লেখক: অর্ঘ্য দে
১লা জুন।
সকালে চায়ের টেবিলে খবরের কাগজের একটা খবর পড়ে চমকে উঠলেন প্রফেসর হিবিসকাস খবরটার সারসংক্ষেপ এই যে, এক বিখ্যাত চিত্রাভিনেতার বয়স হঠাৎ দ্রুত বেড়ে গেছে এবং তার সাথে প্রকাশ পেয়েছে কিছু বার্ধক্যজনিত লক্ষণ। চিত্রাভিনেতার নাম প্রকাশ মেহেতা।
খবরটা পড়ে হিবিসকাসের মনটা সুপারসনিকের গতিতে মাস ছয়েক আগের একটা সকালে চলে গেল। দিনটা ছিল ১লা এপ্রিল। সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে কাগজ পড়ছিলেন, এমন সময় এক বছর তিরিশের সৌম্যদর্শন যুবক আসেন ওনার সাথে দেখা করতে। সেই আগন্তুক যুবক নিজেকে ডাক্তার প্রণব আইচ বলে পরিচয় দেন। ডাক্তার আইচের প্রফেসর কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারেন ডাক্তার আইচ ব্যাঙ্গালোরের নিউরোলজিকাল ডিজেনারেটিভ ডিসিস রিসার্চ সেন্টারের সদস্য এবং প্রফেসর বার্ধক্যজনিত রোগ প্রতিরোধের যে উপায় অর্থাৎ মেশিনটি আবিষ্কার করেছেন ডাক্তার আইচ এবং তার সহকর্মীরা সেই খবর সম্পর্কে শুধু যে ওয়াকিবহাল তাই নয় ভীষণ রকম আগ্রহীও। ডাক্তার আইচ মেশিনটির ব্যাপারে ওনার কথা বলতে এসেছেন।
প্রফেসর হিবিসকাসের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্ছি। নাক চোখ বেশ তীক্ষ্ণ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। প্রিয় রং লাল আর প্রিয় ফুল জবা। ওনার নামের উত্তসের রহস্য লুকিয়ে আছে নিজের প্রিয় ফুলের মধ্যেই। কারণ জবা ফুলের বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘হিবিসকাস রোজাসিনেনসিস’। ওনার গত বছরের গোড়ার দিকে গবেষণার বিষয় ছিল মলিকিউলার জিনোমিক্স। টানা প্রায় আটমাস নিরলস গবেষণার ফসল হিসাবে একটি সম্পূর্ণ নতুন মেশিন আবিষ্কার করেন। যে মেশিনটি মানুষের ‘এ টু এম’ নামের একটি বিশেষ জিন যেটি বার্ধক্যজনিত স্মৃতিশক্তি লোপ পাবার জন্য দায়ী সেটির ওপর কাজ করতে পারে। বহু বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকাতে তার এই মৌলিক আবিষ্কার ও মেশিনটির কার্যপদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। মেশিনটির কার্যপদ্ধতির সংক্ষিপ্তরূপ খানিকটা এইরকম… মেশিনটির সাথে যে হেডফোনের মতো যন্ত্রাংশ ব্যক্তির মাথায় পড়ানো হয় সেই অংশ মেশিন থেকে উৎপন্ন কম্পাঙ্ককে কানের ভিতর দিয়ে সেই ব্যক্তির ভিতরে পাঠায় এবং ‘এ টু এম’ জিনকে লাইসিস বা বিভাজিত করে কোসবিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যায় বাড়ায়। ফলস্বরূপ স্মৃতিশক্তি অনেকটাই রক্ষণ করা বা বজায় রাখা যায়।
ডাক্তার আইচ নব আবিস্কৃত মেশিনটি তাকে মাস চারেকের জন্যে দিতে অনুরোধ করলে প্রফেসর বিনা বাক্যব্যয়ে রাজী হয়ে যান এবং মেশিনটির ম্যানুয়াল ওনার হাতে তুলে দিলে ডাক্তার আইচ প্রফেসরকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যান। এরপর প্রফেসর ডাক্তার আইচের আর কোনো খবরই পাননি।
