এক ঝলক আশা

লেখক : সম্বিত শুক্লা

মূল রচনাঃ

A GLIMMER OF HOPE

Written by T. Vijayendra

[[ অনুবাদকের মন্তব্য: বিজয়েন্দ্র তুঙ্গভদ্রা অর্থাৎ ‘বিজুদা’-র সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৮ সালের একেবারে শেষ লগ্নে। একটি বিকেল – অনেক তর্কবিতর্ক, আলাপ-আলোচনা…  সেই একটি বিকেল পাল্টে দিয়েছিল আমার ব্যক্তিগত বোধকে… প্রায় দ্বিগুণ বয়সী সেই “দাদার” জীবদ্দশায় এটিই শেষ লেখা – অন্তত আমার কাছে যা এসে পৌঁছেছে তার মধ্যে। এর আগে ওনার “যখন কবীর ডাকল সবারে…” অনুবাদ করার জন্য আমার উপর ভার পড়েছিল এই লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করার কিন্তু চিরাচরিত করছি-করব করে করে ওনার জীবদ্দশায় অনুবাদটি করে উঠতে পারিনি। আপাদমস্তক নাস্তিক, বাস্তববাদী, কমরেডের জন্য এই অনুবাদটি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।  ]]

গত কয়েক বছরে হঠাৎ করেই পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠেছে! আমরা গাজার মতো নৃশংস ঘটনা প্রথমবার দেখছি। দিগন্তে ঘনিয়ে আসছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘ। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী মানুষগুলোও আশাহত হয়ে পড়ছে, আর মানব ইতিহাসের সমাপ্তি আসন্ন বলে মনে হচ্ছে…

এখানে আমরা ‘এক ঝলক আশা’ দেখাতে চাই – এর বেশি কিছু না!

বিংশ শতাব্দীতে প্রগতিশীলরা আশার উৎস হিসেবে সবসময় কিউবার উদাহরণ দিতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কিউবা এখনও আশার উৎস। কিন্তু এখন আরেকটি উৎস আছে, অন্তত ভারতের ক্ষেত্রে – সেটি হ’ল কোভিড!

লকডাউনের ভারতে (India under lock down)

২০২০ সালের ২৪ মার্চ সন্ধ্যায়, ভারত সরকার সারা দেশে ২১ দিনের লকডাউনের নির্দেশ দেয়। এর ফলে ১৩৮ কোটিরও বেশি মানুষ গৃহবন্দী হয় কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধের জন্য। এই লকডাউন লাগু করা হয় ২২শে মার্চ ১৪ ঘণ্টার স্বেচ্ছা জনতা কারফিউ পালন এবং কোভিড আক্রান্ত দেশগুলিতে চালু হওয়া নিয়মাবলী জারি করার পর। তখনও ভারতে নিশ্চিত করোনা আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০ জনের মতো। লকডাউন ঘোষণার পর সারা দেশে এক বিরাট জনস্রোত তৈরি হয়, যা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বলা যায়। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই লকডাউন মহামারি বৃদ্ধির হার কমাতে সাহায্য করেছিল। এর ফলে, ৬ই এপ্রিলের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার হার ছয় দিনে নেমে আসে এবং ১৮ই এপ্রিলের মধ্যে তা আট দিনে নেমে আসে।

প্রথম দফার লকডাউনের ২১ দিনের সময়সীমা যখন শেষ হওয়ার মুখে, তখন রাজ্য সরকার এবং অন্যান্য উপদেষ্টা কমিটিগুলো লকডাউন বাড়ানোর সুপারিশ করে। ওড়িশা এবং পাঞ্জাব সরকার তাদের রাজ্যে লকডাউনের সময়সীমা ১ল মে পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এরপর মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ এবং তেলেঙ্গানাও একই পথে হাঁটে। ১৪ই এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমস্ত রাজ্যের রাজ্যপাল এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের লিখিত সুপারিশের ভিত্তিতে দেশব্যাপী লকডাউনের মেয়াদ ৩ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। তবে যেসব অঞ্চলে ভাইরাসের বিস্তার সীমিত বা ন্যূনতম ছিল, সেখানে ২০ এপ্রিলের পর কিছু শর্তসাপেক্ষ ছাড় দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়।

এরপর ১ মে, ভারত সরকার দেশব্যাপী লকডাউনের সময়সীমা আরও দু’সপ্তাহ বাড়িয়ে ১৭ মে পর্যন্ত করে। সরকার ভাইরাসের বিস্তার অনুসারে সমস্ত জেলাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে — সবুজ, লাল এবং কমলা — এবং সেই অনুযায়ী ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়। ১৭ মে, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (National Disaster Management Authority) লকডাউনের মেয়াদ ৩১ মে পর্যন্ত আরও বাড়িয়ে দেয়।

 (তথ্যসূত্র: উইকি)

ভারতে বিপ্লব (Revolution in India)

লকডাউন ভারতীয় জনগণের ভেতরে এক অভূতপূর্ব প্রগতি-বিমুখ সৃজনশীলতার জোয়ার তৈরি করেছিল, যা বিশ্ব আগে দেখেনি! প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া ছিল আরও বিস্ময়কর। এর কারণ কী ছিল? আমার মতে, শত শত বছরের দমন-পীড়ন এবং প্রগতির বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনই এর মূল কারণ। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হ’ল, লকডাউনের মতো পরিস্থিতি কি আবার ঘটানো সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তাহলে আশার ঝলক দেখা যাবে!

লকডাউনের শর্ত কী ছিল? এক কথায়: পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ ভাঙন! এখন, এই পতন আবার ঘটবে বলে আশা করার কি কোনও কারণ আছে? আমি মনে করি, পুঁজিবাদের স্থায়ী পতন বা ধ্বংসের আশা করার অনেক কারণ আছে।

সম্পদ হ্রাস (Resource Depletion)

মানুষ বেঁচে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে। অন্যান্য জীব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদ সম্পদের উপর নির্ভর করে, যা নবায়নযোগ্য। এগুলো ছাড়াও, মানুষ অনবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের মতো খনিজ এবং সোনা, রূপা, তামা ও লোহার মতো ধাতু। এগুলোকে অনবায়নযোগ্য বলা হয় কারণ এদের পরিমাণ নির্দিষ্ট এবং আমরা যত বেশি ব্যবহার করি, তত কম অবশিষ্ট থাকে। শিল্প সভ্যতার শক্তির প্রধান উৎস হ’ল পেট্রোলিয়াম এবং কয়লা, এবং এদের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া শিল্প সভ্যতার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এখন, এই অনবায়নযোগ্য সম্পদ উত্তোলনের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এম. কিং হাববার্ট এটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন খনিজ তেলের ক্ষেত্রে এবং নাম দিয়েছিলেন ‘পিক অয়েল’ (Peak Oil)। এই নিয়ম অনুযায়ী, যখন কোনো সম্পদের অর্ধেক উত্তোলন করা হয়ে যায়, তখন তার উৎপাদন কমতে শুরু করে। অর্থাৎ, মোট মজুতের অর্ধেক তুলে নেওয়ার পরই সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়। এই নিয়মটি একটি নির্দিষ্ট কূপ, একটি অঞ্চল, একটি দেশ, এমনকি সমগ্র বিশ্বের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আজ আমরা জানি যে এই নিয়ম শুধু তেলের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সমস্ত খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিজ্ঞানীরা প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময়কাল গণনা করেছেন। এবং, বিশ্বাস করুন; এদের বেশিরভাগই ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাবে, যার শুরুটা হবে তেল দিয়ে! এই তথ্য প্রায় নির্ভুল, সামান্য কিছু পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু মূল বিষয় হ’ল, বর্তমান শিল্প সভ্যতার অন্তিম লগ্ন উপস্থিত এবং এক দশকের মধ্যেই এর সমাপ্তি ঘটবে। শিল্প সভ্যতার এই পতন হবে ‘অভূতপূর্ব’ একটি ঘটনা, কারণ এটি মানব সমাজে গত কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসা চিরবর্ধমান সম্পদের প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটাবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রবক্তারা, যেমন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, বলেন যে সূর্য একটি অফুরন্ত সম্পদ এবং সৌর ও বায়ুশক্তি সহজেই জীবাশ্ম জ্বালানির জায়গা নিতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এর ফলাফল হতাশাজনক, কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা এখনও কমেনি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে জ্বালানি সরবরাহ, বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস সরাবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাসের কারণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি আবার কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ফিরিয়ে আনছে। সৌর এবং জলবিদ্যুৎ উভয়ের জন্যই প্রচুর ধাতুর প্রয়োজন হয়। সোলারের জন্য তামা এবং কিছু বিরল মৃত্তিকা মৌল (rare earths) দরকার হয়, যেগুলোর সরবরাহ কম এবং ভবিষ্যতে আরও কমবে।

এছাড়াও, সূর্যালোক ধারণ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে খালি জমির প্রয়োজন। মানুষ ইতিমধ্যেই অন্য প্রজাতির থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পৃথিবীর ৯০% এরও বেশি সম্পদ ব্যবহার করছে। এর ফলে অন্যান্য প্রজাতির প্রাপ্যাংশকে আরও ক্ষুণ্ণ করবে। একইভাবে, বায়ুশক্তি আকাশের অনেকটা অংশ দখল করে, যা পাখিদের জন্য বিপজ্জনক। আর এর বাইরে রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তির কারণে সৃষ্ট বিশাল পরিমাণ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের সমস্যা, যা ইতিমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে।

একটি তাত্ত্বিক যুক্তি অনুযায়ী, এই বিকল্প শক্তির উৎসগুলি অর্থাৎ সৌর, বায়ু, পারমাণবিক, হাইড্রোজেন ইত্যাদি সবই শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোকে উৎপাদন এবং ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো (ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন) সবই জীবাশ্ম জ্বালানি এবং অন্যান্য ধাতুর ওপর নির্ভরশীল, যা এখন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ, বিকল্প শক্তির উৎসগুলো ‘সম্ভাব্য’ হ’লেও ‘টেকসই’ নয়!

স্বল্প মেয়াদে, এমনকি নবায়নযোগ্য সম্পদও আমাদের সাহায্য করতে পারে না কারণ পুঁজিবাদী শিল্প সভ্যতা সেগুলোকে তাদের প্রাকৃতিকভাবে নবায়নের হারের চেয়ে বেশি হারে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ, যত নতুন গাছ বেড়ে উঠছে তার চেয়ে বেশি গাছ কাটা হচ্ছে; যতটা জল প্রাকৃতিকভাবে পূরণ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি জল ব্যবহার করা হচ্ছে, ইত্যাদি। সারা বিশ্বে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর নেমে যাচ্ছে। এই সম্পদগুলোকে আবার ‘নবায়নযোগ্য’ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তাদের উত্তোলন মারাত্মকভাবে কমাতে হবে, যার জন্য কয়েক দশক সময় লাগবে। প্রকৃতপক্ষে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনবায়নযোগ্য সম্পদের মতোই এগুলোকে নিঃশেষ করেছে।

সম্পদ নিঃশেষ হওয়ার ফলে পতন ঘটার আগে কিছু বছর সময় থাকলেও, বিশ্ব উষ্ণায়ন আমাদের কোনো সুযোগ দেবে না – যা নিয়ে নিচে আলোচনা করা হ’ল।

জলবায়ু পরিবর্তন (Global Warming)

জলবায়ু পরিবর্তন ইদানিং গণমাধ্যমে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে, কারণ সাম্প্রতিক IPCC রিপোর্ট পরিস্থিতির ভয়াবহতা কথা তুলে ধরে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । “যদি আমরা ১.৫ °C বিশ্ব উষ্ণায়নের নিচে থাকতে চাই, তবে নির্গমন ২০২০ সালের পরে আর বাড়তে পারবে না। ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে, এবং ২০৪০ সালের মধ্যে তা শূন্যে পৌঁছাতে হবে। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এক অভূতপূর্ব রূপান্তরের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার!” কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই ২০২০ সালের সেই সময়সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি।

বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল চালক। এগুলো ‘পার্টস পার মিলিয়ন’ (ppm) এ পরিমাপ করা হয় এবং নিরাপদ মাত্রা সর্বোচ্চ ৩৫০ ppm বলে বিবেচিত হয়, সঠিকভাবে বললে তার চেয়েও কম। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এগুলো নতুন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং সতর্ক করেছে যে “কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।” ২০২৩ সালের মে মাসেও এটি ৪২৪ ppm ছিল! সম্ভবত এটা বলা ঠিক হবে যে পদক্ষেপ নেওয়ার জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও সরকারই প্রকৃতপক্ষে নির্গমন কমাতে প্রস্তুত নয়। বরং, এই বছর তারা যুদ্ধ নিয়েই ব্যস্ত, যা নির্গমন আরও বাড়ায়। একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন যে আমরা ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছি এবং তারা বৈজ্ঞানিক সমাজকে বিশ্বব্যাপী নাগরিক অবাধ্যতা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন!

বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয় (Ecological Degradation)

২০২২ সাল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়ের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাবগুলোর সাক্ষী হয়েছে। ইউরোপে গত ৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনেও বিশাল এলাকাজুড়ে খরা দেখা দিয়েছে। এই অঞ্চলগুলো অত্যন্ত বিস্তৃত এবং এর মধ্যে রয়েছে অধিকাংশ ‘উন্নত দেশ’ ও বিশ্বের কিছু ‘খাদ্য ঝুড়ি’ (food baskets)। পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ৩ কোটি মানুষের উপর। ভারতে‌ও দেশের বিস্তীর্ণ অংশে বন্যার কবলে পড়েছে মানুষ।

বাড়তে থাকা বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা (Growing Inequality and Social Unrest)

বার্ষিক অক্সফাম রিপোর্টে বৈশ্বিক বৈষম্য বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই বৈষম্যগুলো বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। এই আন্দোলনগুলো জীবিকা সংকট এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, যা শুরু হয়েছিল কোভিড-১৯ মহামারী এবং পরবর্তী বিধিনিষেধের ফলে, এবং যা আরও তীব্র হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সম্পদের ক্ষয়, বাস্তুতন্ত্রের, জনগণের ক্রমবর্ধমান আন্দোলন এবং পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ—এই সব মিলিয়ে গোটা বৈশ্বিক ব্যবস্থার পতনের সম্ভাবনা তৈরি করছে।

ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কা এবং আরও ২৭টি ছোট দেশ পতনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে আমরা মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে এবং উচ্চ মজুরির দাবিতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডসে ব্যাপক ধর্মঘট দেখেছি। আগামী বছরগুলোতে আরও অনেক ছোট ও মাঝারি দেশ এই পথ অনুসরণ করবে, এবং তারপর হয়তো বড় দেশগুলোও হাম্পটি ডাম্পটির মতো ভেঙে পড়বে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের সাম্প্রতিক পতন দেখায় যে এই পতন শুরু হয়ে গেছে। যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা যায়, পুঁজিবাদ এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে না, এবং এগুলোর মধ্য দিয়ে টিকে থাকাও সম্ভব নয়। আমাদের বিকল্প পথের দিকে এখনই কাজ শুরু করতে হবে।

সমাজ পুনর্গঠন (Rebuilding Society)

চমস্কি একবার বলেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীকে রক্ষা করার ভার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপরই পড়ে এসেছে। এখন সময় এসেছে অন্যদেরও সেই দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার। গত কয়েক বছরে অনেক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, অন্যরাও সত্যিই তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন!

অ্যানার্কিস্ট ভাবধারায়, অনেক মানুষ পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে ‘অফগ্রিড জীবনযাপন’ (‘offgrid living’) শুরু করেছেন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় – নিজেদের জীবন নিজেরাই পুনর্গঠন করছেন।

তাহলে কি আশার আলো আছে? (So is there a hope?)

হ্যাঁ, আমি মনে করি আছে। পুঁজিবাদ চিরকালীন শক্তির উৎস খুঁজে চলেছে, যা কখনো শেষ হবে না। আমার মতে, এটি একেবারেই আশাহীন প্রচেষ্টা। অন্যদিকে, অনেক সাধারণ মানুষ আবার মাটির কাছাকাছি ফিরে আসছেন, এবং আমাদের নবায়নযোগ্য সম্পদের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করছেন। যদি পৃথিবীর বাকি অংশও তাদের সঙ্গে যোগ দেয় — লকডাউনের সময়ের মতো এবার যদি স্বেচ্ছায়  অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কমিয়ে দেয় — তাহলে মানবজাতির টিকে থাকার একটা লড়াকু সম্ভাবনা তৈরি হবে। চলুন, আমরা সবাই একসঙ্গে সেই পথের পথিক হই!


লেখক পরিচিতি : সম্বিত শুক্লা
সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্বিত শুক্লা গল্প, কবিতা ইত্যাদি লেখেন 'ইচ্ছেমৃত্যু' ছদ্মনামে। প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি লেখা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যেখানে গল্প, কবিতার রূপকের বাইরে বেরিয়ে যুক্তি ও তথ্যের দায় বেশি। জীবিকার পাশাপাশি সববাংলায় এর কাজেই দিনের বেশিটা সময় অতিবাহিত হয় বাকিটা কাটে বইপত্র ও লেখালিখি নিয়ে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।