যৌথ পরিবারের ইতিকথা – ২

লেখক : দেবাশিস চৌধুরী

জন্ম থেকেই যৌথ পরিবারে মানুষ আমি। সেটা ১৯৭০ দশকের একেবারে গোড়ার দিক। আমাদের পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা তখন ২০। ছোটবেলাতে সব থেকে মজা লাগত রাতের খাওয়ার সময়। আগে সব বাচ্চাদের তাদের মায়েরা খাইয়ে দিত। এরপর খেতে বসতেন বাড়ির পুরুষরা। শেষে মহিলারা।

ছোড়দাদু (বাবার ছোটকাকা) তখনও বেঁচে এবং বাড়ির সর্বময় কর্তা। তিনি, বাবা ও বাকি পাঁচ কাকারা একসাথে খেতে বসতেন। তিন ঠাকুমা সমেত মা-কাকিমারা রান্নায় এবং পরিবেশনে ব্যস্ত থাকতেন। সারা দিন অফিস কাছারি করার পর এই একটি সময় বাড়ির পুরুষরা একত্রে মিলিত হতেন। তখন রান্নাঘরের বাইরে লম্বা দালানে মাটিতে পিঁড়ে পেতে বসে খাওয়ার চল ছিল। থালা, বাটি এবং গেলাস সবার আলাদা নির্দিষ্ট করা। অদল বদল হলেই কুরুক্ষেত্র। এটা মনে রাখাটা মহিলাদের পক্ষে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।

আমাদের বাড়িতে রাতে সাধারণতঃ রুটিরই চল ছিল। মাঝে মধ্যে কারুর ইচ্ছে মতন ভাত বানানো হত। তার জন্য দুই ঘন্টা আগে নোটিশ দিতে হবে, এমন অলিখিত এক নিয়ম ধার্য ছিল। এর পিছনে একটাই কারণ ছিল যে নইলে কয়লার উনুন “শগড়ি” হয়ে যাবে। ভাতটা আলাদা ভাবে স্টোভে বানানো হত।

ঠিক দশটার সময় সকলকে হাজির হতে হত। খাবার পরিবেশনের আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত কোন না কোন বিষয় নিয়ে গুরুতর আলোচনা। হেন কোন বিষয় ছিল না যা নিয়ে আলোচনা হত না। তবে বিশেষ হত ফুটবল আর রাজনীতি নিয়ে। ছোড়দাদু ছিলেন সব দিকে বিশারদ। তাই যে কোন আলোচনাতে মুখ্য ভূমিকাটা থাকত তাঁর। আর প্রতিবারেই তাঁর বিপক্ষে থাকতেন মেজকাকা। দুজনায় যেন দুই মেরুর মানুষ। কখনও ওনাদের মতের মিল দেখিনি। আলোচনা লো স্কেল থেকে হাই স্কেলে পৌঁছে যেত। শূন্যে হাত ছুঁড়ে নিজ মত সমর্থন করার চেষ্টা করতেন দুজনেই। সেই সাথে মুখ থেকে ছিটকে পড়ত চিবুনো খাবারের অংশ বিশেষ। বাকি পুরুষরাও দুই দলে বিভক্ত হয়ে যেতেন। 

মহিলাদের এই উত্তপ্ত আলোচনায় অংশ গ্রহণ বর্জিত ছিল। তাঁরা এক পাশে জড় হয়ে মজা লুটতেন। কিন্তু নজর রাখতে হত পুরুষদের ইশারাতে, কখন কার কি ফরমাশ। দুই ঠাকুমা ওদিকে গরম রুটি বানাতে ব্যস্ত।

একদিনের আলোচনা শুরু হল ফুটবল নিয়ে। ছোড়দাদু পাঁড় মোহনবাগানের সমর্থক। আর মেজকাকা ইষ্টবেঙ্গলের। সেদিনের কোন একটি খেলা নিয়ে লেগে গেল তর্ক। মোহনবাগান বোধহয় ম্যাচটা জিতে ছিল। সেই নিয়ে ছোড়দাদু আস্ফালন করছিলেন। মেজকাকাও দমবার পাত্র নয়। যথারীতি দুই দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়া। আলোচনা তখন সরগরম। 

হঠাৎ দুম করে ছোড়দাদু বলে উঠলেন, ‘মোহনবাগানের মানে বুঝিস তুই? এঁড়ে তক্কো করে যাচ্ছিস। মোহনবাগান মানে হল ঐতিহ্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম।’