আজকে কাগজে প্রকাশিত খবরের মূল চরিত্র প্রকাশ মেহেতার সাথে সেই অজ্ঞাত আগন্তুক ডাক্তার আইচের যোগসূত্র খুঁজে বার করার তাগিদে অস্থিরতার সাথে ল্যাবরেটরির দিকে পা বাড়ালেন। বন্ধ ল্যাবে চোখ বুজে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। অস্থিরতা আর সন্দেহের অবসানে সমাধানের ডান দিকে ভেসে উঠল ডাক্তার আইচের মুখ আর বাঁ-দিকে প্রকাশ মেহেতার অকাল বার্ধক্যমুখ, ডানদিক-বাঁদিক মিলে গেল।
প্রফেসর তাড়াতাড়ি ল্যাব থেকে ব্রেকফাস্টের টেবিলে এসে আরেকবার খবরটা ভালোভাবে পড়ে জানতে পারলেন প্রকাশ মেহেতার শুধু যে স্মৃতি লোপ পেয়েছে তাই নয়, তার বয়সটাও এক ঝটকায় ষাট বছরের লোকের মতো হয়ে গেছে। এর থেকেও মারাত্মক খবরটা এই যে প্রকাশ মেহেতা নিজের নামটাও বেমালুম ভুলে গেছেন। নিজের আবিষ্কৃত অ্যান্টিএজিং মেশিনের ভুল ব্যবহার কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা ভেবে নিজেই ভীত হয়ে পড়লেন প্রফেসর। ক্রমশ যেন তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন চোরাবালিতে নিজেরই ভুলে। যাই হোক ভুল যখন তার, শোধরাতেও হবে তাকেই। তিনি প্রকাশ ভিলাতে যাবেন বলে মনস্থ করলেন। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতির যে খবর কাগজে পড়লেন তা থেকে এটা ঠিক যে কোনো অপরিচিত, সাধারণ ব্যক্তি মানে পুলিশ বা প্রশাসন ছাড়া কাউকেই প্রকাশ ভিলাতে ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা ভিলার চৌহদ্দির মধ্যেও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এতক্ষণে মিডিয়ার চ্যানেলও টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট শুরু করে দিয়েছে। মন্ত্রী থেকে আমলা অনেকেই পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে গেছে। এক কথায় অজানা আশঙ্কা আর উদবিঘগ্নতার নিশ্ছদ্র অন্ধকার গিলে ফেলেছে প্রকাশ ভিলাকে।
কিন্তু এও ঠিক যে, তিনি ছাড়া আর কেউ এই বিভ্রান্তিকর অবস্থা থেকে প্রকাশ মেহেতাকে বের করতে পারবে না। নাঃ, ওনাকে যেভাবেই হোক যেতেই হবে…। মুশকিল হচ্ছে তিনি একা গেলে জট আরও বাড়বে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে ইজিচেয়ারে বসে দুলছিলেন এমন সময় চোখ খুলে চেয়ার থেকে উঠে পকেট থেকে সেলফোন বার করে একটা নম্বর ডায়াল করে বলে উঠলেন…. হ্যালো ডাঃ সোম বলছেন, কেমন আছেন? আপনার সাথে একটু দেখা করার দরকার, অনেক দিন তো আড্ডা দেওয়া হয় না… আসছেন তো ? ইটস ভেরী আর্জেন্ট…ওকে বাই।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নিউরো সার্জেন ডাঃ সোম প্রফেসরের বাড়ি এলেন। ডাঃ সোম ওনার এক জন বড় ভক্ত কারণ, প্রফেসরের মুখে গবেষণার বিষয় অর্থাৎ, ‘এ টুএম’ জিনের কথা ডাঃসোম প্রথমে শুনেই উৎসাহিত হয়ে ওনাকে সমস্ত রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রকাশ মেহেতার আকস্মিক পরিবর্রতনের খবরটা অনেক আগেই ডাঃ সোমের কানে এসেছিল কিন্তু প্রফেসরের কাছে কারণটা শুনে কেমন যেন বোকার মতো ওনার দিকে চেয়ে থাকেন। সম্বিত ফিরে এলে ডাঃ সোম বলেন, “আসলে প্রকাশ মেহেতাকে নিয়ে যে মেডিকেল বোর্ড তৈরী হবে সেই বোর্ডের এক্সিকিউটিভ হেড আমি”। ঠিক এই কথাটা শোনার জন্যেই যেন তীর্থের কাকের মতো বসে ছিলেন প্রফেসর। গুমোট পরিবেশে গাছের স্থির পাতায় হাওয়া লাগলে পাতা যেমন নড়ে ওঠে, তেমনই চঞ্চলতায় কেঁপে উঠলেন প্রফেসর। ডাঃ সোমের দুহাত চেপে ধরে প্রফেসর বলে উঠলেন, “ব্যাস। এতেই হবে আর কিচ্ছু চাই না…আমাকে কবে ও বাড়ি নিয়ে যাবে বল।’’ এই প্রশ্নটার জন্যে ডাঃ সোম প্রস্তুত ছিলেন না তাই প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “সত্যি, সত্যিই তুমি যাবে প্রফেসর?” প্রফেসরের দু’চোখের অদৃশ্য জ্যোতি যেন অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো নিয়ে এল।
ডাঃসোম কথা মতো প্রফেসরকে প্রকাশ ভিলাতে নিয়ে এলেন ডাক্তারের ছদ্মবেশে। নিখুঁত ছদ্মবেশে মেডিকেল বোর্ডের বাকি সদস্যরা প্রফেসরকে ডাক্তার বলে ভুল করতে বাধ্য হল। ডাঃ সোম বাকি সদস্যদের সাথে প্রফেসরের আলাপ করিয়ে দিয়ে সকলকে একটা মৌখিক আদেশ দিলেন, যে আদেশ বলে ড. ঋষিকেশ মুখার্জী, মানে প্রফেসরের নিজের ইচ্ছামত প্রকাশ ভিলাতে আসতে যেতে কোনো বাধা থাকল না। প্রফেসর প্রাথমিক আলাপ সেরে কারুর সাথে বিশেষ কথা না বলে সোজা প্রকাশ মেহেতার ঘরে ঢুকলেন। হুইলচেয়ারে অকাল বার্ধক্যের নিদারুণ আঘাতে আহত অসহায় প্রকাশ মেহেতাকে দেখে প্রফেসর যেন পাথর হয়ে গেলেন। দু’জনেই যেন দু’জনার কাছে অনুতপ্ত এবং একে অপরের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে নিলেন এক অখন্ড নীরবতার মধ্যে দিয়ে। হাতের মৃদু টোকায় নাতিদীর্ঘ মৌনতার সমাপ্তি ঘটিয়ে ডাঃসোম বলে উঠলেন, “প্রফেসর এবার কী করবে ভাবছ?”
আমার একটা পেন আর কিছু কাগজ লাগবে। প্রফেসর প্রশ্নের সাথে সবিনয় দাবি জানাল। কথাগুলো ডাঃ সোমে চটজলদি গুরুর আদেশ পালনে খামতি রাখলেন না। অনেকক্ষণ প্রফেসর কাগজে হিজিবিজি কাটছে নীরব দর্শকের মতো বেশ কিছুক্ষণ দেখে ধৈর্য্য হারিয়ে বলে ফেললেন “আশা আছে?” প্রফেসরের সমস্ত মন এমন ভাবে ডুবে গেছে যে পৃথিবীর কোনো শব্দই আর তার কানে পুঁছবে না। হঠাৎই প্রফেসর খাতা পেন ডাঃ সোমের হাতে গুঁজে দিয়ে মেশিনের ছোট-বড় বিভিন্ন নবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। মেশিনের কন্ট্রোল প্যানেলে আঙুল বোলাতে বোলাতে খানিক বিরবির করতে লাগলেন। তারপর চুপচাপ চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। এতক্ষণ প্রফেসরের গতিপ্রকৃতি দেখে ডাঃ সোমের মনে যে চাপা উত্তেজনাটা পিংপংগ বলের মতো লাফাচ্ছিল, সেটাও প্রফেসরের বসার সাথে থেমে গেল।
কী হল প্রফেসর? উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠলেন ডাঃ সোম।
কিন্তু এবারও কোনো উত্তর এল না। স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা হতাশ হলেন ডাঃ সোম।
নাঃ, যতটা সোজা ভেবেছিলাম ততটা সোজা নয়, সময় লাগবে…বেশ সময় লাগবে; প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে ডাক্তার….। নিজের কপালে আঙুল বোলাতে বোলাতে বিরবির করে বললেন প্রফেসর। আমি কিছুদিন এখানেই থেকে যাব, এ সমস্যার সমাধান না করে এখান থেকে যাব না। এই কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে স্পষ্ট করেই বলল প্রফেসর।
