মেঘমালার এক মুহূর্ত

লেখক : রাজশ্রী ঘোষ

মেঘমালা আজ একটু স্বস্তি বোধ করছে কারণ বিনীত আজকে অন্যদিন এর চাইতে অনেকটা ভালো আছে। আজ একবছর পর বিনীত তার ডান হাতটা মেঘমালার হাতের ওপর রেখেছে ।তাদের দশ বছরের বিবাহিত জীবন, বিনীত আজ চারবছর হলো বিছানায় পরে আছে, লাস্ট একবছর বিনীত নড়তে পারে না, কোনো রেসপন্স করে না, সেরিব্রাল এ তার পুরো বডি পড়ে যায় বিছানায়। দিন দিন তার উন্নতি থেকে অবনতি দিকেই এগোচ্ছিল। একটা আয়া ছিল, তার বিনীত এর চাইতে বিনীত এর খাবারের দিকে বেশি ঝোঁক। তাই মেঘমালা ভলেন্টিয়ার রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছে। বিনীতকে যত্ন করার জন্যে। ঠাকুরের কৃপাই হোক মেঘমালার যত্নে হোক বিনীত এখন অনেকটা সুস্থ। মেঘোমালা বিনীতকে ওষুধ দিয়ে স্নানে গেল স্নান করে এসে সে আজ হঠাৎ করেই একটা নীলচে জাম কালারের শাড়ি পরেছে। কালি পড়ে যাওয়া চোখে কাজল দেওয়াতে চোখদুটো আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে, কানে দুটো হালকা দুল, চুল এ খোঁপা করেছে আর চুলে দিয়েছে পলাশফুল। হঠাৎ করেই আয়নার সামনে সে সেই দশ বছর আগেকার মেঘমালাকে দেখতে পেয়ে সে নিজেই লজ্জা পেয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে টুক করে সরে গেল।তার সেই চির পরিচিত জায়গা ছাদের ঈশান কোণে সেই যেখানে একটা ক্যাকটাস গাছ আর খাঁচায় আছে একটা ছোট টিয়া আর সোনালী রোদ্দুর যেখানে খেলা করে মাথার ওপর নীলচে আকাশ যারা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মেঘমালার সুখ-দুঃখ,যন্ত্রণা, আনন্দ প্রতিনিয়ত সাক্ষী কত চোখের জল যে তারা দেখেছে তা মেঘোমালা ছাড়া কেউ জানে না। মেঘমালা একটু খুশি, আজ তার মনে পড়ছে দশ বছর আগে কত ঘটনা কত স্মৃতি বিজড়িত হয়ে আছে তাদের কলেজ ক্যাম্পাস, ইউনিয়ন রুম, টিফিন খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, কলেজ সোশ্যাল, কলেজের বারান্দা, কলেজ ক্যান্টিন, ক্লাসরুম, চক, ডাস্টার আরো কত কিছু। মেঘমালা দশ বছর আগে ঠিক এমনিভাবেই সাজতো অর্চিষের সঙ্গে দেখা করার দিনে। আজ সব ঠিকঠাকই আছে খালি মানুষটা বদলে গেছে, আগে ছিল অর্চিষ আর আজ বিনীত ।কত অবান্তর ভাবছে মেঘমালা কতদিন সে ভাবে না আগের কথা। তার আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে ট্রাম লাইন ধরে হাঁটা, বাদাম খাওয়া, ময়দানে হাতে হাত দিয়ে হাটা, ভিক্টোরিয়া বসে কত অবান্তর বকবক করা, প্রিন্সেপ ঘাটে সূর্যাস্ত দেখা, নন্দনে সিনেমা দেখা ও উত্তর কলকাতার গলি, দুর্গাপুজো আরো কত কি। হঠাৎ মেঘমালার চোখে কাল তৃষ্ণা দেখা দিল, সব তো চলছিল একরকম করে । তার এক এক করে সব মনে পড়ছে – সেদিন ছিল ১৯ শে নভেম্বর,  মেঘমালা ফাইনাল রেজাল্টের দিন মেঘমালা রেজাল্ট নিয়ে অর্চিষের জন্যে ওয়েট করছে কলেজ স্ট্রিটে কিন্তু অর্চিষ কই! সে তো আর আসে না। একঘন্টা, দুঘন্টা গেল, তিনঘণ্টা গেল। এক সময় সন্ধ্যে নেমে গেল অর্চিষ এলো না। ফোন করলো কিন্তু ফোন নট রিচেবল, মেঘমালা হতাশ চোখে বাড়ি ফিরে গেলো বাড়ি গিয়ে দেখে তার ছোটবেলার বন্ধু কলি বসে আছে। সে মেঘমালাকে জানায় অর্চিষ জরুরি দরকারে বাড়ি গেছে। তার মায়ের শরীর খুব খারাপ শুনে মেঘমালার সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে যায় এইভাবে একবছর, দুবছর যায় অর্চিষ আর ফেরে না। ফোন একই ভাবে নট রীচেবল, মেঘমালাকে বাধ্য হয়ে বাড়ির চাপে বিয়ে করতে হয় বিনীতকে। এসব ভাবে আর মেঘমালার চোখ দিয়ে স্রোত নামে অনবরত। এমন সময় নিচে রাখা টেলিফোনটা বেজে ওঠে আর মেঘমালা হঠাৎ করে চমকে ওঠে আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের জলটা আঁচল দিয়ে মুছতে গিয়ে কাঁচা হলুদ রঙের কাঁচুলি বেরিয়ে পড়ে। তৎক্ষণাৎ সে আবার সমস্ত ঠিক করে ফোনের দিকে ছোটে ফোন তুলতেই গলাটা তার চেনা লাগে, বুকটা হঠাৎ করেই ধড়াস করে ওঠে মেঘমালার রাগে অভিমানে ক্ষোভ এ মেঘমালার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। ফোনের ওপার থেকে হ্যালো হ্যালো অনেক বার ভেসে আসছে তার ছোটবেলার বন্ধু কলি সেই মেঘমালার বিয়েতে মেঘমালা শেষবার তাকে দেখেছে তারপর ফোন এ অনেক কথাই হয়েছে কিন্তু বিশেষত এই ছয় বছর তাদের আর যোগাযোগ নেই। কলি তার বিয়েতে বলেছিল কিন্তু মেঘমালা বিনীত এর এই শরীর খারাপ হওয়ার জন্যে গিয়ে উঠতে পারেনি। তারপর সে ফোন এ অনেক বার চেষ্টা করেছে কিন্তু পায়নি ফোন স্যুইচ অফ আজ হঠাৎ ফোন পেয়ে তার আর অভিমান ভাঙতে চায়না কলি জানায় সে বিয়ের পর বরের সাথে আমেরিকা যাওয়ার কারণে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ফোন এ কোনো ভাবেই মেঘমালাকে যোগাযোগ করতে পারেনি।এতক্ষনে মেঘমালা এর মুখ দিয়ে কথা ফুটল। মেঘমালা বিনীত এর পুরো ব্যাপারটা কলিকে খুলে বললো কলি সহানুভূতি প্রকাশ করতেই মেঘমালা বাধা দিয়ে বলল বিশ্বাস কর আমার কোনো অসুবিধা হয় না আমার বেশ ভালই লাগেরে।বিনীত এর ঘরে ওষুধের গন্ধ, টাইম এ টাইম এ খেতে দেওয়া আমার বেশ ভালই লাগে বিনীত এর গায়ের গন্ধ এর সঙ্গে থাকতে থাকতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। আমি প্রতিদিন সকালে নতুন আশা নিয়ে বাঁচি আমার বিনীত ঠিক একদিন ভালো হয়ে উঠবেই আগের থেকে এখন অনেকটাই সুস্থ বিনীত।।

কলি এতক্ষন সব চুপ করে শুনছিল এবার সে কথা বলল ।। বললো তোকে ফোন করার আরেকটা কারণ আছে জানিস তো আমরা রিইউনিয়ন করছি ওটাতে তোকে আসতেই হবে কোনো কথা বা কোনো অজুহাত শুনবো না কিন্তু।।মেঘমালা বললো চেষ্টা করছি।। কলি বললো জানিস অর্চিষও আসছে মেঘমালা এবার না শোনার ভান করে বলে উঠলো জানিস তো এবার ফোনটা রাখতে হবে আমার বিনীতকে ওষুধ দেওয়ার টাইম হয়ে গেছে রাখি পরে কথা হবে বলে ফোন রাখতে না রাখতেই টিয়াপাখি টা ক্যা ক্যা করে উঠলো।মেঘমালা হঠাৎ চমকে উঠে পড়ে দেখলো সে ছাদের সেই ঈশান কোণে বসে কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারেনি তারপর সবটা বুঝতে পেরে নিজেই হেসে উঠলো ।।তারপর এক সেকেন্ডের মধ্যেই দৌড়ে নেমে এলো বিনীত এর ঘরে। বিনীত ঘুমোচ্ছে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পাঁচ মিনিট দেরি হয়ছে বিনীতকে ওষুধ দিতে ।মেঘমালা যাতে কাজের ফাঁকে বিনীতকে ওষুধ দিতে যাতে ভুলে না যায় তাই সে টিয়া টাকে ট্রেনিং দিয়েছিলো। বিনীত ওষুধ খাওয়ারের সময়গুলোতে ক্যা ক্যা করে উঠবে আর মেঘমালা এর মনে পড়ে যাবে বিনীতকে ওষুধ দেওয়ার টাইম হয়ে গেছে।।মেঘমালা বিনীতকে ওষুধ খাইয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই তার খোঁপা করা চুল আজ খুলে দিল সে নিজেই তার ঘন চুলে নিজেই হাত বোলাতে বোলাতে সে গিয়ে দাঁড়ালো বিনীত এর মাথার কাছে জানলার সামনে । আজ মেঘমালার মন অনেক হালকা হয় গেছে কারণ আজ মেঘলা আকাশ কেটে গেছে সে দেখতে পেয়েছে ঝলমলে রোদ ।। বাসন ওয়ালী সমানে হেকে বাসন বাসন নেবে গো বলে চিৎকার করছে আর মেঘমালা তার চুলে নানা আঁকিবুকি কাটছে আর দূরের আকাশটাকে দেখছে আবার নতুন করে সে বিনীত এর সঙ্গে সংসার গুছোনোর জাল বুনছে।।এমন সময় টেলিফোনটা বেজে ওঠে কিরিংকিরিং।


লেখক পরিচিতি : রাজশ্রী ঘোষ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পাঠরতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন