লেখক: শর্মিলা ঘোষনাথ
অচেনা মুখ চেনা সম্পর্ক – প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
(আত্মীয় তো তাঁরাই, যাঁরা আমাদের আত্মার খুব কাছের। হাত বাড়ালেই যাঁদের কাছে পাওয়া যায়। বাধা বিপত্তি এসে যখন চারপাশের জগতকে থমকে দিয়েছে বলে মনে হয়, তখন আবার যাঁরা নতুন করে জীবন পথে চলার ভরসা যোগান- তাঁরাই তো প্রকৃত আত্মীয়। সে সম্পর্ক কি শুধুমাত্র বংশলতিকা বা পারিবারিক যোগসূত্রের ক্ষুদ্র বন্ধনে বেঁধে রাখা যায়? আমার জীবনের পথ চলার অভিজ্ঞতা কখনই তা মানতে পারে না। চলার পথে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এমন অনেক মানুষ এসে চোখে- অন্ধকার- দেখা মূহুর্তে আমার সামনে অযাচিতভাবে হাত বাড়িয়ে সামলে দিয়েছেন, ভেঙে পড়তে দেননি। ঈশ্বরকে দেখা যায় না কিন্তু কোন কোন সময়ে মনে হয় তিনি বোধহয় মানুষের রূপেই কাণ্ডারী হয়ে এসে ঝড়- তুফানে টলমল নৌকোটির হাল ধরে পার করিয়ে দেন, নতুন করে আলোর দিশা দেখান, আর মনে করিয়ে দেন “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিও না”।
সেইসব মানুষদের কারুর মুখ মনে আছে, কারুর বা মুখ মনে নেই, কিন্তু আজ আমার করজোড়ে তাঁদের প্রত্যেককে বলতে ইচ্ছে করে, “তোমরা সবাই আমার পরমাত্মীয়, আমার জীবনে তোমরা না থাকলে হয় আমিই থাকতাম না অথবা জীবনটা এ রকম থাকত না তোমাদের ভুলি কী করে?” তেমন কিছু মানুষের গল্প নিয়ে আজ আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।)
ট্রেন যখন পৌঁছালো, ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই। স্টেশন চত্বরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝখানের একটুখানি ছাউনি দেওয়া অংশে টিমটিম করে কয়েকটা টিউব লাইট জ্বলছে, বাকি প্ল্যাটফর্মে আলো জ্বালিয়ে অকারণে বিদ্যুতের খরচ বাড়ানো- কর্তৃপক্ষ সম্ভবত প্রয়োজনীয় মনে করেননি, তাই কোন আলো লাগাবার ব্যবস্থাও চোখে পড়ছে না। বর্ধমান জেলাশহর থেকে বেশ দূরে সিঙ্গল লাইনবিশিষ্ট এই অখ্যাত রেল স্টেশনে এত রাতে, কাজ থেকে ঘরে ফেরা গুটিকয় মানুষ ছাড়া কেউ ট্রেন থেকে নামেন না। পুরো স্টেশন চত্বরটা নিত্যযাত্রীদের, হাতের তালুর মত করে চেনা। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ক্লান্ত শরীরগুলোর ঘরে ফেরার তাড়াও কম নয়, তাই ট্রেন থামার পর মানুষের আনাগোনা, কথোপকথনের শব্দে যাও বা স্টেশন চত্বরে একটু প্রাণসঞ্চার হয়েছিল, কয়েক মূহুর্তের মধ্যে খালি হয়ে আবার নিঃঝুম হয়ে গেল। কাঁধে নেওয়া ছোট জামাকাপড়ের ব্যাগ আর পার্স নিয়ে অন্ধকারে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি ঠিক করে উঠতে পারছিল না কী করা উচিত।
অফিসের একটি সেমিনারে যোগ দিতে আসা, হিমঘর সংক্রান্ত সেমিনার। আলু হিমঘরে মজুত করার কাজে সমস্যা ও সমাধান নিয়ে পরস্পরের অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত জানার জন্য এই আলোচনা চক্র। এই অঞ্চলে আলুর উৎপাদন প্রচুর তাই হিমঘরের সংখ্যাও অনেক। এখান থেকে দূরে শহরে আয়োজন করলে চাষী, হিমঘর মালিক বা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য – সবার পক্ষে অংশগ্রহণ করা অসুবিধার হবে তাই সবার স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা চক্রটি এই অঞ্চলের একটি হিমঘর চত্বরেই আয়োজনা করা হয়েছে। গ্রাম্য অঞ্চল বলে কাছাকাছি কোন হোটেল বা থাকবার উপযুক্ত জায়গা নেই, তাই দূর থেকে আগত অংশগ্রহণকারীদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও আশপাশের বিভিন্ন হিমঘরের অতিথিশালায় করা হয়েছে। কলকাতা শহর থেকে অনেকটা পথ, পরের দিন সকালবেলা সেমিনার শুরু তাই সরকারী আধিকারিকদের আগের দিন অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কলকাতায় জন্মে, বড় হওয়া মেয়েটির, অফিসের কাজে গ্রামাঞ্চলে আসা এই প্রথম নয়, কিন্তু এইভাবে একা এত রাতে কোথাও পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো হয়নি। তার ওপর এই জায়গাটিতে প্রথমবার আসা, তাই সম্পূর্ণ অচেনা। সরকারী অফিসে আধিকারিকদের মধ্যে কনিষ্ঠতম সদস্য হিসাবে যোগদান করার পর থেকে, বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকরা তাকে কন্যা বা ভগিনীর নজরে দেখেন। কখনোও অফিসিয়াল ট্যুরে একা আসতে দেন না, এক বা একাধিক জন সবসময় সঙ্গে থাকেন। খোলামেলা পরিবেশে অভ্যস্ত, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা মেয়েটির মাঝে মাঝে, সেইসব বয়সে অনেক বড়, রক্ষণশীল উর্ধ্বতনদের, অতিরিক্ত অনুশাসনের বাঁধনে দমবন্ধ লাগে, বিদ্রোহ করে বলতে ইচ্ছে করে যে সে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে, এত বিধিনিষেধের প্রয়োজন নেই। কিন্তু মা বলেন, “যতই হোক, তোমাকে নিরাপদে রাখায় তো ওঁদের কোন স্বার্থ নেই। ওনারা তোমাকে স্নেহ করেন, তোমার মঙ্গল চান, তাই নিজেদের মত করে আগলে রাখেন। ওঁদের সেই শুভ উদ্দেশ্যকে অসম্মান করতে নেই।” অগত্যা সব কিছু চুপ করে মেনে নিতে হয়।
এবারেও বেশ কিছু বরিষ্ঠ আধিকারিকদের সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে একজোট হয়ে আসবার কথা ছিল কিন্তু সদ্য স্বামীহারা মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। বাড়িতে তার দুদিনের অনুপস্থিতির কারণে যাতে মায়ের কোন অসুবিধা না হয়, সে সব দেখতে গিয়ে বেরোতে দেরী হয়ে গেল। হাওড়ায় পৌঁছে জানা গেল নির্দিষ্ট ট্রেন অনেক আগেই ছেড়ে গেছে। তখন মোবাইলের যুগ আসেনি তাই খবরাখবর নেওয়ার এত সুবিধা ছিল না। হয়তো অন্যরা ভেবেছেন কোন কারণে মেয়েটি আসতে পারবে না, তাই তাঁরা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন। অচেনা জায়গায় একা যাওয়ার সাহস না করে হয়তো বাড়িই ফিরে যেত মেয়েটি কিন্তু হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আরেক খুব পরিচিত সিনিয়ার সহকর্মীর সঙ্গে, তিনিও স্টেশনের ট্রেন ধরতে এসেছেন একই সেমিনারে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। মেয়েটি বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে তাঁর সঙ্গে ট্রেনে উঠে পড়ল। গল্প করতে করতে বেশ ভালোই যাওয়া হচ্ছিল, হঠাৎ সেই দাদাস্থানীয় সহকর্মীটির মনে পড়ল কাছেই তাঁর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকেন যাঁর সঙ্গে, সুযোগের অভাবে, বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি ঠিক করলেন সেদিনের রাতটা সেই আত্মীয়ের বাড়িতে কাটিয়ে পরের দিন ঠিক সময়ে সেমিনার শুরু হওয়ার আগেই অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে যাবেন। মেয়েটিকে জানালেন সে কথা, সঙ্গে তাঁর সাথে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাবও দিলেন। সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা বাড়িতে থাকার সেই প্রস্তাবে মেয়েটি সম্মত হতে পারল না। তাছাড়া তখন মোটে বিকেল ৪টের মত বাজে, আকাশে সূর্যের আলো ঝলমল করছে, সহকর্মী দাদার কাছ থেকে জানা গেছে যে সেখান থেকে নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছাতে বড়জোর দেড়- দু’ঘন্টা লাগবে। বাইরে থেকে আগত অতিথিদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে স্টেশনে সরকারী গাড়ির ব্যবস্থাও থাকার কথা, তাহলে চিন্তা কী?
সহকর্মী নেমে গেলেন, ট্রেনও ছেড়ে দিল কিন্তু তারপরেই শুরু হল বিপত্তি। সিঙ্গল লাইন, প্রতিটি স্টেশনে, উল্টোদিক থেকে আসা সব ট্রেনকে পথ দিতে গিয়ে, এই ট্রেনটি অনেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে হতে ঐটুকু পথ যেতে ২ ঘন্টার জায়গায় কখন যে ৪ ঘন্টা পার হয়ে গেল, বোঝাই গেল না। মেয়েটির আর কিছু করার ছিল না, চুপচাপ বসে ট্রেনের জানলা দিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া, বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে আসা, ঝোপে ঝাড়ে জোনাকি জ্বলা নেভা দেখতে দেখতে অবশেষে গন্তব্য স্টেশনে ট্রেন পৌঁছালো। ট্রেন থেকে নেমে ঐ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কোন সরকারী কর্মী বা আশপাশে কোন গাড়ি নজরে এলো না। এরকম পরিস্থিতিতে অনভিজ্ঞ মেয়েটি, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কী করবে সে?
ফিরতি ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরে যাবে? কিন্তু ফেরার ট্রেন কখন আছে, জানা নেই। এখন ট্রেন ধরলে তো পৌঁছতে মাঝরাত হয়ে যাবে, সে ঝুঁকি নেওয়া কি উচিত হবে? যে হিমঘরের গেস্ট হাউসে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার নামটা জানা আছে। মেয়েটি ভাবলো, তাহলে একটাই পথটা খোলা আছে, ওই হিমঘরেই পৌঁছে যাওয়া, কিন্তু যাবে কী করে? প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে বাইরে আসতে একটা ঝুপড়িতে চায়ের দোকান নজরে এলো, কয়েকটা ভাঙাচোরা বেঞ্চি আর টেবিল পাতা। একটা বেঞ্চিতে, যাদের দেখলে অল্পবয়সী মেয়েরা চোখ নামিয়ে দ্রুত সে জায়গা এড়িয়ে চলে যেতে চায়, সেইরকম চেহারার কিছু ছেলে উচ্চৈঃস্বরে প্রাকৃত ভাষায় আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মধ্যিখানে হৃষ্টপুষ্ট, বেশ ভয় জাগানো চেহারার, বোধকরি, দলের পাণ্ডা নেতৃত্বসুলভ ভঙ্গিতে সবাইকে কিছু বলছে, বাকিরা মাঝে মাঝে সম্মতিসূচক মন্তব্য করছে। কথা বলার মত আর কারুকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল। মা বলেন, “কোন মানুষই আগাগোড়া খারাপ হয় না। যাদের সমাজ খারাপ বলে জানে, তাদের ভেতরেও শুভবুদ্ধি সুপ্ত থাকে। সমাজ তাদের দিকে বারবার আঙুল তুলে খারাপ বলে চিহ্নিত করে বলে ভালো হওয়ার ইচ্ছে মরে গিয়ে, তারা জিদের বশে আরো খারাপ পথে চলতে থাকে। শুভবুদ্ধি জাগ্রত করতে পারলে তারাও অনেকের উপকারে আসতে পারে।” মায়ের সেই কথাকে মাথায় রেখে মেয়েটি চায়ের দোকানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দর্শন সেই দলনেতার দিকে এগিয়ে গেল, কোমল অথচ ভীতু, ভীতু গলায় ডাকল, “দাদা, দয়া করে একটু শুনবেন।”
যে ছেলেটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে, সম্ভবত সামনে সমীহ পেয়ে আর আড়ালে পিছনে ‘মস্তান’, ‘গুণ্ডা’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হয়ে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এই ডাকটা বোধহয় অপ্রত্যাশিত ছিল, সেও আবার এক শহুরে, ভদ্রসভ্য চেহারার অল্পবয়সী মেয়ের কাছ থেকে, তাই দলের কেউই প্রথমে আমল দেয়নি। দ্বিতীয় বার ডাক দিতে একজন সহযোগী, মেয়েটির দিকে দলনেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার ঈষৎ রক্তবর্ণের চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপতে থাকা মেয়েটি, যথা সম্ভব গলার স্বর শান্ত রেখে, নিজের সমস্যার কথা অকপটে খুলে বলে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল কীভাবে ওই হিমঘরে সে পৌঁছাতে পারে। শুনে ছেলেটি এতক্ষণের কর্কশ গলা আশ্চর্যজনক ভাবে নামিয়ে নরম স্বরে বলল, “দিদি, জায়গাটা স্টেশন থেকে বেশ দূরে, হেঁটে তো যেতে পারবেন না, আবার নির্জনও। দিনকাল তো আজকাল ভালো নয়, চেনাজানা ছাড়া যে কোন রিকশাওলার সঙ্গে যাওয়া নিরাপদ হবে না। দাঁড়ান দেখছি।” বলে হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো এক সাইকেল রিকশাচালককে নাম ধরে ডেকে বলল, “শোন, এই দিদি সরকারী কাজে এসেছেন, খুব সাবধানে এনাকে নিয়ে যাবি আর ঠিকঠাকভাবে পৌঁছে দিবি। লোকজন না থাকলে ফাঁকা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আসবি না।” ছেলেটি কোন কথা না বলে শুধুই ঘাড় নাড়ল, কম ভোল্টেজের আলো-আধাঁরিতে রিকশায় উঠবার আগে মেয়েটা তার মুখখানাও ভালো করে দেখতে পেল না।
স্টেশন চত্বরে পেরিয়ে রিকশা যে রাস্তায় পড়ল, সেটি সম্ভবত মফস্বল শহরের প্রধান সড়ক। রাস্তায় তেমন আলো না থাকলেও খোলা দু’-চারটে দোকানপাট, কংক্রিটের বাড়ি থেকে আলো এসে পড়ছে। ভোল্টেজ কম তবু মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। নিজের বুদ্ধি ও সাহসিকতার জন্যে নিজেকেই বাহবা দিতে দিতে, নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়েটি রিকশার ওপর আরাম করে বসল। খানিকটা রাস্তা গিয়ে রিকশাচালক হঠাৎ বাঁক নিয়ে মেঠো পথে ঢুকে পড়ল। মেয়েটির একটু অস্বস্তি হলেও সেরকম বিশেষ কিছু ভীতিপ্রদ মনে হল না – হিমঘর তো আর শহরে বানানো হয় না, গ্রাম্য জায়গা তো হবেই। রিকশা চলেছে তো চলেছেই, পথ যেন আর ফুরোচ্ছে না। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে চারিদিকে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু চাষের জমি, না কোন মানুষজন, না ঘরবাড়ি। যতদূর দৃষ্টি যায়, কোন হিমঘরে তো চোখে পড়ছে না। এ কোথায় চলেছে সে?
একবার মনে হল, স্টেশনের চায়ের দোকানের ওই অসামাজিক দেখতে ছেলেটিকে বিশ্বাস করে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলল না তো? এমন নয় তো যে এই রিকশাচালকের সঙ্গে ঐ ছেলেটির কোন বিশেষ বোঝাপড়া বা লেনদেনের চুক্তি আছে, তাই বেছে বেছে এর রিকশাতেই মেয়েটিকে উঠতে বলা হল? ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে হাড়হিম করা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। কী করবে এখন মেয়েটা? তারস্বরে চিৎকার করলেও তো শোনার জন্যে কয়েক মাইলের মধ্যে কেউ নেই। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের এ কোন বিপদ ডেকে আনল? পার্সে তেমন কিছু অর্থ না থাকলেও মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের মেয়ের উপযোগী হাতে, কানে সামান্য কয়েকটা আটপৌরে সোনার গয়না আছে। সেসব দিয়ে দিতে হলে খুব একটা আফশোস হবে না কিন্তু তার চেয়েও বেশী কিছু যদি ছিনতাই হওয়ার উপক্রম হয়? কী করে নিজেকে বাঁচাবে সে? না আছে গায়ে শক্তি, না আছে হাতের কাছে আঘাত করার উপযুক্ত কোন বস্তু। স্কুলে পড়ার সময় মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্যে একবার মার্শাল আর্টের ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ এসেছিল। এখন মনে হচ্ছে সেসময় ট্রেনিং না নিয়ে কী মূর্খামি করেছে সে। ভয়ে মাথা কাজ করছে না, তবু বুদ্ধিতে যা এলো, তার ভরসায় রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো মেয়েটা, যদি এতে তার মাথায় আসা অপচিন্তা দূর করা যায়, “দাদা আমি সরকারী অফিসার, সরকারী কাজেই এখানে এসেছি।” (যদিও এই কথাগুলো আগে থেকেই রিকশাচালকের জানা আর ঐ অন্ধকার জনমানবশূণ্য প্রান্তরে সরকারী অফিসারের তকমা কীভাবে রক্ষাকবচ হতে পারে, সে প্রশ্নের উত্তর মেয়েটার জানা নেই)। তারপর তার মানবিকতা বোধকে জাগিয়ে তুলতে, “বাড়িতে বিধবা মাকে একা রেখে এসেছি।” অনেকক্ষণ একা নিজে নিজে বকে যাওয়ার পর রিকশাচালক মুখ খুললেন, “দিদি, আপনি ভয় পাবেন না। আমি বেশী লেখাপড়া শিখিনি তাই রিকশা চালাই কিন্তু আমার বাড়িতেও তো মা বোন আছে। আপনি নিশ্চিন্তে বসুন, আমি ঠিক আপনাকে পৌঁছে দেব।” বোঝা গেল বাইরে যতই সাবলীল দেখাবার চেষ্টা করুক না কেন, মেয়েটা যে ভয় পেয়েছে, সেটা রিকশাচালকের কাছে লুকোতে পারেনি, তার অসংলগ্ন কথায় ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু হেরে গেলে তো চলবে না। তখনও মেয়েটা কথা চালিয়ে যাচ্ছে, “সে তো নিশ্চয়ই। আপনারা আছেন বলেই তো আমরা নির্ভয়ে এভাবে সরকারী কাজ করতে একা একা গ্রামেগঞ্জে যেতে পারি।” (পরে কোন সময়ে মনে পড়লে মেয়েটির হাসি পেত এই ভেবে যে সে কীভাবে সম্ভ্রম জাগানোর অস্ত্র হিসেবে ‘সরকারী’ শব্দটিকে, ঐ পরিস্থিতিতে অর্থহীন ও হাস্যকর ভাবে বারবার ব্যবহার করেছিল)। বোধহয় রিকশাচালকেরও তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি। উত্তরে সে জিজ্ঞাসা করল, “দিদি, আমার কাছে পরিষ্কার কলের জল আছে, খাবেন? মনে হচ্ছে আপনার গলা শুকিয়ে গেছে।” সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, জলে বেহুঁশ করে দেওয়ার ওষুধ মেশানো নেই তো? সভয়ে মেয়েটি গলার সব জোর একত্রিত করে প্রতিবাদ করে উঠল, “না না, তার কোন দরকার নেই। আমি একদম ঠিক আছি। দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি চলুন।” সম্ভাব্য বিপদ কোন কোন দিক থেকে আসতে পারে- ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে ফেলল সে।
কতক্ষণ চলার পর, মনে নেই, হঠাৎ রিকশাটা, যেন মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা, একটা আলো-জ্বলা চত্বরে ঢুকে পড়ল আর চোখের সামনে দেখা দিল চেনা সহকর্মীদের অনেকগুলো মুখ। মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনে ফিরে এলে কেমন লাগে? মেয়েটির বোধহয় সেরকম কিছু অনুভূতি হচ্ছিল। তাই রিকশা থেকে ব্যাগটা নামানোর জন্যেও অপেক্ষা না করে এক দৌড়ে অতিথিশালার নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে পড়েছিল, রিকশার ভাড়া দেওয়া যে তখনও বাকি, মনে ছিল না। সেদিন কোন সহকর্মী ভাড়া মিটিয়েছিলেন আর কে ই বা ব্যাগ নামিয়েছিলেন, জানা নেই কিন্তু বয়োঃজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে অঢেল তিরস্কার যে জুটেছিল সেটা ভালো করেই স্মরণে আছে। কেন সে স্টেশনে অন্য কোন সহকর্মীকে খুঁজে পাওয়া অবধি অপেক্ষা করেনি? কেন সে অন্ধকারে, জনমানবশূণ্য এতটা রাস্তায় একা আসার এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল? কী ভেবে সে স্টেশন মাস্টারের শরণাপন্ন হওয়ার বদলে মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ওইসব চায়ের দোকানে আড্ডা মারা অসামাজিক ছেলেদের কাছে সাহায্য চাওয়ার মত অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিল? চারদিক থেকে ছুটে আসা এরকম নানা প্রশ্নবাণে সেদিন মেয়েটিকে জর্জরিত হতে হয়েছিল। জানা গিয়েছিল পূর্বপ্রতিশ্রুতিমত অফিসের স্থানীয় শাখার কয়েকজন কর্মী, সহজে নজরে পড়ব বলে, ফেস্টুনসহ স্টেশনের ওভারব্রীজের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন, বাইরে একটু দূরে গাড়িও ছিল কিন্তু মেয়েটি অন্ধকারে ওপরের দিকে না তাকিয়ে শুধু আশপাশে খুঁজেছিল তাই দেখতে পায়নি। আরো কয়েকজনের পরের ট্রেনে আসার কথা ছিল কিন্তু সে কথাও মেয়েটির জানা ছিল না। আর একে অনভিজ্ঞতা, তার ওপর ওইরকম পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যাওয়ায়, স্টেশনের মাস্টারের কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা মাথায় আসেনি। কোন কোন বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী রাগত স্বরে মন্তব্য করেছিলেন যে এইসব উচ্চশিক্ষিতা এখনকার (মানে সে যুগের হিসাবে) মেয়েদের এই রকমের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, নির্বুদ্ধিতারই নামান্তর। মেয়েটির কিন্তু তাতে রাগ হচ্ছিল না বরং মায়ের কথা মনে পড়ছিল, “ওঁরা তোমার ভালো মন্দ নিয়ে চিন্তা করেন বলেই, তোমাকে আপন ভেবে শাসন করেন। চাকরি করতে গিয়ে এত স্নেহ পাওয়া- এ তো তোমার সৌভাগ্য।” মনে মনে সে আরো বলছিল, “মা, তোমার কথা মিথ্যে হয়নি, তুমি ঠিকই বল – সবার মধ্যেই একটা ভালোমানুষ লুকিয়ে থাকে, খুঁজে নিতে পারলে তার হদিস ঠিকই পাওয়া যায়।”
মেয়েটির পরিচয় দেওয়া বাহুল্য তাই না হয় উহ্যই থাক, শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে, এখন সে প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় উপনীত হয়েছে। মা সেই কবে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। বয়োঃজ্যেষ্ঠ, স্নেহপ্রবণ সেই উর্ধ্বতন আধিকারিকদের অনেকেও আজ আর ইহজগতে নেই, অন্যরা বার্ধক্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আজকাল খবরের কাগজে, দূরদর্শনের পর্দায় প্রায়ই মেয়েদের, প্রকাশ্য দিবালোকে, বাড়ির ঘেরাটোপে, স্কুলের নিরাপদ আশ্রয়ে, বড় হয়ে ওঠা নিজের চেনা পাড়ার মধ্যে, এমনকী শিশু, বৃদ্ধাকেও অব্যাহতি না দেওয়া সম্মানহানির সব অবিশ্বাস্য খবর পাওয়া যায়। তখন মেয়েটির সেইদিনের কথা মনে পড়ে। ২৫/ ২৬ বছরের একটি তরুণীর সেদিন, দু’ধারে চাষের জমির মাঝখানের নির্জন মেঠো পথ দিয়ে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় যাওয়ার সময় কত কীই না হতে পারত? ওই আপাতদৃষ্টিতে অসামাজিক ছেলের দল তার অসহায়তার সুযোগ নিতে পারত? এমনকী সোনার গয়না বা পার্সের টাকাকড়ি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে যে কেউ মেরে মাঠের মধ্যে ফেলে দিতেও পারত? তেমন হলে তার মৃতদেহ খুঁজে পেতেই বহুদিন চলে যেত, দেহ হয় তো শনাক্তকরণের অবস্থায়ই থাকত না। কী হত মায়ের, একমাত্র সম্বল মেয়েটিকে হারিয়ে? পাগল হয়ে যেত না অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ত? কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি।
সেদিনের সেই রোমহর্ষক কাহিনী বলার জন্যে আজও মেয়েটি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। কিন্তু কেন? সে যুগেও তো খুন, রাহাজানি, মেয়েদের সম্মানহানির ঘটনা নেহাত কম শোনা যেত না? রিকশাচালকটি নিশ্চিতভাবে সৎ ছিলেন (এমন আরো অনেকের কথা শোনা যায় যাঁরা যাত্রীর অসাবধানে ফেলে যাওয়া মানিব্যাগে হাজার হাজার টাকা পেয়েও আত্মসাৎ না করে ফিরিয়ে দেন) কিন্তু ওই তথাকথিত অসামাজিক ছেলেগুলো? তারা কেন কোনরকম অন্যায় সুযোগ নেওয়ার বদলে মেয়েটিকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন? সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন? সে কি তবে শিক্ষিত, তাদের তুলনায় সামাজিক উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন একটি তরুণীর ভরসা করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার জন্যে, সাহায্য চাওয়ার জন্যে? না কি ‘দাদা’ সম্বোধন করে তাদের অপ্রত্যাশিত মর্যাদা দেওয়ার জন্যে? এই ব্যবহার কি তাদের বহুদিনের অব্যবহৃত, ঘুমিয়ে থাকা সৌজন্যবোধকে জাগিয়ে দিয়েছিল? মেয়েটির জানা নেই তবু সে আজও মায়ের কথামতো মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে চায়, “কেউ কখনো পুরোপুরি খারাপ হয় না। যতই চাপা দিয়ে রাখা হোক না কেন, শুভবুদ্ধি ঠিক সব মানুষের অন্তরের এক কোণে লুকিয়ে থাকে। তাকে জাগ্রত করতে পারলে এ যুগেও দস্যু রত্নাকরের ভেতরে বাল্মিকী মুনিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।” অন্যের কাছে ঘটনাটি যতই অকিঞ্চিতকর মনে হোক না কেন, সেই ভয়াবহ রাত, ওই জনমানবহীন প্রান্তর তার একা পেরোনোর কথা মন পড়লে মেয়েটির এখনো মনে হয় ওই বখাটে ছেলেগুলি ও আপাতদৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর দর্শন দলনেতাটির দাক্ষিণ্যেই সে সেদিন নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পেরেছিল। তাদের বাহ্যিক অবয়ব দেখে প্রাথমিক ভাবে চরিত্রের ধারণা করেছিল ভেবে মেয়েটি এখন লজ্জিতই বোধ করে, ববং মনে হয় তারা সেদিন অচেনা পরমাত্মীয়ের রূপেই, তার কাছে ধরা দিয়েছিলেন।
ছবি: প্রণবশ্রী হাজরা
লেখকের কথা: শর্মিলা ঘোষনাথ
একসময়ে সরকারী দপ্তরে কর্মরত, ভালোবাসা বলতে নতুন offbeat জায়গা, বিশেষত পাহাড়ে বেড়ানো, সেখানকার মানুষজন, তাদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখা আর গান শোনা। দুটো সংস্থায় ইকনমিস্ট হিসেবে কনট্র্যাক্টে কিছুদিন কাজ করার সূত্রে কিছু developmental project এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, কয়েকটা গবেষণামূলক লেখা সংস্থার ম্যাগাজিনে published হয়েছে।
পথেঘাটে এমন মানুষের সাক্ষাত আমাদের সকলেরই ঘটে কিন্তু এতো সুন্দর করে তা প্রকাশ করতে সবাই পারে না।