তুঙ্গনাথের পথে ।। দ্বিতীয় পর্ব ।। আজ সারাদিন তুঙ্গনাথে

লেখক: কৃষ্ণাশীষ রায়

পূর্ব কথা : হাওড়া থেকে ট্রেন এ চেপে হরিদ্বার। হরিদ্বারে সে রাত্রে থেকে পরদিন সকালে রওনা হয়ে দুপুরে পৌঁছলাম সারি গ্রাম। সেখান থেকে ৩ কি.মি হেটে দেওরিয়া তাল।দেওরিয়া তালের ধারে তাঁবুতে রাত্রি যাপন। তার পরদিন সকালে চোপ্তার উদ্দেশে পাড়ি। ২২ কিমি পথ মোটামুটি ১০ ঘন্টায় অতিক্রম করার পর সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ পৌঁছলাম আমাদের সেদিনকার গন্তব্যস্থলে, চোপ্তায়। চোপ্তা’র কাঠের ঘরে কনকনে ঠান্ডা রাত, আর আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি, ঘুমকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে কোনো দেরী করল না।

চলার পথে (চোপ্তা ‘র কাছে) | চিত্রগ্রহণ : লেখক

দিন ৫: সকাল শুরু হল চূড়ান্ত ব্যস্ততা দিয়ে। মঙ্গোল সিং-এর কাছে কিছু মাল রেখে দিয়ে, দরকারি সব জিনিসপত্র একটা স্যাকে ভরে এলাম চোপ্তা মার্কেটে। সেখানে আমরা কেউ ম্যাগি কেউ আলুর পরোটা দিয়ে প্রাতরাশ করে রওনা দিলাম তুঙ্গনাথ মন্দির এর উদ্দেশ্যে। এই রাস্তা চড়াই হলেও বাঁধানো কংক্রিটে। হাঁটতে মন না-চাইলে খচ্চর  আছে মাল ও মানুষ দুইই বইবার জন্য। তবে আমরা হাঁটাকেই শ্রেয় মনে করলাম। মোটামুটি ৪ কিমি রাস্তা। সকাল ৯ টা  নাগাদ রওনা দিয়ে ১২ টা নাগাদ পৌঁছলাম তুঙ্গনাথ এর মন্দিরের সামনে। রাস্তার বর্ণনা বলতে গেলে যেটা বলতেই হয় সেটা হল কিছুদূর অন্তর অন্তর  পাহাড়ের বুকে অফুরন্ত তৃণভূমি, ইংরেজিতে যাকে বলে “Meadows”। সেখানে ঘোড়া, খচ্চর, গরু ইত্যাদিদের দেখা গেল ইতস্তত ঘুরে ঘুরে আহার সারতে। পশ্চাৎপটে আঁকা চোখাম্বা, ত্রিশূল, সুমেরু ইত্যাদি সুউচ্চ শৃঙ্গগুলি। তাছাড়া মাঝে মধ্যে ঘন জঙ্গলও পেরোতে হল, তবে তার ঘনত্ব রোহিনী বুগিয়ালের থেকে অনেকটাই কম।

চোপ্তা থেকে তুঙ্গনাথ | চিত্রগ্রহণ : লেখক
চোপ্তা থেকে তুঙ্গনাথ | চিত্রগ্রহণ : লেখক

মন্দিরে পৌঁছে মন্দির দৰ্শন করে আমরা উঠলাম উত্তরাখণ্ডের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা থাকার জায়গায়। আমরা থাকলাম দোতলায়। সামনে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি আমাদের এই বাড়িটি তুঙ্গনাথ অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত, তাই চারপাশটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করা যাচ্ছে। হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হবার পর পুজো দেওয়ার পালা। মন্দিরের পাথরের শান দেওয়া মেঝেতে উঠেই যেটা প্রথম রোমাঞ্চ জাগল এটা মনে হয়ে যে এর উপরে আর কোনো মহাদেব এর মন্দির বানানো নেই, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দেবাদিদেব মহাদেব এর মন্দির। পুজো, প্রসাদ গ্রহণ পর্ব শেষে রীতি মেনে মন্দির চত্বর একবার প্রদক্ষিণ করলাম। প্রদক্ষিণ করতে গিয়েই প্রথম চোখে পড়ল চন্দ্রশীলা শৃঙ্গ, যেখানে আমরা আগামীকাল ভোরে যাব সূর্যোদয় দেখতে। এখানে তুঙ্গনাথ সম্পর্কে কয়েকটা দরকারি তথ্য দিয়ে রাখি – তুঙ্গনাথ হল তৃতীয় কেদার। পাঁচ কেদারের মধ্যে এটিই উচ্চতম। তুঙ্গনাথ ভ্রমণের আদর্শ সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। মন্দিরটি বছরে প্রায় ছ’ মাস বরফাচ্ছন্ন থাকে। সেই সময় দেবতা পূজিত হন মোক্কুমঠে। এপ্রিল-মে মাসে মন্দির খোলে আবার।

তুঙ্গনাথ মন্দির | চিত্রগ্রহণ : লেখক

যাই হোক, মন্দির প্রদক্ষিণ তো হল, এদিকে তখন আমাদের পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। তখন মনে হতে লাগলো মনীষীরা ঠিকই বলে গেছেন, খালি পেটে ভক্তি হয় না। সুতরাং তাৎক্ষণিক উপায়, ম্যাগি। মন্দিরের সামনেই ছোট দোকান, সেখানে টালির ছাদের নিচে টেবিল পাতা, চেয়ারগুলির উপরে দুই পরত  কম্বল। এটাই এখানকার রীতি, পশ্চাৎদেশ বরফশীতল হাওয়ার থেকে রক্ষা করতে। আমাদের সবার পরণে  তখন সোয়েটার, জ্যাকেট নিয়ে মোটামুটি ৩ টি করে গরম পোশাক, বেলা তখন ২:৩০টা। ২ প্যাকেট ম্যাগি সবে শেষ করে ১ কাপ কফি নিয়ে বসেছি জমিয়ে আড্ডা দেব বলে, মুহুর্মুহু 8 – ৫ টা অপার্থিব হুঙ্কারে কেঁপে উঠল আমাদের চারপাশ। কী হয়েছে বুঝতে-না বুঝতেই শুরু হল বর্ষণ। এখানে বলে রাখি, সামান্য বাজ পড়ার শব্দ আমাদের অপার্থিব মনে হওয়ার একটাই কারণ, এই কলকাতা শহরে শোনা বাজের শব্দ আর ১২৫০০ ফুট উচ্চতায় সেই শব্দের কোনো মিল খুঁজে পাইনি আমরা। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হওয়ার ফলে তার গভীরতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাহাড়ি বৃষ্টির রূপ যারা দেখেছেন তারাই জানেন।

অগত্যা আমাদের আড্ডা আরও প্রসারিত হল। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বৃষ্টি একটু ধরলে, আমরা সেই দোকানে রাতের জন্য খিচুড়ি আর আলুভাজা অর্ডার দিয়ে ঘরে এলাম। তুঙ্গনাথে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। পরিচারক ঘরে সোলার লাইট দিয়ে গেল, কিন্তু সেটির আয়ু কতক্ষণ থাকবে বোঝা গেল না। সন্ধ্যে সবে ৬:৪০, মনে হচ্ছিল মধ্যরাত। কিন্তু সেই হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় ৩টা  লেপের তলায় ঢুকে সোলার লাইটের ঢিমু ঢিমু আলোয় পরের তিন ঘন্টার আড্ডাটা যে অনেকদিন এক টাটকা বাতাসের মতো কাজ করবে সেটা এখন এই লেখাটা লিখতে গিয়ে বেশ টের পাচ্ছি। খিচুড়ি আসতে বেশ দেরি হচ্ছিল, আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম এবার। পরদিন ভোর ৪টের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে চন্দ্রশীলা পিকের উদ্দেশ্যে, যথাযথ বিশ্রামেরও প্রয়োজন সকলের। অবশেষে রাত ১০:৩০ নাগাদ প্রেসার কুকারে করে খিচুড়ি এলো, সঙ্গে আলুভাজা। থার্মোকলের থালায় পরিবেশন করে খাওয়া শেষ করতে আমাদের ৯ জনের লাগলো পাক্কা ১৫ মিঃ। সত্যি কী হারে  ছুঁচো ডন মারছিল !

তুঙ্গনাথ এ রাতের খাবার।

খাওয়া শেষে আমরা সবাই যে যার ঘরে চলে এলাম। বাইরের শব্দে মালুম হল, বৃষ্টিটা  আবার বেড়েছে । আমরা সবাই প্রমাদ গুনলাম, পরদিন কি আমরা সত্যিই যেতে পারব চন্দ্রশীলা, কারণ এই টানা বৃষ্টিতে এই পার্বত্য অঞ্চল বিপদসংকুল হয়ে ওঠে বললেও কম বলা হবে। যা থাকে কপালে। এই সব ভাবনায় ভাসতে ভাসতে পাড়ি দিলাম ঘুমের দেশে।

ক্রমশ


লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণাশীষ রায়

কৃষ্ণাশীষ রায় একজন ভ্রমণ পিপাষু মানুষ। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরতে এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালিখি করতে ভালোবাসেন।

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< তুঙ্গনাথের পথে ।। প্রথম পর্ব ।। দেওড়িয়া তাল ও চন্দ্রশীলা পর্বতশৃঙ্গতুঙ্গনাথের পথে ।। তৃতীয় পর্ব ।। চন্দ্রশীলা – উচ্চতা ৪১০০ মিটার >>

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum