বাংলায় শিশুসাহিত্য নিয়ে ভাবনা

লেখক : মানস রঞ্জন ঘোষ

শিশু মনের উপযোগী সাহিত্য শিশুসাহিত্য। সাধারণত শিশুদের মনস্তত্ত্বকে বিবেচনা করে শিশুসাহিত্য রচনা করা হয়। শিশু পাঠকের বয়সের পাশাপাশি শিশুসাহিত্য বলতে কোন কোন বিষয় বস্তু সম্মিলিত লেখাকে ধরা হবে, সেই ধারণা স্পষ্ট হওয়া দরকার। শৈশব ও কৈশোর খুব কাছাকাছি। তাই কৈশোর বয়সকেও শিশু সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়। সাধারণত ১৪/১৫ বছর পর্যন্ত বয়সীদের মনস্তত্ত্বকে বিবেচনা করে শিশুসাহিত্য রচনা করা হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ছড়া, কবিতা, গল্প সহ শিশুসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাষাগত সারল্য। রং বাহারী চিত্র বর্ণার সমাবেশে শিশু সাহিত্য রচনায় মনোরঞ্জনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার সাথে বিষয় বৈচিত্র্যে নির্বাচনে সৃজনশীল শিক্ষার বার্তাও থাকে। এতে থাকে কল্পনা ও রোম্যান্স, জ্ঞান-বুদ্ধির উপস্থাপনা, রূপকথা, এ্যাডভেঞ্চার আর ভূত-প্রেতের গল্প। তথ্য তালাশ করে জানা যায়, ১৮১৮ সালে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত নীতিকথা নামক গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যের গোড়াপত্তন হয়। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয় প্রমুখ বিশিষ্ট জন শিশু সাহিত্য রচনায় অবদান রাখেন। এরপর রবীন্দ্রযুগের সূচনা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সাধনায় শিশু পাঠক প্রাধান্য পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সমকালীন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ শিশু সাহিত্য রচনায় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিরাশি’, দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূত পেতনী’, উপেন্দ্রকিশোরের উপেন্দ্রকিশোরের ‘টুনটুনি’ আমাদের শৈশবের স্মৃতিকে উষ্কে দেয়। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, অবাক জলপান, কাজী নজরুল ইসলামের ঝিঙে ফুল ইত্যাদি গ্রন্থ সমগ্র বাংলার শিশুসাহিত্য সব বয়সের পাঠকের প্রিয়। আর ভাবতে অবাক লাগে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পান্ডব গোয়েন্দা, নারায়ণ দেবনাথের “বাটুল দি গ্রেট” আজকের শিশুদের কাছে অপরিচিত। একদা স্বনামধন্য শিশু সাহিত্যিক অখিলবন্ধু নিয়োগী তথা স্বপন বুড়ো আজ কেমন যেন অপরিচিত। “এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার ছিল তিন রাণী…” এরকম গল্প শোনা সাধারণ বাঙালি পরিবারের শিশুরা আর সেই শিশু নেই। ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা’.. ফ্লাট বাড়িতে একটি শিশু এই ছড়া শুনে আর বড় হয় না। সূর্যের সঙ্গে হাসতে শেখা, বাতাসের সঙ্গে উড়তে চাওয়ার পথ তাদের সামনে রুদ্ধ। তাই তো ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদে এল বান’… বাড়ির পাশের শুকনো নালাটায় তুমুল বৃষ্টিতে জলপ্রবাহ দেখে ‘নদে এল বান’ কল্পনা করতে তারা অপারাগ। একান্নবর্তী পরিবারের দাদু ঠাকুরমার যুগের সাথে সাথে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘আলিবাবা আর চল্লিশ চোর’, ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ” সব হারিয়ে গেছে। যুগ পরিবর্তনে সেদিনের হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যের সাথে সাথে শিশুরা আজ শৈশবহীন, নির্মল মনোরঞ্জন থেকে যে বঞ্চিত তা আজকের অভিভাবক অভিভাবিকারা মানতে অরাজি। শৈশবহীন শিশুরা আজ বড় অসহায়।

আসলে দোষ আমাদের, আমাদের মানে পরিবর্তীত আর্থসামাজিক পরিবেশ ও শিক্ষা ব্যবস্থার। শৈশব থেকে কৌশর স্বপ্ন দেখার বয়স। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’-এ হাত ধরে নির্মল স্বচ্ছ মনে স্বপ্নের মধ্যে কল্পনায় পৃথিবী গড়ার বয়স। কিন্তু বদলে যাওয়া আজকের পৃথিবীতে সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ বড্ড বেশি বাস্তববাদী। বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের বাবা- মায়েদের একাংশ “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে…” এব গান না শিখে বড় হওয়া অভিভাবক অভিভাবিকা। তাদের হাত শুরু থেকেই প্রতিযোগিতার লাইন দাঁড়িয়ে শিশুর শিক্ষা আরম্ভ।

তাই বলে “আঙ্কল টম’স কেবিন” পড়ে শিশুর চোখে জল পড়া বন্ধ হয়নি। থাম্বেলিনা, গালিভারস ট্র্যাভেলস’… এমন সব শিশু-কিশোর সাহিত্য পড়ে বা শুনে মুগ্ধ হয়। আবেগ প্রবণ শিশু মনের উত্তেজিত হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন এখানেই ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত আজকের প্রজন্ম যত সহজে ‘সিন্ডারেলা’-র হাত ধরে ফেলে, তেমন করে কেশবতী রাজকন্যার হাত ধরতে পারে না কেন? কেন পায় না ‘সোনার কাঠি রূপোর কাঠি’-র স্পর্শ ? ইংল্যান্ডের লেখিকা এনিড ম্যারি ব্লাইটনের গল্পে আজকের কিশোর কিশোরী যেভাবে আইডেন্টিফাই করে নিতে পারে, তেমনি আশাপূর্ন দেবী, লীলা মজুমদারের মত অনান্য বাংলা সাহিত্য পড়ে কেন হয় না, এই জিজ্ঞাস্য কোথায় করবো ? হ্যরি পটারের কাহিনী নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়, বিশ্ব সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ থাকার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তার কারণে পাগলা দাশুর কান্ড কারখানার আকর্ষণের ঘাটতি মনে নিতে কষ্ট হয়। অবাক হতে হয় “হযবরল” নিছক আজগুবি মনে করলেও ইংলিশ মিডিয়ামের অভিভাবক অভিভাবিকাগন চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র শিখিয়ে নিজের শিশু সন্তানকে কঠিন পাথরের দেওয়াল সরিয়ে উপযুক্ত করতে আদা জল খেতে সহজে হয় রাজি। দোষ শুধু আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ? আমরাই তো জীবন জীবিকা থেকে বাংলা ভাষাকে দূরে ঠেলে দিয়ে চলেছি, নিজের সন্তানকে মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে অপারগ। অথচ আমরাই নালিশ করি, ‘আজকালকার ছেলেমেয়েরা এক্কেবারে বাংলা পড়ে না। স্বজাতি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ক্রমশ ফ্যাকাশে। এটাও ঠিক ইংরেজি মাধ্যমের পাশে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার দৈন্যতা চোখে পড়ার মত। ইংরেজি রঙচঙে বইগুলোর মতো করে আমাদের সাবেক কালের বর্ণপরিচয় বা সহজপাঠের রূপবদল আমরা কেন করতে পারি না ? শিক্ষা জগতে বাংলা ভাষার দৈন্যতা সামগ্রিক ভাবে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিক পরিবেশ প্রভাবিত হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

শিশুসাহিত্য রচনার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সহজবোধ্যতা সাথে আকর্ষণীয় হওয়া। কেননা, সহজবোধ্যতা না হলে ছোটোদের বুঝতে কষ্টসাধ্য হবে, আর আকর্ষণীয় না হলে পড়ার আগ্রহ ঠিক মত জন্মাবে না। ছোটোদের মনে কৌতূহল সঞ্চার করা এবং তাদের নরম, কোমল ও আনন্দময় মনকে উজ্জীবিত করার জন্য সহজ ও আকর্ষণীয় রচনার বিকল্প নেই। শিশুদের কল্পনার জগৎকে সৃজনশীলতা, মননশীলতায় পরিপূর্ণ করতে সাহিত্য ভুমিকা নিয়ে থাকে। কবি, সাহিত্যিকদের মনন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এমন শিশুসাহিত্য রচনা শ্রমসাধ্য হলেও যথার্থ দায়িত্ববোধে চেষ্টা ও প্রতিভার সমন্বয়ে সৃষ্টি হতে পারে এমন উদাহরণ বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে অনেক আছে। নতুন যে কোনো জিনিস দেখলে শিশুরা ধরতে চায়, ছুঁতে চায়। শিশুর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে শিশুসাহিত্যে রচনা কালে বিষয় নির্বাচন করাটা গুরুত্বপূর্ণ। যুগ পরিবর্তনের হাত ধরে টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট, ভিডিও গেম সহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক খেলনা সামগ্রী শিশুদের আগ্রহ ও আনন্দের জায়গা দখল করে নিয়েছে তা অনস্বীকার্য। শিশু মনস্তত্ত্বের উপর যার প্রভাব বিরাট। পাঠ্য পুস্তকের বাহিরে অনান্য বই পড়ার অভ্যাসের উপর যার প্রভাব লক্ষণীয়। “শুকতারা” নিয়ে ভাইবোনের সেই কাড়াকাড়ি আর নেই। পুজো আসছে মানে বাঙ্গালির ঘরে পুজো বার্ষিকী “আনন্দমেলা”, সেই উন্মাদনা এখন অতীত। আগেকার দিনে গ্রাম্য পাঠাগারে কিশোর কিশোরীদের ভীর দেখা যেত। বর্তমানে গ্রন্থাগার গুলি প্রায় পাঠক শূন্য। আসলে প্রজন্মের হাত ধরেই নতুন পাঠক তৈরি হয়। পাঠক হারিয়ে গেল সাহিত্য বেঁচে থাকবে কি ভাবে ? পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ যুগে সাহিত্য রচনাকারদের অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। রাজা রানীর রূপকথা ছেড়ে সময়োপযোগী বিজ্ঞান মনষ্কতা তৈরি জন্য সাহিত্যের ভূমিকা নিতে হবে। বাস্তবের সাথে সেতু বন্ধনে আরো নতুন নতুন বিষয় বস্তু আয়ত্ত করে নেওয়া খুব জরুরি। পরিপার্শ্ব অনান্য প্রলোভনে ভালো মন্দ মিলেমিশে আছে। মন্দ ছেড়ে ভালোকে বেছে নেওয়ার দক্ষতায় শিশুসাহিত্য যেন শিশুর আনন্দসঙ্গী হয়ে উঠুক, এটাই কাম্য। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভালো মন্দের স্বার্থে প্রজন্মের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। সবাই কে সাথে নিয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্য অনুরাগীদের সেই ভাবনা ভাবতে হবে।


লেখক পরিচিতি : মানস রঞ্জন ঘোষ
পেশা শিক্ষকতা, মুলত পঠাক, পাশাপাশি একটু আকটু লেখার চেষ্টা।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

2 Comments

  1. Hridoy Hoque

    গুরুত্বপূর্ণ লেখা। শিশুসাহিত্য নিয়ে আসলেই আজকাল অতো জনকে মাথা ঘামাতে দেখি না। আমি নিজেও ও নিয়ে কিছু ভেবেছিলাম। ভবিষ্যতে ছোট্ট একটা প্রজেক্টের সংকল্প আছে। দেখা যাক। জল কতদূর গড়ায়। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। শিশু নিয়ে বহুদিন পড় কিছু পড়লাম।

    • Gayatri Ghosh

      খুব ভালো লাগল ।সত্যি শিশুরা পুস্তক পড়া থেকে বিরত থাকছে, তার থেকে মোবাইল নিয়ে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে।ওদের উৎসাহ দেওয়ার প্রয়োজন আছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।