লেখক : ইয়াসেফ মোহাঃ রিয়ান
গত ডিসেম্বরে শীতের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। মালদা জেলার বাবলা গ্রাম, শহর থেকে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দূরে। গ্রামের শীতের দুপুর সবার মত আমারও খুব প্রিয়। মাঝেমধ্যেই মধ্যাহ্নের পর দুপুর দু’টোর দিকে স্কুটি নিয়ে আশেপাশে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। বহু বছর ধরে বিদেশে থাকি বলে যখনই বছরে একবার বা দু’বার বাড়ি ফিরি, ইচ্ছে হয় ছেলেবেলার সেইসব জায়গাগুলো আবার ঘুরে দেখি। যদিও সবকিছুই প্রায় দিন দিন বদলে গেছে, তবুও…
বেশিরভাগ সময়ই গীতামোড় যাই, আমাদের গ্রাম বাবলা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরে। দুই ধারে আমের বাগান। রাস্তার ধারে গঙ্গাভাঙ্গনের পরিবারদের অস্থায়ী ছোট ছোট ঘর বাঁধা, রাস্তা থেকে ঢেকে যাওয়া দু’ধারের আমের বাগানগুলো ঐ ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায়। দুপুর দু’টোয় বেরোই, কারণ তখন লোকজন তুলনামূলকভাবে কম থাকে। নির্জন দুপুরে গ্রামের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে বড় ভাল লাগে। এ যেন এক অন্যরকমের অলস সময়—বাড়ির লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু কিংবা গ্রামবাসীদের ছাড়াও গ্রামের সাথে একান্ত আলাপনের সময়। গ্রামের রাস্তাঘাট, গাছপালা, দুপুরের বন্ধ হয়ে থাকা দোকানগুলো, দোকানের সামনের ফাঁকা বেঞ্চ, দ্রুত ছুটে যাওয়া বাইকের উড়িয়ে দেওয়া ধুলো, আর সেই ধুলোর মধ্যে এক অনাথ পলিথিনের হাওয়ায় দুলে বেড়ানো—সব মিলিয়ে এক অন্যরকমের সৌন্দর্য্য।
একদিন এরকমই এক অলস রোদের দুপুরে গীতামোড়ে গিয়েছিলাম। পৌঁছে রাস্তার ধারে ত্রিকোণা পার্কের এক কোণায় স্কুটি পার্ক করে হাঁটছিলাম অন্য প্রান্তে, দুপুরের এক কাপ চায়ের খোঁজে। হঠাৎ বিকট এক কান্নার আওয়াজ কানে এল। তাকিয়ে দেখি, পাকা রাস্তার মাঝখান থেকে একটি কুকুর ছানা ভীষণ জোরে অদ্ভুত রকমের আওয়াজ করতে করতে ছুটে আসছে রাস্তার এক পাশে। সেই মুহূর্তে একটি টোটো দ্রুতগতিতে নিজের তালে চলে গেল রাস্তা ধরে। বুঝতে পারলাম, টোটোর চাকা ছানাটির ওপর দিয়েই গেছে। ভাল করে দূর থেকে লক্ষ্য করলাম, একটা পায়ের উপর দিয়ে চাকাটি চলে গিয়েছে—ছানাটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে।
রাস্তার পাশে কিছুদূরে একটি পরিবার রোদ পোহাচ্ছিল। এই দৃশ্য দেখে কেউ বলল ‘আহারে’, কেউ উঠল হেসে, আর কেউ বা মুখ গুঁজে রইল ফোনে—সবকিছু যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক, যেন এমনটা প্রায়শই ঘটে।
আমি ছুটে গিয়ে ছানাটার পাশে দাঁড়ালাম, বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব। পাশের পরিবারের এক দিদিকে অনুরোধ করলাম একটু জল এনে দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছানাটির কান্না বন্ধ হয়ে গেল। নিথর পড়ে রইল পুঁচকে দেহটি। ভয়ে গা শিউরে উঠল—মারা গেল না তো?
না, বেঁচে আছে। পেট ওঠানামা করছে।
ততক্ষণে এক দিদি জল এনে দিলেন। জলের পাত্রটি এগিয়ে দিতেই ছানাটির মা ও আরও দুই ছানা ছুটে এসে আমার দিকে তেড়ে এল, আমাকে কাছে আসতে দিচ্ছে না। তবুও সাহস করে জলের পাত্রটি এগিয়ে দিলাম, ছানাটিকে আলতো করে নাড়িয়ে দিলাম। শুয়ে পড়া অবস্থাতেই জিভ দিয়ে একটু জল চেটে খেল। তারপর তার মা তাকে মুখে তুলে টেনে নিয়ে গেল এক পরিত্যক্ত দোকানের নিরাপদ কোণায়।
ছানাটির পা থেঁতলে গিয়েছিল। সেই পা-টা যন্ত্রণায় কাঁপছিল, ছানাটা আর চিৎকার করছিল না। তার চোখে শুধু যন্ত্রণার জল, আর নিস্তব্ধতা। সেই মুহূর্তে নিজেকে সমস্ত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে খুব ছোট, দোষী ও লজ্জিত মনে হচ্ছিল। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে ঐ কুকুরদের জন্য খাবারের খোঁজ করলাম। কোন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে পাশের একটা দোকান থেকে সকালের বানানো কয়েকটা সিঙ্গাড়া আর কিছু কলা কিনলাম। পাঁউরুটি ছিল না তখন দোকানে। তাছাড়া প্রায় সব দোকানই ছিল তখন বন্ধ। ফিরে এসে খাবারগুলো এগিয়ে দিলাম। জানি না মানবজাতির হয়ে কীভাবে এই প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। সেই মুহূর্তে ওইটুকুই করতে পেরেছিলাম। সেই অপরাধবোধ নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম ওখানে। ততক্ষণে শীতের বিকেল হুট করে সন্ধ্যে হয়ে নেমে এল, অন্ধকার হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে এলাম। সারাদিন মনটা খুব ভার ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল—ছানাটি শেষ পর্যন্ত বাঁচবে তো? পা-টা ঠিক হবে তো?
পরদিন মধ্যাহ্নের আগেই ছুটে গিয়েছিলাম গীতামোড়। গিয়ে দেখি ওখানে আর নেই সেই ছানাটি। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক খুঁজলাম—কোথাও পেলাম না।
আজ সেই ঘটনার পর প্রায় নয় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও সেই বিকট কান্না, সেই যন্ত্রণার চিৎকার, আর ছানাটির চোখের নিস্তব্ধ জল ভুলতে পারিনি। এখনও আফসোস হয়—যদি সেদিন তাকে কোন এক পশু চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারতাম, যদিও জানি না আমাদের এলাকায় বা থানায় আদৌ কোন ভেটেরিনারি ক্লিনিক আছে কি না। জানি না, সেই ছানাটি বেঁচে আছে কি না। যদি বেঁচেও থাকে, সেই পা কি আর স্বাভাবিক আছে?
লেখক পরিচিতি : ইয়াসেফ মোহাঃ রিয়ান
ইয়াসেফ মোহাঃ রিয়ান