইকে উড়িয়ে যাচ্ছে।”
“বোঝো অবস্থা। তা ক্যাণ্ডিডেটরাও কি ঝোলাচ্ছে নাকি?”
“তা একটু, তবে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতও নয়। ভেবে দেখো, আমরাও ঢোকার সময় তো এদের মতই ছিলাম।”
“তা ঠিক বলেছ। কিন্তু একটা জিনিস দেখো, এখন তো প্রতিযোগিতাটাও বেড়েছে, আর সিট তো রোজই কমছে।”
“তা অবশ্য ঠিকই বলেছ, সিট তো রোজই কমছে। আর সিট থাকলেও তাতে সেঁটে থাকার তো কোন গ্যারাণ্টি নেই। স্কুল সার্ভিস কমিশনের কেসটাই দেখে নাও।”
“হমম, ওটা তো কেসের বদলে একেবারে স্যুটকেস হয়ে গেল।”
“তা ঠিক বলেছ।”
“তবে ঘুষের চাকরিতে তো আর শান্তি নেই। আর এই চক্করে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে গেল।”
“তাও ঠিক। এই ঘুষ নেওয়া আর দেওয়া – দু’টোর জন্যেই যত সমস্যা।”
“না দিয়ে আর উপায় কী বলো। নইলে তো তোমার হকের ধান খেয়ে যাবে বকে।”
“আরে এই ঘুষ বলতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ল। একবার একটা পুলিশকে যা ঘুষ দিয়েছিলাম, মালটা সারা জীবন মনে রাখবে।”
“মানে? তুমি ঘুষ দিয়েছিলে?” সান্যালদা একটু নড়েচড়ে বসল।
“হ্যাঁ।” আমি মাথা নাড়লাম।
“যা ঘুষ চেয়েছিল, তার চেয়ে কম দিয়েছিলে নাকি?”
“না না, সে যা চেয়েছিল, তাই দিয়েছিলাম। কিন্তু যা দিয়ে এসেছিলাম, সেটাই মাল সারাজীবন মনে রাখবে।”
“বাওয়াল-টাওয়াল করেছিলে নাকি?”
“এক্কেবারে নিপাট ভদ্রভাবে দিয়ে এসেছিলাম। নো বাওয়াল। তবে মালটা টাওয়ালে মুখ লুকোনোর জায়গা পায়নি।”
“তোমার ভদ্রভাবে দেওয়া মানে খুব ভাল করে জানা আছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা বাজে রকম কেস করে এসেছিলে। তাই তো?”
“সে তো বটেই।” বলে আমি মুচকি হাসলাম।
“তাহলে আর দেরী কেন? বলেই ফেল কী করেছিলে, শুনি একটু।”
“একটু কেন? পুরোটাই শোনাব।” এই বলে আমি চায়ের কাপটা রেখে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরালাম। সোফায় গা এলিয়ে আলতো করে একটা ধোঁয়া ছেড়ে শুরু করলাম।

সে অনেকবছর আগের কথা। তখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া শেষ করে এমবিএ করতে ঢুকেছি। সদ্য ফাস্ট ইয়ারের পড়াটা শেষ হয়ে এসেছে। আর ফার্স্ট ইয়ারের শেষে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার আগে সমস্ত ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে দু’মাসের জন্য একটা সামার ইন্টার্নশিপ করতে হত। তখন লক্ষ্য তো একটাই – এমবিএ শেষ একটা ভালো চাকরি যোগাড় করা। আর সেই ইন্টার্নশিপটা করতে পারলে পরে চাকরি পেতে বেশ সুবিধে হত। তাহলে বুঝতেই পারছ, চাকরি পেতে গেলে সেই ইন্টার্নশিপ পাওয়াটা কতটা দরকার ছিল। তো আমাদের ফার্স্ট ইয়ার শেষ হবার আগেই কলেজে বিভিন্ন কোম্পানি আসতে শুরু করল। আমরাও কোমর বেঁধে লেগে পড়লাম একটা ইন্টার্নশিপ যোগাড় করবার জন্য। তো আমরা বিভিন্ন কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপের জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছি। কেউ সুযোগ পাচ্ছে, আবার কেউ বা পরের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছে। এইরকম ভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন কলেজে একটা অদ্ভুত খবর আসল। একটা কোম্পানি আসছে, যে ইন্টার্নশিপটা নাকি দিচ্ছে তার মালয়েশিয়ার অফিসের জন্য, ভারতে নয়। শুনে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। বলে কী! মালয়েশিয়া! তখন তো আমাদের কাছে তো সেটাই বিলেত। মানে তখন আমরা নিজেদের ট্যাঁকের পয়সা খরচা করে বড়জোর মুম্বাই লোকালে ধাক্কা খেতে খেতে জুহু বীচ অবধি যেতাম, শাহরুখ খানের মন্নতের বাইরে দাঁড়িয়ে ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মত নৃত্য করতাম, তারপরে বড়ে মিঁয়া থেকে একপ্লেট কাবাব আর রুটি কিনে তিন-চারজনে মিলে চেটেপুটে খেয়ে আবার সেই লোকালে ধাক্কা খেতে খেতে ফিরে আসতাম। আর সেই আমাদের মত হাড়-হাভাতেদের সামনে মালয়েশিয়ার হাতছানি। ঠিক যেন আমরা দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গের শেষদৃশ্যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কাজল, মালয়েশিয়া যেন শাহরুখ খান হয়ে ট্রেনের দরজায় বাদুড়ঝোলা হয়ে আমাদের দিচ্ছে হাতছানি, আর আমাদের কলেজের প্লেসমেণ্ট কমিটি অমরীশ পুরীর মতই পিছন থেকে বলছে, “যা বেটা, জি লে আপনি জিন্দেগি।” কয়েকদিন পরেই কলেজ থেকে বলা সবাইকে হ’ল নিজেদের পাসপোর্ট তৈরি রাখার জন্য, কারণ দেড়মাস পরে কোম্পানিটি আসবে কলেজে। পাসপোর্ট! ভিসা! বিদেশ! ভাবতেই কেমন যেন একটা শিহরণ হতে লাগল। আমাদের অনেকেই তো আবার স্বপ্নের ঘোরেই মালয়েশিয়াতে সংসার পাতার চিন্তাভাবনাও শুরু করে দিয়েছিল। ভাবতে তো আর পয়সাও লাগে না, ভিসাও লাগে না। কিন্তু মালয়েশিয়া অবধি যেতে অন্তত পাসপোর্টটা তো লাগবেই। তো আমরা সবাই সেই কাজেই কোমর বেঁধে লেগে পড়লাম।

যে সময়ের কথা বলছি, তখনও কিন্তু পাসপোর্টের অনলাইন পরিষেবা শুরু হয়নি। তখন রীতিমত পাসপোর্ট অফিসের বাইরে ভোরবেলা থেকে লাইন দিয়ে বসে থাকতে হত। একটা লাইন সাধারণ পরিষেবার জন্য, আর তৎকাল পরিষেবার জন্য অন্য লাইন। আর সবচেয়ে বড় মুশকিলটা ছিল, তৎকাল পরিষেবা দিনে মাত্র চল্লিশজনকেই দেওয়া হত। সেজন্য অনেকে তো আবার ভোররাত থেকে এসেই অপেক্ষা করত। তো আমি যেদিন গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম, তখন ঘড়িতে বাজে সকাল সাড়ে ছটা। অফিস খুলবে দশটায়। গুণে দেখলাম সাঁইত্রিশ নম্বরে আছি। একটু শান্তি, মানে আজ অন্তত পাসপোর্টের ফর্মটা জমা দিয়ে দিতে পারব। সমস্ত সার্টিফিকেট, নথিপত্র, আর পাসপোর্ট সাইজ ছবি বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে আছি লাইনে। অফিস সময়মতই খুলল। যথারীতি আমার নম্বর আসতেই ভিতরে গিয়ে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্মটা নিলাম। তারপরে ধীরেসুস্থে ফর্মটা ভরে, ছবি লাগিয়ে, সমস্ত সার্টিফিকেট আর নথিপত্রের জেরক্সসুদ্ধ জমা দিলাম। তারপরে অফিসেই বসে রইলাম। ভেবেছিলাম হয়ত সেদিনই পাসপোর্ট দিয়ে দেবে, কারণ পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে কোন ধারণাই তো ছিল না। শেষে একজন পিওনের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম যে ব্যাপারটা বেশ সময়সাপেক্ষ। আমার জমা দেওয়া ফর্ম প্রথমে যাচাই করে দেখা হবে, তারপরে পুলিশ এসে আমার ব্যাপারে খোঁজখবর নেবে, আর সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হ’লে তারপরেই আমার বাড়িতে পাসপোর্ট আসবে। আর এই পুরো ব্যাপারটা শেষ হতে সময় লাগবে প্রায় এক মাস মত। এত বড় প্রক্রিয়া! বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন সফল করতে গেলে এই যুদ্ধে জয়লাভ যে করতেই হবে, সেটা বেশ আন্দাজ করতে পারলাম। এইজন্যেই ভারতীয়রা কখনও কোন দেশে আক্রমণ করতে যায়নি, এই ঝামেলা পোয়াবে কে। লাইন দাও, ছবি তোল, জেরক্স করো, ফর্ম ভরো, জমা দাও, তারপরে আবার পুলিশের ঝক্কি – বাপরে! তো এই যাচাই প্রক্রিয়া না চাইলেও একমাস চলবে, কিছুই করবার নেই। অগত্যা বাড়ি ফিরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে একদিন প্রতীক্ষার অবসান হ’ল।

একদিন সকালে বাড়িতে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ বাড়ির ল্যাণ্ডফোনটা বেজে উঠল। আমি উঠে গিয়ে ফোনটা ধরে “হ্যালো” বলতেই অন্যদিক থেকে একটা গম্ভীর স্বর ভেসে আসল, “হ্যালো, আপনি কি অভীক বলছেন?”
“হ্যাঁ বলছি।”
“আমি থানা থেকে বলছি।”
থানা শুনেই একমুহূর্তের জন্য পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল। বিগত কয়েকদিনে যা যা কুকর্ম এবং অপকর্ম করেছি, সব একবার মনে করার চেষ্টা করতে করতে একটু শুকনো গলায় বললাম, “হ্যাঁ বলুন।”
“আপনার পাসপোর্ট এসেছে। আপনাকে একবার আপনার সব সার্টিফিকেট নিয়ে একবার আসতে হবে।”
“পাসপোর্ট এসেছে?” আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় ভাবটা তড়াক করে বেড়ে গেল।
“হ্যাঁ, আপনার পাসপোর্ট এসে গিয়েছে। সব সার্টিফিকেট আনবেন। আজ দুপুরের মধ্যেই চলে আসুন।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি একটু পরেই আসছি।”
বলেই ফোনটা রেখে ঘরের মধ্যে একটু হাত-পা ছুঁড়ে নেচে নিলাম। পাসপোর্ট! এবারে বিদেশযাত্রা আর আটকায় কে! একটু ভিআইপি ভিআইপি ভাব আসতে লাগল মনের মধ্যে। আর পায় কে আমায়! কালবিলম্ব না করে সমস্ত সার্টিফিকেট ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে যাব, ভিতরের ঘর থেকে মায়ের আওয়াজ ভেসে আসল, “বাইরে যাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ, থানায় যাচ্ছি। পাসপোর্ট এসেছে।” আমি একটু অধৈর্য্য হয়েই উত্তর দিলাম।
“বাইরে যাচ্ছিস যখন, তখন ফেরার পথে ক’টা জিনিস আনিস তো।” বলে মা বাইরে এসে হাতে একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এগুলো মনে করে নিয়ে আসবি। আর ব্যাগ থেকে একশো টাকা নিয়ে নিস।”
কী আর করা। পিঠে সার্টিফিকেটের ব্যাগ, হাতে বাজারের ব্যাগ, আর পকেটে একশো টাকা নিয়ে বেরোলাম। ভাবলাম, আগে পাসপোর্টটা নিয়ে নিই। ফেরার পথে বাজারটা করে নেব। আর বাড়ি থেকে থানাটাও বিশেষ দূরে নয়। সাইকেল নিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। থানায় ঢুকে একজন অফিসারকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি অন্য একজন অফিসারের দিকে নির্দেশ করে ওনার কাছে বললেন। আমি উক্ত অফিসারের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, “ও, তোমার পাসপোর্ট?”
আমি কিছুটা গদগদস্বরেই বললাম, “হ্যাঁ স্যার। আমারই পাসপোর্ট।”
“আচ্ছা। দেখি একবার সার্টিফিকেটগুলো।” আমি ওনার হাতে সার্টিফিকেটগুলো তুলে দিতে উনি এক এক করে পরীক্ষা করে দেখে আমার পাসপোর্টের খামটা নিজের ড্রয়ার থেকে বের করে টেবিলে রাখলেন। আমি জুলজুল করে খামটার দিকে চেয়ে আছি। উনি প্রশ্ন করলেন, “পাসপোর্ট বানাচ্ছ কেন? বাইরে যাবে নাকি?” আমি ওনাকে মালয়েশিয়ার ব্যাপারটা বলাতে উনি বললেন, “ও-ও, এমবিএর ইন্টার্নশিপ। তা এটা করে আসলে ভাল চাকরি হয়ে যাবে?”
“মনে তো হয় স্যার। হয়ে তো যাওয়া উচিৎ।” আমি একটু খুশির সাথেই বললাম।
“তা বাবা, তুমি তো বিদেশ যাবে, ভাল চাকরি করবে, ভাল মাইনে পাবে। আর আমরা কী পাব?” উনি এবারে একটা সন্দেহজনক হাসি দিলেন।
আমি ব্যাপারটা আন্দাজ করে কতকটা না বোঝার ভান করেই বললাম, “ঠিক বুঝলাম না স্যার।”
“মালকড়ি কামাতে যাচ্ছ, কিছু তো ছাড়ো।” উনি একটা টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বললেন।
আমি একটু ভেবে নিয়ে হাসিমুখে বললাম, “অবশ্যই স্যার। তবে আমার কাছে এখন একশো টাকা আছে। এতে হবে স্যার?”
