লেখক : সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত
ভোর রাতের দিকে জঙ্গলে এসেছিলাম। আর তাকে দেখেছিলাম তখনই।
ভয়ঙ্কর মূর্তি। দানবাকৃতি। মুখের দু’পাশের কষ দিয়ে রক্ত পড়ছে। কানে কুণ্ডল। চুল বড় বড়, ঘাড় ছাপিয়ে নামছে। ভয়াবহ ভাঁটার মত চোখদু’টি। তা দিয়ে যেন গিলে খাচ্ছে আমাকে। ঘন জঙ্গলের মাঝে শুধু দু’জন মুখোমুখি আমরা।
আমি ভয় পেলাম। পেটের দায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। পড়াশুনাটুকুই সম্বল। ইচ্ছে ছিল বিলেত যাব। স্বচক্ষে দেখব ইংরেজ প্রভুদের দেশ। পাকেচক্রে জড়িয়ে পড়েছি এই আর্কিওলজিক্যাল টিমের সাথে। এখানেও সাহেব প্রভুর সাথে বনছে না। বড় স্বাধীনচেতা আমি। কিন্তু তা হলেও রক্তমাংসের মানুষ। এই সেদিনও মা আলগোছে জড়িয়ে ধরে না শুলে ঘুমোতে ভয় পেতাম। চিৎকার করে উঠতাম।
ভয় পেয়ে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। কী দিলাম জানি না। দানব স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর পিছোতে লাগল এক পা-দু’ পা করে।
দানব ভয় পেয়েছে। কিন্তু কেন?
আমি সবিস্ময়ে হাতের জিনিসটির দিকে তাকালাম।
তখনই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোরের আলো ঝলমল করছে তাঁবুর ভিতর।
স্বপ্নের নানা ব্যাখ্যা আছে। ইদানীং ইউরোপের মনীষীগণ তা নিয়ে মাথা ঘামান। কিন্তু আমার সামনে ঘোর বাস্তব। চাকরিটি যেতে চলেছে।
সুলিভান সাহেব ঘোর মদ্যপ। তদুপরি উচ্ছৃঙ্খল। তাঁর কাজের ছিরিছাঁদ নেই। যত্ন নেই। এহেন মানুষকে কেন দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো আমি ভেবে কূলকিনারা পাই না। ইতিহাস জানলেই মরমী পণ্ডিত হওয়া যায় না।
কথায় কথায় একবার বলেছিলাম, “আমাদের উইলিয়ামসন সাহেবকে দায়িত্ব দিলে কবেই…”
সেই থেকে সুলিভান আমার উপর চটা। নেটিভ নিগারের এত সাহস? থাকবি জুতোর তলায়, সেলাম করবি হরবখত। দেখাচ্ছি…
বাবা ছিলেন অনুশীলন সমিতির সদস্য। ঢাকায় সানসান সাহেবের কাছে জুজুৎসু শিখতেন। চল্লিশ ইঞ্চি ছাতির মুগুর ভাঁজা চেহারা। সানসান সাহেব তখন শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে এসেছেন ঢাকায়। ঢাকার জমিদারবাবুরা তখন গোপনে বিপ্লবী দলকে মদত দেন। তাঁরা সানসান সাহেবকে গুরু মেনে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দিলেন। মা এসব গল্প বলে আমাকে তাতাবার চেষ্টা করত। আমি বড় ভীতু। ভারত স্বাধীন কি পরাধীন আমার কী? কে যাবে ওসব ঝামেলায়। আমার পড়াশুনা নিয়ে থাকার জীবন। হব রাখালদাস, হব হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
দল তার রোজকার মত সকালে বেরোয়। সূর্য ডোবার কিছু আগে খোঁড়াখুঁড়ির পাট শেষ করে ফিরে আসে তাঁবুতে। সাহেব লগ বুক লেখে। তারপর মদ নিয়ে বসে। রাতে গুজ্জর সিংএর ডাক পড়ে। আশপাশের গ্রাম থেকে তখন অন্য আমোদের ব্যবস্থা করতে হয়। আমরা চোখ বুজে থাকি। এই নাকি জ্ঞান তপস্বীর জীবন। ছিঃ।
সকাল নটা নাগাদ তাঁবু খালি করে দল বেরিয়ে গেল। সায়েবের মোসাহেব গুজ্জর বলল, “বাবু তুম থহর যাও। নজর রাখো।”
অর্থাৎ তুমি আর এক্সকাভেশন টিমে নেই। এটাই তোমার শাস্তি।
সবাই চলে গেলে পর আমি রাগে দুপদুপিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। তরাইয়ের জঙ্গল এখানে খানিক হাল্কা। তাই আমরা বেস ক্যাম্প করেছি। তবে জানোয়ারের ভয় আছেই। যখন তখন চলে আসতে পারে। মরলে মরব। তাঁবুতে বসে থাকার বান্দা আমি নই। চাকরি কলকাতায় ফিরলে এমনিই যাবে। লাঠি হাতে কোমরে কুকরিটি বেঁধে আমি শিস দিতে দিতে এগিয়ে চললাম।
মা দেখ। মরে গেছ তো কী হয়েছে, ওপর থেকে দেখ। বড্ড ভীতু ভাবতে আমায়। বলতে, কী বাপের কী ছেলে হয়েছে!
এই চললাম আমি। যা হয় হবে। মরলে মরব।
গ্রামকে গ্রাম পেরিয়ে গেল। ধূ ধূ প্রান্তর পেরিয়ে গেল কখন। জঙ্গল কখনও ঘন, কখনও ফাঁকা। তরাই এরকমই। একটু বেশি ফাঁকা হলে এক একখানা গ্রাম গড়ে ওঠে। এমন গ্রামও দেখেছি চারধারে ঘন জঙ্গল। জন্তু জানোয়ার প্রায় ঢুকে পড়ে। তাদের সাথে প্রতিনিয়ত লড়েই বেঁচে থাকে গোটা গ্রাম। চিতা মানুষের বাচ্চা টেনে নিয়ে পালাচ্ছে, পিছন পিছন দা-কুড়ুল হাতে প্রায় গোটা গ্রাম। প্রায়শই হয়।
কখনো বসি। বসে পাখি দেখি, গাছ-গাছালি দেখি। লোকজন সামনে পড়ে। টুপি, শার্ট, গামবুট দেখে সভয়ে সরে যায়। গ্রাম্য এলাকার মানুষ সাহেবদের যম সদৃশ ভয় পায়। সাহেবদের চাটুকার আমাদের মত নেটিভদের আরও বেশি ভয় পায়। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।
দেখতে দেখতে কখন দিন চলে গেল। সূর্য ডোবার সময় এসে গেল। এবার তো ফিরতে হবে। অনেক রাগ দেখানো হয়েছে। আঁধারের তরাই যমের সিংহদুয়ার। মৃত্যু কখন কী ভাবে আসবে জানানও দেবে না। এতক্ষণে টিমও ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই। সম্প্রতি তরাই সংলগ্ন অঞ্চলে হর্ষদেবের একখানি লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই হর্ষদেব কনৌজ অধিপতি বিখ্যাত হর্ষবর্ধন নন। ইনি কামরূপ আসাম অঞ্চলের রাজা অষ্টম শতাব্দীর। লিপি অনুযায়ী মাৎস্যন্যায়ের সময় কামরূপরাজ গৌড়বঙ্গ সমতট অধিকার করেছিলেন। ফলে ঐতিহাসিকরা নড়েচড়ে বসেছেন। মাৎস্যন্যায়ের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধার কম কথা নয়। সুলিভান সাহেবের নেতৃত্বে তাই আমাদের দলটি এসেছে অনুসন্ধান করতে।
যাই হোক ফিরতে গিয়েই বিপদটা হল। ভবানীপুরের গলিঘুঁজির ছেলে। কিন্তু তরাই অঞ্চল ভবানীপুর নয়। শর্টকাট মারতে গেলাম। এতক্ষণ জঙ্গল আর গ্রামের সীমানা দিয়ে চলছিলাম। বেশি বুদ্ধি খাটাতে এবার একটু গভীরে ঢুকলাম। যদি একটু তাড়াতাড়ি হয়।
লাভ তো হলই না, উল্টে খানিক বাদে বুঝলাম বিপদ। হাতে ক্ষুদ্র মশাল। ভয়াল গ্রাস করতে আসা জঙ্গল। আবার সীমানার দিকে ফিরতে গিয়ে সব গুলিয়ে পথ হারিয়ে ফেললাম। গ্রামের সীমানা কোথায়, চারিদিকে সূচীভেদ্য জঙ্গল। আমি একেবারে একা। চারদিকে অদ্ভুত সব আওয়াজ। খুট, খাট। চি চ্যা। মড়মড় করে পাতার উপর চলে যাবার শব্দ। অচেনা পাখি, অজানা জন্তুর অস্ফূট ডাক।
সাহসী লোকের ধাত ছেড়ে যায় এ সময়। আমি তো ভীতুস্য ভীতু। পুঁথিপত্র, পড়াশোনা আর ছাত্র ঠেঙিয়ে জীবন কাটাতে চেয়ে এ কোন চক্করে এসে পড়লাম। হে ভগবান, বাঁচাও! কী কুক্ষণে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এলাম রাগ দেখাতে। হায় হায়। ভয়টা আতঙ্কের দিকে ক্রমশ যাচ্ছে। কান্না উঠে আসছে গলায়, এমন সময়… ওটা কী?
ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঘাসের উপর কী পড়ে ওটা? দূর থেকেও যেন চকচকে ভাব। তেকোনা পেয়ালা গোছের। কাছে এসে তুলে নিলাম। প্রদীপ। বড় আকারের। ধুলোময়লা জমা প্রাচীন প্রদীপ। মনে হয় বহু বহু পুরনো। ফিক করে হেসে ফেললাম। যাক। মৃত্যুর আগে আলাদীনের প্রদীপ তো পেলাম। এই বা কম কী!
ঘষা দিলাম। কিছুই হল না। ফের ঘষা দিলাম মাটিতে।
“কী হল? কই জিন?”
আমার কথা জঙ্গলে প্রতিধ্বনি হতে লাগল। “জিন… জিন…”
আবার চেঁচিয়ে বললাম, “কই হে…প্রদীপের দৈত্য। কই …জিন…এস”
গোটা জঙ্গল যেন ডেকে উঠল, “জিন… জিন…”
আমি কেঁদে ফেললাম।
মশাল, প্রদীপ হাতে চলেছি। ট্যাঁকঘড়িতে দেখেছি সাতটা বেজেছে। মশালও নিভু নিভু। এ মশালগুলি বড় হয়। কুক্ষণে ছোটটিই নিয়ে বেরিয়েছি। এবং একটিমাত্র নিয়েছি বে-খেয়ালে। সাধারণত ব্যাগে গোটা পাঁচেক রাখে সবাই। একসময় মশালও নিভে গেল। এখন ঘনঘোর তরাইয়ের অন্ধকারে আমি একা।
চোখ বুজে ইষ্টনাম স্মরণ করলাম। হে ঈশ্বর রক্ষা কর। যা চাও করব। বংশের মর্যাদা নষ্ট করেছি, আর করব না। শুধু রক্ষা কর। একবারটি বাঁচাও। আর ভুল হবে না। দাদামশায় এক হাতে শিবলিঙ্গ অপর হাতে তরোয়াল নিয়ে গোরা কেটেছেন সিপাই বিদ্রোহে। তিনি ছিলেন রাজস্থানের নিমচ সিপাই রেজিমেন্টে। নিমচ সিপাইরা বিদ্রোহের সময় দিল্লী চলে এলে বাহাদুর শাহ নিজে দাদামশাইকে খিলাত দিয়েছিলেন। দিল্লী পতনের শেষ দিনটিতে একহাতে শিবলিঙ্গ এক হাতে তলোয়ার নিয়ে কাশ্মীর গেটের সেই শেষ যুদ্ধে লড়তে লড়তেই শহীদ হন তিনি। এ গল্প বাবার মুখে শতবার শোনা।
দাদামশাই বীর শহীদ যোদ্ধা। বাবা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে দ্বীপান্তরে। সেই আমি কেন ভয় পাব? পাব না।
বলছি মনে মনে আর দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছি। গোটা রাত বাকি এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে। এমন সময়…
দপ করে দূরে কী যেন জ্বলে উঠেছে। আলো। আলো মানেই মানুষ।
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম প্রথমটায়। কীভাবে সম্ভব? এই অন্ধকার জঙ্গলের মাঝখানে মানুষ আসে কীভাবে? জিন? সত্যিই এ প্রদীপ জিনের কবলে ফেলল না কি?…
আলো নয়, যেন জ্যোতি ঠিকরে পড়ছে। একটা প্রদীপ বা লন্ঠনের আলো এমন হয় না। আমি এগিয়ে চললাম। যা থাকে কপালে। লৌকিক অলৌকিক পরে বিচার করব। আলো যখন জ্বলছে মনে করি সে পথ দেখাতেই জ্বলছে। কেউ নিশ্চয়ই আছে ও-দিকটাতে। ডাকাত? যদি বা হয় মানুষ তো। আমার কাছে কিছু নেই। দয়া করে যদি রাতটুকু আশ্রয় দেয়। আলো মানেই মানুষ। মানুষ মানে ডেরা।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে ও কী! স্তম্ভ? আলো এখানে স্পষ্ট উজ্জ্বল। কাছেই উৎসটি আছে কোথাও। কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। শুধু আলোয় আলোকিত চারিদিক। সাধারণ প্রদীপে এত আলো?
আরও এগিয়ে এলাম। ভাঙা একাকী স্তম্ভটি কাছে চলে আসছে আরও। ক্ষণে ক্ষণে হাতের প্রদীপটিও দেখছি। এও কি সম্ভব? জাদু পিদিম পথ দেখিয়ে নিয়ে এল?
স্তম্ভ কাছে চলে এসেছে। গায়ে ও খুদি খুদি কী? অক্ষর?
পালি!!! এ ভাষা আমি জানি। নিজের আগ্রহে শিখেছিলাম। প্রফেসর উইলিয়ামসন বলেছিলেন “ব্রাভো বয়”। সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন যাতে এই পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে আমি ঠাঁই পাই। পালি ভাষায় কোন অক্ষর নেই। ব্রাহ্মী অক্ষরে পালি ভাষায় সে যুগে লেখা হত।
‘হিডা বুডে জাত শাক্যমুনি তি…’
এই স্থানে শাক্যমুনি বুদ্ধ জন্মেছেন।
কী সর্বনাশ। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তারপর চমকে উঠে হাতের প্রদীপটি দেখলাম। আলোয় সেটিকে উল্টে পাল্টে নজর করে। তলার অংশে পালি ভাষায় সেই লেখাটি। সাথে আরও কিছু লেখা।
‘এই স্থানে মহামানব জন্মেছেন। ভোরবেলা হাঁটার সময় মহারানি মায়াদেবী প্রসব বেদনা অনুভব করেন। তারপর…’
আলোময় উৎসটি দেখা গেছে এবার। তা যেন সচল এখন। এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
পিছনে কিছু মানুষ। তাদের চেহারা কর্কশ। মুখ গম্ভীর। প্রত্যেকের হাতে একটি করে প্রদীপ। বুঝলাম উজ্জ্বল আলোর উৎস। পঞ্চাশটি মানুষের হাতের প্রদীপ।
প্রদীপের আলোতেই জঙ্গল থেকে বেরোনোর রাস্তা পেয়েছিলাম। জনপদে পৌঁছে দিয়েই তারা মিলিয়ে যায়। তাঁবুতে আর ফিরিনি। সুলিভান সাহেব এ আবিষ্কারের ভাগীদার হওয়ার যোগ্য নয়। সোজা কলকাতা এসে দু’মাস পর অধ্যক্ষ উইলিয়াম পেপের হাতে প্রদীপটি তুলে দিয়েছি। তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এই অঘ্রাণ শেষেই অভিযান। পেপেই দলপতি। আমি সৈনিক মাত্র।
পেপে বলেছেন, এই স্তম্ভই মহামতি অশোকের খোদাই করা লিপি বহন করে রয়েছে। অশোক সম্ভবত জন্মস্থানটির সংস্কার করেছিলেন। প্রদীপগুলি তখনই বানানো। সিংহলের দিব্যবদনে আছে অশোকের করা মায়াদেবীর মন্দিরের কথা। জঙ্গলের ওই জায়গাটিতেই সম্ভবত কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদ ছিল। ভোরবেলা সকালে হাঁটার সময় স্তম্ভের ওই স্থানটিতেই প্রসব বেদনা অনুভব করায় বসে পড়েন মায়াদেবী। জন্ম নেন মহামানব। বর্তমানে যে প্রাসাদটিকে জন্মস্থান বলে অভিহিত করা হয়, তা মূল প্রাসাদ নয়। আসল প্রাসাদ এইটি, যা তরাইয়ের জঙ্গল এগিয়ে এসে গ্রাস করেছে। ওই ভাঙ্গা প্রাচীন স্তম্ভটির আশপাশেই প্রথম কেঁদে উঠেছিলেন শিশু সিদ্ধার্থ।
উইলিয়াম পেপে ভারতদরদী পণ্ডিত। তা সত্ত্বেও বলিনি তাঁকে, একটি গোপন বিপ্লবীদল তরাইয়ের জঙ্গলে প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে ভারতে ব্রিটিশ অপশাসন দূর করার যুদ্ধের। দলটি প্রস্তুতির পর্ব শেষ। কয়েকদিনের মধ্যে তারা মূল ভারতে প্রবেশ করে কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আমার বাবার নাম তারা শুনেছে। আমায় তারা অনুরোধ করেছিল তারা এখান থেকে চলে যাবার পরেই পুরাতত্ত্ব বিভাগকে খবরটি দিতে। এ স্থান বুদ্ধের জন্মস্থান তা তারা বুঝতে পারেনি। বুদ্ধের জন্মস্থান এখন ভারতীয় সশস্ত্র বিপ্লবের আঁতুড়ঘর এ ঘটনা কোনও মহাবিপ্লবের ইঙ্গিত কিনা কে বলবে?
শুধু বলেছি তাদেরকে…চোখের জলে ভেসে… অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেবার সময়…
“আজ আমার মৃত্যু হল। এক ভীতু কলমচি পুঁথি-আঁকড়ে-বাঁচা পণ্ডিত এবার হাতে তলোয়ার তুলে নেবে। তার বাপ দাদার মান রাখবে। আমি নতুন করে জন্মালাম। মৃত্যুভয় আমাকে বাঁচার রাস্তা দিল।”
সেই দৈত্যকে আরও একদিন দেখেছিলাম ভোর রাতে। এবারে স্নিগ্ধ সুন্দর প্রতিমূর্তি। পরনে রাজবেশ। যেন সম্রাট। হেসে কী যেন বললেনও।
বুঝলাম, সেদিনের চণ্ডাশোক আজ ধর্মাশোক বেশে এসেছেন।
বললাম, “আমি নতুন করে জন্মেছি। সেই ভীরু আত্মমর্যাদাহীন পণ্ডিতটি আর নই। আপনিই করেছেন”
দৈত্য ছদ্মরাগে বললেন, “ও কী কথা। ভারতবর্ষ অন্ধকারে ডুবে ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদ আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে ধ্বংস হতে বসেছিল। মহামানব বুদ্ধ এসে জন্ম দিয়েছিলেন ভক্তির যুক্তিবাদের। যা করার বুদ্ধ করেছেন।”
আমি হেসে বললাম, “আপনিও কম কি। ছিলেন এক…”
“তবে? আমারও পুনর্জন্ম হয়েছিল। ছিলাম মায়াদয়াহীন চণ্ড… কলিঙ্গযুদ্ধে রক্ত নদী বইয়ে হলাম…”
বলে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে দুটি অঞ্জলি বাড়িয়ে দিলেন। আমিও হেসে প্রদীপটি তুলে দিলাম হাতে।
স্বপ্নে অন্তত যার জিনিস, তার কাছেই ফিরল।
লেখক পরিচিতি : সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত
আমি পেশায় উকিল। নেশায় পাঠক ও লেখক। মূলত ঐতিহাসিক লেখা লেখেন, সঙ্গে আধুনিকও। চর্যা, কল্পবিশ্ব, মলাট, সায়েনটিফিলিয়া, মন্তাজ ইত্যাদিতে লেখা প্রকাশ হয়েছে। কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন।