লেখক : অভীক সিংহ
আজ সকাল থেকে আকাশটা একটু মেঘলা, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, রোদটাও তেমন ওঠেনি। এই রকম পরিবেশে কি আর কেবিনে মন বসে? টুক করে চেয়ার থেকে উঠে কেবিনের দরজাটা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা লাউঞ্জের বাইরে সোফাতে গিয়ে বসলাম। আহা, তোফা ওয়েদার। এই রকম মেঘলা দিনে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে জিবে একটু চা না ঠেকালে মৌতাতটা ঠিক জমে নাকি? তাই আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বেয়ারাকে এককাপ চা দিতে বলে সবে সিগারেটটা ধরাতে যাব, সান্যালদা এসে হাজির। “কি হে অভীক, একা একাই?”
“তুমি কী করে জানলে আমি এদিকে এসেছি বলে?”
“আরে দেখলাম তো,” সান্যালদা আরাম করে সোফায় বসে বলল, “তুমি কেবিন থেকে বেরোলে, এদিক-ওদিক দেখলে, তারপরে গুটিগুটি করে সিঁড়ির দিকে এগোলে। তখনই ধরেছি, নির্ঘাত এদিকেই আসার প্ল্যান করছ।”
“হে হে, তা ঠিক বলেছ।” আমি সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, “তাহলে একটা চা বলে দিই, কি বল?”
“নিঃসন্দেহে বৎস।”
আমি বেয়ারাকে ডেকে আরেকটা চা দিতে বলে হাতে ধরে রাখা সিগারেটটা ধরালাম। “ওয়েদারটা আজ কিন্তু দারুণ সান্যালদা,” আমি আলগোছে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম।
“এই ঠাণ্ডা হাওয়াটা দেওয়াতে শরীরটা একটু জুড়োল। রাতের দিকে মনে হচ্ছে নামাতে পারে।”
“সে নামাক, কোন অসুবিধে নেই। কাল তো শনিবার, কলেজে আসার চাপ নেই।” বলতে বলতে আমি দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আজ আকাশের চেহারাটা কিন্তু একদম সিনেমার ব্যাকগ্রাউণ্ডের মত লাগছে। একেবারে অন্যরকম, বেশ রোম্যাণ্টিক।”
“আরে সিনেমা বলতে গিয়ে মনে পড়ল,” সান্যালদা সোফাতে সোজা হয়ে উঠে বসে বলল, “কাল রাতে গুরু দত্তের ‘পেয়াসা’ দেখলাম। কি পরিচালনা, কি অভিনয়। মাইরি প্রতিবারই মনে হয় এই প্রথম বার দেখছি।”
“সত্যিই গুরু, ওটা ওনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিনেমা তো বটেই, বলিউডের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সিনেমা বললেও অত্যুক্তি হবে না।”
“শাহির লুধিয়ানভির কথা, শচীন কর্তার সুর, আর হেমন্ত-রফি-গীতা দত্তের গান – আহা। শুনলেই মনে হয় একটা অন্য জগতে পৌঁছে গিয়েছি।”
“জানে উয়োহ ক্যায়সে, লোগ থে জিনকে…” আমি নিজের মনে গুনগুন করতে করতে বললাম, “অবিস্মরণীয়।” বলতে বলতে বেয়ারা এসে চায়ের কাপ রেখে দিয়ে গেল।
“তবে একটা কথা মানতেই হবে অভীক,” সান্যালদা চায়ের কাপটা তুলে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে বলল, “অত গুরুগম্ভীর একটা সিনেমার মধ্যেও পর্দায় যে মুহূর্তে জনি ওয়াকার আসলেন, পুরো সিনেমার মেজাজটাই যেন নিমেষের মধ্যে পাল্টে গেল। ‘সর জো তেরা চকরায়ে’ – ওই গানটা তো আমার মনে হয় পুরো সিনেমাটার মধ্যে একমাত্র খুশির মুহূর্ত। যত ছোট দৃশ্যই হোক না কেন, উনি পর্দায় থাকা মানেই একটা যথার্থ কমিক রিলিফ, একটা নির্মল ঠাণ্ডা হাওয়া।”
“অভিনেতার জাত চেনার জন্য ওই একটা দৃশ্যই যথেষ্ট সান্যালদা,” আমি সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে অ্যাশট্রেতে ফিল্টারটা গুঁজে চায়ের কাপটা তুললাম।
“এনারা আগুন, বুঝলে অভীক,” বলে সান্যালদা চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিল।
“তা ঠিকই বলেছ,” আমি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “তবে যে কোন রোলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মত পাবলিককে চোখের সামনে যা দেখেছি, জনি ওয়াকার দেখলে তিনিও হয়ত ধন্য ধন্য করতেন।”
“মানে?” সান্যালদা চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল। “কি বলছ? কোথায়?”
“আছে, আছে, সান্যালদা।” আমি চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বললাম, “একবার একটা সিনেমার সেটে ডাইরেক্টরের সাথে আলাপ করতে গিয়ে দেখেছিলাম।”
“ডাইরেক্টরের সাথে আলাপ করতে গিয়েছিলে? তুমি?” সান্যালদা এবারে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বিস্ময়ের সাথে বলল।
“হ্যাঁ, একটা সিনেমার বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম।” আমি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলাম।
“বলো কি হে,” সান্যালদা প্রায় হাঁ করে রইল। তারপরে একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, “আর সেখানেই তোমার এই পাবলিকের সাথে আলাপ?”
“হুঁ হুঁ বাওয়া, সে যা জিনিস ছিল না সান্যালদা, না দেখলে বিশ্বাস করবে না।”
“মানে উনি খুবই উঁচুদরের অভিনেতা ছিলেন নাকি?”
“উঁহু। অভিনেতারা তো সামান্য পুরুষ, উনি ছিলেন সাক্ষাৎ পুরুষোত্তম। মানে আম আদমির সাথে হিমসাগর আমের যা পার্থক্য আর কী।” বলে আমি শেষ চুমুকটা দিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলাম।
“মাইরি, এ তো আজব কেস। তবে তোমার কথা তো, আমার ঠিক বিশ্বাস নেই। তোমার গল্পে তো আবার সত্যিমিথ্যে নুন-মশলা মেখে তন্দুরের মধ্যে বাদুড়ঝোলা হয়ে গায়ে ফোস্কা নিয়ে বেমালুম রোস্ট সেজে বেরিয়ে আসে। তাই বলছি, একটু ভাল করে ঝেড়ে কাশো তো দেখি।” বলে সান্যালদা চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে সোফাতে একটু এলিয়ে বসল।
আমি সান্যালদার অপবাদটা গায়ে না মেখেই বললাম, “বলছি গুরু, বলছি। তার আগে স্যাট করে একটু মুডটা সেট করে নিই।” বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা সুখটান দিয়ে গল্প শুরু করলাম।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন এমবিএ শেষ করে মুম্বাইতে চাকরি করছি। অফিসে দশটা-সাতটার দিনগত পাপক্ষয় সেরে বাড়ি ফিরেই বসে পড়তাম আঁকার খাতা, গান-বাজনা, লেখালিখি নিয়ে। সেই সময় আমি আর আমার বন্ধু পিণ্টু – দু’জনে মিলে নিয়মিত গান লিখতাম, তাতে সুর দিতাম, আর সাথে গাইতাম। তখন আবার আমরা দু’জনেই সদ্য সদ্য গিটার শিখে বেরিয়েছি। সালটা ২০০৮, “রক অন” সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছে, আর তারই সাথে আমাদের অনুপ্রেরণার বাঁধনছাড়া গরুটাও। প্রায় রোজই অফিস থেকে এসে গান লেখা আর রেওয়াজ করা চলত। কয়েক মাসের মধ্যে মনের মত বেশ কয়েকটা গান তৈরী হওয়ার পরে আমরা দু’জনে ভাবতে লাগলাম, এই গানগুলো স্টেজে গাইবার সুযোগ পেলে বেশ হ’ত। কথায় বলে, মুম্বাই স্বপ্নের শহর। কিন্তু তা বলে সুযোগ তো আর রাস্তার মোড়ে ঠেলাগাড়ির শুকনো চাটনি আর নুনমাখা কাঁচা লঙ্কা দেওয়া বড়াপাও নয়, যেটা চাইলেই পাঁচটাকায় একপিস করে পাওয়া যাবে। তাই আমরা দু’জনেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন জায়গায় সুযোগসন্ধানের জন্য চেষ্টা চরিত্র করতে শুরু করলাম। কিন্তু স্বপ্নের কুমড়োপটাশ যে আমাদের গান শোনার জন্য এত জলদি নেচে উঠবে, সেটা আমরা কেউই ভাবিনি।
এক শনিবার সন্ধ্যেবেলায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখি লোডশেডিং। খোঁজ নিয়ে জানলাম, হাউসিংয়ের একটা ট্রান্সফর্মার উড়ে গিয়েছে, কতক্ষণে ঠিক হবে বলা মুশকিল। অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে “দুত্তোর” বলে আমরা দুই বন্ধু আমাদের গিটারদু’টো নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সামনে রাখা বেঞ্চে বসেই আমাদের গানগুলো গুনগুন করা শুরু করলাম। সবে মিনিট পনের মত হয়েছে, আলো-আঁধারিতে আচমকাই খেয়াল করলাম, আমাদের বেঞ্চের পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আমাদের গান শুনছে। আমরা তাকে দেখে গান থামাতেই সে বলল, “থামলে কেন? বেশ তো লাগছিল তোমাদের গানগুলো।”
আমাদের মুখ দিয়ে প্রায় একসাথেই বেরল, “আপনি বাঙালী?”
ভদ্রলোক হেসে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। আমি প্রদ্যোৎ নস্কর, এখানকার বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেণ্ট। তা তোমাদের তো আগে কখনও দেখিনি এই হাউসিং চত্বরে।”
আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললাম, “এই কয়েক মাস হ’ল চাকরিসূত্রে এখানে এসেছি।”
“আর গান-বাজনাটা কি শখে করা?”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “হ্যাঁ, কতকটা শখই বলতে পারেন।”
“বাহ বাহ, বেশ বেশ। তা এই গানগুলো কি তোমাদেরই তৈরী নাকি?”
পিণ্টু বলল, “একদম ঠিকই ধরেছেন, এগুলো আমাদেরই গান। কথা আর সুর আমাদেরই দেওয়া।”
“বাহ, চমৎকার।” বলে ভদ্রলোক তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রটি ছুঁড়ে দিলেন আমাদের দিকে, “আমাদের অনুষ্ঠানে গাইবে নাকি?”
“আপনাদের অনুষ্ঠানে?” বলে আমরা দু’জন কিছুক্ষণ হাঁ করে রইলাম। মাইরি, এ তো এক্কেবারে মেঘ না চাইতেই পানি, সোনা না বলতেই খনি, পানু না ভাবতেই জ– আচ্ছা বাদ দাও। আমরা আরও কিছু বলবার আগেই ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ। আমাদের বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন এখানে সারা বছর অনেক অনুষ্ঠান করে, মিউজিক আর ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রী থেকেও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসেন। আমি চাই তোমরা আমাদের সদস্য হও আর আমাদের এই অনুষ্ঠানগুলোতে পারফর্ম করো। আমি নাদব্রহ্ম সঙ্গীত অ্যাকাডেমির হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান শিক্ষক। তাই গান সম্পর্কে একটু-আধটু জ্ঞান আছে বলতে পারো।” বলে ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন।
আমরা স্পিকটি-নট্। আসলে একসাথে এতগুলো জিনিস শুনে আমাদের মগজের তখন মুড়িঘণ্ট দশা। আমি আর পিণ্টু হাঁ করে কতকটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ভদ্রলোকের দিকে। বহু কষ্টে পিণ্টুর মুখ দিয়ে বেরলো, “মিউজিক আর ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রী থেকে…”
ভদ্রলোক আমাদের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করে মৃদু হেসে বললেন, “নইলে আর বলছি কী। আচ্ছা, এক কাজ করো। কাল তো রবিবার, তোমাদেরও অফিস ছুটি, আর আমারও ক্লাস নেই। কাল সকাল দশটা নাগাদ আমার বাড়ি চলে এস। এই যে সামনের বাড়িটা দেখছ, আমি এটার দোতলায় ছয় নম্বরে থাকি। সকালের জলখাবারটা আমার বাড়িতেই করে নিও। খেতে খেতে আড্ডাও হবে, আর তার সাথে একটু আলোচনাও করে নেওয়া যাবে।”
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সব কথা শুনে যন্ত্রচালিতের মত মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ইতিমধ্যে কারেণ্ট চলে আসায় ভদ্রলোক আমাদের বিদায় জানিয়ে একটু হেসে নিজের বাড়ির দিকে এগোলেন। আমরা ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে কিছুক্ষণ ওখানেই বসে রইলাম। একটু পরে দ্রিঘাংচু দশা কাটিয়ে ধাতস্থ হয়ে পুরো ব্যাপারটা যখন উপলব্ধি করলাম, তখন আমাদের আর পায় কে। দু’জনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে বত্রিশ পাটি দন্তবিকাশ করে “জিও কাকা, ফাটাফাটি” বলে একটা চিৎকার ছেড়ে রীতিমত নাচতে নাচতে দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে। সেই থেকে শুরু।
