ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী (পর্ব – ৫ )

লেখক: দামিনী সেন

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

৭ম পরিচ্ছদ

গ্যারেজে গাড়িটা রেখে ধীর পায়ে উঠে এসে দরজায় বেলটা বাজায় সুজয়। প্রায় মিনিট-খানেক অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে ওঠার মুখেই দরজাটা খুলে দেয় অপর্ণা। “ও, তুমি! এসো।” বলেই আবার একরকম ছোটে সে। টিভিতে প্রিয় সিরিয়াল ছেড়ে উঠে আসতে হওয়ায় এখন তার সময়ের বড়ই অভাব।

মৃদু হেসে পিছনে দরজাটা নিজেই বন্ধ করে সুজয়। তারপর বাইরের জুতোটা ছেড়ে ঘরের চটিটায় পা গলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে পা বাড়ায় সে। সিঁড়ি থেকেই তাকিয়ে দেখে, লিভিং স্পেসে বসে অপর্ণা, সামনে টিভির পর্দায় চোখদু’টো তার স্থির। সামান্য হাসি খেলে যায় তার ঠোঁটে। নীরবেই উপরে উঠে যায় সে।

কিছুক্ষণ পর চেঞ্জ করে আবার বেড়িয়ে আসার পথে মেয়ের দরজার সামনে একবার দাঁড়ায় সুজয়। একটুক্ষণ কী ভাবে। তারপর টোকা দেয়। “পুট্টুস, আসব একটু?”

“বাবা! হ্যাঁ, এস।”

“কী করছিস রে?” ঘরে একঝলক উঁকি মেরেই সুজয় দেখতে পায় বাড়িতে পড়ার খাটো শার্ট ও পাজামায় তার মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। নড়াচড়ার জায়গা করে নিতে সেখান থেকে সব আসবাবপত্রের সরে গিয়ে ঠাঁই হয়েছে সেই দেওয়ালের ধারে। কম্পিউটার টেবিলের চেয়ারটা গুটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঐ টেবিলেই হেলান দিয়ে; পড়ার টেবিলের চেয়ারটাও তার গুটিয়ে যাওয়ার অপারগতার লজ্জাতেই বোধহয় যতটা সম্ভব জড়সড় হয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টায় টেবিলের ফাঁকে; স্ট্যান্ডফ্যান, ড্রেসিং টুল, আরও হাবিজাবি যা কিছু সব গিয়ে জড় হয়েছে মেয়ের খাট ও ওয়ার্ডরোবের মাঝের যৎসামান্য ফাঁকটুকুতেই। আর আয়নার সামনে ফাঁকা হয়ে ওঠা অতবড় জায়গাটায় রাজরাণীর মতোই একা বিরাজ করছে তার মেয়ে।

তা নিজ রাজ্যে বাবার এমন হঠাৎ হানায় সে রাণী অবশ্য তখন একটু থতমত খেয়ে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছেন। আরএকটু ভিতরে এসে সুজয়ের চোখে পড়ে খাটের উপর একটা খোলা খাতা। সুজয় হেসে ওঠে। “ও, পড়াশুনো ছেড়ে এখনও নাটকেরই রোল মুখস্থ চলছে তাহলে!”

“বাবা, প্লিজ। মাকে বল না। কী করবো বল? একটা জায়গায় বডি এক্সপ্রেশনের সাথে ডায়ালগ থ্রোয়িং কিছুতেই মেলাতে পারছি না যে। তাই একটু … ও পড়াশুনো নিয়ে ভেবো না। ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।” তারপর আরেকটু কাঁচুমাচু হয়ে মেয়ে যোগ করে, “আসলে মা এইসময়টা সিরিয়ালে ডুবে থাকে তো। তাই এইসময়টাই একটু প্র্যাকটিস করে নিচ্ছিলাম। নাহলে তো জানোই …”

“তা তো বটেই। তা তো বটেই। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো আমরা কেউ কারুর কাছে কিছু লুকোই না। তাহলে তুইই বল … মার কাছে এটা লুকোনো কি ঠিক হবে?” মুচকি হাসে সুজয় আর মেয়ে তার হাঁ হাঁ করে ওঠে।

“আচ্ছা আচ্ছা। বলবো না। তবে একটা শর্ত …”

“কী?” মেয়ের ভুরু এবার বঙ্কিম।

“তেমন কিছু না। স্রেফ এক কাপ সুন্দর কফি।”

“ওঃ বাবা, তুমি না!” মেয়ের চোখে কপট রাগটুকু তখনও রয়ে গেছে দেখে সুজয় যোগ করে,
“তাহলে কিন্তু আরও একটা সুখবর দিতে পারি।”

“কী?”, ঘুষের প্রস্তাবও বোঝাই যায় মেয়ের মন তেমন গলাতে পারেনি।

“আজ তোদের ঐ গেছো বাঁদরটা অফিসে এসেছিল। তোদের নাটকের ব্যাপারে কিছু অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। দিয়েছি হাজার ক’য়েক। কিছু বিজ্ঞাপনেরও ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করবো কথা দিয়েছি।”

“সত্যি!” অপ্রত্যাশিত খুশিতে প্রায় লাফিয়ে ওঠে এবার মেয়ে। “টাকা নিয়ে যা টানাটানি চলছিল না। বাবা, ইউ আর গ্রেট! আমি এক্ষুণি তোমায় কফি করে দিচ্ছি।”

মেয়ের খুশি দেখে সুজয়ও হেসে ওঠে। “সেটাই তো আমার চাই এখন।” মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার চুলগুলো আদর করে একটু ঘেঁটে দেয় সে। মেয়েও পুষি বিড়ালের ভঙ্গিমায় বাবার বুকে মাথা গোঁজে। “ও হ্যাঁ। খুউব ভালো করে প্র্যাকটিস কর। স্টেজ পারফরমেন্স তোর কিন্তু খুব ভালো হতেই হবে। না হলে কিন্তু পুরো বিষয়টারই নানারকম অপব্যাখ্যা হতে পারে। আমার পক্ষে তো নয়ই, তোর বা এমনকি অনিরও সম্মান কিন্তু জড়িয়ে গেলো এখন এর সাথে।”

৮ম পরিচ্ছদ

মিষ্টিমুখ দোকানটা ছাড়িয়ে আরএকটু এগিয়েই বাঁদিকে বাঁক নিয়ে অনিদের ছোট্ট গলি। মোড়ের মাথার ল্যাম্পপোস্টে একটা টিমটিমে আলো ছাড়া সে রাস্তায় আর কোনও আলো নেই। টিউব অবশ্য লাগানো হয়েছিল প্রতিটি পোস্টেই। কিন্তু খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আর কেউই তেমন উদ্যোগ নেয়নি সেগুলো সারাবার।

তা বলে গলিটা তেমন অন্ধকার থাকে না কখনই। অন্তত এই সন্ধ্যে সাড়ে ৮ টা ৯ টা নাগাদ। বিভিন্ন বাড়ির জানলা দিয়ে কিছু না কিছু আলো সেখানে চুঁইয়ে নামেই। অন্তত লোডশেডিং না হলে।

এই সময় অবশ্য লোক খুব একটা আর থাকে না রাস্তায়। দু-চারজন ছাড়া। আর গলিটার একটু আগে বংশীদার চায়ের দোকানে বসে পাড়ার কিছু ছেলে বুড়ো আড্ডা মারে। অনি চেনে তাদের সবাইকেই, তারাও চেনে অনিকে। রিহার্সাল থাকলে ও মোটামুটি এইসময়েই ফেরে। ওরাও ডেকে তখন অনেক সময় খোঁজখবর নেয়, জানতে চায় নাটকটা এবার কবে, কোথায়, কিসের উপর, ইত্যাদি। তবে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে জীবনেও কেউ খুব একটা উচ্চবাচ্য করে না। অনিও অবশ্য তাতে রাগটাগ করে না। করে কী করবে? ও তো জানেই, এরা এ’রকমই। সারাদিন যে যেভাবে পারে খেটেখুটে দিন গুজরানের পর এই গুলতানিটুকুই তাদের অবসরযাপন। নাটক-নভেলের ধার এরা কোনোদিনই ধারে না। দু-চারটে জনপ্রিয় সিনেমা, খবরের কাগজ পড়া জ্ঞান সম্বল করে ওবামা থেকে মের্কেল, পুতিন থেকে মাকরঁ, সকলের পিণ্ডি চটকানো, আর কিছু গসিপ, গুজব, পিএনপিসি, এতেই সীমাবদ্ধ এদের জীবন। তবু তো তার কাছে তারা নাটকের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে। এটুকুই তো অনেক।

আজ কিন্তু সে লক্ষ করল, চায়ের দোকানের ভিড়টা বেশ বেশিই। কিছুটা যেন উত্তেজিতও। কী হয়েছে জানার কৌতুহলে সেও নেমে পড়ে সাইকেল থেকে। একটু এগোতেই দেখতে পায় পিন্টুকে। ওরই বয়সী। তবে পড়াশুনো ছেড়েছে আগেই। এখন গাড়ি চালায়। ভাড়ায়। ফুটবল ওর নেশা।

“এই পিন্টু, কী ব্যাপার রে!” পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে সে।

“জানিস না! আমাদের এতদিনের খেলার মাঠটা আর তার পিছনের পুকুরটাও নাকি বিক্রি হয়ে গেছে।”

“সে কী রে! মাঠটা তো এতোদিন ধরে ক্লাবের ছেলেরাই ব্যবহার করছে। ওর কোনও মালিক ছিল বলে তো শুনিনি।”

“সে তো আমরাও শুনিনি। কিন্তু এখন শুনছি। ঐ মিষ্টির দোকানের মালিকেরই নাকি ওর বেশ কিছুটা অংশ ছিল। আর বাকিটা কে আরেকজনের, কোথায় লন্ডন না প্যারিস ভগবান জানে, মোটমাট বিদেশে থাকে।”

“আর পুকুরটা!”

“হ্যাঃ। পুকুর। পুরসভায় খোঁজ নিতে গিয়ে কী জানা গেছে জানিস! ওদের ম্যাপ অনুযায়ী ওখানে নাকি কোনো পুকুর কস্মিনকালেও ছিল না। বরং তোদের বাড়ির ওদিকটাই নাকি পুকুর। নোটিশও ধরিয়ে দিয়েছে সাথে সাথেই। কেন তোরা পুকুর বুজিয়ে গত ৫ বছরের মধ্যে ওখানে একটা আস্ত পাড়া গড়ে তুলেছিস?”

“সে কী রে! আমাদের পাড়াটার বয়স তো ৩০ বছরেরও বেশি!” বিস্মিত অনির মুখের দিকে তাকিয়েই একটা অশ্লীল গালাগালি বেড়িয়ে আসে পিন্টুর মুখ দিয়ে। তারপরই লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি জিভ কাটে সে, “সরি সরি। তোরা তো আবার কলেজে যাওয়া মেয়ে। আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। একটু ক্ষমাঘেন্না করে দিস।”

অনি অবশ্য কোনও জবাব দেয় না। মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে সেখানেই। ওর হাতদুটো খুব জোরে চেপে ধরে সাইকেলের হ্যান্ডেলটা। একটু পরে ধীরে ধীরে আবার মুখ তোলে সে।

অবাধ্য চুলগুলোকে বরাবরের অভ্যেস মতোই হাত দিয়ে পিছনদিকে ঠেলে দেয়। তারপর প্রায় নিজের মনেই, কিন্তু খুব কেটে কেটে শব্দগুলো উচ্চারণ করে সে, “ওরা বললো, আর রাতারাতি এতবড় মাঠটার মালিক গজিয়ে গেল! জলজ্যান্ত পুকুরটা হয়ে গেল নেই! আর আমাদের বাড়িগুলো হয়ে গেল পুকুর! ঠিক আছে। আমরাও কিন্তু এত সহজে ছেড়ে দেবো না।” ওর চোখদু’টো ছড়িয়ে পড়ে দূরে। কালো জিন্সের উপর হাল্কা সবুজ ছাপা কামিজ পড়া ছোটখাটো মেয়েটির চোখের সেই দৃষ্টির সামনে জড়সড় হয়ে পড়ে ওর বাল্যবন্ধু ডাকাবুকো ছেলে পিন্টুও।

আগামী পর্বের লিঙ্ক এখানে

অলংকরণ – শর্মিষ্ঠা দেবযানী


লেখক পরিচিতি: দামিনী সেন
গত শতাব্দীর শেষ পাদে জন্ম। ছেলেবেলা কেটেছে মফস্‌সলে। সেখানেই পড়াশুনো — স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ঘুরতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পড়তে। জানেন একাধিক বিদেশি ভাষা। আগ্রহ বহুমুখী, কলমের অভিমুখও। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সাবলীল তাঁর কলমের গতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। কাব্যগ্রন্থ “ভাঙা সে সাম্পান” প্রকাশের পথে। ধারাবাহিক উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী”-র মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।