লেখক: মিত্রা হাজরা
সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে ?
ডাক না রে তোর বুকের ভিতর, নয়ন ভাসুক নয়নধারে —রবি কবি।
সন্ধ্যা নামছে ধীরে, পাখিরা ফিরছে আপন কুলায়। দূরে শাঁখের শব্দ শুনতে পেল মানুষটা। চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি বধূর মুখ, লাল পাড় সাদা শাড়ি, তুলসী তলায় প্রদীপ দিচ্ছে। এ তো তার বৌ! ভাঁড়ারা গ্রাম,দাস পাড়া—সব মনে পড়ে যায়। মা ডাকছে—ওঠ লালন মাঠে যেতে হবে, বেলা হয়ে গেছে। আমি লালন, আমার মা আছে, বৌ আছে, তারা হয়তো আমার জন্য কাঁদছে, সাঁইজী আমি বাড়ি যাব। অবশ্যই বেটা, ঘরের ছেলে ঘরে ফেরো।
হাতে একতারা, মাথায় ঝুটি বাঁধা চুল, লালন চলেছেন ঘরের টানে, মন যে বাঁধা ঘরের পানে। দুপাশে কৃষিজমি বর্ষার জলে সবুজ, সজীব। হাওয়ায় মাথা দোলায় কচি ফসলের গাছ। প্রকৃতি দেবী যেন সবুজ লাবণ্য এর গালিচা বিছিয়েছে। অযত্নে বর্ধিত বাঁশঝাড় আর বেতবন, নূপুর বাজিয়ে নৃত্যপরায়ণা নটীর মত চঞ্চল নদী বহে যাচ্ছে পাশে পাশে। ঘরে ফেরার আনন্দে প্রকৃতির রূপে বিভোর হয়ে একতারা হাতে গান গাইতে গাইতে চলেন লালন—‘না জেনে ঘরের খবর, তাকাও কেন আসমানে ‘ ।
লালনের মন আজ খুঁজে চলে তার প্রিয়াকে, কত কষ্ট পেয়েছে! কেমন আছে সব কে জানে! পথ যেন আর শেষ হতে চায় না! জলে ভাসছে কতকগুলো হাঁস ,কিছু নাম না জানা পাখি জল ছুঁয়ে আকাশে উড়ে গেল ডানা মেলে। গ্রামের ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে, মাটির দেওয়ালে রঙ করা, উঠোনে তুলসী গাছ –আল্পনা দেওয়া উঠোন। দ্রুত পা চলে লালনের, ঐ তো তার বাড়ি, কত মাস পরে সে ঘরে ফিরছে। মা– ডাক দিল লালন-মাগো! মা বের হয়ে আসে –কে? মা আমি—- লালন। পরনে সাদা ধুতি, চুল চুড়ো করে বাঁধা,হাতে একতারা—এ কি তার লালন! তুই বেঁচে আছিস্ বাবা! আমার লালন–জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন মা। ঘর থেকে স্ত্রী বের হয়ে এল, এ কি দেখছে!! বৈধব্যের বেশ! মলিন মুখ, এই তার বৌ! মা কেঁদে বলেন—তবে যে তোর সাথীরা বলল— তুই না ফেরার দেশে চলে গেছিস্! হ্যাঁ মা– আমার বসন্ত হয়েছিল, আমি মরে গেছি ভেবে সব আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সিঁরাজ সাঁই আমাকে তুলে সেবাযত্ন করে বাঁচায়,আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম মা, মনে পড়তেই তোমার কাছে চলে এসেছি।
হৈ হৈ পড়ে গেল গ্রামে, গ্রামবাসীরা এসে জড় হল, এলো সমাজপতিরা। কী! মুসলমানের ঘরে অন্ন জল খেয়েছো! তোমার তো জাত গেছে! এ গ্রামে তোমার থাকা হবে না, তোমরা একঘরে হবে। শিউরে উঠলেন মা, তোমরা এ কথা বলোনা, আমার ছেলে কতকাল পর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, ও কোথায় যাবে? না ওর এখানে থাকা হবে না, ওকে চলে যেতে হবে। লালন বললেন—— ঠিক আছে, আমি মা বৌ নিয়ে এ গাঁ ছেড়ে অন্য গাঁয়ে চলে যাব, ভিক্ষা করে খাব। একটাই তো জীবন, কাটলো দুঃখ দুঃখেই — এটা এক জন্ম থেকে জন্মান্তরের পথ। পথই সঙ্গী আমার, ভাঁড়ারা গ্রাম তাঁকে ভিটে ছাড়া করলো। এত দুঃখ, এত দহন! এ কেমন জাত! কেমন ঈশ্বরের বিচার! মনের রঙে বৈরাগ্যের রঙ ধরলো লালনের। ঘর ছাড়ার সময় বৌ, মা– কেউ সঙ্গী হলো না তার। বৌ কেঁদে বলল— বিধবার বেশ তো পরিয়েছে সমাজ, আজ নতুন করে জাত খোয়াতে পারব না। মা আসতে চাইলেন না বৌ কে ছেড়ে, আমি গেলে ওকে কে দেখবে?
লালন একা হয়ে পথে নামলেন আবার, অভিমানে কান্না এসে গেল– গান গাইতে গাইতে লালন ফিরে চলেন পথে পথে—“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন বলে জেতের কি রূপ, দেখলাম না এ নজরে”। ফিরে এলেন কাহার সম্প্রদায় ভুক্ত বাউল গুরু সিরাজ সাঁই এর কাছে। গুরু সিরাজ দরবেশ, সুফী সাধক, তিনিই বাঁচিয়েছিলেন লালন কে। গুরু আমাকে আশ্রয় দিন আপনার চরণে। থেকে গেলেন লালন সিরাজ সাঁই এর কাছে, গুরু তাঁকে দীক্ষা দিলেন । লালন হলেন লালন সাঁই। লালন নিত্য প্রশ্ন করতেন গুরুকে, বিশ্ব সংসার ও জীব জগৎ নিয়ে। তাঁর সব কৌতুহল মেটাতেন সিরাজ সাঁই। সাধনার নানা রূপ, নানা পথ সম্বন্ধে জানাতে থাকেন গুরু। জানান–‘রঙমহলের’ কথা । এ এক দেহতত্ত্ব তাতে লাগানো তালা। ভিতরে প্রবেশ করতে হলে তোমাকে সেই তালা খোলা জানতে হবে। শুধুই সাধনার দ্বারা এ জ্ঞান লাভ হবে,তবেই মনের মানুষের দেখা পাবে।
বাউলের মনের মানুষ এই দেহতত্ত্ব-এ লুকিয়ে আছে। এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। গুরু বলেন– মানুষের দুই সত্ত্বা, একটি বাহিরের দেহধর্ম পালন করি, খাই দাই ঘুমাই। আর অন্তরের সত্ত্বায় রস আস্বাদন করি। নিজেকে জানার চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে জানলেই সকল জানা হয়ে যাবে। এই যে আমাদের দেহ—দাঁড়িয়ে আছি, শ্বাস নিচ্ছি, প্রবৃত্তি আছে, নিবৃত্তি আছে, কাম আছে, প্রেম আছে দুটোকেই স্বীকার করতে হবে। তাহলে বৈরাগ্য! —-না বৈরাগ্যে তাঁকে পাওয়া যাবে না। তাই বাউল গানে আমরা জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা পাই। মুক্ত চেতনাই বাউলের চেতনা। লালন দিনে দিনে সেই মনের মানুষের সন্ধানে ব্যাকুল হলেন। গহন বনে একা বসে গান বাঁধেন ,গান করেন-
–“মিলন হবে কতদিনে/আমার মনের মানুষের সনে।
চাতক প্রায় অহর্নিশি /চেয়ে আছে কালো শশী
হব বলে—চরণদাসী, না হয় না কপালগুণে।
মেঘের বিদ্যুত মেঘে যেমন–লুকায়ে না পায় অন্বেষণ
কালারে হারিয়ে তেমন/ ঐ রূপ হেরি এ দর্পনে।
ঐ রূপ যখন স্মরণ হয়— থাকে না লোক লজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই–
ও প্রেম যে করে সেই জানে।”
মানুষের মুখে মুখে এ গান ভেসে গেল দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে।
বাউলের মনের মানুষ বা স্রষ্টা যাই বলা হোক না কেন, সব কিছু ই লুকিয়ে আছে নিজের মধ্যে, শুধু তাকে খুঁজে নিতে হবে। এই খোঁজাও অনন্ত
কালের। চাতক এখানে রূপক, চেয়ে আছে মেঘের পানে, কখন বৃষ্টি নামবে, তবে তৃষ্ণা মিটবে। কি সে তৃষ্ণা! ঈশ্বর তৃষ্ণা, নিজেকে জানার তৃষ্ণা। এই খোঁজার শেষ নেই বাউলের। জীবন শেষ হয়ে যাবে—— তবু খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। এই কথাই পড়ি রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে– “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না ।
এই জানার ই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।”
বাউলের সুর ও বাণী কবিগুরু গ্রহণ করেছেন তাঁর গানের মধ্যে, অকপটে বলেছেন– আমার মনের মাঝে মিশে গেছেন লালন ফকির আর বাউল গান।
চলবে…
গ্রন্থ ঋণ —
লালন ভাষা অনুসন্ধান –আবদেল মান্নান
লালন সমগ্র–মোবারক হোসেন খান
লালন শাহ ফকির–মুহম্মদ আবদুল হাই।
লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।