রূপকার

লেখক : রুমা ভট্টাচার্য

পারুল দু’বার এসে ডেকে গেছে। ভুবনের কোনো সাড়া নেই। একমনে কাজ করে যাচ্ছে। বেলা বাড়ছে। তৃতীয়বার পারুল এসে গলায় জোর এনে বলল,
“বলি, চান-খাওয়া কি করতে হবে না? কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি। এবার মাটি ছেড়ে ওঠ?”
ভুবন তাকাল পারুলের দিকে। হেসে বলল, “মাটি ছাড়ার কথা বলিসনি পারু। এই মাটিকে ছাড়লে আমি মাতৃহারা হব। আমার বাপ বলত – মাটি হল আমাদের মা। বুঝলি?”
“খুব বুঝেছি। এবার ওঠো দিকিন। কত্ত বেলা করবে আর বল তো?”
“এই তো হাতের কাজটুকুন সেরেই উঠছি।”
উঠোনের একধার ঘেঁষে বেশ কিছুটা লম্বা জায়গার চারদিকে বাঁশ গেঁথে মাথার ওপর খড়ের ছাউনি, তার ওপর প্লাস্টিকের মোটা শিট দিয়ে তৈরি হয়েছে চালাঘর। তিনদিকে উঁচু করে দরমার বেড়া দেওয়া। এই হল ভুবনের কাজের জায়গা। উঠোনের বাকি খোলা অংশ জুড়ে সারাদিন অফুরন্ত রোদ থাকে। হাতে তৈরি মাটির জিনিস সবই এই রোদেই শুকিয়ে নেয় ভুবন।

কৃষ্ণনগরের ষষ্ঠীতলায় ভুবন পালকে লোকে এক ডাকে চেনে। মৃৎশিল্পী সে। মাটির পুতুল, রকমারি ফুলদানি, ছোটখাট দেব-দেবীর মূর্তি – সবই বানায় ভুবন। ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীদের তো বিশ্বজোড়া নাম। ঘূর্ণি থেকে ষষ্ঠীতলার মোড় অনেকটাই দূরে। তবু ষষ্ঠীতলার লোকেরা বলে, “আমাদের ভুবন ঘূর্ণির পোটোদের থেকেও দড় গো। এমন পুতুল বানায়, যেন জীয়ন্ত!”
ষষ্ঠীতলায় মৃৎশিল্পীর অভাব নেই। ঘরে ঘরে এই শিল্পই রোজগারের উপায়। কিন্তু ভুবনের হাতের কাজের সূক্ষ্মতার কাছে অন্য কারিগররা হার মেনে যায়। এবার ভুবনের কাজের দায়িত্ব আরও অনেকটা বেড়েছে। বর্ধমানের রায়চৌধুরী পরিবার থেকে সে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি তৈরির বরাত পেয়েছে। বর্ধমানের সতীশ রায়চৌধুরীরা জমিদারের বংশ। এখন জমিদারি না থাকলেও ঠাট-বাট রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। তাদের ঘরে কুলদেবতা আছেন গোপীনাথ জিউ, রাধারাণী। তবে এবার নাটমন্দিরে স্থাপনের জন্য চার ফুট উচ্চতার রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি তৈরির অর্ডার দিয়েছেন স্বয়ং সতীশ রায়চৌধুরী।

“বাহ্‌, চুনোমাছের ঝালটা বেড়ে রেঁধেছিস। আরেকটুন দে দেখি।” মাছের ঝাল দিয়ে এক গরাস ভাত মুখে দিয়ে ভুবন বলল।
ভুবন তার রান্নার প্রশংসা করলে পারুল খুব খুশি হয়। কী-ই বা আর করবে সে? সারাদিন ঘর সংসার আগলে, রান্নাবান্না করেই দিনগুলো কাটে তার। বিয়ের সাত বছর ঘুরে গেল। এখনও কোল ভরল না পারুলের। শিকড় তাবিজ কম করেছে সে? ঠাকুরের থানে কম হত্যে দিয়েছে? তবু ভগবান মুখ তুলে চাননি।
ভুবনের তো তবু কাজ আছে। মাটির পুতুল, প্রতিমা যা কিছুই সে বানায়, এমন আত্মস্থ হয়ে বানায়, যেন তার সৃষ্টিতে সে প্রাণ দিচ্ছে। তার হাতে জন্ম নেওয়া মূর্তিগুলোর সাথে সে কথা বলে, হাসে। আড়াল থেকে পারুল অনেক দিন এ দৃশ্য দেখেছে। আরও আশ্চর্য লাগে তার, পাইকার এসে যখন অর্ডারি মাল সব নিয়ে যায়, তখন ভুবন দু’চারদিন ভীষণ মনমরা হয়ে থাকে। যেন কেউ তার সন্তান-সন্ততিদের তার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এই বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতেই আবার নতুন সৃষ্টিতে দ্রুত নিজেকে জুড়ে ফেলে সে।
কিন্তু পারুল? তার যে কিছুই নেই! কী ভাবে কাটে তার দিনগুলি? পাড়াগাঁয়ে বন্ধ্যা নারীর বড় জ্বালা। কোন মঙ্গল অনুষ্ঠানে এয়োতিদের ক্রিয়াকর্মে সে অনাহুত। ঘর-গেরস্থালিতে পারিপাট্য আনতে আনতে সে হাঁফিয়ে ওঠে। প্রতি মাসে তার রজঃস্বলা হবার দিনটি শুরু হলে গভীর বিষণ্ণতা তাকে ছেয়ে ফেলে। সাজানো ঘর-দুয়ার এলোমেলো করে দিতে মন চায়। রান্না করতে ইচ্ছে করে না। ভুবনকে অসহ্য লাগে। ভুবনের তৈরি মাটির মূর্তিগুলিকে অসহ্য লাগে। মনে হয় টান মেরে আছড়ে ভাঙে ওই নিষ্প্রাণ স্থবির পুতুলগুলোকে।
তবু, সব সয়ে নিতে হয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে পারুল বলল,
“আরেকটু দিই মাছ?”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাতায় আরও একটু মাছের ঝাল ভুবনের পাতে তুলে দিল সে। খেতে খেতে ভুবন বলল,
“কাল থেকে রাধাকৃষ্ণের মূর্তিতে হাত দেব, বুঝলি পারু। মুশকিল হয়েছে, জলঙ্গীর পাড় এমন ভাঙছে, মাটি পাওয়াই হচ্ছে মুশকিল।”
“সনাতন দাদার বৌ বলছিল, দাদা নাকি ফুলডাঙা থেকে মাটি কিনেছে।”
“হ্যাঁ গেল হপ্তায়। ছোট এক ম্যাটাডোর মাটি, পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিয়ে কিনেছে ও।”
“ওগো, তুমি যেন ধার নিওনি! তোমার দরকার পড়লে আমার বিছেহারখানা বন্দক (বন্ধক) রেখে দাও। কী হবে আমার ও হার দিয়ে?”
বৌয়ের কথায় ভুবন হাসে,
“দূর পাগলি। তোর হার বন্দক দিয়ে মাটি কিনব, আমার সে অবস্থা নাকি? তুই চিন্তা করিস না। ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।”

শুরু হয়ে গেল ভুবনের রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি তৈরির কাজ। আপাতত ছোটখাট কাজ এখন সরিয়ে রেখেছে সে। সতীশ রায়চৌধুরী বাবুর শ্বশুর বাড়ি কৃষ্ণনগরে। এবার কৃষ্ণনগরের বৈশাখী মেলায় এসে সতীশ ভুবনের কাজ দেখলেন। ভুবন মেলায় অন্য অনেক পটুয়াদের মত তার নিজের তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে বসেছিল। সতীশের শ্যালক বিনয় সান্যাল ভুবনের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনিই সতীশকে ভুবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সতীশবাবুর অভিজ্ঞ চোখ ঠিক চিনে নিয়েছিল প্রকৃত শিল্পীকে।
ভুবনকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করেন?”
ভুবন একগাল হেসে বলেছিল, “বাবু, আমাকে আপনি বলবেন না। হ্যাঁ দেবদেবীর মূর্তি আমি বানাই। তবে সবই ছোট মাপের।”
“বাহ্‌ বেশ। আমাকে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি তৈরি করে দাও তাহলে। আমি বাড়ি ফিরে তোমাকে মাপটা জানিয়ে দেব।”
“আচ্ছা বেশ। কবে নাগাদ লাগবে বলুন?”
“জন্মাষ্টমীতে প্রতিষ্ঠা করব। তা, ধর এখনও মাস দুই-তিন হাতে পাবে।”
“একদম বাবু। জন্মাষ্টমীতেই আপনি মূর্তি পিতিষ্টে করতে পারবেন। আমাকে শুধু মাপটা একটু তাড়াতাড়ি জানিয়ে দেবেন।”

সতীশ বর্ধমান ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর শ্যালক বিনয়কে ফোনে বিগ্রহের মাপ জানিয়ে দিয়েছিলেন। মূর্তি চার ফুট মাপের, খুব বড় নয়। ভুবন বাঁশের কঞ্চি আর খড় দিয়ে প্রথমে কাঠামো তৈরি করে নিল। তার উপরে মাটির প্রলেপ। মাটি জোগাড় করতেই ভুবনের ঝামেলা হয়েছে প্রচুর। জলঙ্গী নদী তীরের মাটি খুব পরিষ্কার। পাথর, কাঁকর থাকে না। এই মাটির সঙ্গে বেলে মাটি মেশাতে হয়। এরপর আরও একটি জিনিস লাগে – উইয়ের ঢিবি! এই উইয়ের ঢিবির মাটি মেশালে মূর্তি খুব সুন্দর তৈরি হয়। নদীর পাড়ে আর কিছু না থাক, উইয়ের ঢিবি রাশি রাশি।
জলঙ্গী নদীতে ভাঙন এখন একটা বড় সমস্যা মৃৎশিল্পীদের কাছে। উর্বরা মাটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে নদীর গর্ভে। ভুবন তীর বরাবর হেঁটে অনেক দূর দূর থেকে সংগ্রহ করে এনেছে মাটি। তারপর শুরু করেছে খড়ের কাঠামোয় মাটির প্রলেপের কাজ। একটু একটু করে জন্ম নিচ্ছে এক অপূর্ব কারুশিল্প।

এদিকে পারুলের হয়েছে জ্বালা।
নাওয়া-খাওয়া এখন ভুবনের মাথায় উঠেছে। সকালে এক বাটি মুড়ি গুড় আর ঢকঢক করে জল খেয়ে সে নামে উঠোনে। মাটিতে হাত ছুঁইয়ে কপালে ঠেকায় আগে। তারপর কাজে হাত। সূর্য ঠাকুর মাথার ওপর ওঠেন যখন, পারুল তার আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ভুবনের চালার ভেতর এসে দাঁড়ায়। এত বেলা করার জন্য ঝঙ্কার দিয়ে তাড়া লাগাবে বলে আসে সে। কিন্তু সব ভুলে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভুবনের হাতে জন্ম নিচ্ছে অপূর্ব সুন্দর মুরলীধরের মূর্তি, সঙ্গে শ্রীরাধা। কাজ এখনও অনেক বাকি। তবু শ্রীকৃষ্ণের বঙ্কিম ঠামে দাঁড়ানোর ভঙ্গি, শ্রীরাধিকার অপরূপ দেহসৌষ্ঠব – সবটা দেখে পারুল মুগ্ধ হয়ে গেল। দো’মেটে লাগানোর পরে মূর্তির রূপ ফুটে উঠছে পরিপূর্ণ রূপে।
থেবড়ে বসে পড়ল পারুল মাটির মেঝেতে। বলল, “ও মা কী সোন্দর দেখতে লাগছে গো।”
ভুবন এতক্ষণ কাজে মগ্ন ছিল। খেয়াল করেনি পারুলকে। এবার ওর কথায় চমকে তাকাল। বলল, “পছন্দ হয়েছে তোর?”
“বাবা, পছন্দ হবেনি? এমন রাধাকেষ্টর পিতিমে ঘরের জন্য একখান গড়ে দাও না গো। আমি রোজ মালা পরাব, পুজু করব!”
“আচ্ছা আচ্ছা সে হবে ‘খন। আগে বাবুদেরটা শেষ করি দাঁড়া। সময় বেশি নেই।”
“মোটে তো জষ্টি পড়েছে। মেলা দেরি আছে এখনও। এবার জন্মাষ্টমী শ্রাবণের একদম শেষে পড়েছে।”
ভুবন আবার কাজে ডুবেছে, সঙ্গে গুনগুন করে গাইছে এক মেঠো সুর। এবার পারুল বলে, “এবার ওঠো দিকিন বাপু। বেলা শেষ হতে যায়!”

মাঝে একটা মাস গেছে। ভুবনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। রাধারাণীর নীল বসন, কৃষ্ণের পীত বসন, দু’জনের গায়ের গয়না, কৃষ্ণের বাঁশের বাঁশিটি, সব ভুবন কিনে এনেছে ষষ্ঠীতলার পাইকারি বাজার থেকে।
এর মধ্যেই পাড়ায় সবাই জেনে গেছে ভুবন বড় ঠাকুর গড়ছে। ছোট এলাকা। সবাই সবার খোঁজ রাখে। ছোট ছোট পুতুল, হাঁড়ি, কলসি বা ঘর সাজানোর মাটির জিনিসপত্র পাড়ার কুমোররা বানায় সকলেই। কিন্তু তারা সবাই জানে, ভুবন হল জাত শিল্পী। সে যা বানায়, তা-ই অসামান্য হয়। প্রায়দিনই প্রতিবেশী বন্ধুরা দেখতে আসে ভুবনের কাজ।

শ্রাবণ মাস পড়ল। মাটির কাজের বড় শত্রু হল বৃষ্টি। রঙের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে রোদ্দুরে শুকিয়ে নেওয়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ভুবনের রং লাগানো শেষ। আজ রোদ্দুরে শুকোতে দেবে। দুই মূর্তির মুখও ছাঁচে তৈরি করে নিয়েছে ভুবন। ছাঁচে প্রথমে পলিমাটির প্রলেপ দিয়ে, তার ওপর পাট ও তুষ মিশিয়ে একটি স্তর চাপিয়ে, সবশেষে দিয়েছে এঁটেল মাটি। শুকিয়ে এলে ছাঁচ থেকে মুখাবয়ব বের করে নিয়ে চালার ভিতরেই কাগজ পেতে রেখেছে।
উঠোনে সূর্যদেব এখন মধ্য গগনে। চড়া রোদে বাইরে তাকানো যায় না। চোখ যেন ঝলসে যায়। কিন্তু ভুবন কারিগরের এই রোদ্দুরটিই যে দরকার। সে পারুলকে বলল, “আজ রোদ খাইয়ে শুকিয়ে নিই। কাল আবার রোদে দিতে হবে। পুরো শুকোলে তারপর বসন পরাব। চল, ধর দেখি পারু উঠোনে নিতে হবে।”
পারুলের মন আজকাল বেশ খুশি খুশি থাকে। দিনগুলো যেন অত একঘেয়ে লাগে না। সংসারের হাজার কাজের মধ্যে সে মাঝে মাঝেই ভুবনের কাছে এসে দাঁড়ায়। মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি দেখে। কী ভেবে দু’হাত জড়ো করে প্রণাম করে।
“সাবধানে ধর। সামলে, সামলে…”
দু’জনে ধরাধরি করে উঠোনের চড়চড়ে রোদে যুগল মূর্তিকে নিয়ে আসে।
“থাক। আজ এই বেলার রোদটা খাক। আবার কাল সকালে দেখা যাবে।… কই, তোর রান্না হয়েছে? চল দু’টো খেয়ে নিই।”
“রান্না কখন সারা! চল।”
“এক সপ্তার মধ্যে আশা করছি বাবুকে দিয়ে দিতে পারব, বুঝলি পারু।”
ভুবন খেতে খেতে বলল। পারুলের মুখে মনখারাপের ছায়া।
“ইশ, ঠাকুর চলে গেলে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগবে গো।”
ভুবন হাসল, “তোকে তো বলেছি তোর ঘরের জন্য একখান জোড়া মূর্তি অমন গড়ে দেব।”

খাওয়া-দাওয়ার শেষে আজ দুপুরে একটু শান্তির ঘুম নেমেছে ভুবনের দু’চোখ জুড়ে। পারুলও সারাদিন খেটে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশের পশ্চিম কোণে যে বুনো মোষের পিঠের মত বিশাল মেঘ জমেছে, দুটি নিদ্রাতুর মানুষ জানতেই পারেনি।
হঠাৎ পারুল ঘুমের মধ্যেই খানিক সজাগ হল। কী যেন ডাকছে? অচেতন থেকে চেতনায় আসতে যেটুকু সময়, তার পরেই সে চিৎকার করে ভুবনকে ডাকল,
“ওগো ওঠো… সব্বোনাশ হয়ে গেল… ওঠো…”
ভুবন ধড়ফড় করে উঠে বসল বিছানায়, “কী হয়েছে?”
পারুল ততক্ষণে দোর খুলে বারান্দায় ছুটে গেছে। ভুবন ব্যাপার উপলব্ধি করে লাফ দিয়ে ছুটে উঠোনে নেমে আসল। প্রবল বর্ষণে মাটির মূর্তি ধুয়ে যাচ্ছে তখন। রং গোলা জল নামছে রাধা কৃষ্ণের দেহ বেয়ে। ভুবন পাগলের মত চেঁচাল,
“পারু তুই রাধার পিতিমেটা ধর। শিগগির কর। চালার ভেতরে নিতে হবে। জলদি কর…”
পারুল সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। প্রচণ্ড জোর বাতাসের সঙ্গে জলের তোড়! যেন ভাসিয়ে নেবে সব। কোনমতে দু’জনে মূর্তি দুটি উঠোন থেকে তুলে চালার নীচে আনল। হাতের চাপে নরম হয়ে বসে যাচ্ছে মূর্তির ভেজা দেহাংশ।

জল ঝড় থামল এক সময়। উঠোনময় ছপছপ করছে জল। সন্ধে হয়ে গেছে। ঠান্ডা শীতল আঁধার নেমেছে। চালার নীচে বসে আছে ভুবন আর পারুল। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকা ভুবনের পিঠটা অব্যক্ত কান্নার দমকে কাঁপছে। তার এতদিনের পরিশ্রম জলে ধুয়ে গেছে। এক সময় বুক নিঙড়ে কান্না বেরিয়ে এল ওর,
“পারু, আমার সব শেষ হয়ে গেল রে!”
পারুল দু’হাতের বাঁধনে জড়িয়ে ধরল ভুবনকে।
ফিসফিস করে বলল,
“না গো, সব শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের ঘরে অতিথি আসছে।”
ভুবন ওই মুহূর্তে কথাটার অর্থ ধরতে পারল না। হাহাকার করে বলল, “আমি বাবুকে মুখ দেখাব কেমন করে?”
পারুল ভুবনের কাঁধে মাথা রেখে নরম করে বলল, “আবার নতুন করে শুরু কর। তুমি বাপ হবে গো। আমার পেটে সে এসেছে এতদিনে।”
ভুবন থমকে গেল। তার সব খেদোক্তি নিমেষে গেল থেমে। যেন বুঝেও বুঝতে পারছে না ও পারুলের কথাটা।
“কী বললি?”
“হ্যাঁ গো। সত্যি!”
আনন্দের হাসি অশ্রুতে মাখামাখি হয়ে গেল ভুবনের মুখ। পারুলকে বুকের কাছে টেনে নিল ও। ছোট্ট চালাঘরে ভাঙা-গড়ার খেলায় চলকে উঠল জীবন!

পরের দিন সকালে দেখা গেল, যতটা খারাপ ভাবা হয়েছিল, অবস্থা ততটাও খারাপ নয়। ছাঁচে বানানো রাধা কৃষ্ণের মুখ চালার নীচে ছিল, তাই ভেজেনি। শুকিয়ে গেছে। নতুন উদ্যমে ভুবন দিন রাত এক করে খেটে কাজ করতে লাগল। মানুষ চাইলে কী না পারে? ঠিক জন্মাষ্টমীর আগেই সম্পূর্ণ হল তার সৃষ্ট রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি।
সতীশ রায়চৌধুরী খবর পেয়ে নিজে এসে ভুবনকে যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে মূর্তি নিয়ে গেলেন। বলাই বাহুল্য, ভুবনের শিল্পকর্ম তাঁকে মুগ্ধ করেছে।

দিন যায় একটি একটি করে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো সবই শেষ হল। পারুলের ভরা মাস। এখন ভুবন ঘরের কাজে পারুলকে কিছু কিছু সাহায্য করে। সতীশবাবু জন্মাষ্টমীতে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার উৎসবের দিনটিতে ভুবন ও পারুলকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ভুবন গিয়ে দেখে এসেছে কী সমারোহে স্থাপন করা হয়েছে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি! শ্রদ্ধার সঙ্গে মিশে ছিল ভুবনের বুক ভরা গর্ব – এ মূর্তির জন্ম যে তার হাতে! পরক্ষণেই দু’হাত জড় করে প্রণাম জানায় সে, মনে মনে বলে, “অপরাধ নিও না মাধব। আমি তো শুধু তোমার মাটির মূর্তিটুকু গড়েছি। তোমাকে কি কোনো মৃত্তিকা মূর্তিতে বাঁধা যায়? তুমি যে অসীম প্রভু!”
ঘরে ফিরে পারুলের কাছে রায়চৌধুরী বাড়ির উৎসবের গল্প শোনায় সে। পারুলও ভক্তিভরে প্রণাম করে।

বছর ঘুরে নতুন বছর শুরু হল। সময়ের নিয়মে উপস্থিত হল পারুলের প্রসবের ক্ষণটিও। হাসপাতালে পারুলকে ভর্তি করে ভুবন অপেক্ষা করছে। তখনই এল বিনয়বাবুর ফোন। কাজের জন্য ভুবন একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বটে, তবে তার ব্যবহার ওই অবরে সবরে।
“হ্যাঁ বাবু, বলুন!”
বিনয় বাবু বললেন, “জবর খবর আছে তোমার জন্য।”
“কী বাবু? আমি তো কিছুই জানি না।”
“জানবে জানবে। বর্ধমানের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোয় এবার মা দুর্গার মূর্তি বানানোর বায়না পাবে তুমি। সতীশবাবু তোমাকে দেখা করতে বর্ধমান যেতে বলেছেন। যত শিগগির সম্ভব যেতে হবে।”
অপ্রত্যাশিত আনন্দে ভুবনের চোখে জল এসে গেল। হাসপাতালে পারুলের বেডে তার ডাক এল একটু পরেই। ফুটফুটে পুত্রসন্তান হয়েছে পারুলের। নতুন মায়ের মুখটি জ্বলজ্বল করছে সুখের আবেশে।
ভুবন সদ্য পাওয়া আনন্দ সংবাদ জানাল পারুলকে। তারপর বলল, “ছেলের নাম কী রাখবি পারু?”
একমুখ হেসে পারুল বলল, “কানু! জানো, তুমি যখন কেষ্ট ঠাকুরের পিতিমে গড়ছিলে, তখন আমিও কানুকে একটু একটু করে গড়েছি আমার ভিতরে। আর আজ কানুর জন্ম নেওয়ার ক্ষণটিতেই তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজের সুযোগ পেলে।”
“ঠিক বলেছিস!”

নিজেদের শরীর থেকে জন্ম নেওয়া শিশুপুত্রের দিকে পরম স্নেহ, ভালবাসামাখা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে দুটি মানুষ। সে দৃষ্টিতে লেগে থাকে একটি নিটোল সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন!


লেখক পরিচিতি : রুমা ভট্টাচার্য
দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা। ছোটবেলা থেকেই গল্পের বই পড়ার নেশা। কবিতা লিখে থাকলেও গল্পই প্রথম পছন্দ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।