লেখক: কৃষ্ণাশীষ রায়
পূর্ব কথা : কলকাতা -> হরিদ্বার (রাত্রি যাপন) -> সারি গ্রাম .. দেওরিয়া তাল (রাত্রি যাপন) -> চোপ্তা (রাত্রি যাপন) -> তুঙ্গনাথ (২ রাত্রি যাপন) -> চোপ্তা -> কনকচৌরি
আমাদের এখন অবধি যাত্রাপথ উপরের ছোট্ট নোটটিতে দিয়ে রাখলাম |
দিন ৬ : তুঙ্গনাথ থেকে নেমে এসে মঙ্গোল সিং এর ডেরায় পৌঁছে আমাদের ব্যাগপত্তর তুলে দিলাম গাড়িতে। এখান থেকে আমরা যাবো কনকচৌরি। চোপ্তা থেকে কনকচৌরির দূরত্ব ৫২ কি.মি। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে আমাদের লাগল ঘন্টা তিনেক। এটি গাড়ির রাস্তা, এতদিন যা নয়নাভিরাম দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে এসেছি তুলনায় এই রাস্তা তার সমকক্ষ না-হলেও মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে অপরূপ উপত্যকাগুলি চোখ টানছিল।
কোনোকচৌরিতে পৌঁছলাম, তখন বিকেল ৩টা। উঠলাম মায়াদীপ হলি’ডে হোমে। হলি’ডে হোমটি আদতে একটি পাহাড়ের ঢালে, রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা নিচে। পৌঁছে দেখলাম এটি ইকো-ট্যুরিজম আদলে তৈরি কিছু কটেজ। বাঁশের তৈরি সব কটেজগুলি, কিন্তু ভেতরে আধুনিক সব কিছুরই সুব্যাবস্থা আছে, যেমন ডিশ টেলিভশন, ইন্টারকম, ঘর সংলগ্ন গিজার সমেত বাথরুম। অনেকদিন পরে যেন আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া গায়ে লাগল।
ঘরে জিনিসপত্র রেখে, সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে হল খাবারের দোকান। বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, অসময়ের দুপুরের খাওয়া সারলাম আলুভাজা, ডিমের ওমলেট, ডাল আর ভাত দিয়ে। চোপ্তা থেকে বেরোনোর আগেই ফোন করে এই দোকানে আমাদের খাবার কথা বলে রাখা ছিল।
খাওয়া শেষ করতে করতে সোয়া পাঁচটা বেজে গেল। বেলা শেষ হওয়ার আগে আমরা আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে লাগলাম।
ছোট্ট জনপদ কনকচৌরি, রুদ্রপ্রয়াগ-পোখরি রোডের ধারে পড়ে এই গ্রামটি। এখান থেকে রুদ্রপ্রয়াগ মাত্র ৪০ কি.মি। পরের দিন ভোরে আমাদের কার্তিকস্বামী মন্দিরে যাওয়ার কথা। রাস্তার ধারেই একটি গেট তৈরি করা হয়েছে, যেখান থেকে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটি শুরু হয়েছে। ওই অঞ্চলের লোকেদের মুখে শুনলাম আর দিন পনেরো পরে এক বড়ো উৎসব হবে এই কার্তিকস্বামী মন্দিরে তথা কোনোকচৌরিতে। তাই হয়তো গ্রামের বাসিন্দাদের জটলা বেঁধে পুজোর সামগ্রী, নতুন জামাকাপড় এইসব কেনাকাটা করতে দেখা গেল। দেখতে দেখতে সূর্য পাটে গেল। এই গ্রামে বিদ্যুৎ আছে, সুতরাং আলোর অভাব বোধ করলাম না। তবে এতদিনের অভ্যাসের বশেই আর পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যই আমরা আলো নিভিয়ে বাইরে চেয়ার এনে বসলাম গোল করে। ঝকঝকে আকাশ, তারার মিটমিট আর দূরে পাহাড়ি ঘরবাড়ির জোনাকির মতো আলো সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
এতদিনের ধকলের জন্যই বোধহয়, আমাদের চলার গতি অন্যদিনের তুলনায় কিছুটা শ্লথ ছিল। মন্দির চত্বরে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সোয়া সাতটা। ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ, সামনে পশ্চিমদিকে ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে চোখের সামনে গগনচুম্বী হয়ে দাঁড়িয়ে বান্দার পুঞ্চ, কেদার ডোম, মেরু, সুমেরু, চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ, দ্রোনগিরি, নন্দা ঘুন্টি, ত্রিশূল, নন্দা দেবী পর্বতমালা।
দেবাদিদেব মহাদেবের বড় ছেলে কার্তিকেয়, তাঁরই নামাঙ্কিত মন্দির এই কার্তিকস্বামী মন্দির। কার্তিকস্বামীকে যুদ্ধ এবং জয়ের প্রতীক বলে মানা হয। এই একই দেবতা তামিলনাড়ুতে মুরুগণস্বামী, কর্নাটকে সুব্রহ্মণ্য এবং আমাদের বাংলায় কার্তিকেয় রূপে পূজিত হন। মন্দিরের উচ্চতা ৩০৫০ মিটার। জনশ্রুতি আছে এইখানে একটি মার্বেলের পাথরের উপর কোনও এক কালে প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরি হয়েছিল এই কার্তিকস্বামীর অবয়ব।
আমাদের সেদিনই ফেরার কথা হরিদ্বার। ৮-১০ ঘন্টা গাড়ির জার্নি। তাই আর বেশিক্ষণ থাকা হল না কার্তিকস্বামী মন্দির চত্বরে, এবারে নামার পালা। উৎরাই-এ নামতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। সকাল ১০টা নাগাদ কোনোকচৌরিতে এসে পৌঁছলাম। ডিম্ পাউরুটি দিয়ে জলযোগ সেরে উঠলাম গাড়িতে। নাঃ, ফেরার রাস্তার আর কোনও বর্ণনা দেব না, তখন কিছুক্ষণের জন্য মনের মধ্যে ফ্ল্যাশব্যাক চলছিল আমাদের প্রথমদিন ট্রেনে ওঠার সময় থেকে, দেওড়িয়া তাল, রাম সিং -এর আধ সেদ্ধ খিচুড়ি, রোহিনী বুগিয়াল-এর বৃষ্টিতে মাখামাখি পরোটা আচার, দুর্ভেদ্য জঙ্গল, তুঙ্গনাথ – চন্দ্রশীলা – কার্তিকস্বামীর স্বপ্নীল কিন্তু অতীব বাস্তব ভূদৃশ্য। মাঝে এক জায়গায় দুপুরের খাওয়া সারলাম, জায়গাটা তেহারি জলাধারের কাছাকাছি। হরিদ্বার ঢোকার মুখে পেরোলাম সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যান। গুটিকতক ময়ূর আর বাঁদর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। হরিদ্বার পৌঁছে যার যার মতো আমরা ঘুরে কেনাকাটা করলাম। সন্ধ্যা হলে গেলাম হর কি পৌরি ঘাট এ, সেখানে গঙ্গায় প্রদীপ ভাসালাম। তারপর হোটেলে ফিরে, গোছগাছ সম্পূর্ণ করলাম |
তারপর …………আবার কু ঝিক ঝিক .…….. কলকাতা .. রুকস্যাক খালি করা.. ট্রেক শ্যু-র জমাট কাদা পরিষ্কার করা, পরদিন থেকে রুকস্যাকের বদলে ল্যাপটপ ব্যাগ আর ট্রেক শ্যু-র জায়গা নেবে ফর্মাল শ্যু …… দৈনন্দিন জীবনে ফেরা, যেটাও অত্যন্ত দরকার ভ্রমণের আর্থিক সঙ্গতির জন্য, আর অপেক্ষা করা আবার ব্যাগ বদলাবার, জুতোয় কাদা লাগাবার দিনটার জন্য ! …….
লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণাশীষ রায়
কৃষ্ণাশীষ রায় একজন ভ্রমণ পিপাষু মানুষ। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরতে এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালিখি করতে ভালোবাসেন।