লেখক : কেয়া রায়
ধাইয়ের মুখে খবরটা শুনে আমিনা সঙ্গে সঙ্গে আঁচলের গিঁট খুলে পঞ্চাশটা টাকা তার হাতে দিল। তারু ধাই এইটুকুতে খুশী হল না। কচর কচর পান চিবোতে চিবোতে বলল, “কী আমিনা ফুপি! এত্তো বড় খুশির খপরটা দিলাম, মোট্টে পঞ্চাশ টাকা! একটা গোটা নোট ছাড়ো দিকি, আজ এখুনো বউনি হয়নিকো।”
“পরে আবার দেবানি, বৌ। এখুন হাত এক্কেরে খালি।”
“বেটার ঘরে বেটা হল। পেরথম খপর দিলাম। কাঁসার থালা বাটি গেলাস নোবো। আর একখান গায়ে দেবার চাদরও।”
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আমিনা ঘরের পথ ধরল। চোখের পানিতে পথঘাট ঝাপসা। বেটার ঘরে বেটা এসেছে! তার ফারুক বাপ বনেছে! এই তো না হো’ক চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে কোল জুড়ে ফারুক এল। ওর বাপ নাসের সেদিন খুশিতে পাগল হয়ে গেছিল। হাঁড়ি হাঁড়ি মন্ডা মেঠাই দু’হাতে গাঁয়ের লোককে বিলিয়েছিল।
সেই ফারুক বছর দুই আগে বাপের অমতে নিকা করেছে ফতেমাকে। নাসের ওদের ঘরে ঠাঁই দেয়নি। ও চেয়েছিল বেটা আরও লেখাপড়া শিখে দিগগজ পণ্ডিত হো’ক, বাপ পিতিমোর নাম রোশন করুক। তা বলতে নেই, পড়াশোনায় বেশ মাথা ছিল ছোঁড়াটার। স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় নাসের ঘরছাড়া করেছে নিজের ছেলেকে। ফারুক সাত ক্রোশ দূরে দৌলতপুরে শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হয়ে আছে। ইলেকট্রিকের কাজ শিখে সে এখন ভালই দু’পয়সা কামায়।
ত্রিশ টাকার কেরোসিন কিনে আমিনা দ্রুত ঘরের দিকে রওনা দিল। রোগা মানুষটা ঘরে একা আছে। ছেলে চলে যাবার পর থেকে নাসের যেন কেমন বুড়িয়ে গেছে। আগে চাষের কাজে অসুরের মতো খাটতো। এখন একবেলা চষেই হাঁপায়। অথচ গোঁ ছাড়বে না। এই দুই বছরে একবারও ছেলেকে ডাকেনি। মুখে সব সময় কেবল বংশমর্যাদার কথা, ঈমানের কথা। আমিনা ভাবে, আজ তার ঘরে চাঁদের হাঁট বসার কথা। পুত, পুতের বৌ, নাতি। ভরভরন্ত সংসার। তা নয়, এই দুই কুড়ি বছর পেরিয়েও রোজ হেঁসেল ঠেলা। অবশ্য কীই বা ছাতা-মাথা রান্না হয়! পয়সা কৈ? একবেলা চাট্টি থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড় রেঁধে রেখে দু’বেলা খাওয়া।
মিঞা বড় অবুঝ। আরে, প্রেম করে বিয়ে তো আজকাল ঘরে ঘরে জলভাত। তা নিয়ে এত গোঁসা করে থাকলে চলে! কী না, তার বেরাদরিতে কেউ কখনও প্রেম-পিরিতি করে বিয়া সাদি করেনি। প্যায়ার মোহাব্বত করা গুনাহ। দিন বদলেছে। কিন্তু নাসের মিঞা এখনও পুরোনো ধ্যানধারণা আঁকড়েই বসে আছে। কষ্ট পাচ্ছে, তবু বংশের সম্মান তার কাছে সবার উপরে।
আমিনা মনে মনে ভাবে, কে জানে কার মতো হল বাবুটা! হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তো? বাচ্চারা একটু নাদুসনুদুস হলে ভাল লাগে। স্বাভাবিক প্রসব হ’ল, নাকি পেট কেটে সিজার? ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পেরেছিল তো, নাকি বাড়িতেই প্রসব? মনে বুড়বুড়িয়ে ওঠে হাজারও প্রশ্ন। তার নাতি, তার বুকজোড়া ধন। কবে যে কোলে নেবে! কথায় বলে, আসলের থেকে সুদ মিষ্টি। মিঞাকে খবরটা দেখার জন্যে মনটা আকুপাকু করছে।
বাড়ি ফিরে ঘরের কাজ সারতে সারতে গুনগুন করে গান গাইছিল আমিনা। মনটা আজ বেজায় খুশি। নাসের ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল, “কী ব্যাপার? আইজ এত খুশ ম্যাজাজ যে?”
“আছে, আছে। খুশির খপর আছে। শুনাইলি কী দিবা কও?”
“আমার আছেটা কী তুমারে দিবার মতোন? আর যেটুকু যা আছে, সবটুক তো তোমারই।”
“বলি তবে, তুমি দাদা হয়েছ গো। আমাদের ফারুক বাপ বনেছে। চাঁদের কণা জন্ম নেছে।”
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না নাসের। আমিনা ঠাহর করে দেখে, বুড়োর চোখে জল। দেওয়ালে টাঙানো কাবা পাথরের ছবির দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করে, “লা ইলাহা ইল্লিলাহা। আল্লা ভালো রাখুন।”
আমিনা এগিয়ে গিয়ে চৌকির পায়া ঘেঁষে নিচে বসে। “মিঞা, একখান কথা কই। এইবেলা তুমি মাপ করি দাও ফারুকরে। আমার বুকের পাঁজরা ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। কও তো পুত, পুতের বৌরে ঘরে তুলি।”
হাত তুলে নাসের বলে, “সে আমারে মুখ দেখাবার লায়েক রাখেনি। বেহেস্তে গিয়ে গুষ্টিকে কী জবাব দিব? পড়াশুনা শিকেয় তুলে শাহেনশাহ সাদি করেছে পিরিত করে। আম্মা আব্বুর কথা ভেবেছে সে? ভাবে নাই।”
“গুষ্টি গুষ্টি গুষ্টি! গুষ্টির পিন্ডি! মরা গুষ্টি নিয়াই পড়ি থাকো তুমি। কচি পোলাপাইনের মুক দেখো না। সব, সব শ্যাষ করি দিলা।” কান্নায় ভেঙে পড়ে আমিনা।
পাঁচ মাস কেটে গেছে। এখনও আমিনা নাতির মুখ দেখেনি। ফারুক বাপকে লুকিয়ে পুকুর পাড়ে এসে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যায়। প্রতি মাসেই আসে। শ্বশুরবাড়িতে সে সুখেই আছে। তবু আব্বা আম্মার জন্য তারও মন কাঁদে। বাপের গোয়ার্তুমির কারণে ঘরছাড়া। তাই ছেলের দায়িত্ব পালন করতে পারে না, শুধু মায়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে যায়। রোজই বলে, বৌকে মেনে নিলেই সে ঘরে ফিরে আসবে। শ্বশুরবাড়িতে ঘর-জামাই থাকতে তারও মানে লাগে। মায়ে-পোয়ে কত গল্প-গাছা হয়। মাকে সে ছেলের ফটো দেখিয়েছে। ছোট্ট দাদুভাইয়ের ফোকলা দাঁতের হাসির ছবি দেখে আমিনা আহ্লাদে হেসে কেঁদে সারা হয়।
ফারুক চলে যাওয়া অব্দি এই তিন বছর ওর ঘরটা আমিনা রোজ ঝেড়েঝুড়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। চোখ বুজে কল্পনা করে ঐ ঘরে তার ফারুক ফিরে এসেছে। রসুই ঘরে বৌ উনুনে রান্না চড়িয়ে কষিয়ে গোস্ত রাঁধছে। সে আর নাসের দাদুভাইকে নিয়ে খেলছে। শিশুটা দুদ্দাড় করে ছুটে বেড়াচ্ছে উঠোনময়। বড় সুখের দৃশ্যকল্প।
ডাকে সেদিন চিঠি এল। ফারুকের শ্বশুর চিঠি দিয়েছে নাসেরকে। বড় বিনীত সে চিঠির ভাষা। দশই জ্যৈষ্ঠ দাদুভাইয়ের মুখেভাত। ঐদিন নাসের যেন বাচ্চার মুখে প্রথম ভাত তুলে দেন। আতান্তরে পড়ে গেল নাসের। ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু প্রথম ভাত খাবে, তাও আবার তার হাত থেকে! একমাত্র বংশধর। না গেলে গুনাহ হবে। নিমন্ত্রণপত্রে শিশুর ছবি দেখে প্রাণটাও আনচান করছে যে।
নাসের পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে ভাবে। আমিনা তাই দেখে মিটিমিটি হাসে। ভাবে, “বুড়া আচ্ছা জব্দ।” নাসের বলে, “হাসো যে বড়। তুমি সব জানতে, তাই না?” বুড়ি গালে হাত দিয়ে অবাক হবার ভাণ করে। আর মনে মনে ভাবে, “বুড়া, তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। ফারুকের শ্বশুরকে দিয়ে এই চিঠি লেখাবার বুদ্ধিটা কার?”
অবশেষে নাসের রাজী হল। বেয়াই বাড়ি যাবার তোড়জোড় শুরু হল। খালি হাতে যাওয়া যায় না। আমিনা তার কানের একজোড়া সোনার মাকড়ি ভেঙে নাতির জন্য পোক্ত করে একখানা তাগা গড়াল। নিজের হাতে বানানো কিছু কাঁথাকানি সঙ্গে নিল। মসজিদ থেকে ঘোড়ার ক্ষুরের নজরকাঠিও নিয়ে এসেছে। উঠোনে জামগাছটা ভরে ফল এসেছে। এই গাছের মিষ্টি জাম খেতে ফারুক বড় ভালবাসে। মিঞাবিবি মিলে গাছে পরিষ্কার কাপড় টাঙিয়ে টাঙি দিয়ে প্রচুর জাম পাড়ল।
দশ তারিখে বেরোবার সময় নাসের বলল, “আমিনা, আমার ফেজটুপিখানা বের কর। ওখানা সাচ্চা মুসলমানের চিহ্ন। আইজ এমন একখান খুশির দিন। আজ ওখানা মাথায় দিয়ে যাই। ও কি যে সে জিনিস! আমার দাদুর দেওয়া জিনিস। আজমীর শরিফে যাবার কালে কিনে দিয়েছিলেন।”
“মনে আছে গো, মিঞা, মনে আছে। ওটা পরেই তো নিকা করতে গেছিলে। অবরে-সবরে, পরবে-পাব্বনে, ওইটেই তো তোমার সাজ।”
অতএব, ট্রাঙ্ক থেকে বেরোলো লাল রঙের ফেজটুপি। যত্ন করে কাপড়ে মুড়ে তোলা ছিল। এ টুপির মূল্য অসীম। পূর্বপ্রজন্মের দেওয়া উপহার। নাসেরের আন-বান-শান। টুপির সামনে পুঁতি, নিকেল আর রূপার অসামান্য কারুকাজ। সেই টুপি পরে, চোখে সুরমা এঁকে, গায়ে আতর ছড়িয়ে, সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে নাসের যখন তৈরী হল, আমিনা তখন চোখ ফেরাতে পারছিল না। আমিনা একটা শান্তিপুরী তাঁত পরে, গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিল। তারপর দুজনে রওনা দিল দৌলতপুরের দিকে।
ছেলের শ্বশুরবাড়িতে খুবই যত্ন-আত্তি হল তাদের। আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি নেই। বেয়াই বেয়ানের সাবলীল উষ্ণ অভ্যর্থনায় নাসের অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। ওদের আত্মীয় স্বজন ছিল অনেকজন। লাল জরির কাজ করা জোব্বা পরা খোকাটাকে তো আমিনা কোল থেকে নামাতেই চায় না। নাতিও দাদির কোলে আদর খায়, দুষ্টুমি করে। নাসেরের ফেজটুপিখানা খুব পছন্দ হল নাতির। সে কেবলই টুপি ধরে টানাটানি করে। নাসের সস্নেহে বলে, “তুমারেই তো দিব গ, দাদুভাই। তুমারেই দিয়ে যাব। এই টুপিতে তুমারই যে নেয্য অধিকার। আমার দাদা আমারে দেছিল, আমি তুমারে দিব।” ছেলে, বৌ এসে বাপ মাকে কদমবুশি করল। নাসের দীর্ঘ দুই বছর পর ছেলের সঙ্গে কথা বললেন। বৌমাকে আশীর্বাদ করলেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়া মিটতে মেলা দেরি হল। এলাহী আয়োজন ছিল; বিরিয়ানি, গোস্ত, সিমাই। তবে আর বেশিক্ষণ ওদের থাকা হল না। ফারুক জানাল, আবহাওয়া দপ্তর থেকে ঝড় বৃষ্টির পূর্বাভাস করেছে। বেলায় বেলায় বেরিয়ে যাওয়াই ভাল। ফারুক এগিয়ে গিয়ে বাপ মাকে তুলে দিল ট্রেকারে।
দুজনে আজ খুব খুশি। আমিনার কথা যেন থামতেই চায় না। “খোকাডা কী সোন্দর দেখলা! কবে উয়াদের ঘরে আনবা? বৌ তো বেশ ঘরোয়া, মনে হল। আমারে নিজি হাতে পান সাজি আনি দিল।”
“বেয়াই বেয়ান মানুষ মন্দ নয়। কী ভালো ব্যাভার! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। মক্কা মদিনা ঘুরি আসিছে। আল্লা ওদের ভাল করবেনে।”
আমিনার যেন কথার ফুলঝুরি ছুটছে। নাসের গোঁফে তা দিতে দিতে শোনে আর মৃদু হাসে। ধর্মপ্রাণ মুসলিম সে। বেয়ানরাও তাই। তার দোয়া পূর্বপুরুষরা কবুল করেছে। মনে মনে ভাবে, সামনের মাসেই ভাল দিন দেখে ছেলে, ছেলে বৌকে ঘরে তুলবে। আমিনাও একটু শান্তি পাবে।
মাঝপথে ট্রেকারের টায়ার পাংচার হয়ে গেল। ড্রাইভার ব্যাটা মিঞাবিবিকে রাস্তায় নামিয়ে দিল। আর কোন যানবাহন না পেয়ে দুজনে হাঁটতে শুরু করল। এখনও বেশ দূরে বাসা বাড়ি। আধঘন্টা হাঁটতে না হাঁটতেই ঝড় শুরু হয়ে গেল। কী ঝড়, কী ঝড়! মুহূর্তে দিকবিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। কেবল ধুলোবালির ঝাপটা। দুজনে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। রাস্তার দুপাশে চাষের জমি। কোত্থাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। ‘কড় কড়াৎ’ শব্দে পিলে চমকানো বাজ পড়ছে। ঝিপঝিপ বৃষ্টি শুরু হল। জনমানবহীন রাস্তায় দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া দিশেহারা হয়ে পড়ল। শনশন করে তীরের মত বাতাস বইছে। তার মধ্যে দুজনে হাত ধরাধরি করে এগোবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া নাসেরের ফেজটুপিটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল ক্ষেতের দিকে। নাসের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতের দিকে নামার চেষ্টা করল। আমিনা তার হাত চেপে ধরে বলল, “যেতি দাও, মিঞা। টুপি আনতি গিয়া এই তুফান রেতে মাথায় বাজ পড়ি মরবা নাকি!” নাসের অস্ফুটে বলল, “বাপ ঠাকুর্দার চিহ্ন! আমার শরতাজ, আমার ঈমান। আমারে ছাড়ি দাও।” আমিনা সবেগে বলল, “না, যেতি দিব না। তুমার বাপ পিতামো কব্বেই মরেছে, মিঞা! আমি এখনও বাঁচি আছি। আমিই তোমারে এদ্দিন বাঁচায়ে রাখিছি। আমার থেকি অই টুপি তুমার বেশী হল! আমার প্রতি তুমার কুনো কর্তব্য নাই, বল? বল আজ।” নাসের মুখ ফিরিয়ে একবার আমিনার মুখের দিকে চাইল। তারপর ধীরে ধীরে নিজের হাত ছাড়িয়ে চাষের আলের ওপর ঝাঁপিয়ে নেমে টুপির খোঁজে মিলিয়ে গেল।
আমিনা ঘন অন্ধকারের দিকে চেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল।
লেখক পরিচিতি : কেয়া রায়
আমি লেখালেখি করতে ভালবাসি।