অভিশপ্ত চিরুনি

লেখক : অভীক সিংহ

আজ রবিরার, বাঙালির জাতীয় জঙ্গল সাফাই অভিযান দিবস। এই দিনটায় বাঙালিরা বিগত এক-দু’মাসের সযত্নলালিত জঙ্গলগুলিকে সাফাই করতে বেরোয়। আসলে মাথায় বুদ্ধি খেলানোর জন্য এই জঙ্গলগুলির সাফ হওয়াটা অত্যন্ত আবশ্যক। তার থেকেও জরুরি, সংসারে অশান্তির কালে অকস্মাৎ সেই জঙ্গলের একমুঠো গিন্নির হাতে পড়লে সেই জমিয়ে রাখা গাছগাছড়া শেকড়বাকড় সমেত উপড়ে তো আসবেই, তার সাথে কিঞ্চিৎ মাটির চাকলাও উঠে আসার সম্ভাবনা প্রবল। আমি সেই জঙ্গল বা গাছগাছড়া নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই, বরং আমার চিন্তা সেই গাছের নিচে মাটি ঘেঁটে যাওয়া নিয়ে। অতএব আগামী গৃহযুদ্ধের আগেই গিন্নির মোক্ষম অস্ত্রটিকে লুকিয়ে ফেলা, থুড়ি ছেঁটে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। হয়ত সেই কারণেই ছোটবেলা থেকেই বাবা কান ধরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিতেন নাপিতের সামনে। আর কথায় বলে না, মানুষ অভ্যেসের দাস। ছোট থেকে চোখের জলে, নাকের জলে মুখের উপর কুচি কুচি চুল সেঁটে গিয়ে সেই বিতিকিচ্ছিরি কুটুকুটে অবস্থার সম্মুখীন হয়ে যে শিক্ষা পেয়েছি, তার মূল্য বুঝতে বেশ কয়েক দশক লেগে গিয়েছে বইকি। তো সেই শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়ে রবিবার একটু বেলা করে হাজির হয়ে গিয়েছি সেলুনে। দরজা ঠেলে ছোট ঘরটার মধ্যে ঢুকতেই এয়ার কণ্ডিশনারের হাওয়াতে শরীরটা জুড়িয়ে গেল। বাইরে চড়া গরমের চরম চড় থেকে বাঁচিয়ে এই একটা ছোট্ট এসিই বুঁদির গড় রক্ষা করে চলেছে। আর এই সেলুনও এমন একটা অদ্ভুত জিনিস, যেটা চলেছে বিজ্ঞানের যুগে বিশ্বায়নের একেবারে বিপরীতে – মানে ইটালিয়ান থেকে একেবারে খোদ ভারতীয় স্তরে উন্নতি। তো সে যাই হোক, রবিবার মানেই তো হয় পাঁঠা কাটা পড়বে, নয়ত পাঁঠাদের চুল। তো সেলুনের মধ্যে আমার মতই বেশ কয়েকটাকে বেঞ্চে বসে থাকতে দেখলাম, সবাই বসে নিজেদের পালার অপেক্ষায়। আমিও আর পালানোর গতিক না করে একটা খালি বেঞ্চে সেঁধিয়ে পাশে রাখা খবরের কাগজটা পাঁঠার মতই গিলতে শুরু করলাম। ওদিকে নাপিত তখন চেয়ারে বসা এক জনতার মুণ্ডু নিয়ে রাগবি খেলছে। রান্নাঘরে প্রায়ই দেখি, গিন্নি চালের কৌটোকে এদিক ওদিক ঝাঁকিয়ে ভিতরে দিব্যি জায়গা বানিয়ে নেন। এটাও বোধহয় সেই রকমই প্রক্রিয়া। মুণ্ডু ধরে ঝাঁকালে মাথার মধ্যেও মনে হয় নতুন জ্ঞান ঢোকার জায়গাটা খুলে যায়। বা হয়ত নাপিত ওনাকে ভবিষ্যতের গৃহযুদ্ধের জন্য শরীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত করে দিচ্ছেন। তবে মোদ্দা কথা হ’ল, চুল কাটার পরে ব্রহ্মতালু এবং ঘাড়ের গোড়ায় রদ্দা ব্যাপারটা বেশ আরামদায়ক। শরীর এবং মাথা – দু’টোই বেশ ফুরুফুরে শরীফ হয়ে যায়। আর তার সাথে একটু যত্ন করে নবরত্ন তেল দিয়ে মাথাটা মালিশ করে দিলে মনে হয় মাথার নিচে একটা বালিশ থাকলেই ষোলকলা পূর্ণ – জাগতিক ছলাকলা থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়ে ডিগবাজি খেয়ে সোজা অবস্থান ম্যাসলোর আত্মোপলব্ধির স্তরে।

“কী হে, তুমিও?” আওয়াজটা আসতেই মুখ তুলে দেখি সান্যালদা এসে হাজির।
“আরে গুরু,” আমি কাগজটা সরিয়ে রেখে বললাম, “এই চলে আসলাম। আজ রবিবার, আজ জঙ্গল কাটার দিন।”
“বেশ বেশ।” সান্যালদা দাঁড়িয়ে একবার সামনে বড় আয়নাটার দিকে তাকিয়ে মাথার মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, “আর বেশিদিন না কাটলে তো এবারে রাপুনজেল হয়ে যাব মাইরি।”
আমি মনে মনে একবার সাহস করে স্যাণ্ডো গেঞ্জী, পাজামা, আর চশমা পড়া রোমশ ভুঁড়িওয়ালা রাপুনজেলের চেহারাটা কল্পনা করলাম, জানালা থেকে কোয়ার্টারের নিচে নালা অবধি চুল ঝুলিয়ে বসে আছে। নাহ্‌, এই দৃশ্যের সামনে হ্যারি পটারের হ্যাগ্রিডকেও কেট উইন্সলেট মনে হবে। মাথা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যটাকে মন থেকে তাড়াতাড়ি মুছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তা কতদিন পরে এদিকে আসলে?”
“সে প্রায় মাস তিনেক হবে।”
“বাবা রে। এই গরমে মাথায় আগাছার জঙ্গল নিয়ে আছো কী করে?”
“সেই জন্যেই তো আজ চলে আসলাম।”
“হমম, বুঝলাম গুরু। কিন্তু আজ তো একটু সময় লাগবে মনে হচ্ছে, লাইন আছে।”
“সে লাগুক, লাইন ইজ ফাইন উইথ মি।” বলে সান্যালদা আমার পাশে বসে পড়ল। তারপরে অন্যদিকের চেয়ারে কর্মব্যস্ত নাপিতকে দেখে খুব সন্দিগ্ধভাবে নিচুগলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা অভীক, এরা চিরুনিগুলো কি পরিষ্কার করে?”
“নিশ্চয়ই করে। কেন বলো তো?”
“আরে দেখই না, সবার চুল তো কাটছে ওই একই চিরুনি দিয়ে। কার মাথায় কী আছে, কে জানে। কারও মাথায় ঘা, উকুন, বা পোকা থাকলে সেইগুলো তো একজনের থেকে অন্যদের মাথাতেও যেতে পারে। হ্যাঁ কি না?”
“তা অবশ্যই পারে, কিন্তু তার সম্ভাবনা কম। নাপিত তো দেখেই কাটছে।”
“ধ্যুৎ, তোমার মনে হয় ওরা অত দেখে দেখে করে?” সান্যালদা আমার যুক্তিটাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার এইসব সেলুনের চিরুনিগুলোর উপরে একেবারে বিশ্বাস নেই।”
“ও কথা বলো না সান্যালদা, চিরুনির অভিশাপ লাগে।”
“অ্যাঁ, সে আবার কী?” সান্যালদা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই বলল।
“আরে সে অনেক ব্যাপার আছে, খুব ভয়ানক জিনিস।” আমি একটু গম্ভীরভাবে বললাম।
“আবার ফাজলামো হচ্ছে? চিরুনির অভিশাপ? এই গরমে কি তোমার মাথাটাও গিয়েছে নাকি?”
“নিজের চোখে দেখা জিনিস সান্যালদা, কী করে অবিশ্বাস করি বলো?” আমি একটু দুঃখের সাথেই বললাম।
“নিজের চোখে দেখেছ? বললেই হ’ল?” সান্যালদা অবিশ্বাসের সাথে বলল।
“নাহলে আর বলছি কি, সে যা জিনিস দেখেছিলাম, ওরে বাবা।”
সান্যালদা কিছুক্ষণ আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “কী দেখেছিলে বলো তো শুনি।”
“বলছি, তার আগে একটু চা হবে নাকি?”
“এখানে চা পাবে কোত্থেকে?”
“এই তো পিছন দিকেই একটা চায়ের গুমটি আছে। আর এখানেও তো এখনও সময় লাগবে। তার চেয়ে চলো একটু চা খেতে খেতে কেসটা বলছি।”
সান্যালদা একবার ভিতরের দিকে চেয়ে দেখল, তারপরে দেখল কবজিতে আঁটা ঘড়িটার দিকে। একটু চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, চলো। এখানে বসে থাকার চেয়ে একটু চা হলে মন্দ হয় না।”
আমরা দু’জনে সেলুন থেকে বেরিয়ে গুটিগুটি পায়ে চায়ের গুমটিতে এসে হাজির হলাম। “দো কাপ চায়ে, অউর দো গোল্ড ফ্লেক” বলতেই দোকানী আমার দিকে দু’কাপ চা আর দু’টো সিগারেট এগিয়ে দিল। আমরা দু’জনে চায়ের কাপে একটা করে চুমুক দিলাম। তারপরে সিগারেট ধরাতে ধরাতে সান্যালদা বলল, “এবারে বলো, শুনি।”
আমি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শুরু করলাম।