মেজকাকা ওদিকে হাতের রুটিটা অনেকক্ষণ ধরে মুখগহ্বরে ঢোকাবার চেষ্টা করছিলেন। উত্তেজনার ফলে সেটি বারবার গন্তব্যের কাছে গিয়েও ফিরে আসছিল। ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম? বললেই হল? একা মোহনবাগান বুঝি দেশের স্বাধীনতা এনেছে? কেন ইষ্টবেঙ্গলের লোকেরা সেই সময় কি হাতে চুড়ি পড়ে বসে ছিল? যা জানো না সেই নিয়ে তক্কো করতে এসো না। সব থেকে বেশী শহীদ হয়েছেন ইষ্টবেঙ্গলের বিপ্লবীরা।’

‘ও আমরা হইনি বুঝি? হাওয়াতে গা ভাসিয়ে উড়তুম বুঝি সবাই? শুধু তোরাই দেশটা স্বাধীন করলি? এই কথাগুলো আমাকে বলেছিস ঠিক আছে। বাইরে কাউকে বলিসনি। গায়ে থুতু দেবে লোকে।’

‘কি স্বাধীনতা এনেছ তা তো হাতেনাতেই দেখতে পাচ্ছি। সব জিনিষের দাম অগ্নিমূল্য। সংসার চালানো সাধারণ মানুষের পক্ষে দায় হয়ে পড়েছে। এই তোমাদের স্বাধীনতা আনার পরিণাম। দেশ ভাগই আটকাতে পারলে না আবার বড় বড় লেকচার মারছ।’

খেলা ছেড়ে আলোচনাটা রাজনীতিতে গিয়ে ঠেকল। তখন আর সেটা দু দলের মধ্যে জোট বেধে নয়। আলাদা আলাদা চলতে থাকল। ছোড়দাদু আর মেজকাকার মধ্যে তো ছিলই। ওদিকে বাবা আর আমার ছোটকাকার মধ্যে লেগে গেল দ্বন্দ্ব। অপর দিকে সেজকাকা আর রাঙ্গাকাকা। বাকি ভালকাকা ছিলেন সুবিধাবাদী পার্টি। সব দিকে তাল দিয়ে চলে ছিলেন। তবে সব থেকে মজা লাগত ছোড়দাদু আর মেজকাকার লড়াইটা।

মেজকাকা এক সময় বলে উঠলেন, ‘এই তো পাড়ার দুগগাদা বলছিল, নীলু একার রোজগারে সংসার চালানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ছোড়দাদু বললেন, ‘কেন দুগগার বদলি হয়েছে বুঝি? আগে তো বাঁ হাতে বেশ কামাত। তখন তো সাতজনের সংসার আয়েশ করে চলত। আর এখন আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে যত গোল।’

‘দুগগাদা মোটেই কোনদিনও বাঁ হাতে কামায়নি। শত্তুরে দুর্নাম রটিয়েছে শুধু।’

‘তুই ছাড়া সারা পাড়াটা বুঝি ওর শত্তুর? যা না পাশের বাড়ির জগাকে জিজ্ঞেস কর না, ওর আপিসেই তো কাজ করে। একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দেবে।’

এরপর ঠাকুমার মধ্যস্থতায় আলোচনা স্তিমিত হয়ে আসে। বাকি খাবারটুকু শেষ করে কর্তারা সবাই বড়সড় ঢেঁকুর তোলেন। মেজকাকা মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বৌদি এঁচড়টা আজ বেড়ে হয়ে ছিল। কে এনে ছিল?’

মা ছোট্ট জবাব দিলেন, ‘ছোটকাকা।’

ছোড়দাদুর দিকে ফিরে মেজকাকা মুচকি হেসে বললেন, ‘ছোটকাকা ঠিক এই রকমই এঁচড় আনবে। বেশি পাকাও নয় আবার বেশি কচিও না। তবেই না টেস্ট আসে।’

‘তোকে কাল হালিশহরের কুমড়ো খাওয়াব। বাজারে এসে গেছে। বড়বৌমা ছক্কাটা রাঁধেও ভাল।’

অবাক হয়ে ভাবছিলাম খাওয়ার আগে কি দিয়ে শুরু হয়ে ছিল আর খাওয়া শেষ হল কি দিয়ে। এটা বোধহয় একমাত্র যৌথ পরিবারেই সম্ভব।


লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
দীর্ঘকাল কর্মসূত্রে আমি লখনৌতে প্রবাসী। গল্প লেখাটা আমার একটা প্রিয় সখ। আমার গল্প পড়ে সবার মনোরঞ্জন হোক, এটাই আমার কামনা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum