সম্পর্ক

লেখক: রেশমিন খাতুন

জয়িতা পায়েস করার সময় একটু বেশীই চাল নিলো। আজ জয়িতার ছেলের মাষ্টারমশাই অনিকের জন্মদিন। ছেলেটা এত পরিশ্রমী ও প্রতিভাধর হওয়ার পরেও একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জয়িতা খুব করে চায়, অনিকের দিকে ভগবান যেন মুখ তুলে তাকায়। ওকে দেখলেই নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। একটা মায়া পড়া ছেলে, তার “দিদি দিদি” ডাকে যে আন্তরিকতা থাকে, সেটাকে জয়িতা অবহেলা করতে পারে না কখনও।

জয়িতার ছেলে পিকলুও ওই সময় বেশ আনন্দের সাথেই পড়াশোনা করে। পড়ার পরে অনিক ওকে অনেক গল্প শোনায় নাহলে পিকলুকে পড়ানো কতটা কঠিন সেটা জয়িতা খুব ভালোই জানে। জয়িতার বর কমলেশ, একটা কর্পোরেট অফিসের ম্যানেজার পদে বহাল আছে। হয়তো কাজের চাপেই সব সময় গম্ভীর মুখে থাকে, কেমন যেন রসকষহীন মানুষ। অফিস আর কাজ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। জয়িতা মাঝে মাঝে এই সংসার সামলাতে গিয়ে হাঁফিয়ে ওঠে।

অনিকের পড়ানো প্রায় শেষ, তখন জয়িতা পায়েসের বাটিটা হাতে করে অনিকের কাছে এসে বলে, “ভাই এটুকু খেয়ে নাও। তোমার জন্মদিন উপলক্ষে করেছি।”
“দিদি, আপনি আবার এসব করতে গেলেন কেন? আমি তো নিজেই ভুলে গেছিলাম, আজ আমার জন্মদিন।”
“আমি তো ভুলিনি, তাই এটুকু তোমার জন্য ভাই। খেয়ে নাও।” 
অনিক পায়েসের বাটিটা তুলে চামচ দিয়ে খেতে শুরু করে।
“খুব ভালো স্বাদ হয়েছে দিদি।”
এভাবেই জয়িতা আর অনিকের ভাই-বোনের সুন্দর সম্পর্কটা আরোও দৃঢ়তা পায়।

একদিন কমলেশের অফিসে ছুটি থাকায় বাড়িতেই ছিল। পিকলুর টিউশনের সময় হয়ে গেলেও অনিক আসেনি তখনও। 
“কী ব্যাপার জয়ি, পিকলুর মাস্টারমশাই  এখনও এলো না তো…”
“চলে আসবে এবার। অনেকগুলো ব্যাচ পড়ায় তো, তাই হয়ত আজ একটু দেরী হচ্ছে।”
“এত লেট এলে চলবে কিভাবে? মাসের শেষে টাকাটা তো একই নেবে। আর সেটা যেহেতু আমাকেই দিতে হবে, তাই গায়ে তো লাগবেই।”
জয়িতা কিছু একটা শক্ত  উত্তর দিতে চায়, কিন্তু সেটা চেপে যায়। কবেই বা বলতে পেরেছে?
জয়িতা ভেবেছিল M.A. করার পর কোনোও একটা চাকরিতে জয়েন করবে। কিন্তু বিয়ের পর কমলেশ কখনোও চায়নি জয়িতা চাকরি করুক। কয়েকবার চেষ্টা করেছিল  কমলেশ কে বোঝাতে, কিন্ত সে সব শেষে কমলেশ নিজের জায়গাতেই টিকে থাকে। সেসব ভাবতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে যায় জয়িতার। সেদিন আর অনিক আসেনি, তাই পিকলুকে কমলেশই পড়াতে বসায়। পিকলুকে বলে, “দেখি বাবা তোমার ইংরাজি পড়াটাই আজ দেখি।”
বই আর খাতাগুলো নাড়াচাড়া করে জয়িতার উদ্দেশ্যে বলে, “এখনকার সিলেবাস তো অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। কিন্তু অনিক তো পিকলুকে সেভাবে নুতন সিলেবাস অনুযায়ী পড়াচ্ছে না। পুরোনো সিলেবাস অনুযায়ী পড়াচ্ছে। এভাবে তো চলবে না।”
“কিন্তু পিকলু তো অনিকের কাছে পড়ার সময় খুব ভালো রেসপন্স দেয়। আমি লক্ষ্য করেছি।”
“সেসবে লাভ নেই। এইমাসের পর আর তাকে আসতে হবে না বলে দিও। আমি পিকলুর জন্য নুতন মাস্টারমশাই জোগাড় করে নেবো।”
“কিন্তু অনিক তো বেশ ভালো ছাত্র। ও একটা নিয়ম মেনে পড়ায়। তুমি মাত্র একটা দিন দেখেই ওর ব্যাপারে সব বুঝে গেলে?”
“শোনো, বেশী মুখে মুখে তর্ক কোরো না। যা বলেছি, সেটা বলে দিও। এভাবে দেরী করে আসা, বা একেবারেই না আসা এসব  আমি সহ্য করব না।”
তখনই পিকলু বলে ওঠে, “বাবা, অনি দাদা আমাকে কী সুন্দর ছবি এঁকে দিয়েছে। এই দেখো।”
“তোর মাস্টারমশাই পড়াতে এসে  ছবি আঁকে? এসব আবার কী? না না, এভাবে চলতে পারে না।”
জয়িতা বলে ওঠে, “কিন্তু অনিক পিকলুকে খুব ভালো ছবি আঁকা শিখিয়েছে।”
“ওসব ছবি টবি আঁকা দিয়ে কী হবে? পিকলুর জন্য একটা ভালো ইংরাজির শিক্ষক দেখছি, পরের মাস থেকে সে আসবে।”
জয়িতা কিছু বলতে গিয়েও আর কিছু বলেনা। রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যথারীতি পরের মাসে নুতন গৃহশিক্ষক পড়ানো শুরু করেন পিকলুকে। মধ্যবয়স্ক গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ তিনি। নাম সমরেন্দ্র চক্রবর্তী। পড়ানোর বিষয়ের বাইরে পিকলুকে অন্য কোনোও বিষয়ে কথা বলতে দেন না। ওনার এই রোবোট সুলভ আচরণে, পিকলুর দমবন্ধ হয়ে আসে। তখন জয়িতা এসব দেখে আর ভাবে, ভাই কি আজ ফের বাড়ি থেকে না খেয়েই পড়াতে চলে গেল? খুব কষ্ট হয় অনিকের কথা ভেবে। অজান্তেই দুচোখের কোনা দুটো ভিজে ওঠে……


লেখকের কথা: রেশমিন খাতুন
আমি রেশমিন খাতুন, বি.এড. কমপ্লিট করার পরে এখন আমি  প্রাইভেট স্কুলে পড়াই। আর লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বই আমার নেশা; গল্পের বই পেলে সব ভুলে যাই। ক্লাশ ফাইভ থেকে লাইব্রেরী যাই। প্রিয় লেখিকা – সুচিত্রা ভট্টাচার্য। লেখক অনেক জন আছেন । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,নারায়ন স্যানাল। যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম তখন স্বরচিত গল্প লিখে একবার প্রাইজ পেয়েছিলাম, সেকেন্ড হয়ে “পথের পাঁচালি” বইটা পুরষ্কার পাই। ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। মনে অনেকদিন রেশ ছিল, প্রথম প্রাইজ তো। এখন ফেসবুকে নিজস্ব একটা পেজ আছে “আলেয়ার আলো” নামে। আর “শুকতারা” – ওখানে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম, “ভূত দাদু” নামে। তো ওখানেও আমি সেকেন্ড হয়েছিলাম, তো ওরা আমাকে বাইপোস্ট  তিনশত টাকা আর কিছু বই গিফ্ট করেছিল। ভীষন আনন্দ হয়েছিল। আর এখন ফেসবুকে অনেক পেজে  লিখি যেমন  ‘মলাট’, ‘ইচ্ছে ডানা’, ‘অক্ষর’, ‘গল্পগুচ্ছ’, ‘বইপোকা’, ‘লতা’, ‘জনতার কণ্ঠ’, ‘সায়র পত্রিকা’ ইত্যাদি পেজগুলোতে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।