সে ধরো আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগের কথা। আমি তখন ক্লাস নাইনে। সকালে স্কুল, আর বিকেলে ক্রিকেট। পাড়ার পাড়ার প্রায় প্রতি সপ্তাহে ম্যাচ লেগেই থাকত। সেই সময় আমাদের পাড়াতে এক দাদা ছিল, আমাদের দলের ওপেনার আর ফাস্ট বোলার। আমাদের চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড়। মাথায় ঝাঁকড়া চুল নিয়ে যখন বোলিং করতে আসত, সামনের দলের ব্যাটসম্যানদের প্রাণপাখি তখন খাঁচার ভিতর থেকেই কাঁচা কাঁচা খিস্তি দিত। আদ্ধেক পাবলিক তো ওর দৌড়নোর সময় ছয় ফুট তিন ইঞ্চির উপরে হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল দেখেই হয় শুকিয়ে যেত, নয় লুকিয়ে যেত। আর সেই দাদাও নিজের চুল খুব যত্ন করে রাখত। সেলুনে গেলে নাপিতকে নিজের মত নির্দেশ দিয়ে চুল কাটাত, চুলে যে সে রকমের তেল বা শ্যাম্পু ব্যবহার করত না, স্কুলে যাওয়ার সময় সবসময় মাথায় টুপি পরে যেত, যাতে চুল নষ্ট না হয়ে যায়। আমরা হাঁ করে দেখতাম। আমি তো একবার তার দেখাদেখি নিজেই নাপিতকে নির্দেশ দিয়ে চুল কাটাতে গিয়ে মাথায় একটা ছোটখাট অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ বানিয়ে নিয়ে চলে এসেছিলাম, বাড়িতে উধুম ক্যালানি খেয়েছিলাম। তো এইভাবেই চলছিল। ক্লাস টুয়েল্ভের পরীক্ষার পরে আমাদের সেই দাদা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেল আর্কিটেকচার নিয়ে পড়তে, আর আমাদের ক্রিকেট দলটাও একেবারে মুণ্ডুকাটা মুরগী হয়ে গেল।

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে তিন বছর, আমি উঠেছি ক্লাস টুয়েলভে। সামনেই উচ্চমাধ্যমিক, তাই খেলাটা একটু হলেও কমেছে। আর মাঠে গেলেও আমাদের সেই দাদার অভাবটা সারাক্ষণ মনে হত। দাদা প্রথম বছর মাঝে মাঝে বাড়ি আসত, পরে আস্তে আস্তে বাড়ি আসাটা খুব কমিয়ে দিয়েছিল। তখন তো আর এরকম ফ্লাইটের রমরমা ছিল না, আর ট্রেনের বুকিং করতে হলেও তখন স্টেশনের বুকিং কাউণ্টারে গিয়ে হাপিত্যেশ করে পড়ে থাকতে হত। তাছাড়া পড়াশুনোর চাপটাও বাড়ছিল। তাই দাদার সাথে আমাদের দেখা হওয়াটা আর প্রায় হতই না বললেই চলে। তো একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাঠে গিয়েছি, দেখি সবাই জটলা পাকিয়ে বসে আছে। আমি এগিয়ে তাদের কাছে যেতেই দেখি সেই জটলার মধ্যে একটা খুব চেনা মুখ। এ কে? এ তো আমাদের সেই দাদা! কি অবস্থা হয়েছে দাদার! মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, বয়সটা যেন এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে, আর মাথায় – সেরেঙ্গেটির জঙ্গলের বদলে তাকলা মাকান মরুভূমি। টাকলা মাকানও বলা চলে। চুলের নামে কয়েক গাছা আগাছা, যেন টাকের চারিদিকে শনির বলয় হয়ে ঘিরে রয়েছে। মাঠের সকলেই একেবারে হাঁ। দাদার চুল যেন কেটে নয়, কেউ চেটে সাফ করে দিয়েছে। আমি ব্যাপারটা একটু হালকা করার জন্য দাদার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী খবর দাদা? কেমন আছ?”
দাদা নিজের মাথার দিকে আঙুল দেখিয়ে হতাশস্বরে বলল, “কেমন আছি দেখতেই তো পাচ্ছিস।”
“সে তো দেখছি। কিন্তু এটা হ’ল কীভাবে?”
দাদা চুপ। কোন উত্তর নেই। বুঝলাম, ব্যাপার গুরুতর। আমরা সবাই মিলে দাদাকে চেপে ধরাতে দাদা আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল।

আর্কিটেকচার বিষয় নিয়ে পড়ার সূত্রে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের তিনমাসের জন্য একটা ইন্টার্নশিপ করতে হয়। সেই তিনমাস কোন একটা আর্কিটেকচারের কোম্পানীর সাথে কাজ করতে হয়, যাতে বিষয়টা সম্পর্কে অনেক খুঁটিনাটি জিনিস জানা যায়। প্রায় আট-ন’মাস আগে কলকাতার একটু বাইরের দিকে এইরকম একটা কোম্পানীতে দাদা ইন্টার্ন হয়ে যোগদান করে। আসবার আগে অফিস থেকে একটু দূরে একটা মেসের সন্ধান পেয়ে সেখানে এসে ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রোজ একটা ট্রেন আর দু’টো বাস পাল্টে অফিসে পৌঁছতে প্রায়শই দেরি হয়ে যেত, আর বসের কাছে জুটত বকুনি। তাই দাদা অন্য একটা বাসা খোঁজা শুরু করে। কপালজোরে অফিসের খুব কাছেই একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার সুযোগ পেয়ে যায়। একটা ছুটির দিন দেখে দালাল এসে দাদাকে বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যায়। বাড়ি দেখে তো দাদার চক্ষু চড়কগাছ। সে কি বাড়ি, না প্রাসাদ! বিশাল বড় দরজা খুলে ঢুকতে ঢুকতে দাদার প্রায় পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়। বাড়ির চারিদিকে বিশাল জায়গা জুড়ে বাগান। কী নেই সেখানে! আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আরও কত ফলের গাছ। তাছাড়া ফুলের বাগান তো আছেই। বেশ বনেদি বাড়ি, অনেকটা সাবেকি ধাঁচের। বাড়ির দরজাগুলো উঁচু, পেল্লায় সব জানালা, উপরে কড়ি বরগার ছাদ, চুণ সুড়কি করা দেওয়াল, ঢালাই করা লাল মেঝে। দাদার গলা শুকিয়ে গিয়েছে, এই বাড়িতে থাকার ভাড়া দিতে গেলে তো দু’টো কিডনি একেবারে লেডিকেনির মতই বিক্রি হয়ে যাবে। ভয়ে ভয়ে দাদা দালালের সাথে বাড়ির ভিতর ঢুকল। একটা কাজের লোক এসে বিশাল হলঘরে রাখা মখমলের সোফাটায় বসতে বলল। দাদারা বসার একটু পরে একজন ভদ্রমহিলা আসলেন। বয়স প্রায় সত্তরের দিকে, ফর্সা রঙ, চেহারায় একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। দেখলেই পুরনো দিনের কোন জমিদার বাড়ির সম্ভ্রান্ত কেউ বলে মনে হয়। তিনি এসে দাদাদের সামনে বসলেন। দাদা উঠে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করতেই তিনি দাদার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। দাদা আর্কিটেকচারের ছাত্র শুনে বেশ খুশি হলেন। তারপরে কথায় কথায় বললেন যে, ওনারা আদপে পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা। এখানে কলকাতায় ওনাদের বিশাল ব্যবসা। ওনার স্বামী মারা গিয়েছেন প্রায় বছর ছয় আগে। এখন ব্যবসা উনি নিজেই দেখেন। তাঁর ছেলে, বৌমা, আর একমাত্র নাতি থাকে বিলেতে। প্রতি বছর পুজোর সময়টাতেই বাড়ি আসে। আর বাড়িতে প্রাণী বলতে একজন খানসামা, দু’জন রান্নার লোক, একজন মালী, একজন ড্রাইভার, আর ওনার একটা পোষা ডোবারম্যান। তবে এতদিন একা থাকতে থাকতে উনি একরকম বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছেন, মন খুলে কথা বলবারও তো কেউ নেই। সেই কারণেই একজন পেয়িং গেস্ট রাখতে চান। আর দাদাকে দেখে ওনার নিজের নাতির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তাই দাদা পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার কথা বলাতে উনি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। আর দাদা ভয়ে ভয়ে ভাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করাতে তিনি জিভ কেটে বলেছিলেন, “ছি ছি, নাতির কাছ থেকে পয়সা নেব? তুমি বাবা এখানে এমনিই থাকো। তোমাকে কোন পয়সা দিতে হবে না। আমি তোমার জন্য আমার নাতির ঘরটা খোলার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি ওখানেই থাকবে, কোন অসুবিধা হবে না।” তখন যদি কেউ দাদাকে বলত যে ভারত ফুটবল বিশ্বকাপ জিতে গিয়েছে বা সলমান খানের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, দাদা হয়ত তাও বিশ্বাস করে নিত। আনন্দ, উত্তেজনায় দাদার মুখ দিয়ে আর কথা সরছিল না। এও কি সম্ভব? এত বড় প্রাসাদে অতিথি হয়ে থাকবার সুযোগ তো ভাগ্যবানের কপালেই জোটে। দাদা আর দেরি না করে সেদিনই বিকেলে মেস থেকে নিজের মালপত্র নিয়ে চলে আসল সেই প্রাসাদে। ভদ্রমহিলা নিজে দাদাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন নিজের নাতির ঘরে। ঘরে ঢুকে তো দাদার ধাঁধা লেগে যাওয়ার দশা। এইরকম ঘর সে তো হয় দেখেছে সিনেমাতে, নয়ত আর্কিটেকচারের বইতে। অসামান্য কারুকার্য করা সুবিশাল মেহগনি কাঠের খাট, আলমারি, টেবিল, চেয়ার, আরও কত কি। দাদা ঘরের মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে চারিদিকের আসবাবপত্র দেখছে, এমন সময় পিছন থেকে খানসামা ঢুকল হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে। “এটা খেয়ে নিন বাবু। রাত আটটার সময় নিচে চলে আসবেন ডিনারের জন্য।” দাদা মন্ত্রমুগ্ধের মত ঢকঢক করে শরবতটা খেয়ে নিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল।