অফিসার একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “একশো? ঠিক আছে, তাই দাও। তুমি তো আবার স্টুডেণ্ট, তাই কাজটা ডিসকাউণ্টেই করে দিচ্ছি।”
আমি আবার সেই হাসিমুখে বললাম, “অনেক ধন্যবাদ স্যার।” বলে আমার পকেট থেকে পার্সটা বের করে অফিসারকে বললাম, “আমি দিচ্ছি স্যার, আপনি অনুগ্রহ করে একটু গুনে নিন।” বলে প্রথমেই পার্স থেকে চল্লিশ টাকা মত বের করে অফিসারের সামনে রাখলাম। তারপরে বের করলাম একমুঠো একটাকার কয়েন। অফিসারের সামনে টেবিলের উপরে রেখে “এক, দুই, তিন” করে গুনতে শুরু করলাম। অফিসার কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সোজা হয়ে উঠে বসতে বসতে আমি গোনা শেষ করে “তাহলে সাতান্ন টাকা হ’ল” বলে আবার পার্সে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলাম একমুঠো আট আনার কয়েন। সেটকেও টেবিলের উপরে রেখে গুনতে শুরু করলাম। অফিসার তখন রীতিমত বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে, আর তার কপালে ঘাম জমতে শুরু করে দিয়েছে। আর থানার অন্যান্য অফিসাররাও নিজেদের টেবিল থেকে উঠে এসে আমাদের টেবিলের পাশে জড়ো হয়েছে রগড় দেখার জন্য। আমি নির্বিকারচিত্তে আট আনার কয়েন গুনে চলেছি। গোনা শেষ করে অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললাম “আটষট্টি টাকা হয়েছে স্যার।” বলে পার্সে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলাম চার আনার কয়েন। অফিসার তখন প্রায় ককিয়ে উঠলেন, “অনেক হয়েছে, আর লাগবে না।”
আমিও নাছোড়বান্দা। “কী বলছেন স্যার। আপনি আমার জন্য এতকিছু করলেন। আমি চাকরি পাব, ভাল মাইনে পাব, আর আপনাকে কিছু না দিয়েই চলে যাব? তা তো হয় না স্যার।” বলে আমি আবার গুনতে শুরু করলাম। আমি “এক, দুই” করে গুনছি, আর আমার সাথে থানার অন্যান্য অফিসাররাও গলা মিলিয়ে গুনছে। সে এক দেখার মত দৃশ্য। গুনতে গুনতে সবে চার অবধি পৌঁছেছি, সেই অফিসার এবারে কাতরকণ্ঠে বললেন, “ছেড়ে দে বাবা, ঘাট হয়েছে। আর লাগবে না। এই নে তোর পাসপোর্ট। তুই এবারে আয়।”
“সবে তো বাহাত্তর টাকা হয়েছে স্যার। এখনও তো –”
“আমি ওতেই চালিয়ে নেব, আমার আর কিছু লাগবে না। তুই তোর পাসপোর্ট নে আর বিদেয় হ’।”
আমি একটু হতাশমুখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আচ্ছা স্যার, আপনি যেমন বলবেন।” বলে পাসপোর্টের খামটা তুলে ব্যাগে পুরে টুকটুক করে থানা থেকে বেরিয়ে আসলাম।

এই পর্যন্ত বলে থামলাম, সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছে। সান্যালদা এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। আমি একটা শেষ টান দিয়ে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলছি, সান্যালদা বলে উঠল, “মাইরি, যন্ত্র জিনিস তুমি একখানা। পুলিশকেই টাইট দিয়ে চলে আসলে?”
“আসল কেস তো কয়েক দিন পর হয়েছিল।” আমি চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিতে দিতে বললাম।
“সেটা আবার কী?”
“সেই অফিসার পরের রবিবার গিয়েছে বাজার করতে। মাছের বাজারে গিয়ে রুই মাছের দাম জিজ্ঞাসা করাতে তাকে কী বলেছিল জানো?”
“কী?” সান্যালদা উৎসাহের সাথে জিজ্ঞাসা করল।
“স্যার, কাতলা তো একশো টাকা কিলো। তবে আপনার জন্য বাহাত্তর টাকা।”
“অ্যাঁ? বলো কী?”
“আরে শোনই না। অফিসারটা মাছের বাজার থেকে পালিয়ে গিয়েছে শাকসব্জির বাজারে। সেখানে সবজি কিনে পয়সা দিতে গিয়েছে, সবজিওয়ালা তাকে কী বলেছিল জানো?”
“কী?” সান্যালদার হাসি প্রায় ফেটে পড়ার উপক্রম।
আমি মুচকি হেসে বললাম, “স্যার, বড় নোট দিচ্ছেন কেন? এতগুলো খুচরো পেলেন, সব খরচা হয়ে গিয়েছে?”
“উফফ, লা জাওয়াব, লা জাওয়াব,” বলে সান্যালদা সোফা চাপড়ে হো-হো করে হেসে উঠল।


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< অভিশপ্ত চিরুনি

লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।