লেখক : ডঃ অভীক সিনহা
কি হয়েছে জানেন তো, বেশ কয়েকবছর ধরে একটা আজব সমস্যায় ভুগছিলাম। আসলে একটা ব্যাপার কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছিল না, আর সেটা হল আমার স্নানঘরে যে কলটা আছে, সেটা কোনদিকে ঘোরালে শাওয়ার থেকে জল পড়বে, আর কোনদিকে ঘোরালে কল থেকে জল পড়বে। ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছিল না। বিভ্রান্তি থেকে বিপত্তির জন্ম, আর সেই বিপত্তির চরম হল এই কয়েকদিন আগে। কিন্তু সেই বিপত্তি থেকে চিরতরে পরিত্রাণ যে এইভাবে পাব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
সদ্য কেচে ইস্তিরি করা পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে নৈশাহার উপলক্ষ্যে একটু বাইরে বেরোনোর উপক্রম করছিলাম। আলমারি ঘেঁটে আমার বর্তমান কোমরের সাইজের প্যান্টটা খুঁজে বের করতে গিয়ে হাতটা একটু ধুলোমাখা হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম, এতই যখন সাজুগুজু করে বেরোচ্ছি, তখন হাতটা ভালো করে ধুয়ে নিয়ে বেরোলেই হয়। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। সটান স্নানঘরে ঢুকে কলটা ঘুরিয়ে যেই কলের নিচে হাত রেখেছি, তখনই বিপত্তিটা ঘটল। জল উত্তাপ নিবারক বলে জেনে এসেছিলাম, কিন্তু জল পড়লে যে আগুনও লেগে যেতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করাটা বাকি ছিল। আসলে সদ্য কেচে ইস্তিরি করা পাঞ্জাবি যদি এক লহমায় ঘর পোঁছার ন্যাতা হয়ে যায়, তাহলে মাথার আর কি দোষ বলুন। মাথার উপরে শাওয়ার থেকে তখনও টপটপ করে জল পড়ছে আমার মাথায়, আর আমি বেবাক বেবুনের মত অগ্নিবর্ষণকারী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখছি ওটার দিকে। শেষমেশ একটা পুরোনো টি-শার্ট পড়েই সে যাত্রা বেরোতে হল। নৈশাহারের পুরো মজাটা ভেজা দেশলাইয়ের বাক্সের মতোই নেতিয়ে গেল।
রাতে বিছানায় চোখ বুঝে শুয়ে আছি, সবে একটা আধোঘুমের মতো আমেজ এসেছে। এমন সময় মনে হল, কেউ যেন আমায় ধাক্কা দিচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে বসেছি, এত রাতে আমার ঘরে কে ঢুকল? কেনই বা ঢুকল? কোত্থেকে ঢুকল? এইসব একগাদা হাবিজাবি প্রশ্ন মাথায় নিয়ে চোখটা একটু কচলে ভাল করে তাকিয়ে দেখি, ঘরে দু’জন মানুষ। দু’জনেই বেশ বয়স্ক, একজনের মুখভর্তি সাদা দাড়ির জঙ্গল, আর অন্যজনের মাথায় নিপাট শুভ্রকেশে বাবরি ছাঁট। পোশাক-আশাক দেখে তো ঠিক চোর-ছ্যাঁচোড় বলে মনে হচ্ছে না। একটু আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আপনাদের তো ঠিক…”, আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বাবরি ছাঁট বলে উঠল, “কলের সমস্যায় ভুগছ খোকা?” পাশের দাড়ির জঙ্গল খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠল। আমার একটু রাগই হল, এই মাঝরাতে দুই উটকো লোক আমার ঘরে ঢুকে আমাকে নিয়ে মজা করছে। একটু রেগে গিয়েই জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “কে আপনারা? কি চান?” এবারে দাড়ির জঙ্গল মুচকি হেসে আমার থুতনি ধরে নাড়তে নাড়তে বলল, “চাই তো তোমার খোকা, কলের সমস্যার সমাধান।” একমুহূর্তের জন্য ভেবে নিয়ে বললাম, “তা যখন সমস্যার সমাধান দিতেই এসেছেন, তখন অত ভাঁট না বকে বলেই ফেলুন না মশাই। আমি তো আর আপনাদের যেচে ধরে আনিনি।” এবারে বাবরি ছাঁট বলে উঠল, “যেখানে সমস্যা দেখি, সেখানেই আমরা সমাধান দিই।” বলেই দাড়ির জঙ্গলের দিকে ফিরে বলে উঠল, “ওহে কার্ল, তুমি বলবে, নাকি আমাকেই বলতে হবে?” দাড়ির জঙ্গল উত্তর দিল, “এডাম দাদু, আপনি বয়োঃজ্যেষ্ঠ, শুভকাজটা আপনিই করুন।” এবারে বাবরি ছাঁট আমার দিকে ফিরে বলল, “শোন খোকা, ওই যে দাড়িবুড়োকে দেখছ, সমাজের নিচের স্তরের মানুষদের জন্য ও কাজ করেছে। আর এই যে আমি, সমাজের উপরের স্তরের মানুষরা আমার কাজের অনেক সুবিধা নিয়েছে। এবারে কলটা কোনদিকে – মানে, ঘটে কিছু ঢুকল?” কথাটা শুনে একটা বিদ্যুৎচমকের মত দু’জনের মুখটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। এ কি? এ আমি কাদের দেখছি? এ যে অবিশ্বাস্য ! দাড়ির জঙ্গল এবারে হাসতে হাসতে বলল, “সমস্যার সমাধান সব সময়ে আমাদের দুজনের কাছেই থাকে। কোন একজনকে যদি বাদ দিতে চাও, ফুল কেলো হয়ে যাবে কিন্তু বলে দিচ্ছি। ওহে এডাম দাদু, চল এবারে যাই। ওদিকে কুজনেটস যে আমাদের জন্য পেগ বানিয়ে অপেক্ষা করছে, তা খেয়াল আছে? একটু দেরি হলেই তো ব্যাটা আবার খিস্তি করবে।” বাবরি ছাঁট গম্ভীরমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা তো বটে, এই বেবুনটার মাথায় কি সমস্যার সমাধানটা ঢুকেছে?” দাড়ির জঙ্গল অস্থিরভাবে বলে উঠল, “দুত্তোর, নিকুচি করেছে এই হাঁদামুখো বেবুনের। এত সহজ জিনিস মাথায় না ঢুকলে কাল আবার এসে গাঁট্টা মেরে ঢুকিয়ে যাব।” বলেই ম্যাজিকের মত দুই বুড়ো একেবারে ভ্যানিশ হয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লুডোর ছক্কার মত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে ব্যাপারটা কি হল। নিজেকে চিমটি কেটে দেখি দিব্যি জেগে আছি। চুপিচুপি বিছানা থেকে উঠে স্নানঘরে উঁকি মেরে দেখলাম কেউ লুকিয়ে আছে কি না। একটু সাহস সঞ্চয় করে পা টিপে টিপে স্নানঘরে ঢুকে সেই কালান্তক কলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাত-পাঁচ ভেবে কলটাকে বামদিকে ঘোরালাম। বিস্ময়ের সাথে দেখলাম আমার হিসেবে মিলে যাচ্ছে, একেবারে দু’য়ে-দু’য়ে বাইশ। জল পড়ছে নিচের কল থেকে ! একটু পিছিয়ে এসে কলটা ঘোরালাম ডানদিকে। এবারেও আমার অবাক হওয়ার পালা। জল পড়ছে শাওয়ার থেকে, আমার মুখে, মাথায়, গায়ে – কিন্তু এখন আর রাগ হচ্ছে না। মনে হল আর্কিমিডিসের মত দিগম্বর হয়ে রাস্তা দিয়ে “ইউরেকা-ইউরেকা” বলতে বলতে ছুটি। কলের রহস্য আমি উদ্ঘাটন করে ফেলেছি।
তারপরে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর, অনেকগুলো ঋতুচক্র পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মাইরি বলছি, কল ঘুরিয়ে জলের বিভ্রান্তি আর কোনদিন হয়নি। আজও যখন একা বসে থাকি, তখন মনে মনে ভাবি যে সেই রাতে ঠিক কি হয়েছিল। ওনারা দু’জন কি সত্যিই এসেছিলেন? নাকি আমার মনে ভুল? উত্তরটা আজও অজানা, কিন্তু একটা জিনিস বুঝেছিলাম, যে ওনারা একে অপরের পরিপূরক। এডাম দাদুর পাশে কার্ল না থাকলে হয়ত জলের কলটা আজও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে, হয়ত…
লেখক পরিচিতি : ডঃ অভীক সিনহা
লেখকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন গোয়া ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের সাথে। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। তাঁর লেখা প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
বলছি সব জায়গাতেই এই নিয়ম খাটবে তো? নাকি এই সমস্যাও উপরতলা নিচের তলার চিরন্তন সমস্যা হয়ে থাকবে?