লেখক: ইচ্ছেমৃত্যু
বাবার কোলে ওঠার কথা মনে পড়ে না। তার মানে এই নয় যে, বাবা আমাকে কোনদিন কোলে নেয়নি! নিয়েছিল নিশ্চয় – ছোট মানুষের মন, কী মনে রাখার, কী নয় ঠিক করে উঠতে পারেনি। ফলত বাবার কোলে ওঠার স্মৃতির ভাঁড়ার প্রায় শূন্য – না একদম শূন্য নয়।
বাবাকে খুব ভয় পেতাম ছোটতে। তার মানে এই নয় যে বাবা আমাকে বা আমাদেরকে খুব মারধোর বা বকাবকি করত। বরং মায়ের হাতে চড়-চাপটা বা বকা খাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। বাবার হাতে মার খাওয়ার স্মৃতি প্রায় শূন্য – না একদম শূন্য নয়।
পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিল বলে ছোটতে বাঁদরামির বহিঃপ্রকাশ প্রায়শই ঘটত। এরকমই বাঁদরামি করতে করতে একবার হনুমানিই করে ফেলেছিলাম বলে মনে হয়। কী করেছিলাম মনে নেই যদিও, কারণ সেই একই – অস্বেচ্ছাকৃত স্মৃতি-সঞ্চয়। তবে সেই হনুমানির কথা বাবা দুপুরে বাড়ি ফিরতেই মা-জেঠিমা হয়ে বাবার কানে উঠল। বাড়ির উঠোনে একটা ভাঙ্গা ডাল পড়েছিল – অদ্ভুত ভাবে সেই ভাঙ্গা শুকনো ডালটার কথা আমার মনে আছে। বাবা হাতের কাছে সেটা পেয়েই পিটিয়েছিল – এবং কতটা পিটিয়েছিল, কতটা লেগেছিল কিছুই মনে নেই। কিন্তু আমি খুব কেঁদেছিলাম এটা মনে আছে।
না, স্মৃতিতে আরও কিছুটা আছে তারপর। কিছুক্ষণ পর বাবা জামা প্যান্ট ছেড়ে স্নানের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে আর আমি বোধহয় তখনও কাঁদছি; হেঁচকি তুলে তুলে। বাবা আমাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়েছিল; আমার সঞ্চিত স্মৃতির পুঁজিতে এটাই বাবার কোলে চাপার একমাত্র ঘটনা। সেই ছোট্ট আমি, আমার ছ’ ফুট দু ইঞ্চি লম্বা বাবার কোলে চেপে হেঁচকি তুলে তুলে উঠোন জুড়ে ঘুরছিলাম। আমার স্মৃতিতে সেটাই প্রথম অত উঁচু থেকে নিচের পৃথিবী দেখা। বললে হয়ত বাড়বাড়ি লাগবে কিন্তু না বলে পারছি না, বড় হয়ে নাগর দোলায় চেপেছি, বহুতল অট্টালিকার উপরে উঠেছি, আকাশ গাড়িতে চেপেছি কিন্তু কোনোদিন সেই অনেক উপর থেকে নিচে দেখার অনুভূতিটা হয়নি যেটা সেই ছোট্ট – খুব ছোট্টবেলাতে হয়েছিল। হয়ত সকলের কাছেই বাবার কোলের থেকে উঁচু আর কিছুই হয় না!
লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।