সহোদরা

লেখক : সুতপা সোঽহং

‘খবর শুনছিস হরেন? শীলার ঘরে আবার মেয়েছেলে ঢুকেছে। ঢুকতেই শালি দরজায় ছিটকিনি দিয়েছে। প্রেম পিরিতি কেস।’ বলতে বলতে শিবু গুটখা মুখে পুরে পিচিক করে পিক ফেলল। হরেন ভুরু কুঁচকে তাকালো। ‘মেয়েছেলে ঢুকছে মানে?’

‘তুই কোন দুনিয়ায় থাকিস বে? শীলাকে চিনিস না? ওই গা দুলানী মুখ পচানীকে চেনে না এখানে কোন শালা!’

“চিনবো না কেন? এ বেশ্যা পাড়ার কোন মাগীকে আমি চিনি না?” বলে হরেন উঠে দাঁড়ালো।

“তালে শালা মানে মানে করে সাধু সাজিস কেন বে?”

“ওর ঘরে কেন মেয়েছেলে ঢুকবে? মেয়েছেলের দরকার কী ওর ঘরে? ঢুকবে তো সব কাস্টমার। পুরুষ মানুষ।” হরেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

শিবু মুখটা কুঞ্চিত করে কর্কশ গলায় বলে উঠলো, “ছোটো খোকা! মেয়েছেলে মেয়েছেলেতে‌ও হচ্ছে! এ পাড়ার বেওসা লাটে উঠাবে ও শালি।”

“কী বলিস এসব? কীভাবে হবে? ওদের কি ওইটা আছে? আর যে মেয়েছেলেটা ঢুকছে তার সঙ্গে যে ওসব‌ই করছে তুই জানলি কী করে?”

“এ বেশ্যা পাড়ায় আমাদের সিআইডি রিপোর্টার কি কম আছে বে? হাতকাটা কালু, ও পাড়ার ময়না সবাই তো বলাবলি করছে। ও মাগিকে নাকি এ পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিবে। এতো পুরুষ নাগর থাকতে ও মাগির রস কমে না। আবার লাগে মেয়েছেলে। থুঃ”

হরেন সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়ে। গোল গোল ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভিতর দিয়ে ও আকাশটাকে দেখতে চায়। আকাশ‌ও কি কম ধোঁয়াময়! গোটা পৃথিবীর চিন্তার ধোঁয়া তো ওই মাথার আকাশটায়। ওর ভারী আশ্চর্য লাগে। শীলাকে তো কম বছর ধরে চেনে না। যখন শীলা প্রথম এ পাড়ায় এলো তখন ওর বয়স মেরে কেটে এগারো বারো। হরেনের কুড়ি। ওর বাপ তাড়ি খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে ওকে বেচে দিয়েছিলো হাত কাটা কালুর কাছে। অতো কচি মেয়ে কিন্তু ভরা শরীর দেখে কাস্টমারের জিভ লকলক করতো। কালু কম টাকা কামায়নি ওর শরীর বেচে। কালু মাঝে মাঝে‌ই ওর কুতকুতে চোখে ঝিলিক তুলে বলতো, ‘এ আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস বুঝলি। কম করে হলেও চল্লিশ বছর ডিম দিবে। একে হাতছাড়া করা যাবে না কিছুতেই।’

“কী বে শালা গুম মেরে গেলি যে! প্রেম মোহাব্বত আছে নাকি ও মাগির সঙ্গে। মেয়েছেলের সাথে ইয়ে করতে শুনে এমন মুষড়ায় পড়লি যে!” শিবুর কথায় হরেনের সম্বিত ফেরে। শেষবারের মত সিগারেটে আরেকটা টান দেয়। শীলার কথা ভাবতে ভাবতে সিগারেটটাই পুড়ে গেছে। দশটা টাকা নষ্ট। নষ্টের কথায় হরেনের মনে পড়ল বুড়ো চক্কোত্তির কথা। এই আগের মাসেও মরার আগ পর্যন্ত এক কথাই সারাদিন বলত ‘নষ্ট নষ্ট নষ্ট। সব নষ্ট। খাবার নষ্ট। কাপড় নষ্ট। টাকা নষ্ট।‌ তবু শালা এ নষ্ট কিছুই নয়। আসল তো শালা জীবনটা পুরাই নষ্ট।’ বেশ্যা পাড়ার একেবারে শেষ মাথায় একটা ভাঙাচোরা টালির ঘরে বুড়ো থাকত। সারাদিন খক খক করে কাশত আর বিড়বিড় করে নিজেকেই সারাদিন গালমন্দ করত। ও বুড়োর ধারে কাছে কেউ ঘেঁষত না। যৌবনে ঘরে সতীলক্ষ্মী ব‌উ থাকতেও মেয়ে শরীর ভোগ করতে করতে কখন সিফিলিস রোগ তাকে ভোগ করা শুরু করে বুড়ো টের পায়নি। সিফিলিসের দগদগে ঘা নিয়ে বুড়ো যেদিন কাতরিয়ে কাতরিয়ে মরল সেদিন থেকে হরেনের‌ও ওই নষ্টের ভূত মাথায় চেপেছে। সারাদিন খালি হিসেব করে কোথায় কী নষ্ট হল। আর সেসব নষ্টের হিসেব শেষে একটাই উপসংহারে ঠেকে : এ নষ্ট তো কিছু‌ই নয়। আসলে তো জীবনটাই শালা পুরাই নষ্ট।

“চল চল দুটাকেই ঠ্যাঙানি দিয়ে আসি। এ পাড়ায় ও বেলেল্লাপনা চলবে না। না শুনলে ও মাগিকে আর পাড়ায় থাকতে দেওয়া যাবে না। হবে শুধু ছেলেতে মেয়েতে। কোনো মেয়ে-মেয়ে , ছেলে-ছেলে চলবে না।” শিবু আরেকবার গুটখার পিক ফেলে হরেনের কাঁধ ধরে হ্যাঁচকা টানে। কিন্তু হরেন উৎসাহ দেখায় না। কোমরের কাছে দাঁদটা চুলকাতে চুলকাতে বলে “তুই যা। আমার মেলা কাম আছে।”

শিবু একবার অবজ্ঞার চোখে ওর দিকে তাকায় তারপর পিচিক করে পিকটা ফেলে উঠে চলে যায়। হরেন আবার ভাবনায় হারায়। দুনিয়াটাই শালা জালি। যতদিন স্বার্থ আছে মাথায় করে রাখবে। স্বার্থ শেষ তো তুমি ভাঙা কুলোর চেয়েও কমদামী। তখন‌ তোমাকে অকারণে পায়ের নীচে পিষে ফেলতেও কারোর কিছু মনে হবে না। হরেন মাঝে মাঝে ভাবে মানুষ হয়ে জন্মানোটাই পাপ। আর কোনো পশু মানুষের মত এমন নেমকহারামি বা অকারণে অত্যাচার করে না। কিন্তু ওর মাথায় ঢোকে না এই সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে শীলার মধ্যে তো কখনো কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। যখন প্রথম প্রথম এ বেশ্যা পাড়ায় এলো তখন খুব কাঁদতো। কাস্টমার চলে গেলে ব্যথায় বসতে পারত না, শুতে পারত না। ক্ষান্ত বুড়ি দিনের বেলায় ঘরের ছিটকানি লাগিয়ে তেল মালিশ করে দিত। তাতে ব্যথা কমতো কিনা জানে না। তবে বুড়ি যে ওর খুব যত্ন-আত্তি করতো সেটা বুঝত। ক্ষান্ত বুড়ি যখন মাঝে মধ্যে শীলাকে শীতের দুপুরের রোদে চুলে তেল দিয়ে দিত কিংবা ঘরের আঁচারটা বাটিতে করে এনে দিত হরেন তখন দাঁড়িয়ে যেত। রক্তের সম্পর্কহীন মা মেয়ের চোখের দৃষ্টিতে ভালোবাসা, টান, মায়া ঝরে পড়ত সেটাই হরেন লোভী দৃষ্টিতে দেখত। জন্ম থেকে ভালোবাসা কী হরেন জানে না। তবু কী এক দুর্বোধ্য মনকেমনের বুকভরা ব্যথা নিয়ে কোনো এক শীতের দুপুরে, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে সেই অসম্ভব অধরা জিনিসটাকে বোঝার চেষ্টা করত। হরেন এ পাড়ায় অজস্র শরীর দেখেছে, লোলুপ হিংস্র শরীরের খিদে দেখেছে। গোটা দুনিয়াকে দেখেছে কীভাবে সবাই ছোটে টাকা, মেয়ে-শরীর আর ক্ষমতার পিছনে। জীবনে কম কিছু দেখেনি। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এই যে এক জীবনেই সে কত হাজার জীবনের ছবি দেখে নিয়েছে এ বেশ্যা পাড়ায় না থাকলে হয়তো জানা হত না। তবু আবার কতকিছু‌ই না অদেখা, অজানা, অধরাও রয়েছে। এখানেও প্রতিদিনের অভ্যাসের রুটিনে কত আশ্চর্য‌ই ঘটে। যেমন এক ভরা মজলিসে একদিন শীলা ক্ষান্ত বুড়িকে ‘মা’ বলে ডেকেছিল। তাই নিয়ে কম হাসাহাসি হয়নি! মেয়েরা এ ওর গায়ে হেসে ঢলে পড়েছিল। জোরে জোরে অশ্রাব্য গালি পাড়তে পাড়তে মাগিরা বলে উঠেছিল, “আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। বেশ্যাপাড়ায় আবার মা বাপ ভাই বোন সম্পর্ক সোনার পাথর বাটি। এখানে খালি টাকা আর শরীরের সম্পর্ক।”
কিছুজন তো হিংসায় জ্বলে পুড়ে ধমকিও দিয়েছিল “ভালো চাস তো শুধরে যা মাগী। মা বোন পাতিস শশ্মানে। এখানে নয়। এ হল কামলীলাক্ষেত্র। এখানে কাম ছাড়া ঈশ্বর নাই।”

হরেনের মনে পড়ল সেই শীলা যখন যুবতী হলো ওর জন্য কাস্টমাররা মুখিয়ে থাকত। এমন‌ও হয়েছে একরাতে দুজন কাস্টমারকে একসাথে সার্ভিস দিতে হয়েছে। এখনো কি ওর জলবা কম! ‌এখনো চাইলে যে কোন পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। অথচ ও নাকি দিনদুপুরে মেয়েছেলে নিয়ে ঘরে দোর দিয়েছে। মেয়েমানুষ দিয়ে মেয়েমানুষের শরীরের চাহিদা মেটে নাকি! হরেন বসে বসে ভাবে আর দাঁদ চুলকায়। আরেকটা সিগারেট ধরাবে নাকি ভাবে। ধরাতে গিয়েও ভাবে সব‌ই নষ্ট। কিডনি নষ্ট, টাকা নষ্ট, জীবনের মুহুর্ত নষ্ট, বাতাস নষ্ট। জীবনটাই শালা পুরাই নষ্ট আর মনটা শালা সেপটিক ট্যাঙ্ক। সে গন্ধে নিজের‌ই গা গুলিয়ে ওঠে। হরেন তাই ক্রমাগত নিজের কাছ থেকেই পালায়, পালাতে চায়। তবু কী এক অভ্যাসবশে এ পাড়াতেই থেকে যায় দিনের পর দিন এই ক্লেদাক্ত পাপের ভিতরে।

সে কাস্টমারের খাতাটা মেলে ধরে। আজ কুড়িটা মাগীর  বুকিং হয়েছে। অর্ধেক অ্যাডভান্স‌ও পেয়েছে। হাত কাটা কালু আর হিসেব লেখে না। সে কাজটা হরেন পেয়েছে। কালু এখন এ বেশ্যা পাড়ার মাথা বলা যায়। ও যা বলবে তাই হবে। এই যে হরেন এখানে হিসাব রাখার কাজটা পেয়েছে তা কালুর জন্য‌ই। নাহলে এই বেটা শিবুই কালুকে কম তেল মালিশ করেনি কাজটার জন্য। বাপ মা মরা অনাথ হরেনের জন্য হাতকাটা কালুর বরাবর‌ই একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব ছিল। দুজনের বয়স পিঠাপিঠি হলেও কালু সবসময় বড় দাদার মত গার্জেনগিরি করেছে। কখনো কখনো বিনা কারণে শাস্তিও দিয়েছে। তবু হরেন তাতে কখনো মনঃক্ষুন্ন হয়নি। বরং কালুর এই গার্জিয়ানগিরি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে। তবু কেউ তো একজন আছে যে শাসন করে, স্নেহ করে, বিপদে সামলিয়েও নেয়। এটুকুই তো সে সারাজীবন চেয়ে এসেছে। একটু ভালোবাসা, একটু স্নেহ, একটু আশ্রয়।

কানে একটা হৈ হৈ আওয়াজ আসছে । হরেন উঠে দাঁড়ালো। কী হলো আবার। এ পাড়ায় ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে। মাগীগুলোর খুব মুখ। শরীর মনের জ্বালা জুড়ায় ওরা ইচ্ছে মতো অশ্রাব্য গালি দিয়ে। তাই কারণ থাকুক কিংবা না থাকুক দিন দুপুরে ওদের কোন্দল চলেই। হরেনের এসব গা সওয়া। কিন্তু শিবুর মুখে শীলার কথাটা শুনে আজ বসে থাকতে পারল না। এখুনি ওকে তাড়াচ্ছে নাকি শয়তানগুলো। একটু হেঁটে শীলার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েদের একটা জটলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমানে গাল পেড়ে যাচ্ছে শীলার ঘরের বন্ধ দরজাকে উদ্দেশ্য করে। শীলার‌ও মুখ কম না। এখনো যে ও বেরিয়ে তেড়ে গাল দেয়নি এতেই হরেন অবাক হয়ে গেল। তবে কি ঘটনা সত্যি। মাস দুয়েক আগেও এমন‌ই এক কানাঘুষা শুনেছিল। সেই মেয়েছেলেটাই নাকি আবার এসেছে। তিন্নি নাকি নিজের চোখে সেই মেয়েছেলেকে আর শীলাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে। এমন সময় কালু এল। এসেই পরপর লাথি মারল দরজায়, “এ পাড়ায় তোর জায়গা হবে না শীলা। দরজা খোল। বেরিয়ে যা এ পাড়া থেকে। ব্যবসা তুই লাটে তুলে দিবি। কাস্টমার যদি শোনে মেয়েতে মেয়েতে করেছিস কেউ আর আসবেই না এ পাড়ায়।” কালু আরো লাথি মারতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই শীলা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। ওর মুখ পাথরের মতো থমথমে। কালুর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো, “কেন জায়গা হবে না এ পাড়ায় শুনি? কী করেছি আমি? কী এমন মহাপাপ করে ফেলেছি যে এতদিনের আস্তানা আমাকে গুটাতে হবে? শরীর বেচার চেয়ে আর বড় পাপ কী আছে? কী শালার পুতেরা উত্তর দে। চুপ করে আছিস কেন?”

কালু একটু থমকায়। শীলার এমন রক্তচোখ, আগুনে লোহার তাওয়ার মত লাল হয়ে ওঠা ফর্সা মুখ দেখে কালুর নিরেট পাথরের মত মনেও আঁচ লাগে। সে নিজেকে একটু সামলিয়ে নরম গলায় বলে ওঠে “ওই মেয়েছেলে নিয়ে শুসনি তুই?”

“হ্যাঁ শুয়েছি। তো? বোন-বোনেতে জড়িয়ে শোয় না?”

কালু একটু ভড়কে গেল। পাড়ার সব মাগমাগীরা তামাশা দেখার জন্য জড়ো হয়েছে। তার মধ্যে থেকে তিন্নি এগিয়ে এসে বলল “বোন আবার কোত্থেকে এলো? এতোদিন তো দেখিনি। তার জন্য দরজা দেওয়া কেন রে মাগী?”

“কেন শরীর বেচি বলে মা বোন থাকতে নেই? নাকি দরজা লাগানোর অধিকার নেই?”

“বাপরে ! অধিকার! বেশ্যার‌ও আবার শোয়াশোয়ির জন্য অধিকার আছে নাকি বে?” শিবু লাল দাঁতগুলো বের করে খেঁকশিয়ালের মত খেঁকিয়ে ওঠে। তারপর নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে তিন্নির স্তনে খোঁচা মারে।

সপাট করে এক থাপ্পর শিবুর গালে এসে পড়ে। “আরেকবার গায়ে হাত দিয়েছিস তো শালা হাত‌ই ভেঙে ফেলব” শাসাতে শাসাতে তিন্নি পিছনদিকে ঘুরে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। তাতে শিবুর রসভঙ্গ হয় না। তিন্নির মুখভঙ্গির নকল করতে করতে বলে ওঠে, “দেখা দেখি কেমনতর বোন যার সাথে শোয়াশোয়ি চলে!”

মাগ মাগীর দল অসহিষ্ণু। এই কথার লড়াইয়ে তাদের আগ্রহ নেই। তারা চায় একটা রক্তারক্তি তুমুল মীমাংসা। শীলার জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা , হিংসার কমতি ছিল না কখনোই। এই এক সুযোগ পাওয়া গেছে শীলাকে উচ্ছেদ করার। তাদের মধ্যে থেকে শোরগোল ওঠে, ‘শীলাকে এ পাড়া থেকে তাড়াও। মাথা নেড়া করে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।’
শীলা লক্ষন বোঝে। তাই দাঁতে দাঁত চাপে। চোয়াল শক্ত হয়। তিন্নির মত আরেকটা থাপ্পরে শিবুর লাল ক্ষয়াটে দাঁতগুলো ভাঙার তীব্র ইচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে আটকায়। তারপর ঘরের ভিতরে চোখের ইশারা করতেই মেয়েটি বেরিয়ে আসে। কপালে একটা বড় জন্মদাগ। হরেন এক লহমায় চিনতে পারলো। এতো ক্ষান্ত বুড়ির বোবা মেয়েটা যাকে কিনা হরেনের সাহায্যেই বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলো শীলা যাতে ওর জীবনটা অন্তত শীলার মতো নষ্ট না হয়। সবাই তীক্ষ্ণ নজরে শীলার আর মেয়েটার মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজছিলো এবং খুঁজে না পেয়ে জয়ের আনন্দে, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠছিল। তাদের হিংস্র চোখের চাউনিতে হরেনের বুক কেঁপে উঠলো। সে কালুর দিকে এগিয়ে গেল। “ও শীলার আপন বোন। আমি চিনি কালুদা। ওকে ছেড়ে দাও।”

কালুর নিজেও শীলার এই পরিচয় দেওয়া মেয়েটাকে নিয়ে সন্দেহ ছিল। কেমন যেন চেনা চেনা। এ যে কোনো মতেই শীলার বোন হতে পারে না তা নিয়ে নিজেও শতকরাভাগ নিশ্চিত ছিল। তবু ব্যবসার খাতিরে শীলাকে একেবারে তাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষেও ছিল না। ভেবেছিল সবার রাগ পড়ে গেলে শীলাকে আবার এ পাড়ায় জায়গা দেবে। কিন্তু হরেনের কথায় ও চমকে উঠলো। কুতকুতে চোখগুলো আরো ছোট করে হরেনকে বুঝতে চাইলো। হরেনের কথার সত্যতা ওর চোখ দেখে যাচাই করতে চাইলো। কিন্তু হরেন নিষ্পৃহ। সে চোখে শুধু কালু সততা আর দৃঢ়তা‌ই দেখতে পেল। হরেন সবার দিকে ফিরে দৃঢ় গলায় সে‌ই এক‌ই কথা পুনরাবৃত্তি করল। সে স্বরে যেন কী ছিল সবাই এক এক করে পিছু ফিরতে লাগলো। এমনকি শিবুও একসময় তাল না পেয়ে সরে পড়ল। রঙ্গমঞ্চে শুধু হরেন, শীলা আর তার বোন পড়ে থাকল। শেষ বিকেলের আলোতে তখন সেখানে অপূর্ব এক ঘোর সৃষ্টি হয়েছে। সেই ঘোরেই কিনা জানা নেই শীলা হরেনকে বলে উঠলো “ও চোখে দেখতে পায় না। ওকে একটু গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসবে, দাদা?”

লেখক পরিচিতি : সুতপা সোঽহং
সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত। সুতপার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'জলের কোলাজ'রেনেসাঁস শারদ সন্মান ২০২৪ এ মনোনীত হয়েছে। অসংখ্য পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। লেখালেখির পাশাপাশি চিত্রশিল্পেও খ্যাতি লাভ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।