লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
সকাল সকাল ভোটটা দিয়ে আসব ভেবেছিলাম। একদম সকাল সকাল। কিন্তু ঘুম সেই ভাঙল নটাতেই। তৈরি হতে আরও এক ঘণ্টা। উঠেই তো আর বুথে যাওয়া যায় না, একটু সময় লাগে। দশটায় যখন বেরলাম, তখন কড়া রোদ। এবছরটা খুবই গরম পড়েছে। ছাতাটা খুলে বেরিয়ে পড়লাম।
আমার ভোটের বুথটা আমার ভাইপো পাপাইয়ের গতিতে গেলে সাত-আট মিনিট হবে। আমার গতিতে পনেরো মিনিট। আমি অবশ্য একটু খুঁড়িয়ে হাঁটি। একবার ভোট হয়ে যাবার পরে পায়ে একটা চোট পেয়েছিলাম। বাঁহাতে লাঠিটায় ভর করে ডানহাতে ছাতাটা মাথার ওপর ধরে হাঁটছিলাম, হঠাৎ কেষ্টদার সাথে দেখা।
কেষ্টদার সাথে মাঝে দেখা অনেকবারই হয়েছে, কিন্তু কথা হয়েছে সেই আগের বছর এরকম সময়তেই। আমার মত সাধারণ মানুষদের সাথে কেষ্টদা বছরের সাধারণ সময়টাতে কথা বলতেই বা যাবে কেন! কেষ্টদা এই পার্টি করে। সাধারণ সময়ে দূর থেকেই দেখে, আজ কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “আরে অমুকবাবু যে! কেমন আছেন?”
আমি সৌজন্যের একটা হাসি হেসে বললাম “ভালো”
আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল কেষ্টদা, “পায়ের চোটটা বেড়েছে নাকি?”
“না না! অনেকদিন থেকেই তো এরম”
“ও হ্যাঁ তাই তো! দাঁড়ান একটা রিসকা ডাকছি! অ্যাই!” চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটাকে ডাকল কেষ্টদা, “আরে দাদার জন্য একটা রিসকা ডাক!”
“না না! রিসকা কেন! এইতো ঠিক চলে যাব!”, আমি কিছুতেই রিক্সা নিলাম না। টিভিতে না রেডিওতে শুনছিলাম কোনও পার্টির লোকের দেওয়া রিক্সা-গাড়ি নেওয়া উচিত না।
“ঠিক আছে দাদা!”, কেষ্টদা হাত জড়ো করে বলল, “এখন সেবা করতে দিলেন না আর কি বলবো! আগামী পাঁচবছর কিন্তু আপনাদের সেবা করেই কাটিয়ে দেব। দেখবেন দাদা!”
একটা শুকনো হাসি হেসে এগিয়ে গেলাম আমি।
কিছুদূর এগোতেই ডাক দিলো বিষ্টুদা। বিষ্টুদা ঐ পার্টির লোক। রাস্তার ধারে বড় ছাতার তলায় টেবিল চেয়ার পাতা। বিষ্টুদা ঐ পার্টির ছেলেমেয়েদের সাথে ওখানেই বসে। যদিও আমি যতদূর শুনেছি বুথের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও পার্টির লোক এইভাবে বসে থাকতে পারে না। অবশ্য ওরা যেখানে বসে আসে সেটা আদৌ ১০০ মিটারের মধ্যে কিনা জানা নেই আমার। “আরে অমুকদা! কাগজটা দাও!”, বিষ্টুদা হাত বাড়াল। আমি ফটো ভোটার স্লিপটা এগিয়ে দিলাম। একটা ছেলে এগিয়ে এসে স্লিপটা নিল।
“দাদা আমাদের লোক”, ছেলেটাকে বলল বিষ্টুদা।
ওদের তালিকার সাথে আমার স্লিপটা মিলিয়ে তালিকায় দাগ দিল ছেলেটা।
আমার দিকে ঘুরে বিষ্টুদা বলল, “ অ্যাতো তারিখে ফিস্ট আছে পাড়ায়! এসো কিন্তু!”
তারিখ যেটা বলল সেটা ভোটের ফলাফল ঘোষণার তারিখ। স্লিপটা ফেরত দিয়ে ছেলেটা বলল আমায়, “আমাদেরটা দাদা অ্যাতো নম্বরে!”
নাম্বারটা ভোটের মেশিনে ওদের প্রার্থীর নাম্বার। শুকনো হাসি হেসে এগিয়ে গেলাম আমি। আরও কিছুদূরে অন্য একটা পার্টির অন্য একটা দাদা আর তার ভাইয়েরা ধরল আমায়।
ঠিক একদিন আগেই আমি এদের কাছে অচেনা অজানা একজন সাধারণ নাগরিক ছিলাম। আজ হঠাৎ করে সবার চেনা হয়ে উঠলাম। কোন চিহ্নে ভোটটা দেব ভাবতে ভাবতেই বুথের ভেতরে এসে ঢুকলাম। লাইন ছিলনা, তাই আমি আসতেই ঘরের ভেতরে ঢুকতে দিল। ফার্স্ট পোলিং অফিসার আমার থেকে ফটো ভোটার স্লিপটা নিল। তারপর ওর তালিকার সাথে আমার স্লিপটা মিলিয়ে তালিকায় দাগ দিল। স্লিপটা ফেরত দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “তেত্তিরিস! নাম অমুক!”
“হ্যাঁ আছে!”, “ঠিক আছে!” পোলিং এজেন্টরা তাদের তালিকা দেখে উত্তর দিল। সেকেন্ড পোলিং অফিসার আমার হাতটা টেনে নিয়ে ওর সামনে রাখা খাতায় একটা টিপসই দেওয়ালো। তারপর একটা ভোটার স্লিপ কেটে থার্ড পোলিং অফিসারকে দিল। থার্ড পোলিং অফিসার আমার তর্জনীতে ভোটের জন্য স্পেশাল বানানো বেগুনী রঙের কালিটা লাগিয়ে দিল। তারপর একটা সুইচ টিপে ইভিএম মানে ভোট দেবার মেশিনটা চালু করে ভেতরে যেতে বলল আমায়।
আমি মেশিনটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। অনেকগুলো চিহ্ন, অনেকগুলো নাম। কাকে ভোট দেব? মেশিনের ওপর থেকে নীচে অবধি অনেকবার চোখ বোলালাম, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না।
এই চিহ্নের দিকে আঙুলটা বাড়াতে একটা খবর চোখের সামনে ভেসে উঠল। খুন। যে প্রার্থী এই চিহ্ন থেকে দাঁড়িয়েছে, তার দলের লোকেরা গত বছর খুন করেছিল বিমলদাকে। বিমলদা একজন প্রতিবাদী শিক্ষক ছিলেন। আমি হাত সরিয়ে নিলাম। ঐ চিহ্নের দিকে হাত বাড়াতে আবার ভেসে উঠল অন্য একটা খবর। ধর্ষণ। দুবছর আগে যখন কাজের শেষে মালতীদি বাড়ি ফিরছিল, তখন তাকে ধর্ষণ করেছিল ঐ পার্টির ছেলেরা। আমি সরিয়ে নিলাম হাত। অন্যান্য বিভিন্ন চিহ্নগুলোর দিকে হাত বাড়াতেও বিভিন্ন খবর ভেসে এল চোখের সামনে। ভেসে এল ছবি। অবক্ষয়ের ছবি, হতাশার ছবি। ভেসে উঠল মুখ। মৃতদের, ধর্ষিতাদের, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের, প্রতারিত সর্বস্বান্ত মানুষদের মুখ ভেসে উঠল।
“ কী হল দাদা!” বাইরে থেকে পোলিং অফিসার তাড়া দিল। “এত দেরী হচ্ছে কেন? তাড়াতাড়ি ভোটটা দিয়ে বেরিয়ে আসুন।”
কিন্তু কাকে ভোট দেব আমি যে বুঝেই উঠতে পারছি না। অবশেষে আশার আলোর মত নতুন একটা চিহ্ন চোখে পড়ল, নতুন একটা মুখ। কিন্তু সেও কতটা করবে বুঝতে পারছিনা। আগে তো দেখিনি তাকে, তার সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। তাকে ভোট দেওয়া কি ঠিক হবে? আর বাকি তো কোন মুখই দেখতে পাচ্ছি না, যাকে আগামী পাঁচ বছর দেখতে চাই আমি। চোখ বন্ধ করলাম। সেই সব মুখগুলোই ভেসে উঠল আবার।
“আরে দাদা! তাড়াতাড়ি ভোট টা দিন।” পোলিং অফিসার উঠে দাঁড়িয়েছে এবার। কপাল থেকে ঘাম মুছলাম। পোলিং এজেন্টরাও তাড়া দিচ্ছে। এদিকে আমি কাকে ভোট দেব বুঝতে পারছি না। কিন্তু ভোট আমায় দিতেই হবে। আমি বাড়ি বসে ভোট না দিয়ে সমালোচনা করব বলে এখানে আসিনি। আমি সরকার নির্বাচন করতে এসেছি। ভোটদান আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। আঙুলটা আবার বাড়ালাম মেশিনের দিকে। দেখি আঙুলটা কাঁপছে। আশা আর সংশয় নিয়েই আমি নতুন চিহ্নটায় ভোট দিয়ে দিলাম।
কানের মধ্যে ভোটের মেশিনের বিপ শব্দটা বেজে চলেছে এখনও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বুথ থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে পা চালালাম আমি। যাকে ভোটটা দিলাম, ঠিক করলাম কিনা জানিনা। আগামী বছরগুলোতে অপেক্ষা করতে হবে। হয় আমি উত্তরটা পাব, নাহলে আবার সেই মৃত-ধর্ষিত-প্রতারিত মানুষের মুখগুলো দেখতে পাব। আমি যত তাড়াতাড়ি পারলাম পা চালিয়ে এগোতে থাকলাম। বিপ শব্দটা বেজে চলেছে এখনও। কানে তালা ধরে যাচ্ছে।
আচমকা ছুরি নিয়ে তেড়ে এল একজন। আমার দিকে একরাশ ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছে সে। কিছু বলছে সে চেঁচিয়ে, কিন্তু বিপ শব্দটার দাপটে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না আমি। যা বুঝলাম এই হল সেই জেতা দলটার কর্মী। খেয়াল হল তার মাথায় বাঁধা কাপড়ে আঁকা বিশেষ চিহ্নটা। এইমাত্র তো এই চিহ্নতেই আমি ভোটটা দিয়ে এসেছি। কিন্তু সে আমাকে কি বলছে? বিপ শব্দটা কাটিয়ে ওর কথা ভালভাবে শুনতে পাচ্ছি না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আমার পায়ে ছুরি চালিয়ে দিল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
সেই থেকে আমি খুঁড়িয়ে হাঁটি।
ঘুমটা ভাঙতে অ্যালার্মটা বন্ধ করে দিলাম। আজতো ভোট দেবার দিন। গত পাঁচবছর আমি ঘুমোচ্ছিলাম। আমরা সাধারণ মানুষরা পাঁচবছরে এই একবারই জাগি। অনেক আশা নিয়ে এই একবারই জাগি। তাও সবাই জাগে না। জেগেই আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভেবেছিলাম সকাল সকাল ভোটটা দিয়ে আসব। এর পরের গল্পটা সেই একই। প্রতিবারই একই গল্প।
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।
বেশ ভালো লাগলো।প্রিসাইডিং অফিসার হওয়ার কথা মনে পড়ে গেলো।ভয়ও লাগলো।