তারপরে দেখতে দেখতে প্রায় আড়াই মাস কেটে গেল। এতদিনে দাদা পুরো ব্যাপারটা সঙ্গে একটু সড়গড় হয়ে উঠেছে। রোজ সকালে অফিসে বেরনোর আগে দাদার ঘরে জলখাবার পৌঁছে যায়। আর বিকেলে যখন ফিরে আসে, তখন ঘরের টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা থাকে বিভিন্ন রকমের ফল। তাছাড়া ছুটির দিনে বিভিন্ন রকমের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তো থাকেই। মানে সব মিলিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ড। তাছাড়া রোজ সন্ধ্যেবেলায় ভদ্রমহিলার সাথে বসে দাদার সে কত রকমের গল্প হত। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি দাদাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন। মনেই হত না যে দাদা ওই প্রাসাদে পেয়িং গেস্ট হয়ে আছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও দাদার চোখ টেনেছিল একটাই জিনিস। সেটা হ’ল ওই ঘরের ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা হাতির দাঁতের একটা চিরুনি। ওটা নাকি বার্মা থেকে নিয়ে আসা। দাদার একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল ওই চিরুনিটার প্রতি। সকাল সন্ধ্যে সুযোগ পেলেই দাদা ওই চিরুনিটা দিয়ে বেশ সময় নিয়ে চুল আঁচড়াত। চিরুনিটা অদ্ভুত রকমের মোলায়েম, যেন চুলের মধ্যে দিয়ে কেউ একটা অদৃশ্য হাত বুলিয়ে দিত। মনে মনে দাদা তার একটা নামও রেখেছিল, গজগামিনী। কোনমতেই দাদা গজগামিনীকে কাছছাড়া করতে চাইত না। রাতে ঘুমনোর সময়ও গজগামিনীকে মাথার পাশে রেখেই ঘুমোত। এইভাবে যেতে যেতে একদিন দাদার ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার দিনটা এগিয়ে আসল। আলিগড় ফেরার পালা। নিজের সমস্ত মালপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ দাদার মাথায় একটা চিন্তা খেলে উঠল।  গজগামিনীকে একা রেখে যাবে? ও এই বিরহজ্বালা সহ্য করতে পারবে তো? ওকে নিজের সাথে নিয়ে নিলে কেমন হয়? এত বড় বাড়ি, এত আসবাবপত্র – এগুলো থেকে একটা চিরুনি খোয়া গেলে কেউ হয়ত খেয়ালও করবে না। তবু একবার ভাবল, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।” তারপরে নিজের মনেই হাসতে হাসতে বলল, “বালের মৃত্যু।” বলে টুক করে গজগামিনীকে পুরে নিল ব্যাগে।

দাদা ভাবতেও পারেনি যে নিজের কথাটা এমনভাবে ফলে যাবে। গজগামিনীকে নিয়ে আলিগড় ফিরে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই দাদার জীবনে ধীরে ধীরে নেমে এল অন্ধকার। এক এক করে উঠতে শুরু করল দাদার চুল। প্রথম দিকে একটু আধটু ওঠায় দাদা বিশেষ পাত্তা দেয়নি। তারপরে দু’মাস যেতে না যেতেই চুলের ঘনত্ব কমতে লাগল। আড়াই মাসের মাথায় দাদা একদিন আবিষ্কার করল মাথার ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটা মসৃণ সমতলভূমি। ছুট লাগাল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিল, কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু লাভ হ’ল না। আস্তে আস্তে জঙ্গল উজাড় করে সমতলভূমি গতরে বাড়তে লাগল, আর মোটামুটি আট মাসের মধ্যেই সমতলভূমি পরিণত হ’ল একটি দ্বীপে। আর গজগামিনী? দাদা তাকে মাঝে মাঝে বের করে উদাস চোখে দেখে, উচ্ছিষ্ট আগাছার মধ্যে একটু বুলিয়ে আবার আলমারির তাকে তুলে রেখে দেয়। “শালা চিরুনিটাই অভিশপ্ত ছিল রে।” এই বলে দাদা নিজের পাশে রাখা ব্যাগের ভিতর হাত ঢোকাল। ব্যাগ থেকে বের করে আনল গজগামিনীকে। তারপরে আমাদের সামনে তুলে ধরে বলল, “এই দেখ, কেউ নিবি নাকি?” সেটা দেখে আমরা প্রায় পিছনদিকে ছিটকে পড়লাম। বলে কী? ওই অভিশপ্ত চিরুনি মাথায় দিই, আর আমাদের কেশ একেবারে নিকেশ হয়ে যাক আর কি। আমরা পত্রপাঠ ওখান থেকে চম্পট দিলাম।

এই অবধি বলে সিগারেটটাকে খালি চায়ের কাপে গুঁজে ডাস্টবিনে ফেলে আমি উঠলাম। সান্যালদা এতক্ষণ চোখ বড় বড় করে শুনছিল। তারপরে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, “চিরুনিটা সত্যিই অভিশপ্ত ছিল নাকি?”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “কী মনে হয়?”
“হতেও তো পারে। পুরনো বনেদি বাড়িতে কত রহস্যই তো লুকনো থাকে। কিন্তু তবুও কেমন যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“আসলে -”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আসলে কী?”
আমরা সেলুনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “দাদা আর তার বাবা দুজনেই গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পুরো ব্যাপারটা দেখে কী বলেছিল জানো?”
“কী বলেছিল?” সান্যালদা আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করল।
“পুরোটাই বংশগত। কাকুর চুল উঠে গিয়েছিল উনিশ বছর বয়সে, আর দাদার বাইশে।”
“আর গজগামিনী?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “ওটা এখন কাকুই ব্যবহার করেন, নিজের আগাছাগুলো গুছিয়ে রাখতে। শুনেছি তিনিও ওটাকে নাকি মাথার পাশে রেখেই ঘুমোন। আর তিনিও ওটার একটা নাম রেখেছেন, কেশলতা।”
“মাইরি, ধন্য অভিশাপ,” সান্যালদাও হো-হো করে হেসে উঠল।


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< কেস মেস

লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।