অবিনশ্বর

লেখক: অয়ন মৈত্র

মহালয়ার সকালে ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে অন্তত পাঁচজনকে পাব যারা তখনও অনলাইন। বীরেন ভদ্র যাদের পারফেক্ট অ্যাম্বিয়েন্স তৈরি করে দিচ্ছেন হেরিটেজ মেনে নিঃশর্তে, নিখরচায়। একমাত্র ইনিই এখনো কিভাবে টিকে গেলেন রিমিক্স, ডিজে ছাড়াই এই টেকস্যাভি বং সন্তানদের মাঝে, এ রহস্য উদঘাটনের দায়িত্বভার সিবিআই না সি আই ডি কার
নেওয়া উচিত সে বিতর্কের ব্যাপার। কিন্তু যে যুগে আমার দাদু গলা খুসখুস দূর করতে ভিকসের ব্যবহার শেখেনি, সেরকম এক আদিম সময় তৈরী, টানা দেড় ঘণ্টার এই কনসার্টটি কি এক অমোঘ জাদুবলে আমাদের যাবতীয় টিপিক্যাল পূজো ফিলিংসের একমাত্র স্টেকহোল্ডার হয়ে গেল জেনারেশন কে জেনারেশন ধরে, ভাবতে বসলে এখনো অন্তত নিজেকে আঁতেল বলে মনে হয়না।
আর একটা ব্য্যাপার খুব অবাক লাগে। সেটা হল ক্যাপ বন্দুক। আমার বাবা ক্যাপ ফাটিয়েছেন কিনা জানা হয়নি কখন। কিন্তু আমি ফাটিয়েছি দেদার।। আজ থেকে সতেরো আঠেরো বছর আগে তখনও গোঁফ গজায়নি ভালোমত। বাবার শেভিং কিটস্ থেকে ‘ওল্ড স্পাইস’এর ঠাণ্ডাটা পাব বলে অপেক্ষা করতাম, কখন বাবা দাড়ি কামানো শেষে আমার গালে একটুখানি লাগিয়ে দেবে। তখনও চিনতাম না টাচস্ক্রিন কি। ভিডিও গেম বলতে সুপার মারিও বুঝতাম। বাবা কাকার মুখ সারাক্ষণ ‘সরকার’ এটা করছে, ‘সরকার’ ওটা করছে শুনে অনেক খুঁজেও এত বিখ্যাত লোকটার কোন ছবি দেখতে পাইনি, শুধু জানতাম ‘সরকার’ পদবী যখন, তার মানে লোকটা বাঙালি। সেই দিনগুলোতে আমাদের অ্যাডাল্টহুডের একমাত্র ‘ভোটার কার্ড’ ছিল এই ক্যাপ বন্দুক। ‘কোয়েল’ আর ‘লায়ন’ এই এই দুই ব্র্যান্ডের ক্যাপের মধ্যে ‘লায়ন’ এর বিক্রিই বেশি ছিল আওয়াজ বেশি বলে। কুড়ি টাকার বন্দুকটার ‘লিভার’টা খুলে ক্যাপের রোলটা লোড করতে করতে নিজেকে র‍্যাম্বো ভাবতাম। র‍্যাম্বো ম্যাগাজিন লোড করছে তার কালাশনিকভ টায়। টার্গেট লিস্টে সাধারণত সেইসব অবাধ্য ভাই, বা কড়া ধাতের দিদিরা থাকত, যারা সারা বছর পেছনে জেমস বন্ডের মত নজরদারি করে গেছে কখন পড়া ছেড়ে টিভি দেখতে গেছি বা পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়েছি এবং নির্ভুলভাবে বাবার কাছে সেই সব রিপোর্ট পেশ করে আমাদের সেইদিনের মত বরবাদ করে তবেই ঘুমোতে গেছে।
সেই বয়সে আমাদের ইতিহাস ছিল, বিশ্বাস ঘাতকতার ইতিহাস, মার খাওয়ার ইতিহাস, হাজার গণ্ডা ‘বারণ’ এর ইতিহাস। সাধারণত নেলসন ম্যান্ডেলা হিসেবে দাদুর ভূমিকা, কিম্বা মাদার টেরিজা হিসেবে ঠাকুমার, সবসময় কাজ করত না। ইতিহাস চিরকালই শাসকের এ তো জানা কথাই। তা এইসব ‘ অপ্রেশন’ এর বিরুদ্ধে আমাদের একমাত্র হাতিয়ার হতে পারত পরীক্ষার রেজাল্ট। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবকেই আমরা মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করেছিলাম। দিদি, ভাই, মা, মাসি সব্বাইকে অতিষ্ঠ করে এবার পাড়ায় পাড়ায় চড়তে বেরতাম আমার মতোই আর ও ‘বিপ্লবী’ দের সাথে।
খুব অবাক হয়ে দেখি, আজ ও এই টুইটার আর ‘জিও’র যুগে পাড়ার বাচ্চারা এখনো ক্যাপ বন্দুক হাতে ভয় দেখিয়ে যায়। এই দুনিয়াজোড়া বিশ্বায়নের বাজারে বিনা বিজ্ঞাপনে, নুন্যতম প্রচার ছাড়া কি করে কয়েক প্রজন্ম ধরে ‘ক্যাপ বন্দুক’ আর ‘ মহিষাসুরমর্দিনী’ নিজেকে শুধু বাঁচিয়ে না, বহাল তবিয়তে বাঁচিয়ে রেখেছে ভাবলে অবাক লাগে। যেখানে মানুষের হার্ট থেকে বারো বছরের সম্পর্ক, সব কিছুর ‘রিপ্লেসমেন্ট’ তৈরী হয়ে গেছে, যেখানে প্রত্যেক ‘পার্মানেন্ট’ এর একটা অপরিহার্য ‘ অলটারনেটিভ’ থাকে, যেখানে কোন কিছুর ‘গ্যারান্টি’ না তার ‘ওয়ারেন্টি’ থাকে, সেখানে আজও কিভাবে এরা দুজন একই রকম প্রাসঙ্গিক, অপরিহার্য, ও শাশ্বত থেকে গেল, ভাবনার বিষয়, গভীর ভাবনার বিষয়।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

  1. জুবিন ঘোষ

    অয়ন মৈত্র এই মুহূর্তের একজন অন্যতম শক্তিশালী প্রাবন্ধিক। অয়ন বাবুর প্রবন্ধের টেস্ট একটু অন্যরকমের মজা। প্রবন্ধ ঘেঁটে প্রবন্ধ তৈরি করার চেয়েও অয়নের মানস কলম এক্ষেত্রে চিত্রের মতো সমসাময়িক পরিস্থিতির ছবি আঁকে। আশ্চর্যের ব্যাপার এমন একটা স্বর্ণ কলম থাকতেও নিজেকে এতটুকু জাহির করে না অয়ন বাবু। ঘুমন্ত শিশুও যেন তাঁর প্রবন্ধের স্বাদ নিতে পারে অনায়াসে, এতটাই সাবলীল চলন। সহজাত এই দক্ষতাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাবিউস হয় সববাংলায়। কারণ সববাংলায় একটি তথ্যভিত্তিক সাইট। সেখানে তথ্যের রূঢ় সত্যই কেবল উন্মোচনের যোগ্য। কিন্তু সেই অয়নবাবুকেই যদি আমরা সববাংলায় ‘লেখালিখি’ সাইটের মতো ক্রিয়েটিভ মাধ্যমে পাই, তখন প্রকৃত বিশ্লেষণমূলক লেখার বিশেষজ্ঞ এক অন্য অয়ন মৈত্রকে চোখে পড়ে। আমি মনে করি অয়নবাবুর আরও অনেক বেশি ক্রিয়েটিভ লেখায় হাত দেওয়া উচিত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।