লেখক: শিবানন্দ পাল
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’… ২২শে শ্রাবনের মেঘলা আবহে কোলাহলের মাঝে টাউন হলে বিশাল বক্সে গান বাজছে। গানের কথা বিভাসের সব শোনা হল না। তার শরীর ও মন ওই সুরে ভাসলো।
ইংরাজি সাহিত্যে সবে স্নাতক হয়েছে। ইবসেনের ‘অ্যান এনিমি অফ দি পিপিল’। মনে পড়লো তার একটা লাইন- ‘দি স্ট্রংগেস্ট ম্যান ইন দি ওয়ার্ল্ড ইজ হি হু স্ট্যান্ডস মোস্ট এলোন’- ইবসেনের কথা।
রবিঠাকুরেরে গান তখনো ভাসছে বাতাসে। বিভাসের অনুভবে রবীন্দ্রনাথ আর ইবসেন এক হয়ে গেল। দুই বিখ্যাত নাট্যকার জীবনের একই উপলব্ধিতে মিলিত হল তাঁর বিশ্বাসে সত্যের বন্ধনে ধরা দিয়ে। দুজন মানুষ পৃথিবীর দু প্রান্তে দুই ভিন্ন সময়ে জীবন সম্বন্ধে এই অমোঘ উপলব্ধিতে উপস্থিত হয়েছেন। বিভাসের অনুভবে এটাই সত্য শিব সুন্দরের ন্যায় ভাস্বর হয়ে উঠলো।
বাতাসে গান ভাসছে….‘যদি ঝড় বাদলের আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে, তার বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজরে জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে’।
কিছু স্মৃতি মনের গোপন কোণে ভাসছে তখন। যে স্মৃতি চিরস্থায়ী হয়ে থাকে চিরদিনের জন্যে, তেমনি কিছু কথা বিভাসের মনে এলো…
পঁচিশে বৈশাখ পাড়ার অনুষ্ঠানে রেশমি প্রতিবছর নাচের প্রোগ্রাম করে। একবার সে করেছিল ভানুসিংহের পদাবলী, বিভাসের সে বছর উৎসাহের অন্ত ছিল না, কোন ভোর বেলায় উঠে হাত মুখ ধুয়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে আঁধার থাকতে থাকতে ফুল তুলতে বেরিয়েছিল। তুলেছিল বেল টগর জুঁই আর একটা একটা করে সংগ্রহ করেছিল ঝরা বকুল। অনেক ফুল তার চাই যে, মালা গাঁথতে হবে।
টগর মিলেছিল মেলা কিন্তু বেল জুঁই অত পাবে কোথায়? আর ঝরা বকুল কুড়োনো চাট্টিখানি কথা? সেই কোন ভোরবেলার অন্ধকারে!
২৫শে বৈশাখ ফুলের চাহিদা যে খুব! উত্তরপাড়া দক্ষিণপাড়া সব পাড়াতেই রবীন্দ্রজয়ন্তী। সবাই চায় সব ফুল আগে নিতে। পাড়ায় ফুল গাছ আছে কজনের? নিদেনপক্ষে সিজিন ফ্লাওয়ার। বেল টগর জুঁই তো সেকেলে।
বিভাস ছুটেছিল কোর্ট বাড়ির দিকে, সেখানে বিশাল বকুল গাছের নিচে ঝরা বকুলের সাদা চাদর পাতা ছিল যেন। বকুলের গন্ধে ম ম করছিল চারদিক। বিভাস ছুটে এসে দাঁড়াতে কী যেন সড়সড় করে সরে গিয়েছিলো ফুলের বিছানা হতে।
সাপ! হতে পারে নিশ্চয়। পাশেই ঝিলখানা। বিভাসের সেদিকে তাকাবার অবসর ছিল না। দুহাতে সে ভরে নিয়েছিল প্লাস্টিকের ব্যাগ। মুঠো মুঠো বকুল সংগ্রহে তার মনে এসেছিল যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। দিনের সূর্যর প্রকাশ তখনো দেরি ছিল।
বিকেলে অনুষ্ঠান শুরু। প্রধান অতিথি পাড়ার হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার তপনবাবু। গুরুগম্ভীর সুরে রবীন্দ্র কবিতা আওড়ে চলেন। মাঝে মাঝে বক্তৃতা। বলেন ভালো কিন্তু, মাইক পেলে সহজে ছাড়েন না।
একটি ঘণ্টা পার হয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা যখন উশখুশ করছে, তিনি বক্তৃতা শেষ করবেন না আরও কিছুক্ষণ চালাবেন মনে মনে ভাবছিলেন। এমনি সময় হঠাৎ একটা উটকো লোক স্টেজে উঠে পড়লো। হাতে তার একটা লাঠি।
কিছু বুঝবার আগেই লাঠির ঘায়ে ফটাস করে রবীন্দ্রনাথের ছবি ভেঙ্গে চুরমার। রবীন্দ্রনাথের গলার রজনীগন্ধার মালা সে লাঠির ডগায় পাকিয়ে শূন্যে ঘোরাতে শুরু করেছে। এ কী পাগল রে বাবা!
লণ্ডভণ্ড অবস্থা। লোকজন সব পালাতে পারলে বাঁচে। বাচ্চাগুলো হাউমাউ করে কান্না জুড়েছে, ওদের বাবা মা বুঝতে পারছে না কী করবে। অনেকে দূরে দাঁড়িয়ে মজাও দেখছে।
ষণ্ড মতো লোকটাকে আগে দেখেছে বিভাস। কানুদা নামে এই লোকটা শুনেছিল সত্তরের দশকে নাকি নকশাল করত। রেশমির নাচের অনুষ্ঠান তখনো হয়নি। কতো কষ্ট করে ফুল সংগ্রহ করে সে মালা গেঁথে নিয়ে এসেছে রেশমির জন্য। আলাদা করে কাগজের ফুল, মালা, সাজও কিনে এনেছে। অনুষ্ঠান যদি না হয় সে সব কোনো কাজে লাগবে না।
একটা প্রচণ্ড রাগে বিভাসের মাথা দপদপিয়ে উঠেছিল। লোকটা নিজেকে কী ভাবে? কিন্তু যা চেহারা সামনে যেতেও ভয় করছিল। রবীন্দ্রজয়ন্তী ভেস্তে গিয়েছিলো। লোকটাকে কেউ আটকাতে পারেনি। বিভাস নিজেও পারেনি।
সেই কানুকে দুর্গাপুজোর দশমীর দিন সিদ্ধি খেয়ে ভাসানের মিছিলে ধুনুচি নিয়ে নাচতে দেখে অবাক হয়েছিল বিভাস। আবার দেখেছিল সবাই সাবাসি দিচ্ছে। ওকে ঘিরে মেয়েমদ্দ সবাই ভিড় করে রয়েছে। বিভাস আর পারেনি, তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। বুক চিতিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটুও ভয় করেনি।
চিৎকার করে বলেছিল, এই লোকটা সেদিন রবীন্দ্রনাথের গায়ে লাঠি মেরেছিল না, আজ সবাই সাবাসি দিচ্ছ! লজ্জা করে না তোমাদের?
কানু তখন অর্ধেক নেশার ঘোরে। সে কিছুই শুনতে পায় নি।
বিভাস বলেছিল, তোমার জন্যে সেদিন রবীন্দ্রজয়ন্তী মাঠে মারা গেলো। আজ যে খুব ধুনুচি নাচ দেখাচ্ছো! খুব ফুর্তি না?
কানু নেশার ঘোরে বিভাসকে ঠাকুর ভেবে তাঁকে ধুনুচি নাচ দেখাচ্ছিল।
বিভাসের রাগ তখন সপ্তমে উঠেছিলো। সে বলেছিল, আমি তোমাকে নাচতে দেব না। কানুর হাত থেকে সে ধুনুচি কেড়ে নেবার চেষ্টা করছিল।
কানু একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, আঃ! কী বুলচ?
শুনতে পাচ্ছ না?
চারদিকে ঢাকের আওয়াজ, বিভাস কানুর কানের কাছে মুখ রেখে বলেছিল, সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফটো ভেঙেছিলে কেন?
উত্তেজনায় সে তখন হাঁপাচ্ছিল।
কানু ততক্ষণে যেন কিছুটা ধাতস্থ হয়েছিল। সে বলেছিল, রবিকে আমি চিনিনে বাপ। জানিনে কোথায় থাকে!
ওর কোথায় বিভাস আরও রেগে গিয়েছিলো। সে আরও জোরে ওর কানের কাছে চিৎকার করে বলেছিল, রবি নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফটো ভেঙেছিলে!
কানু তখন বলেছিল, কিছু কি আর বুঝে শুনে ভেঙেছিলুম বাপ? চারদিকে সবাই ভাঙাভাঙি করে, আমিও ভেঙে দিলুম।
তুমি তো লেখাপড়া জান! রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করে কোনও অনুতাপ হয়নি?
কী হয়নি? কানু কান বাড়িয়ে জানতে চেয়েছিল।
অনুতাপ! দুঃখ! বিভাস চিৎকার করে শুনিয়েছিল।
দূর বোকা! দুখু হবে কেন? আমি মুখ্যু মানুষ! দেখিস না কতো চোর জোচ্চোর নেতা মন্ত্রী খুনি ডাকাত আত্মসর্বস্ব শিল্পি-বুদ্ধিজীবী পরিস্কার জামা কাপড় পরে রবীন্দ্রনাথের গলায় মালা চড়ায়, তখন তাঁর লাগে না বুঝি?
কী কথার কী উত্তর! মাতাল কানুর কোথায় বিভাস আর কথা বাড়ায় নি সেদিন।
প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল। কোলাহল থেমেছিল। সকলে যে যার বাড়ি মুখো। তখন আসছে বছর আবার এস মা! বলে কানু ধুনুচি ফেলে বিভাসকে জড়িয়ে কাঁদতে বসেছিল।
আমাকে ফেলে চলে গেলে মা, একলা আমি কাকে নিয়ে থাকব? এই বলে সে কাঁদছিল।
কী আর করে, কানুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল বিভাস। সে নিজে বাড়ি ফিরেছিল অনেক রাতে।
গভীর রাতে হঠাৎ গোলমালের আওয়াজে তাঁর ঘুম ভেঙেছিল। ‘অন্ধকারের উৎস হতে আলো …’ কে যেন গাইছিল কোথাও।
দূরে তেঁতুলগাছের নিচে অসংখ্য জোনাকির আলোয় বিভাস দেখেছিল একটা লম্বা আলখাল্লা পড়া মানুষ–ই তো গান গাইছে। কতোগুলো কুকুর তাঁকে ঘিরে ধরেছে।
দেখি তো?
এই তোরা কী করছিস?
ঠিক তখনি কোথা হতে তীব্র গতিতে এসেছিল একটা মোটর সাইকেল। তার হেড লাইটের আলোয় বিভাস দেখতে পেয়েছিল ওই মুখ অবিকল রবীন্দ্রনাথের।
এ ঘোর অন্যায়! এ ঘোর অন্যায়! চিৎকার করে উঠেছিলো বিভাস।
ঘুমটা তখনি ভেঙেছিল।
সে রাতে আর তার ঘুম হয়নি। ছাদে উঠে এসেছিল একা। দেখেছিল আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ।
একাদশীর এক ফালি চাঁদ তখন একদল তারাদের নিয়ে রাত সফরে বেরিয়েছিল।
অনেক দিন পর বিভাস রাতের আকাশ দেখছিল।
উঃ! পায়ে একটা ছোটো কাঁটা ফুটেছিল বুঝি।
অনেকদিন রেশমির সাথে কোনও যোগাযোগ নেই। অনাস্বাদিত উন্মাদনায় কেটে যাওয়া কৈশোরের সেই দিনগুলো কিছুতেই ভুলতে পারে না।
জীবনের প্রথম প্রেম বোধহয়। অভিভাবকের মতো পাশে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
দুজনে কতবার গলা মিলিয়ে গেয়েছে ‘আমার পরান যাহা চায়…’। ছিলেন কেন, রবীন্দ্রনাথ আজো তার একান্ত আশ্রয়।
হৃদয়ের বিজন ঘরে রেশমির স্মৃতি আজ জেগে উঠলো। ‘আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন …’ গাইতে ইচ্ছে করে। একবার … দুবার …
না, গলায় সুর আসে না।
চোখের জলে অনুভুত হয় এখনও সে কি মনে মনে রেশমিকেই চায়?
কিন্তু রেশমি এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই সে জানে না।
রেশমি! সাগর পারে ডাক্তার স্বামীর সাথে ঘর করছে। স্বামী ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। হাসপাাতালের কাজ আর নার্সিং হোম নিয়ে দিন রাতের একুশ ঘণ্টা ব্যস্ত।
রেশমি তার সাজানো ঘরে কাচের জানলার ভিতর থেকে বাইরের দৃশ্য দেখে। দেখে রাশি রাশি ফুলের মতো বরফ পড়ছে।
বারোমাস এই দৃশ্য দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত। ক্লান্ত গলায় আচমকা গেয়ে ওঠে ‘আমার পরান যাহা চায়…’।
গলা ধরে আসে। সুর খেলে না।
টেমস নদীর পাড়ে একটা ত্রিকোনা ছাদওয়ালা ওদের বাড়িটা। নদীর পাড় ঘেঁসে শুয়ে আছে লম্বা একটা হাইওয়ে। বিশাল চওড়া। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে খুব দ্রুত পার হয়ে যায় একটা দুটো গাড়ি। গাড়িগুলোর পিছনের লাল আলোগুলোর দিকে রেশমি তাকিয়ে থাকে, যতক্ষণ দেখা যায়।
এমনি চাঁদের আলোয় রাত্রে চরাচর ভেসে গেলে ঘরের সাউনড সিস্টেমে রেশমি গান শোনে, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে …’।
যে গান সে একদিন গেয়েছিল বিভাসের সঙ্গে- ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে …’।
আজ আত্মকেন্দ্রিকতার এই দিনে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বিভাস আশ্বিনের সারা আকাশে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। না চাঁদ নেই। তবে তারারা আছে। রেশমির আকাশেও হয়তো একই তারাদের স্রোত ভাসছে।
হয়তো এসময় তার স্বামী তার পাশে আছে।
হয়তো তার কথা মনেই পরে না।
বিভাস খোলা আকাশের নিচে গাইতে চেষ্টা করে ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ …’।
না। পারে না।
দু ফোঁটা মুক্তো বুঝি গড়িয়ে পড়ে..…!
সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়।
লেখকের কথা: শিবানন্দ পাল
শিবানন্দ পাল একজন ফ্রিল্যান্স লেখক। শখ – ফটোগ্রাফি, পড়াশোনা, ভ্রমণ। পেশায় গ্রন্থগারিক শিবানন্দ পালের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – ‘স্বপ্ন নিয়ে’। এছাড়াও তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য বই – ‘সাহারা’, ‘জননীর জন্ম’, ‘বড় মাপের মানুষ’, ‘কয়লা খনির বৃত্তান্ত’, ‘অনুপম খাজুরাহো’, ‘পটভূমি মাইসোর’, ‘কোরা কাগজ’, ‘আমি শ্রীকবিকিঙ্কণ ‘, ‘আজ বসন্ত’, ‘নিঃসঙ্গ সময়’, ‘জীবন যুদ্ধের গল্প’, ‘বিস্ফোরণ’, ‘স্বনির্বাচিত কিশোর গল্প’, ‘প্রসঙ্গ সাধারণ গ্রন্থাগার’, ‘সাধারণ গ্রন্থাগার প্রসঙ্গে’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘এ সময় বদলে যাবে’, ‘গল্পসল্প’, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকা’ ইত্যাদি।
সুন্দর লেখা ।
দু তিন জায়গায় সমান্য টাইপ প্রমাদ থেকে গেছে ।