তারপরে দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় দেড় বছর। আমাদের গান প্রথম অনুষ্ঠানে হিট হওয়ার পর থেকেই বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনের সবক’টা অনুষ্ঠানেই তখন আমাদের জায়গাটা একরকম বাঁধা। বেশ চলছিল। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজোও চলে আসল। অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলায় গীটার হাতে গানটান শেষ করে আমরা স্টেজ থেকে নেমে আসছি, দেখি প্রদ্যোৎদা স্টেজের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। “পিণ্টু আর অভীক, এদিকে এস তো একটু।”
আমরা নেমে এসে ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম, “বলুন প্রদ্যোৎদা।”
“একটু আমার সাথে এস, একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কী সারপ্রাইজ?” আমরাও কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম।
“সেটা বলে দিলে তো সারপ্রাইজের মজাটাই নষ্ট। এস দেখি আমার সাথে।” বলে প্রদ্যোৎদা একটা রহস্যময় হাসি হেসে আমাদের একরকম টানতে টানতেই দর্শকাসনের সামনের সারির একজনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “বিকাশদা, এই সেই পিণ্টু আর অভীক, যাদের কথা তোমায় বলেছিলাম।” তারপরে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “তোমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি শ্রী বিকাশ দত্ত, স্বনামধন্য ডকুমেণ্টরি ফিল্মমেকার। উনি তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে চান।”
আমরা কতকটা অবাক হয়েই ওনার সাথে করমর্দন করে বললাম, “নমস্কার স্যার।”
“আরে স্যার বলতে হবে না, আমাকে সবাই বিকাশদা বলেই ডাকে, তোমরাও তাই বল। আর তোমাদের গান আমার বেশ ভাল লাগল, সুরের উপর ভাল দখল আছে। তোমাদের জন্য একটা অফার আছে। অবশ্য যদি তোমরা রাজি থাক, তবেই।”
“কী অফার বিকাশদা?” পিণ্টু অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করল।
“আমার এক বন্ধু, অরবিন্দ বোস, চিত্রপরিচালক। ও নিজের পরবর্তী শর্টফিল্মের জন্য নতুন সঙ্গীত পরিচালক খুঁজছে। আর খুঁজে বের করার দায়িত্বটা দিয়েছে আমাকে। প্রদ্যোতের সাথে এই প্রসঙ্গে কথা হ’তে হ’তে ও তোমাদের নামটা বলল। আর আজ চক্ষুকর্ণের বিবাদও ভঞ্জন হয়ে গেল। তা বল, তোমরা রাজি তো? তাহলেই কিন্তু কথাটা ফাইনাল করব।”
সঙ্গীত পরিচালনা? রূপোলি পর্দায় আমাদের নাম? আমাদের হাঁটুতে প্রায় খঞ্জনি শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পেটের মধ্যে প্রজাপতি পাগলু ড্যান্স করছে। উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল, “আ-আমরা? শ-শ-শর্টফিল্মের সঙ্গীত পরিচালক? আ-আপ-আপনি স-স-সত্যি বলছেন?” আমার জিবটা গেল বেমালুম জড়িয়ে।
বিকাশদা হো-হো করে হেসে আমাদের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “পরের রবিবার তোমাদের কাছে অরবিন্দর কাস্টিং ডিরেক্টর মণীশ পাণ্ডে আসবে। বিহারী ছেলে,অল্পস্বল্প বাংলাও জানে। ও এসে তোমাদের নিয়ে যাবে অরবিন্দর কাছে। ঠিক আছে তো?”
আমাদের বুদ্ধিসুদ্ধি ততক্ষণে বাই-বাই করে চলে গিয়েছে, বাঁই-বাঁই করেও হতে পারে। মুখ দিয়ে কিছুই বেরল না। উনি একবার হেসে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন, “আজ একটু তাড়া আছে। আমি প্রদ্যোতের কাছ থেকে তোমাদের ফোন নম্বর নিয়ে নেব। আর তোমরা কিন্তু রবিবার সময়মত পৌঁছে যেও।” বলে প্রদ্যোৎদার দিকে ফিরে বললেন, “আজ আসি রে। আবার দেখা হবে।” বলে উনি আমাদের বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা তখনও শক-স্তব্ধ।
দেখতে দেখতে রবিবার এসে গেল। সকালবেলাতেই মণীশের ফোন এসেছিল, ও এগারোটা নাগাদ আসবে বলেছে। আমরা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নানটান করে তৈরী হয়েই ছিলাম, মণীশ আসতেই বেরিয়ে পড়লাম। ওর গাড়িতে করে চললাম আন্ধেরীর দিকে, শুটিংয়ের লোকেশনে। বেশ মিশুকে গল্পবাজ ছেলে। যদিও বাংলাটা একটু ভাঙা, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। রাস্তায় যেতে যেতে ও নিজের কথা, নিজের গ্রামের কথা, ওর শুটিং-সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প শোনাচ্ছিল, আমরাও মজার সাথে শুনছি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে আমরা এসে পৌঁছলাম নির্ধারিত স্থানে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা এগোলাম মণীশের সাথে। শুটিং স্পট! ক্যামেরা, লাইট, চেয়ার, সাউণ্ড সিস্টেম, ফিল্ম ক্রু – আরও কত কি। আমরা দু’জনে ড্যাবড্যাব করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি। হঠাৎ মণীশ আমাদের আঙুল তুলে দেখাল একদিকে – পরিচালক অরবিন্দবাবু একটা চেয়ারে বসে শট নিচ্ছেন। ভয়ানক মেজাজী মানুষ, এই সময় ওনাকে বিরক্ত করা মানা, তাই মণীশ আমাদের একটু দূরেই দাঁড়াতে বলে অন্যদিকে গেল। আমরাও বাক্যব্যয় না করে সেখানে দাঁড়িয়েই শুটিং দেখতে লাগলাম। শট শেষ হতে উনি হাত তুলে আমাদের ডাকলেন। দুরুদুরু বুকে আমরা ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি একজন স্পটবয়কে ডেকে আমাদের জন্য দু’টো চেয়ার আনিয়ে বসতে বললেন। চেয়ার বসে আমরা কথা বলতে শুরু করলাম। বেশ রাশভারি ভদ্রলোক। অল্পবিস্তর আমাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে উনি শুরু করলেন ফিল্মের গল্পটা বোঝাতে, কোন সিকোয়েন্সে কেমন ধরণের আবহসঙ্গীত দরকার, সুরের মাত্রা কেমন হবে, ইত্যাদি। এমন সময় কাছেই একটা গোলযোগ শুনে আমাদের তিনজনের দৃষ্টি সেই দিকেই গেল। যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে এক-দেড় গজ দূরে মণীশ একজনের একটা ছেলের উপরে চেঁচাচ্ছে, আর অন্যজন চুপ করে শুনছে। বেশ বিরক্ত হয়েই অরবিন্দবাবু একটু উঁচু গলায় ডাকলেন, “অ্যাই মণীশ, হচ্ছেটা কী?” আমরা প্রমাদ গণলাম।
যার সাথে ঝামেলা হচ্ছিল, তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মণীশ এক ছুটে অরবিন্দবাবুর কাছে এসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, “আর বলেন না স্যার, দিমাগ খরাব করে দিল।”
“কেন কী হয়েছে?”
“কী বলি স্যার,” বলে অন্য ছেলেটির দিকে নির্দেশ করে বলল, “ইকে যাই রোল বলি, তাতেই আগ লাগিয়ে দেয়। মানে স্যার –”
অরবিন্দবাবু সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন, “বলিস কী! নিয়ে আয় এদিকে।”
মণীশ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “অ্যাঁ, উকে ডাকব স্যার?”
“হ্যাঁ, ওকেই ডাকো।”
মণীশ ছেলেটিকে ডেকে আনতে তিনি সোজা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে? তুই নাকি সব রোলেই আগুন লাগিয়ে দিস?”
ছেলেটি মাথা নিচু করে একটু অপরাধীর সুরে বলল, “আজ্ঞে, কেউ তো ঠিকমত শেখায়নি। নিজে নিজে শিখে করতে গিয়েই একটু গণ্ডগোল হয়ে যায়।”
মণীশ ছেলেটাকে বাধা দিয়ে বলতে গেল, “আসল মে স্যার, ম্যাটারটা হয়েছে কী –”
“তুমি থামো তো।” মণীশকে চুপ করিয়ে অরবিন্দবাবু ছেলেটার দিকে ফিরে বললেন, “তো একটা রোল করে দেখা তো দেখি।”
মণীশ আমতা আমতা করে বলতে গেল, “আপনি ম্যাটারটা গলতি করছেন স্যার, আসলে –”
“বললাম না চুপ করতে,” মণীশকে ধমক দিয়ে অরবিন্দবাবু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী রে? দেখা?”
“এক্ষুনি আসছি স্যার।” বলেই ছেলেটা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। অরবিন্দবাবু কিছু না বলে পাশে রাখা স্ক্রিপ্টের খাতাটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন। মণীশ পাশে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে, আমরা বসে। কিন্তু কেন জানি না, মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘোরতর কেলো হতে চলেছে। আর যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই অমাবস্যা রাতে লোডশেডিং হয়।
মিনিট পাঁচের মধ্যেই ছেলেটা এসে হাজির, হাতে একটা প্যাকেট। সে সেটা অরবিন্দবাবুর দিকে এগিয়ে দিতে উনি একটু অন্যমনস্ক হয়েই প্যাকেটটা নিয়ে খুললেন। প্যাকেটের ভিতর থেকে যে বস্তুটি বেরলো, সেটা দেখে মণীশের চক্ষু ছানাবড়া, আমাদের পেটের মধ্যে পিলে একবার ডিগবাজি খেল। আমরা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে অরবিন্দবাবুর দিকে। আনমনে স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তেই তিনি সেই বস্তুটায় দিলেন এক পেল্লায় কামড়। তারপরেই–
“থু থু থু। ইয়্যাহ চ্ছি, ওয়াক থু।” মুখ থেকে আধচেবানো বস্তুটিকে ফেলে সেটার দিকে তাকিয়ে অরবিন্দবাবু অগ্নিশর্মা হয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, “কী ছিল এটা?”
ছেলেটা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মণীশ বলতে গিয়েছিল, “হামি তো আপনাকে সাওধান –”
“চোপ।” রীতিমত চিৎকার করে উঠলেন অরবিন্দবাবু, “বেরো, বেরো সবক’টা এখান থেকে।”
আর আমরা? গীটারের ব্যাগ বগলদাবা করে তৎক্ষণাৎ শুণ্ডি এক্সপ্রেসের স্পিডে হাওয়া। পিছন থেকে অরবিন্দবাবুর হুঙ্কার তখনও ভেসে আসছে। আর ওখানে থাকে? সোজা ট্যাক্সি ধরে স্টেশন, সেখান থেকে লোকাল ধরে সোজা বাড়ি। জীবনে আর কোনদিন ওই স্পটের ত্রিসীমানায় যাইনি।
এই অবধি বলে থামলাম। প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজছি, সান্যালদা হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, “মাইরি, কী অবস্থা। রোলে এভাবেও আগুন লাগানো যায়। কিন্তু ভদ্রলোক কেসটা ধরতে পারেন নি?”
আমি সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বললাম, “আসলে মণীশ তো বাংলাটা ভাল করে বলতে পারত না, তাই ও ‘পুড়িয়ে দিয়েছে’ না বলে ‘আগ লাগিয়ে দিয়েছে’ বলেছিল। সেখান থেকেই ঝামেলা।”
“ওহ হো। তার মানে অরবিন্দবাবু সেদিন –”
সান্যালদা কথা শেষ হওয়ার আগেই বেয়ারা এসে আমাদের চায়ের কাপগুলো নিতে নিতে বলল, “স্যার, আজ সকালের ব্রেকফাস্টে এগরোল আছে। আপনাদের দেব?”
আমি আর সান্যালদা দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। দু’জনেই স্পিকটি নট।
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
খুব ভালো লিখছিস বন্ধু, চালিয়ে যাও… তোর শেষের লাইন গুলো মনটা ছুঁয়ে গেলো, বিশেষ করে দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখা শুরু…
আরে কাকা, অনেক ধন্যবাদ রে 😊😊😊