কথা না বাড়িয়ে ডাঃসোম প্রফেসরের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে সেদিনের মতো চলে গেল।
পরপর তিন দিন কেটে গেল। ঘুম আর খাওয়ার মতো সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করা প্রফেসরের মতো একজন বিজ্ঞান সাধকের মানায় না। তাই হয়তো তার নিরলস প্রচেষ্টায় ভাটা পড়ল না। এরই মাঝে টিমের কয়েকজন উৎসাহী সদস্য উঁকি মেরে দেখে গেছে প্রফেসরের কর্মকান্ড। কিন্তু যতটা উৎসাহ নিয়ে তারা ঘরের ভিতরে চোখ রেখেছে, ততটাই নিরুৎসাহিত হয়ে ফিরে এসেছে। প্রফেসরের ডাক পড়লেই সবাই আশান্বিত হয়… এই বুঝি কিছু একটা মিরাকেল হল! প্রফেসরের অভগ্ন সাধনা আর উৎসাহীদের আনাগোনা এইসব ঘটনার চক্রাকার পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়েই আরেকটা দিন কেটে গেল।
পঞ্চম দিনেও যখন কোনো আশানরূপ ঘটনা ঘটল না, সবাইকার মনে তখন সংশয় দানা বাঁধল। তার সাথে প্রফেসরের যোগ্যতা নিয়েও নানারকম প্রশ্ন উঠল। দু’হাতে দুটো কফিমগ নিয়ে ডাঃ সোম ল্যাবে ঢুকলেন। প্রথমটায় ডাঃ সোমের মনেও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়েছিল কিন্তু প্রফেসরের চিন্তামগ্ন স্থির মূর্তি দেখে নিজের হৃত বিশ্বাস ফিরে পেলেন। মেঝেতে পড়ে রয়েছে ছেঁড়া কাগজের স্তূপ। একটা আধ ছেঁড়া জীর্ণ কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে কাগজের ভাঁজ খুলে পারম্যুটেশন-কম্বিনেশ্নের ফর্মুলা ছাড়া তেমন কোনো আশাজনক সংকেত ডাঃ সোমের নজরে পড়ল না। পাছে প্রফেসার বিরক্ত হন তাই প্রফেসারকেডাকাডাকি করলেন না। কফিমগটা মেশিনের পাশের টেবিলে রেখে প্রফেসারের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কফি রেখে গেলাম’। ডাঃ সোম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
অনেকক্ষণ পর চোখ খুলতে কফিমগের দিকে নজর যেতেই ক্লান্তি কাটাতেপ্রফেসর কফিমগ হাতে তুলে নিলেন। মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ আয়েশ করে বার দুয়েক চুমুক দিলেন। কফি খেতে খেতে বুঝতে পারলেন পায়ের তলার মাটি কেমন যেন কাঁপছে। কাঁপুনিটা থেমে গেল। প্রথমটায় ব্যপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। নিজের মনকে প্রশ্ন করলেন, ‘মনের ভুল নয় তো ?’ ফের সেই একই কম্পন অনুভব করলেন। এই কম্পনের ফলে কিছুটা কফি মেশিনের কন্ট্রোলপ্যানেলে পড়ে গেল। প্রফেসার পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে লাগলেন। মোছা শেষ হলে আবার চেয়ারে এসে বসলেন। ততক্ষণে কম্পনটা থেমে গেছে। প্রফেসার আবার সমাধান সূত্রের চিন্তায় ডুবে গেলেন। এমন সময় খেয়াল করলেন কোথা থেকে ঘরে একটা বর্ণময় প্রজাপতির আবির্ভাব হয়েছে।প্রফেসর ভাবলেন প্রজাপতিটা কোনোভাবে হয়তো ঘরে ঢুকে পড়েছে। মেশিনের চারপাশে প্রজাপতিটা উড়তে লাগল। এইভাবে খানিকক্ষণ ওড়ার পর একটা স্যুইচকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেতে লাগল। প্রজাপতির এমন অদ্ভুত চলন দেখতে দেখতে বশীভূত হয়ে কখন যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন নিজেও বুঝতে পারেননি প্রফেসার।
এভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এমন একটা আশাতীত ঘটনা ঘটল যা তার চিত্তচাঞ্চল্যকে একধাপে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলল। তিনি দেখলেন মেশিনের কাঁটাররিডিং পজিটিভের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এর খানিক পরেই প্রকাশ মেহেতার মাথায় লাগানো হেডফোনে একটা মৃদু কম্পাঙ্ক শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কম্পাঙ্ক পাঁচ থেকে দশ, দশ থেকে কুড়ি হার্জে চলে গেল।
অদ্ভুত একটা আওয়াজ হতে থাকল। আওয়াজটা গোটা ঘরের শূন্যতায় দ্রুত ছড়িয়ে গেল। এর সাথে সাথেই প্রজাপতির ওড়ার গতিও অনেকটা বেড়ে গেল। প্রজাপতির আগমন, কম্পাঙ্কের গুণোত্তর প্রগতিতে বৃদ্ধি — এইসব ধারাবাহিক ঘটনাগুলো দেখে প্রফেসরের আচমকা মনে পড়ল ঠিকই তো, মেশিন তার পূর্বকল্পিত নিয়মে কাজ করছে।
মেশিনকে তো এইভাবেই কাজ করাতে চাইছিলেন উনি। প্রফেসরের দিন তিনেকের ক্লান্তি নিমেশে উধাও হয়ে তার চোখেমুখে ফুটে উঠল সাফল্যের দ্যুতি। বছর দুয়েক আগে শব্দবিজ্ঞানের একটা তত্ত্বের ওপর গবেষণার সময় তিনিই উপলব্ধি করেছিলেন যে, কম্পাঙ্ক যদি ইকোফ্রেন্ডলি মানে, জীব দেহের পক্ষে উপকারী হয়, তাহলে নাকি যেকোনো কীটপতঙ্গের গমনের ওপর তার লক্ষণীয় প্রভাব পড়ে। মেশিনের কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখতে তিনি বুঝতে পারলেন খানিক আগে পড়ে-যাওয়া কফি মোছার সময় নিজের অজান্তেই একটা বিশেষ স্যুইচে চাপ পড়েছিল। এর ফলেই মৃদু একটা কপাঙ্ক শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটা তার কানে এসে পৌঁছায়নি। বহু রঙে রঞ্জিত প্রজাপতিটা হয়তো মেশিন থেকে উৎপন্ন ক্ষীণ কপাঙ্কের আঁচ পেয়েছিল অনেক আগেই। আর তাই মেশিনের কাছাকাছি উড়ছিল। মানুষ যে কপাঙ্ককে আগাম অনুভব করতে বা আঁচ করতে অক্ষম, পতঙ্গ বা কীটেরা সেই কপাঙ্ককে সহজেই বুঝতে পারে। এই ক্ষেত্রও তাই হয়েছে। একটা জটিল সমস্যার সমাধান করতে এসে যে আরেকটা ব্যাপার প্রমাণস্বরূপ আবিষ্কার করতে পারবেন তা ভাবেননি তিনি। ডাঃসোম এক ঝটকায় দরজা খুলে ল্যাবে ঢুকে এলেন। বললেন, ‘সব ঠিক আছে তো? একটু আগেই একচোট ভূমিকম্প হয়ে গেল। কেমন একটা আওয়াজ শুনলাম যেন!’ প্রফেসর কোনো উত্তর দিলেন না। অন্যমনস্কভাবে এদিক ওদিক তাকালেন। কোথাও প্রজাপতিটাকে আর দেখতে পেলেন না।
বাকিরাও ডাঃ সোমের পিছু পিছু বাঁধভাঙ্গা কৌতূহল নিয়ে সদলবলে ঝোড়ো হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকে পড়ল। প্রত্যেকের বিস্ফারিত চোখ প্রকাশ মেহেতার দিকে আটকে গেল। সকলেই দেখতে পেল প্রকাশ মেহেতার মুখ জুড়ে একটা অদ্ভুত আলোর ছটা খেলা করছে, আর তার সাথে একটানা কেঁপে চলেছে প্রকাশ মেহেতার শরীরের উপরের অংশ। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আলো আর কম্পনের সাথে মিলিয়ে গেল প্রকাশ মেহেতার চোখে মুখের বার্ধক্যের সমস্ত রেখাচিহ্ন।
