প্রেমপত্র

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

অনেকদিন আগে বিয়ের পর একবার শুশুনিয়া আসবার কথা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু বিয়ের পর আর আসা হয়নি। এত বছর পর যে আমরা এলাম, পুরনো দিনগুলোর কথা দেওয়ার কথা মনে পড়ছে বেশ। বিয়ের আগে কত কি প্ল্যান করেছিলাম, কত কথা একে অপরকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সব কি আর হয়ে ওঠে? কিছু কিছু প্ল্যান হয়, আর কিছু শুধুই স্মৃতির কোণায় হারিয়ে যায়। আমাদের এই প্ল্যানটাও হারিয়ে গেছিল, কি মনে হল জানিনা আমিই সেদিন বললাম নীলিমাকে, “অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। চলো না কোথাও!”
“কোথায় যাবে?” সংসারের কাজ করতে করতে নীলিমা জিজ্ঞেস করেছিল আমায়।
“শুশুনিয়া!” আমি বলেছিলাম।
“কবে?” খুব একটা উত্তেজনা ছিল না ওর গলায়।
“আগে বলো যাবে কিনা?” আমি একটু সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম। আসলে বিয়ের আগে যতটা সহজ ছিল নীলিমাকে নিয়ে যাওয়া, বিয়ের পর যেন ততটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। একটু কোথাও যাবার কথা বললেই মায়ের ওষুধ, বাবার দেখাশুনো কত কি প্রসঙ্গ যে চলে আসে, আমি তাই ওকে বলি না আজকাল। ও থাকুক ওর সংসার নিয়ে। কিন্তু সেদিন খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
আমার দিকে তাকাল নীলিমা, সেই পুরনো চাহনি, একটুখানি কৌতুক মেশানো, “হ্যাঁ যাবো।”
আনন্দে আমি জড়িয়ে ধরলাম ওকে।
“কি করছ? ছাড়ো!” এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বলল ও। আমিও এদিক ওদিক দেখলাম, কেউ নেই। তারপর ওর গালে একটা হামি খেয়েই পালালাম। যেতে যেতে বললাম, “ঠিক আছে তাহলে। টিকিট কাটছি।”
ঘুরে দেখেছিলাম লজ্জায় রাঙা ওর লাল গাল মুছতে মুছতে পালিয়ে গেছিল ও।
 
এ বছরে নীলিমার জন্মদিনটা রবিবারে পড়েছে। আর আমিও সেইমত প্ল্যান করে এসেছি এখানে। গত কয়েক বছরে আমার বা ওর কারও জন্মদিনই সপ্তাহের শেষদিনে পড়েনি। আর বিয়ের পর থেকে সত্যি কথা বলতে জন্মদিন পালনও সেভাবে করা হয়না। তাই এই কয়েক বছর আমরা প্রায় ভুলেই গেছিলাম জন্মদিনগুলোর কথা। অবশ্য আমরা ভুলে গেছিলাম বলা উচিত হবে না, বলা উচিত আমি ভুলে গেছিলাম। ও ঠিক মনে রাখে আমার জন্মদিন, মনে রাখে সবকটা দিন। ভুলে যাই আমিই। কিন্তু এবারে ভুলিনি। তার জন্য ভেতরে ভেতরে একটা গর্বও করছিলাম। আমরা শনিবারেই পৌঁছে গেলাম শুশুনিয়া। প্রথমদিন কাছেপিঠেই কিছু কেনাকাটি করলাম। ও বাড়ির জন্য, আত্মীয়দের জন্য কিনল অনেক কিছু। আমি সেভাবে কিছু কিনিনি। এই সব কেনাকাটির দায়িত্ব ওইই পালন করে। আমি কোনোদিন মাথাও ঘামাইনি। আজও ঘামালাম না। তবে জন্মদিনে একটা কেকের ব্যবস্থা তো করতে হবে। সেইমত একসময় নীলিমাকে লুকিয়ে আমি কেকের ব্যবস্থা করলাম। ওর চোখ এড়িয়ে ঘরের মধ্যেই রেখে দিলাম কেকখানি। আর সারাদিন শুধু রাত হবার অপেক্ষাই করতে থাকলাম। কিন্তু সেদিনই যেন রাত হতে চায় না। দুপুর, বিকাল, তারপর সন্ধ্যে, সময় যেন কাটতে চায় না।
 
অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত এল। এই কয়েক ঘণ্টা নীলিমার কথা শুনেও যেন শুনতে পাচ্ছিলাম না আমি। ভাবছিলাম একবার রাত আসলে চমকে দেব ওকে।
“কি হয়েছে বলো তো? ” জিজ্ঞেস করল নীলিমা।
“কি আবার হবে?” আমি বললাম।
“না কোনও কিছুতেই যেন মন নেই।”
“মন নেই মানে? এ কি পড়াশোনা করছি নাকি”
“জানি না” একটু বোধয় রেগেই গেল নীলিমা। আমি ওকে দুহাতে ধরতে গেলাম। ও আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে আর মন দাও না তুমি। আমি জানি। আমার কথা আর শুনতে ভালো লাগে না”
“তোমার কথাই তো শুনি গো সারাদিন।”
“হ্যাঁ! তাই জন্যই তো আর ভালো লাগে না। আমি সব বুঝি।”
এই রাগ যদি বেড়ে যায় এখন, তাহলে কি হবে। আমি ওকে জোরে আঁকড়ে ধরলাম, “কোথায় দেখি কত রাগ করেছো তুমি!”
“উফফ ছাড়ো!”
 
তবে মন যতই ব্যস্ত রাখি না কেন, মন পড়ে আছে আমার সেই রাত বারোটায়। বারবার আমি ঘড়ি দেখি, আর দেখি নীলিমাকে। ঠিক বারোটায় আমি ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম।
“কি হল?” আচমকা অন্ধকার হতে জিজ্ঞেস করল নীলিমা। আমি নীলিমাকে এনে বসালাম কেকের সামনে। ফস করে দেশলাইটা জ্বেলে কেকের ওপর রাখা মোমবাতিগুলো জ্বালালাম।
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!” বেসুরো গলাতেই আমি গাইতে শুরু করলে হেসে আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “থাক আর গাইতে হবে না। অন্য লোকেরা জেগে যাবে।” তারপর আমার দিকে হাত পেতে জিজ্ঞেস করল, “কই দাও আমার গিফট!”
আমি চমকে উঠলাম। এই একটা কথায় আমার সমস্ত উত্তেজনা একটা লজ্জার রূপ নিল। এত বছরে নীলিমার জন্মদিনে কখনও ওকে সেভাবে কোনও গিফট দিইনি। বিয়ের আগে প্রতি জন্মদিনে একটা কাগজে চকোলেট মুড়ে দিতাম। কাগজটায় লেখা থাকত আমার মনের কথা, আমার প্রেমপত্র। আসলে প্রথমবার যখন নীলিমাকে সাহস করে মনের কথা বলব ভেবেছিলাম, তখন ওকে এরম চিঠিই লিখেছিলাম। সেটা ছিল নীলিমার জন্মদিন। তখন এত মোবাইল, ইন্টারনেট ছিল না। ছিল না এত শপিং করবার জন্য বড় বড় মল। মানুষের হাতে মোবাইল না থাকলেও ছিল সময়। আমার মনের কথা লিখে, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্যাডবেরিটা সেই চিঠিতে মুড়ে তুলে দিয়েছিলাম ওর হাতে। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা। বেশ ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করেছিলাম মনে আছে। ও ভ্রূ কুঁচকে পড়ছিল চিঠিখানি। তারপর যখন মুখ তুলে চাইল তখন ওর মুখের যে হাসিখানি লেগে ছিল, ঐ হাসিতে লেগে ছিল যে উত্তর, তা আজও মনে আছে আমার। তারপর থেকে ওর জন্মদিনে এই ধারাটাই অব্যাহত রয়েছিল বিয়ের আগে অবধি। প্রতি জন্মদিনে ওকে মনের কথা জানিয়ে আমি চিঠি লিখে একটা ক্যাডবেরি সেই চিঠিতে মুড়ে ওকে দিতাম। কখনও অন্য কোনও গিফট দিইনি, কখনও ভাবিওনি তাই, ও-ও আজ অবধি আমার কাছে কোনও গিফট চায়নি। আর চায়নি বলেই আমি সেটাকেই স্বাভাবিক মেনে নিয়েছিলাম। বিয়ের পর তো এই চিঠি দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। বিয়ের পরে ওকে জন্মদিনে কোথাও বাইরে নিয়ে যেতাম খেতে, কখনও বা না হলে আমরা বাড়িতেই ভালো করে খাবার বানিয়ে খেতাম। ওকে যখন জিজ্ঞেস করতাম, “কি চাই বলো?”
“তুমি তো আছো। আর কিছু চাই না আমার।”
আমি ওকে বুকে টেনে নিতাম। আসলে দামি দামি গিফট কেনা ও পছন্দ করে না। প্রথমবার বিয়ের পর জন্মদিনে একটা দামি হার কিনে এনেছিলাম, ও বকা দিয়েছিল, “এত দামি জিনিস কিনেছ কেন”
“কেন আবার? তোমার জন্মদিন…”
“তো কি হয়েছে। তাবলে এত দামি একটা হার। শুধু শুধু পয়সা নষ্ট।” কিন্তু সেই হারখানি রাতে পরে এসে বেশ আদর করেছিল আমায়। তবে তারপর থেকে নিজে থেকে কোনও কিছুই কিনে আনিনি। সবসময় ওকে বলেছি, যখন যা মনে হবে যেন কিনে নেয়। এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে এতদিনে। এটাই তো আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ ওর এই চাওয়ায় আমার ভেতরের দীনতা যেন প্রকাশ পেয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে দীন দেখাতে কে চায়! আমি চট করে প্যাকেট থেকে সকালের কেনা একটা বাঁকুড়ার কাঠের ঘোড়া এনে বললাম, “এই নাও। কেমন হয়েছে?”
“এটা?” একটু যেন রাগের সাথেই বলল ও।
“হ্যাঁ। কেমন?”
“বাজে।” এক কথায় বলে দিল ও, “যা কিছু একটা ধরিয়ে দিলেই হল না?” ও পাশ ফিরিয়ে বসল, “আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। কিছু নেই সেটা বললেই হত। এরম ভাবে অপমান করার কি ছিল?”
পাশ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল নীলিমা। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই লজ্জা পেলাম। সে রাতে আর কিছু হল না। মোমবাতিগুলো থেকে থেকে এমনিই নিভে গেল।
 
পরের দিন সকাল বেলা আগের রাতের ঘটনা নীলিমার মনে নেই আর। কিন্তু আমার মনে থেকে সেটা গেল না। কেমন একটা বোঝা বুকের মধ্যে আটকে রইল যেন। ওকে কিছু একটা না দিতে পারার যে দুঃখ, সেটা মনের মধ্যে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা ছোট পাথরে পা দিয়ে নীলিমা হড়কে যেতেই আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। একটানে নীলিমার হাত শক্ত করে ধরে ওকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচালাম আমি। কিন্তু ঐ দু সেকেন্ডেই আমার বুকে যে কি ঝড় বয়ে গেছে সেটা আমিই জানি। শুশুনিয়া পাহাড়ে ওঠার রাস্তাটা একটু সাবধানেই চলতে হয়। শক্ত পাথড়গুলোর ওপরেই প্রচুর আলগা নুড়ি আছে, যেগুলোয় পা দিয়ে হড়কে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে যারা নিয়মিত আসে, তাদের জন্য এগুলো কোনও সমস্যাই না। এই তো এখানে কিছুটা উঁচুতে উঁচুতে একটা দুটো করে শরবতের দোকান, তারা তো রোজ পাহাড়ে উঠে তাদের দোকান খোলে। সেরকমই একটা দোকানের সামনে এলাম আমরা।
“বসুন বসুন! শরবত খেয়ে যান।” দোকানদার ডাক দিল।
“শরবত খাবে?” নীলিমাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“হ্যাঁ! খেলেই হয়” উত্তর দিল নীলিমা। দোকানদারের দিকে ঘুরে আমি বললাম “দুটো!”
 
দুজনের হাতে দুটো শরবতের গ্লাস দিয়ে লোকটা বলল, “খেয়ে দেখুন, শুধু ক্লান্তিই না, মনের অবসাদও দূর হয়ে যাবে।”
শরবতে আর কি অবসাদ দূর হবে! আমি এখনও কোনও গিফটের জোগাড় করতে পারিনি, মন ভালো নেই আমার।
“খেয়ে নিন! মন একদম ভালো হয়ে যাবে আপনার!” একেবারে যেন মনের কথা কেড়ে নিয়েই বলল লোকটা। চমকে উঠলাম আমি। লোকটাকে ভাল করে দেখলাম। কেমন যেন অদ্ভুত বেশভুষা লোকটার। লম্বা, কালো আর সুদর্শন চেহারা। মাথায় মুকুটের মত একটা টুপি, তাতে আবার পালক লাগানো। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকটাকে যাত্রাদলের লোক বলে মনে হচ্ছে না। বরং ভালই লাগছে তাকে। এই পোশাক বেশ ব্যক্তিত্বের সাথেই বহন করছে সে।
“কেমন?” শরবতের দিকে ইঙ্গিত করে বলল লোকটা।
“খুব ভালো” আমি আর নীলিমা প্রায় একসাথেই উত্তর দিলাম।
“দাঁড়ান আপনাদের একটা জিনিস দেখাচ্ছি!” বলে লোকটা দোকান থেকে বেরিয়ে অন্যদিকে গেল। প্রায় পাঁচ মিনিট পর সে ফিরে এল, তার হাতে কোনও গাছের দুটো পাতা।
“এটা কি জানেন?” জিজ্ঞেস করল লোকটা।
আমি মাথা নাড়লাম। জানি না। জানে না নীলিমাও।
“সীতাপত্র।” লোকটা বলল “এটায় যা লিখবেন সেটা রয়ে যাবে পাতাতে। প্রভু শ্রীরাম এই পাতাতে মা সীতাকে পত্র লিখেছিলেন।” একটু থেমে লোকটা আবার বলল, “কিন্তু এখানের মানুষ তো অত বোঝে না। অন্য গাছের সঙ্গে এই গাছগুলোও কেটে নেয়।” একটা পাতা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, “এনিন। আপনার খুব কাজে লাগবে।” তারপর একটা দেশলাই কাঠি বার করে অন্য পাতাটায় লিখল, “জয় শ্রী রাম”। আস্তে আস্তে পাতাটার রস শুকিয়ে লেখাটা ফুটে উঠল তাতে।
“পাতার রসটাই এমন।” আমি বললাম, “শুকোলে তো লেখা ফুটবেই। এ আর এমন কি?”
“কিন্তু সব পাতায় তো আর প্রভু শ্রীরাম মাতা সীতাকে প্রেম নিবেদন করেননি!” লোকটা বলল।
“ভালো বিজনেস ফেঁদেছে। এখন রামের লাভ লেটার বলে দাম চাইবে।” মনে মনে ভাবলাম আমি।
লোকটা পাতাদুটো আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “এ অমূল্য জিনিস দাদা। এর কোনও দাম হয় না। আপনার জন্যই আনলাম।”
আমি অবাক। লোকটা আবার যেন আমার মনের কথা বুঝেই উত্তর দিল। লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “শরবতের কত হল?”
“যা দেবেন।” লোকটা বলল, “আপনারা আমার সন্তানের মত। আপনারা খুশি থাকলেই তো আমি খুশি।”
 
পয়সা দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় লোকটা এগিয়ে এসে আমায় বলল, “এটা কিন্তু প্রভু শ্রীরামের লাভ লেটারের প্যাড। মনে রাখবেন।”
লোকটার নাটকীয়তায় নাকি সত্যিই পাতাটার মধ্যে কিছু একটা আছে, সেটা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু পাতাটা হাতে নিয়ে বেশ ভালো লাগল। আমি হেসে শুধু ওনাকে বললাম, “নিশ্চয়ই!”
শরবতটাও সত্যি অন্যরকম ছিল। দুজনেরই কেমন শরীরে আলাদা জোর পাচ্ছি এখন, নীলিমাও বলল। কে লোকটা? কেমন একটা লাগল আমাদের। কেমন অদ্ভুত, কিন্তু একটা ভালো লাগা।
“কি সুন্দর করে লোকটা গল্প বলতে পারে!” নীলিমা বলল।
“হ্যাঁ!” আমি সায় দিলাম ওর কথায়, “আর সাজটাও কেমন অদ্ভুত না!”
“প্রভু শ্রীরামের লাভ লেটারের প্যাড!” নীলিমা বিড়বিড় করল। বুঝলাম কথাটা ওর বেশ মনে ধরেছে। আর তখনই আমার মাথাতেও একটা দারুণ আইডিয়া এসে গেল। মনটা ভরে উঠল খুশিতে। মনে মনে লোকটাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম আমি।
সন্ধ্যাবেলায় হোটেলে ফিরে ম্যানেজারের ঘরে গেলাম। কিছু জরুরি কথা বলে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “দেখুন হয়ে যাবে তো?”
ম্যানেজার আশ্বাস দিয়ে বলল “সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে স্যার।”
বেশ খুশির মেজাজে ফিরতে যাবো ম্যানেজারের ঘর থেকে, ম্যানেজার ডাক দিল, “স্যার!”
“হ্যাঁ বলুন!” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“এই কিছুক্ষণ পড়েই কিন্তু সাঁওতালি ডান্স আছে। আপনাদের ভালো লাগবে।”
“ও আজকেই না?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“হ্যাঁ স্যার।”
 
কিছুক্ষণ পরেই সাঁওতালদের একটা দল এল। দলে বড়দের সাথে বাচ্চারাও আছে। নাচ শুরু করবার আগে একটা লোক, যে সম্ভবত সেই দলের পাণ্ডা হবে, ওদের নিজেদের কথা, নিজেদের সংস্কৃতির কথা বলল। বলল এই নাচগান ওরা পেটের জন্য না, নিজেদের সংস্কৃতিটা বাঁচানোর জন্য করছে। নাহলে ওদের আগামী প্রজন্মও তো ভুলেই যেতে বসেছে। বেশ ভালো লাগছিল লোকটার কথা শুনতে। নীলিমা তো একমনে শুনছিল। ওকে দেখেই আমার খেয়াল পড়ল বাকি থাকা কাজটা। সাঁওতালেরা যখন নাচ চালু করল, তখন দর্শকদের ভিড় এড়িয়ে, নীলিমার চোখ এড়িয়ে আমি চলে এলাম আমাদের রুমে। সেই ভদ্রলোকের দেওয়া সীতাপত্রটা তুলে নিলাম হাতে। একটা সেফটিপিন আগেই জোগাড় করে রেখেছিলাম। তারপর ছোট ছোট অক্ষরে সেই পাতাটায় আমি লিখলাম আমার মনের কথা। ব্যাকগ্রাউন্ডে সাঁওতালি গানের আওয়াজ আমার লেখাকে আরও আবেগপ্রবণ, আরও সুন্দর করে তুলল। লিখতে বসে বুঝলাম কত কথা জমা পড়ে ছিল এতদিন, যেগুলো বলা হয়নি। কিন্তু এইটুকু পাতায় তো সবটা লেখা সম্ভব না। আর একটা পাতার সন্ধানে হোটেলের রুম হাতড়ে বেড়ালাম । উফ এখন নীলিমা এসে গেলে প্ল্যানটাই ভেস্তে যাবে। কি বোকা না আমি, তখন ম্যানেজারের কাছে চাইলেই তো হত! কিন্তু এত কি আর মাথায় ছিল আমার! তারপর চোখে পড়ল হোটেলের বুকিং-এর কাগজখানি। ওটার পিছনদিকটাকেই আমার প্রেমপত্রের দ্বিতীয় পাতা হিসাবে ব্যবহার করলাম। ছোট করেও অনেক কিছু কথা লিখে ফেললাম। বেশ ভালো লাগছে নিজের বউকে প্রেমপত্র লিখতে। মনটা সেই অতীতের দিনগুলোয় ফিরে ফিরে যাচ্ছে বারবার। আর সাঁওতালি আবহসঙ্গীত সেই অতীতকে মনে করাচ্ছে খুব সুন্দরভাবে। অতীত থেকেই তুলে আনা কয়েকটা মুহূর্ত আমি খোদাই করলাম ঐ পাতাটায়। বিস্তারিত লিখলাম হোটেলের বুকিং-এর কাগজটায়। তারপর দুটোকেই লুকিয়ে রাখলাম আমি। আবার চলে এলাম হোটেলের প্রাঙ্গণে, এসে দাঁড়ালাম নীলিমার পাশে। আমায় পেয়ে আমার কাঁধে মাথা রাখল ও, “কোথায় ছিলে? কি সুন্দর লাগছে দেখো?”
“হ্যাঁ!” ওর কথায় সায় দিলাম আমি।
 
ডিনার শেষে আমরা দুজনে উঠে এলাম রুমে। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম গোটা হোটেলের সকলের ফিরে যাওয়ার। আমার আনচান ভাব ও ঠিকই ধরে ফেলে। জিজ্ঞেস করল, “আজ আবার কি হল?”
“কিসের কি হল?” আমি বললাম।
“কেমন যেন ছটফট করছ। কালকের মত।”
“ছটফট কোথায় করছি?”
” আমি কি জানি? আজ আবার কি বলে মুড খারাপ করবে?”
আমি কিছু বলতে যাব, বাইরের আলো নিভে গেল। অর্থাৎ সমস্ত অতিথিরা ফিরে গেছে যে যার রুমে। আমি চুপি চুপি বেরিয়ে এলাম। ম্যানেজার আসতে জিজ্ঞেস করলাম ,”সব রেডি তো?”
“হ্যাঁ স্যার।”
একটা লোক হোটেলপ্রাঙ্গণে কিছু কাঠ এনে সাজাল। তাতে কেরোসিন তেল ঢেলে দিল। তারপর একটা দেশলাই কাথি জ্বেলে ফেলে দিল তাতে। দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। রুমের ভেতর গিয়ে এবার আমি ডেকে আনলাম ওকে।
 
“কি হয়েছে?” বিরক্ত নীলিমা জিজ্ঞেস করল।
“এসো না!” আমি বললাম।
“রাত্রিবেলা আবার কি হল?”
“আরে এসই না!”
আমার সাথে সাথে নীলিমা এল রুমের বাইরে। হাতে আমার লেখা প্রেমপত্র আর সঙ্গে একটা ক্যাডবেরি। ক্যাডবেরিটা আমি আজ রাস্তাতেই একটা দোকান থেকে কিনে এনেছিলাম। হোটেলের আঙিনায় এসে ক্যাম্পফায়ারের এই ব্যবস্থা দেখে আশ্চর্য আর অভিভুত হয়ে গেল ও।
“আমার জন্য?” আবেগপ্রবণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আমায়। উত্তরে শুধু মাথা নাড়লাম আমি।
“তোমার জন্মদিনের গিফট!”
ওর চোখ ছলছল করে উঠল। আমি ওর হাতে প্রেমপত্রখানি তুলে দিলাম। আবারও খুশিতে প্রায় কেঁদেই ফেলত, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, ও-ও আমায় জড়িয়েই রইল অনেকক্ষণ। এবারে আমিই লজ্জা পেয়ে বললাম, “ছাড়ো!”
ও ছেড়ে দিল আমায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। আমরা দুজন গিয়ে বসলাম ক্যাম্পফায়ারের পাশে। সারারাত গল্প করলাম দুজনে।
“তুমি এরম ব্যবস্থা করবে ভাবিনি!” নীলিমা বলল আমায়।
“আমিও তো ভাবিনি” আমি হেসে উঠলাম।
“তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো বর জানো?” নীলিমা আমার গা ঘেঁষে বসল।
“তাই নাকি?”
“হুম!” ওর দুহাত আমার কোলে রাখল। নীলিমাকে এভাবে কাছে পাবো ভাবিনি। এভাবে কখনও ওর সাথে সময় কাটাবো ভাবিনি। সীতাপত্রের গল্পকথা কতটা সত্যি আমি জানি না। কিন্তু সত্যি বা গল্প যাই হোক না কেন, আমাকে নীলিমার এত কাছে এনে দিল ঐ প্রেমপত্রখানিই। মনে মনে প্রভু শ্রীরামকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম, ধন্যবাদ দিলাম ঐ লোকটাকেও। নিস্তব্ধ রাতে দুজনের সঙ্গ দুজনে উপভোগ করতে করতে কখন যে গভীর রাত নেমে এসেছে বুঝতেই পারিনি। বুঝতে পারলাম যখন নিভে গেল ক্যাম্পফায়ারের আলোও। আমরা উঠে এলাম নিজেদের রুমে।
 
নীলিমার মুখে লেগে থাকা হাসিটায় আমার বুকের থেকে ভার নেমে গেছিল। আমরা দুজন শুয়ে পড়লাম বিছানায়। আর হঠাৎ আমার ওপর উঠে বসল নীলিমা। ওর ভারে বুকে এক অন্য অনুভূতি হল। অনেকদিন পর অনুভুতিটা বেশ ভালো লাগল। আমি ওকে টেনে নিলাম আমার কাছে। ও টেনে নিল সীতাপত্রখানি। আমার কপাল থেকে নাক অবধি বোলাতে থাকল। তারপর ওর ঠোঁটের অনুভূতি পেলাম। আর কিছু মনে নেই আমার। আমি হারিয়ে গেলাম নীলিমার কাছে, হারিয়ে গেলাম নীলিমার মাঝে।


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।