মুখোমুখি

লেখক : অভীক দাস

কফি হাউসে মিনিট দশেক আগেই পৌঁছে গেল অলকেশ। কলেজে আজ শেষ ক্লাস না নিয়ে আগেভাগেই সে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে কলেজ থেকে। সায়নী ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, তার আসতে একটু দেরি হবে। শিয়ালদহের কাছে বাসে আছে, জ্যামে আটকে গেছে। কফি হাউসের ভেতরে স্বাভাবিকভাবে বিকেলের দিকে ভীষণ ভীড় থাকে! অলকেশ গেট দিয়ে ঢুকে দাঁড়িয়ে ভিতর দিকে উঁকি মেরে দেখতে থাকে কোন টেবিল খালি আছে কি না! ওপরে টেবিল খালি থাকলেও সেখানে যাওয়া তো সম্ভব নয়, তাই নীচেই তাকে টেবিল খুঁজতে হচ্ছে। একদম শেষদিকে একটা টেবিল ফাঁকা দেখতে পেয়ে হাঁটা শুরু করে অলকেশ। কিন্তু, ওই টেবিল অবধি পৌঁছানোর আগেই দু’টি ছেলে মেয়ে অলকেশকে ডেকে তাদের টেবিলটা ছেড়ে দেয়।

টেবিলে বসার পর অলকেশ সায়নীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সকাল থেকেই তার মন আনচান করছে, মৃদু হৃদকম্পনও অনুভব হচ্ছে! দীর্ঘ তিন মাস ধরে সোশ্যাল মিডিয়াতে কথা বলার পরে আজই তাদের প্রথম মুখোমুখি দেখা হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল অনুযায়ী সায়নী উচ্চশিক্ষিতা, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি দপ্তরে চাকরী করে। সায়নী প্রথমে আজ দেখা করতে রাজি হয়নি, পরে অনেক করে অলকেশ অনুরোধ করার পরে সায়নী দেখা করতে রাজি হয়। টেবিলে বসার পরেই সায়নীর ফোন এল। অলকেশ ফোনটা ধরে বলে উঠল, “তুমি এসে গেছ? আচ্ছা শোন, নীচেই মাঝ বরাবর একটা টেবিলের পাশে বসে আছি। সাদা জামা আর কালো রঙের প্যান্ট পরে। আমায় তুমি দেখতে পাচ্ছ?”
ফোনের ওপার থেকে উত্তর এল, “হ্যাঁ! তোমাকে দেখতে পেয়েছি।”
অলকেশ বসে থাকা অবস্থায় সামনে লোকজনের ভীড়ের মধ্যে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও সায়নীকে দেখতে পেল না। সায়নীর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে শুধুমাত্র তার মুখের একটাই ছবি দেখেছে। এবারে সামনাসামনি দেখলে অলকেশ নিশ্চই সায়নীকে চিনতে পারবে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ অলকেশের পিছন থেকে একটি মেয়ের গলার আওয়াজ এল, “অলকেশ?” বসে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই অলকেশ পিছন ঘুরে তার মুখটা ওপরের দিকে তুলেছিল দেখার জন্য। কিন্তু, সেটার আর প্রয়োজন হলে না, কারণ সায়নীর উচ্চতা বসে থাকা অলকেশের কাঁধ বরাবর ছিল!!

দীর্ঘদিন অনলাইনে কথা বলতে বলতে সায়নীর প্রেমে পড়ে গেছিল অলকেশ! তার কথা বলার ধরণ, জ্ঞান, বই পড়ার নেশা, আবৃত্তি, গানের কণ্ঠস্বর – সবকিছু নিয়ে সায়নী বড় গুণের অধিকারী হলেও শারীরিক উচ্চতায় বিধাতা তাকে অসম্পূর্ণ রেখেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। বামন মেয়েটিকে দেখে আশেপাশে থেকে চাপা ব্যঙ্গাত্মক হাসির শব্দ অলকেশের কানে আসতে লাগল! অলকেশ একটু ইতস্তত বোধ করাতে, সায়নী বুঝতে পেরে বলে ওঠে, “আমার অভ্যেস আছে রাস্তাঘাটে এরকম হাসি আর টোন-টিটকিরি শোনার! ঠিক এই কারণেই আমি আসতে চাইছিলাম না। প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেঁচে থাকাটা আমার মতন মেয়েদের কাছে আজকের দিনে সত্যিই অভিশাপ। দেখ, তুমিও নিশ্চই মনে মনে ভাবছ, ‘পালাতে পারলে বাঁচি!’ নিশ্চই আমার ফোটো দেখে আন্দাজ করতে পারনি যে আমি এরকম!”
সাময়িকভাবে একটু ঘাবড়ে গেলেও তারপর নিজেকে সামলে অলকেশ অপকটে বলে উঠল, “হ্যাঁ, এটা সত্যি তোমার শুধু মুখের ছবি দেখে তোমার শারীরিক গঠন আন্দাজ করা মুশকিল! তবে কি জানো, প্রতিবন্ধকতা মাঝে মাঝে আশীর্বাদও বটে। এই দেখ না, ভিড়ের মাঝেও কিরকম আমায় দয়া করে এক যুগল কি সুন্দর এই টেবিলটা ছেড়ে দিল!”
সায়নী এতক্ষণে লক্ষ্য করল টেবিলের ডানপাশে ঠেস দিয়ে রাখা রয়েছে একজোড়া ক্রাচ! সায়নীর নীরবতা দেখে অলকেশ আবার বলে ওঠে, “কি হল? তুমিও নিশ্চই আমার ফোটো দেখে আন্দাজ করতে পারোনি আমি যে এরকম?!?” হেসে উঠল অলকেশ!! তারপর দুজনেই ক্ষণিক নীরব থেকে ‘মুখোমুখি’ একে অপরের দিকে ভেজা চোখে শুধুই তাকিয়ে রইল।

বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকা কফি হাউসের ইমারতে, আজ আবার নতুন সম্পর্কের ‘জন্ম’ হলো।


লেখক পরিচিতি : অভীক দাস
অভীক দাস
ঠিকানা : বাগুইআটি, কলকাতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।