লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী
গরমে ঘুম ভেঙে গেল। সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টি হয়েছে। তবু গুমোট ভাব গেল না। যাবে কি করে? তেতে ওঠা মাটির খিদে কি ছিটে ফোঁটায় মেটে! শুকনো গলায় জল ঢেলে দাঁড়ালাম বারান্দায়। আকাশে তারা নেই। বাতাস ছুটি নিয়েছে। গাছের পাতাগুলো ঝরবে না কাঁদবে বুঝতে না পেরে থম মেরে ঝুলে আছে। নেড়িগুলো নর্দমার পাশে জিভ বের করে কেতরে ঘুমাচ্ছে। শুনশান রাস্তায় আলোগুলো জ্বলছে আর নিবছে। ল্যাম্প পোষ্টগুলোর বোধহয় দম বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। যেটুকু আলো আছে তাও বোধহয় একেবারেই নিবে যাবে।
আধো অন্ধকারের মধ্যে রাস্তার উল্টো দিকের ফুটপাতে একটা মানুষের অবয়ব ফুটে উঠল। চোখ ছোট করে ভাল করে দেখলাম। হ্যাঁ একটা বুড়ো মত লোক দাঁড়িয়ে। একটু ঝুঁকে থাকা রোগা চেহারা। এক মুখ দাড়ি। উসকোখুসকো চুল। পরণে মলিন ঢোলা পাজামা। সাথে রঙ চটা পাঞ্জাবি। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। আঁতেল টাইপের হলেও ঠিক আঁতেল নয়। একটু যেন খ্যাপা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে থু থু ছেটাচ্ছে। চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না। ল্যাম্প পোষ্টের আলোটা হঠাৎ কয়েক সেকেন্ড বেশি জ্বলল। মুখটা স্পষ্ট হল। আরে! এত রাতে এই লোকটা কোথা থেকে এল?
ও পুরন্দর চাচা। এত রাতে রাস্তায় কেন?
তাই তো কথা ছিল রে। ভাট বকি যে, তাই পুরের অন্দরে থাকা কপালে নেই। শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোই যে আমার কাজ।
তা বলে এত রাতে?
রাতেই তো মজা রে। মৃত্যু উপত্যকার শরীরের ঘাগুলো দগদগে হয়ে ফুটে ওঠে। আর আমি তাতে থুথু ছেটাই। আজ অবশ্য অন্য কারণ।
কি কারণ?
আজ আমার জন্মদিন ছিল।
তাতে তোমার কি? তোমার জন্মদিন নিয়ে কে মাথা ঘামায়!
আমিও তো তাই ভাবতুম। কিছু কচি বিপ্লবী দেখতাম ফোনের মাধ্যমে থোবনাবইয়ে আমার জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাত। কিন্তু এখন দেখলাম লাতখোর অনেক আছে।
লাতখোর?
শুধু কি লাতখোর? ওরা বিশ্ব আবালের দল।
আবালের দল?
তা নাতো কি। আচ্ছা এই টালমাটাল সময়ে সবাই যখন নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত তখন কেউ অন্যের কথা ভাবে! ওদের নিজেদেরই ভাল করে খাবার জোটে না, অথচ বিশ্বের হা-ভাতেদের চিন্তায় ঘুম নেই।
অন্যের জন্য চিন্তা করা তো ভাল কাজ।
অ্যাই, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্ঞান মারাবি না বলে দিলুম। রাস্তায় নামার মুরোদ নেই বড় বড় বাতেলা আছে। দেখলেই ঝাঁট জ্বলে যায়। যা বলছি শোন। তা সেই ছোকরার দল টেনে নিয়ে গেল ওদের আড্ডায়। ফুল-মিষ্টি দিয়ে বলে আমার কথা শুনবে। আমি আর কি শোনাব! বললাম ফাঁকটা এত বড় হচ্ছে যে একটা কথাই শুধু বলতে ইচ্ছে করে –
“গাঁড় মারি তোর মোটরগাড়ির,
গাঁড় মারি তোর শপিং মলের,
বুঝবি যখন আসবে তেড়ে
ন্যাংটো মজুর সাবান কলের।”
এই রকম নোংরা কথা নাতির বয়সী ছেলেগুলোর সামনে বললে? ওরা তোমার সমন্ধে কি ভাববে বলো তো।
ওরা তোদের মত ঢ্যামনা না। যা ভাবার ঠিকই ভেবে নেয়। পাতলা দাড়িগোঁফওয়ালা একটা ছেলে হাত দুটো ধরে বলে উঠেছিল, দাদু আমরা কেন এভাবে বলতে পারি না?
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, তোরা আরও জোরে বলতে পারবি। ধাক্কাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্যই দিবি বলে আমার বিশ্বাস।
ওরা তো ছাড়তেই চাইছিল না। বলে, আমাদের সাথে নিয়ে চলো। সারা শহরে ফ্যাত-ফ্যাত সাঁই-সাঁই করে তোমার সাথে ঘুরব। অতি কষ্টে ওদের থামিয়েছি। এখন বাড়ি যা তোরা। নিজেদের আরও তৈরি কর। ঝাঁপানোর দিন সামনেই আসছে। এই সব বলে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে এখানে এসে দাঁড়ালাম। আর সাথে সাথেই হাফ প্যান্ট পরে, খালি গায়ে ভুঁড়ি নিয়ে তুই হাজির। তা এত রাতে তুই বারান্দায় কেন? বেশি খেয়ে গরমে ঘুম আসছে না নাকি স্বপ্নদোষে ঘুম ভেঙে গেছে?
কি যে বলো চাচা।
ঠিকই বলি।
একটা কথা বলো চাচা। যে কথাগুলো তুমি ছেলেগুলোকে বললে তা কি সত্যিই হওয়া সম্ভব। হলে এখনই হয়ে যেত। কারণ দেয়ালে পিঠ ঠেকতে তো আর বাকি কিছু নেই।
এখনও হচ্ছে না তবে যেকোনও সময় হবে। তোরা পাপ স্খলনের তাগিদে দানা ছিটিয়ে আর কত দিন ঠেকিয়ে রাখবি?
ঠেকনা দিয়ে যদি ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করা যায় …
উদগান্ডুর মত কথা বলিস না। যদি ঘুরে দাঁড়াতে …! ও সব ভুলে যা। সারা জীবন ঝুঁকিয়েই রাখবে। দাঁড়াতে দেবে না। দাঁড়াতে দিলে যে অনেকের অনেক কিছু দাঁড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে। হামাগুড়ি দিয়েই চলতে হবে যতদিন না … থেমে যায় চাচা।
যতদিন না.. কি? বলো চাচা, বলো।
পুরন্দর চাচার চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল। চাপা গলায় কেটে কেটে বলল, যতদিন না গুঁড়িয়ে দেওয়ার শক্তি জোগাড় হচ্ছে ততদিন অপেক্ষা করতেই হবে।
শক্তি কি জড়ো হচ্ছে?
বালটা প্রশ্ন করছে দেখো। যেন টিভির টক শো চলছে। রাস্তায় নাম সব দেখাচ্ছি।
বারান্দা থেকে রাস্তায় নামব কি করে? চোট লাগবে তো।
কিছু তো জমিয়েছিস তাই ভয় তো লাগবেই। চোখ বুজে লাফ মার। পায়ের তলায় অনেক মেদ জমেছে। কিচ্ছু হবে না।
বলছ?
তাড়াতাড়ি নাম। না হলে আমি রেলিং বেয়ে উঠে পেছনে একটা লাথ মারব।
চাচা খচে গেলে সত্যিই লাথি মেরে দেবে। তার থেকে লাফিয়ে পড়াই ভাল। যা হবে দেখা যাবে।
মারলাম লাফ। চাচা ধরে নিল। নিকোটিনের প্রলেপ লাগা দাঁতে হেসে বলে, এই তো! পথে এসো বাছা।
কি দেখাবে বললে?
দাঁড়া। একটু কষ্ট কর। কিছুটা পথ হাঁট।
এই অন্ধকারে হাঁটব?
আলো ঝলমলে পথে হাঁটা খুব সহজ। অন্ধকারেই তো হাঁটবি। হোচট খাবি। রক্তাক্ত হবি। তবে না খেলা জমবে। বেশি দূর নয়। গলি ছেড়ে বড় রাস্তা অবধি যাব।
খ্যাপা বুড়োর সাথে হাঁটা কি সহজ কাজ! বুড়ো তো তরতর করে এগিয়ে যায়। আমি গতি বাড়িয়েও ধরতে পারিনা। ঘেমে নেয়ে পৌঁছলাম বড় রাস্তায়। এখানে আলো আছে। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখের উপর হাত রাখল চাচা। হাতটা ধরে বলল, চল। এবার চোখ বন্ধ করে হাঁট।
না দেখে পথ চলব কি করে?
আমি হাত ধরে আছি তো। দেখতে দিলেই তোর চোখে পড়বে বড় রাস্তার মায়াবী আলো। গাড়ির ছুটে চলা। যখন দেখার ঠিকই দেখতে পাবি।
কিছুটা রাস্তা চলার পর চাচা থামল। চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, এবার চোখ খোল।
সামনে কি যে হচ্ছে বোধের বাইরে। কঙ্কালসার চেহারার একদল উলঙ্গ লোকজন হাত পা ছুঁড়ছে। চুল, দাঁড়ি, লোম সব একাকার। অদভুত তাদের চিৎকার। চাচা কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কি দেখছিস বল।
কি যে বলব বুঝতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম।
কি হল? বল কি দেখছিস?
না মানে … বস্ত্রবিহীন.. উত্তেজিত.. ক্ষুধার্ত … জনতা …
কষিয়ে পেছনে একটা লাথি মেরে চাচা বলল, শালা চুতিয়া। এদের দেখেও কবিতা আউড়াচ্ছিস। ভারী গলায় কাব্য মারানোর জন্য গার্ল ফ্রেন্ডের ড্রইং রুম আছে। গলায় মডিউলেশান আনার জন্য স্কচ, চাট সব থাকবে। এখন আমার ভাষায় কথা বল। নাহলে প্যান্টটা এক টানে খুলে ফেলব। ল্যংটো পোঁদে ফুল, চাঁদ, তারা নিয়ে কবিতা লিখিস।
তোমার ভাষা ….
হ্যাঁ। ওদের ভাষাই আমার ভাষা। বস্ত্রহীন, ল্যাংটো। বুঝলি …
না বুঝেই ঘাড় নাড়ালাম। প্যান্ট খুলে নেবার ভয়ে মিনমিন করে বলতে থাকলাম – মাঝ রাতে …
আ বে সুশীলকুমার। অনেক সংস্কৃতি মারিয়েছিস। এটা নন্দন চত্বর নয়। এটা রাস্তা। এখানে বেঁচে থাকার লড়াই হয়। যা বলার চিৎকার করে বলতে হয়।
ঠিক। চিৎকার করে বলতে হয়। যেভাবে পুরন্দর বলে –
মাঝ রাতে ল্যাংটো পোঁদে
ফ্যাতাড়ুদের চিৎকার-
টানছে যারা পেছন দিকে,
মারব তাদের গাঁড়।
পিঠের উপর একটা চাপড় মেরে চাচা বলে উঠল। জিও বেটা! এই তো কিছুটা মানুষ হয়েছিস। আরও অনেক পথ চলতে হবে। তবে না চর্বি গলবে।
কিছু বলতে যাওয়ার আগেই দেখি চাচা নেই। কোথায় যে মিলিয়ে গেল। যা বাব্বা। আমায় পথে নামিয়ে পুরন্দর চাচা হাওয়া হয়ে গেল! আমি এখন ফিরব কি করে!
লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।
অনবদ্য
অসম্ভব ভাল লেখা!
অন্যরকম লাগলো, খুব সুন্দর ❤️
লেখককে কুর্ণিশ