লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী
রাস্তায় দু’দলের ঝামেলা, যানজট, অটো ষ্ট্যান্ডে লম্বা লাইন, এইসব নানা বিপত্তি পেরিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হল। ফলে রোজকার ঠেকে পৌঁছলাম বেশ রাতে। আশেপাশের বাড়ি থেকে ভেলকি দেখানো সিরিয়ালের শব্দ ভেসে আসছে। পাশের দো’তলা বাড়ির কাকু খাওয়ার পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কানে হেড ফোন গুঁজে দাঁত মাজছেন। অত রাতে কেউ আড্ডা দেওয়ার জন্য বসে থাকবে এই আশা করিনি। খানিকটা অভ্যাসের বশেই রকে আসা। অবাক হলাম হাবুকে দেখে।
চারিদিকে ধোঁয়ার কুন্ডলী। তার মধ্যে বসে একমনে হাবু গাঁজা ভরা বিড়ি টানছে। ধুমকি মেরে বসে কোনও রকমে চোখ দুটো খুলে রেখেছে। আজ নেশা একদম তুঙ্গে। ধমক দিয়ে বললাম, কিরে এখনও বসে বসে গাঁজা টেনে যাচ্ছিস? যা বাড়ি যা।
খুব কষ্ট করে জড়ানো গলায় হাবু বলল, “রামেন্দসুন্দর তিবেদিটাকে কি গালাগালিই না দিতাম।”
প্রথমে কি বলছে বুঝতে পারি নি। তারপর মনে পড়ে গেল যুক্তাক্ষরে হাবুর ‘র’ হাল্কা বেরোয়। আর এখন নেশার ঘোরে তো ‘র-ফলা’ উধাও হবেই।
— হঠাৎ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয়কে নিয়ে পড়লি কেন?
— কি যে গদ্য লিখেছিল কিছুই বুঝতে পারতাম না। অথচ এখন সব পরিস্কার হয়ে গেল।
মনে পড়ে গেল পাঠ্যপুস্তকে ওনার একটা প্রবন্ধ ছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে নিয়ে। হাবুর মতে অবশ্য গদ্য। ওর বিভাজন খুব পরিস্কার। গল্প, পদ্য আর বাকি সব গদ্য। এক বিশাল ব্যক্তিত্বের বিস্তৃত জীবনের অনুপম বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ প্রবন্ধের কথা হাবুর কেন মনে পড়ল কে জানে!
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে হাবু জিজ্ঞেস করল, কি ভাবছিস?
— ভাবছি তোর কাছে কি পরিস্কার হয়ে গেল?
— হাবু মাথা নেড়ে বলে, ঐ যে কি একটা লিখেছিলেন না রামেন্দবাবু,
বড় জিনিসকে ছোট দেখানোর যন্তর…
— বুঝেছি। তুই ত্রিবেদী মহাশয়ের বিদ্যাসাগরকে নিয়ে প্রবন্ধের কথা বলছিস। ওতে লেখা ছিল,
“বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত বড় জিনিসকে ছোট দেখাইবার জন্য নির্মিত যন্ত্রস্বরূপ।”
— হাবু উত্তেজিত হয়ে ‘জ – জ’ করে কি যেন বলতে গেল। নেশার ঘোরে জিভ শুকিয়ে গেছে। হাতে জলের বোতল ধরিয়ে বললাম, একটু শান্ত হ।
— ঢক ঢক করে প্রায় আধ বোতল জল খেয়ে, একটা লম্বা ঢেকুর তুলে হাবু বলে উঠল, ওটা জীবনচরিতের বদলে মূর্তি হবে বুঝলি।
— মূর্তি?
— আজ্ঞে হ্যাঁ। ওনার মূর্তি মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে আমাদের অনেক বড় বিষয় ছোট করে দেখিয়ে দেয়।
— হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর গলায় বলে, জাতি সত্ত্বা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ধর্মীয় সহাবস্থান … অনেক কিছু আছে বুঝলি।
— খুব যে খবরের কাগজের ভাষায় লেকচার দিচ্ছিস। তা এগুলোর সাথে মূর্তির সম্পর্ক কি?
— ওসব বড় বড় ব্যাপার তোর মাথায় ঢুকবে না। ছোট করে বলি। সপ্তাহ দুয়েক আগে পাড়ার ঝামেলার কথা শুনেছিস তো?
— হ্যাঁ। রকের কিছু বখাটে ছোঁড়ার সাথে পুচুর ঝামেলা হয়েছিল।
— ব্যস হয়ে গেল! শুধু এইটুকুতে কিছুই বোঝা যায় না। আগুপিছু সব বুঝতে হয়। শোন তাহলে –
আমাদের বাড়ির পিছনের রাস্তায় বছর খানেক হল একটা নতুন ঠেক হয়েছে। সব উঠতি বয়সের ছোকরা। কিছু অন্য পাড়ার ছেলেও জুটেছে ওদের সাথে। বিশ্ব বখাটের দল সব। যেমন মুখের ভাষা, তেমন চালচলন। ছুড়ি হোক বা বুড়ি, ঠেকের সামনে দিয়ে গেলেই অশ্লীল শব্দ বাণ ধেয়ে আসে। এই লুম্পেনদের দৌরাত্বে সবাই অতিষ্ঠ। দু’একবার পাড়ার লোকেরা প্রতিবাদ করলেও কোনও ফল হয় নি। ভদ্রলোকের পাড়া তো! সামান্য প্রতিবাদেই শেষ। মুখোমুখি চোখে চোখ রেখে দল বেঁধে রুখে দাড়ানোর লোক নেই। সবাই ভাবে কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে। অথচ সবাই মনে মনে চায় লুম্পেন, বখাটেদের শায়েস্তা করতে। এই রকম সময় সিনে এল পুচু। পুচুকে চিনিস তো?
— খুব একটা পরিচয় নেই। ছোট থেকে তো দেখি নি।
— কি করে দেখবি? বছর চারেক হল এ পাড়ায় ভাড়া এসেছে। ওর আর একটা পরিচয়ও আছে। ওপাড়ার কেলো মাস্তানের এক নম্বর চামচা। পুচু গিয়ে বখাটেগুলোকে বোঝালো, ওর কথা না শুনলে কেলোদাকে বলে বখাটেকেগুলোকে মেরে ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে। ব্যস! বখাটেগুলো একদম পুচুর ন্যাওটা হয়ে গেল।
— পুচুকে তো দেখিনা ওদের সাথে।
— পুচু অত কাঁচা কাজ করে না। সবার সামনে মেশে না, রাত্রে ওদের সাথে বসে জলপুলিশের সাথে লুকোচুরি খেলে।
— বুঝলাম। তাহলে পুচুর সাথে ওদের ঝামেলা হল কেন?
হাবু একটা ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে বলল, সকাল বিকেল গোটা পাঁচেক খবরের কাগজ পড়ে আর টিভি দেখে কিছু জানা যায়না। পর্দার আড়ালের খবর রাখতে হয়।
— সেটা কিরকম?
পুচু বুঝে গেছে বখাটেগুলোকে শায়েস্তা করলেই ও পাড়ার লোকেদের কাছে হিরো হয়ে যাবে। অথচ বখাটেগুলোকে ছাড়া ওর চলবে না। ওদের ঘাড় ভেঙেই যে খেতে হবে। তাই ওদের ভয় দেখিয়ে নিজের কব্জায় রাখতে হবে।
ঝামেলার দিন দুই আগে রাত্রিবেলা পুচু গিয়ে ছেলেগুলোকে বোঝালো। আমার সাথে হাতাহাতি করতে হবে তোদের। সবে দু’পাত্রর পেটে পড়েছে। তার মধ্যে এসব কি বলছে পুচুদা! কিছুই বুঝতে পারল না। পুচু বোঝাল, গলাবাজি হবে, ধাক্কাধাক্কি হবে। কিন্তু কেউ কাউকে মারব না। বখাটের দলের মাথায় কিছুই ঢুকল না। একজন বলল, তোমার গায়ে হাত দেব? দিবি। কারণ, সবাই জানবে পুচু লড়ছে বখাটেদের বিরুদ্ধে। ভদ্রলোকেরা নিশ্চিন্তে থাকবে। আমরা ঝগড়া-ঝগড়া খেলা খেলে যাব।
— বাহ! ভাল বুদ্ধি তো পুচুর। তা তুই এত খবর কিভাবে জানলি?
— মাঝ রাত অবধি ছাদে ঘুরি কি এমনি এমনি? ছাদের ধারে ঘাপটি মেরে ছোকরাগুলোর কথা শুনি। কিন্তু পুচুর আসল উদ্দেশ্য তো অন্য।
— আবার কি উদ্দেশ্য?
ওর আসল উদ্দেশ্য পাড়ায় কেলোর আধিপত্য কায়েম করা। যাতে ও পুরো পাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। সেই লক্ষ্যে ঝামেলার পর থেকেই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, আমি অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। কেলোদাকে ছাড়া হবে না। মানুষের প্রয়োজনে কেলোদা সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। উনি একবার সামনে এলেই ছোঁড়াগুলো ল্যাজ তুলে পালাবে।
— কই আমাকে তো কিছু বলে নি!
তোকে-আমাকে বলবে না। কিন্তু পাড়ার চিন্তায় ঘুম না আসা ভদ্রলোকেদের মাথাটা ভালই খেয়েছে। তারা ঠিক করেই ফেলেছে, কেলোকে নিয়ে আসবে পাড়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে।
— তাতে যদি লুম্পেনগুলো শায়েস্তা হয় তো ক্ষতি কি?
— ক্ষতি অনেক রে! সাময়িক শান্তি এলেও পাড়ার নিয়ন্ত্রণ আর পাড়ার লোকের হাতে থাকবে না। আম আর ছালা দুইই যাবে। তারপর পড়ে থাকা আঁটির গায়ের শাঁস চাটবি আর জর্দ্দা কোম্পানির ছাপ মারা কাপড়ে ঘেরা ষ্টেজে টেগোর সাহেবের গলায় মালা দিয়ে গান গাইবি – বাংলার মাটি, বাংলার জল ….
ধুতি-চাদর পড়া লোকটার ভাঙা মূর্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল, নিজেদের এলাকার সমস্যা নিজেদেরই মেটাতে হয়। লড়াই, ঝগড়া করে আমরা ঠিক লুম্পেনদের সামলে নেবো। কিন্তু বেপাড়ার কেলো মাস্তানদের আসতে দিলেই বিপদ। তারপর হাতটা বাড়িয়ে বলল, অনেক ভাট বকলাম। টেনে তোল। বাড়ি যাব।
হাবুর কাঁধে হাত দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, দিনের আলোর মত সত্যটা ও কত সহজে বুঝে নিল! সেই ছোটবেলায় পড়েছিলাম, গোপাল অতি সুবোধ বালক। আর আমরা সুবোধরা এখন গোপাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।
দুর্দান্ত!