ডাঃ সোমের খুশি অসীমে পুঁছালো এবং তিনি আবেগ বিহ্বল হয়ে প্রফেসরকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, “আমি জানতাম তুমি ঠিক পারবে… শুধু তুমিই পারবে …।’’ ডাঃ সোমের কথার সমর্থনে সবাই একসাথে হাততালি দিয়ে উঠল। প্রফেসর মেশিন বন্ধ করতেই প্রকাশ মেহেতা হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রফেসরকে উদ্দেশ্য করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,“প্রফেসর…।” অনেকদিনের জমানো কান্না আর অনুতাপে গলা বুজে এল প্রকাশ মেহেতার। প্রফেসর দু’হাত দিয়ে প্রকাশ মেহেতার ডান হাত চেপে ধরতেই নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রকাশ মেহেতা অঝোরে কেঁদে ফেললেন। বাস্তব জীবনে যে এইরকম নাটকীয়তা অপেক্ষা করছিল এবং নাটকীয়তার শেষে যে তার জন্যে বিধাতা লিখে রেখেছে নতুন এক জীবন কাহিনী, তা অভিনেতা প্রকাশ মেহেতা কোনোদিনও ভাবেনি।
এক সনামধন্য চিত্র তারকার জন্যে অপেক্ষামান চিন্তাগ্রস্থ অগণিত ভক্তদের সারপ্রাইজ দেবার উদ্দেশ্যে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই প্রকাশ মেহেতাকে প্রকাশ ভিলার দোতলার ঝুল বারান্দায় নিয়ে এসে দাঁড় করালেন প্রচারবিমুখ প্রফেসর হিবিসকাস। প্রকাশ মেহেতা হাসি মুখে হাত নাড়তেই চিরপরিচিত নায়ককে পরিচিত বেশে দেখে উদ্বিগ্ন ভক্তদের মধ্যে খুশির হিল্লোল বয়ে গেল। হিবিসকাস কিন্তু আড়ালেই রয়ে গেলেন, অগাধ এক প্রশান্তি তার মুখমণ্ডল জুড়ে। সদ্য উদিত সূর্যের আলোকছটার মতো যা ছড়িয়ে পড়ছে দূর দিগন্তে।
লেখকের কথা: অর্ঘ্য দে কবিতা দিয়েই লেখালেখি জগতে যাত্রা শুরু।কবিতা ছাড়া লেখার অন্য মাধ্যম ছোটো গল্প গল্পের মূল বিষয় মূলত হরর, ফ্যান্টাসি কিংবা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। ছোটোদের জন্য 'ছোটোদের রূপকথা', 'পথের সুজন', 'পত্রিকা' শারদ সংখ্যা পত্রিকায় কিছু ছোটো গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত কবিতা এবং গল্পর অন্য ওয়েব বা মুদ্রিত পত্রিকা 'ক্ষেপচুরিয়াস','কেয়াপাতা', চা-পাতা', 'কবিতা পাক্ষিক, 'ফেরারি' ইত্যাদি। লেখক বাংকার প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও পরিচিত লিটল ম্যাগাজিনেই কবিতা লিখেছেন। দেশ পত্রিকা, এবং শারদীয়া আনন্দবাজারে এর আগে কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশিত বই : গল্প গ্রন্থ 'মৃত্যুর কোড' (গিলগামেশ প্রকাশনী) কলকাতা বইমেলা-২০১৯। ডার্ক ফ্যান্টাসি, হরর, থ্রিলার ছোটো গল্পের সংকলন। কাব্যপুস্তিকা: 'ডিসেম্বরের বাজনা' (আলোপৃথিবী প্রকাশনী)।
Sundar lekha.Aar dirghau kamona koree
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
এক অভিনব ভাবনা।ভালো লাগলো।
প্রফেসর হিবিসকাস ভালো লাগল । এই লেখার সিরিজ হোক।
শিবাজী পণ্ডিত
সম্পাদক গা ছমছম
অনেক ধন্যবাদ দাদা। সিরিজে ছটি গল্প আছে।
অন্যরকম লেখা। এক নিঃশ্বাসে পড়লাম । ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ।